নভেম্বর রেইন

এক

রিমা বাসর ঘরে বসে আছে নতুন বউ সেজে। সাজ বলতে আজ বিকেলেই কেনা লাল বেনারসি শাড়ি আর হাত ভর্তি চুড়ি ছাড়া তেমন কিছু নেই অবশ্য। হুট করে বিয়ে করলে এর থেকে বেশি কিছু থাকারও কথা না। সে ঘড়ি দেখল, রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আসিফ আসছে না কেন কে জানে! রিমার ঘুম আসছে, সে কয়েকবার হাই তুলল। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি আর উত্তেজনার পর শরীর এখন আরাম চাচ্ছে। সে রুমের দরজার দিকে একবার তাকালো। নাহ দরজা আটকানো,আসিফের খবর নেই। ঘড়ি দেখে বুঝল ঠিক চল্লিশ মিনিট ধরে সে একা এই রুমে বসে আছে,কি আশ্চর্য! আসিফ আসছে না কেন? দরজার ওপাশে ড্রয়িং রুম, সেখান থেকে মৃদু সুরে ভেসে আসছে গান। রিমা খেয়াল করে দেখল প্রায় আধা ঘন্টা ধরে একই গান ঘুরে ফিরে বাজছে। গান্স এন রোজেস এর নভেম্বর রেইন। নভেম্বরের এই বৃষ্টিতে একেবারে পারফেক্ট গান। কিন্তু একই গান বারবার বাজাচ্ছে বলে শুনতে এখন একঘেঁয়ে লাগছে। গানটা এখন বরং উদ্বেগ তৈরি করছে, আসিফ আসছে না কেন এখনও, কোন সমস্যা হয়েছে এই বাসায় এসে?

 

তাদের বাসর হচ্ছে আসিফের বন্ধু শাহেদের গাজীপুরের বাসায়। শাহেদ আর তার বউ এই রুমটাকে যথাসাধ্য পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে। শাহেদ দম্পতি হাসিখুশি মিশুক ধরনের। তারা যে অনাহূতের মতো হুট করে এসে ঘাড়ে চড়ে বসেছে সেটা নিয়ে কোন বিরক্তি নেই। আজ বিকেলে কাজি অফিসে বিয়ে করে আসিফ তাকে নিয়ে গাজীপুরে তার বন্ধু শাহেদের বাসায় এসে উঠেছে। সারাদিনের কথা ভেবে রিমার এখনও অদ্ভুত লাগছে, পুরো দিনটাই গেছে ঘোরের মধ্যে।

 

দুপুরে আসিফের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখনও সে জানত না কি করতে যাচ্ছে তারা আজ। সে এসেছিল  তার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়ে গেছে সেই খবর দেয়ার জন্য। সেটা শোনার পর আসিফ গম্ভীর হয়ে গেল। মাথা নীচু করে থাকল কিছুক্ষণ তারপর মুখ তুলে ধীরে হাহাকারের গলায় বলল, রিমা তুমি তাহলে অন্যের হয়ে যাবে ……

আসিফের শান্ত স্বরে রিমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল! নভেম্বরের শুরুর এই দিনটাও কেমন অন্যরকম। সারাদিন আকাশে মেঘ, থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, চারিদিকে শীত শীত ভাব। মেঘে ঢাকা আলোয় দাঁড়িয়ে ঝির ঝির বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা আসিফের দিকে তাকিয়ে রিমার কি হয়ে গেল,  সে আসিফের হাত ধরে বলল,আসিফ চল আমরা বিয়ে করে ফেলি।

 

আসিফ বেকার মানুষ, বাবার হোটেলে থেকে বিয়ে করার চিন্তা করা অসম্ভব ব্যাপার। তবু ভীতু আসিফ হঠাৎ সাহসী হল। গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, চল আজই বিয়ে করব।

 

তারপর তারা দুজন চলে গেল ঘোরের মধ্যে। শাড়ি কিনল চুড়ি কিনল,বন্ধুদের ডেকে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল। তখন মনে হল কোথায় যাবে এরপর? আসিফের বাসায় নতুন বউ নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। রিমাও আর বাসায় ফিরতে চায় না। বাসা থেকে তার বিয়ে ঠিক করেছে, এখন সেখানে ফিরে যাওয়া বিপদজনক। ঠিক হলো কিছুদিন কারও বাসায় কাটিয়ে তারপর যার যার বাসায় জানাবে।

 

আসিফের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহেদ গাজীপুর থাকে।  শাহেদ ফোনে সব শুনে বলল, চলে আয়। যতদিন খুশি থাকবি, কোন অসুবিধা নাই।

 

টঙ্গী আর বোর্ড বাজারের ভয়ানক জ্যাম ঠেলে গাজীপুর যাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার। রাস্তায় রিমার খুব লজ্জা লাগছিল। নতুন বিয়ে হল- সেই লজ্জা, অচেনা কোন বাসায় যাচ্ছে বাসর করতে সেটাও লজ্জার। আবার মাঝে মাঝে তার বেশ মন খারাপও হচ্ছিল। বাবা মার কথা ভেবে খারাপ লাগছিল রিমার। বাবা ডিস্ট্রিক জাজ ছিলেন,সারা জীবন সততার সাথে চলেছেন বলে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা আছে তাঁর, একমাত্র মেয়ে পালিয়ে একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছে জানলে বাবা কিভাবে সহ্য করবেন কে জানে! আচ্ছা আসিফ যে বন্ধুর বাসায় নিয়ে যাচ্ছে তারাও কি মনে করবে!

 

কিন্তু আসিফের বন্ধুর বাসায় পৌঁছে রিমা সহজ হয়ে গেল। হাসিখুশী শাহেদ আসিফের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে হচ্ছে। শাহেদ দম্পতি তাদের হাসি মুখে বরন করে নিয়েছে। এই অল্প সময়েই তারা তাদের ঘরগুলোতে কিছু বেলুন কিনে এনে সাজিয়েছে। একটা রুমে ফুল ছড়িয়ে দিয়ে বাসর ঘর বানিয়েছে। ছোট কিন্তু দারুন সুন্দর এই আয়োজন দেখে রিমার মন ভালো হয়ে গেল । এরা আসলেই চমৎকার মানুষ। শাহেদের বউ নীলা যত্ন করে রিমাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে তাকে কানে কানে কিসব উপদেশ দিচ্ছিল,লজ্জায় রিমার গাল লাল হয়ে যাচ্ছিল। নীলা রাত সাড়ে দশটার দিকে তাকে এই পরিপাটি করা রুমে রেখে গিয়েছে। রিমা এখন অপেক্ষা করছে আসিফের জন্য। সে ঘড়ি দেখল সাড়ে এগারোটা বাজে। এক ঘন্টা হলো সে একা এই রুমে। আসিফের আসতে দেরি হচ্ছে কেন? কোথায় গেল সে? রিমা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, এই সময় দরজা খুলে আসিফ ঢুকল।

 

–বউ কি খবর বলো? অনেকক্ষণ একা বসে আছ না?

 

আসিফের মুখে বউ ডাক শুনতে লজ্জা লাগছে,আবার ভালোও লাগছে তার। রিমা রাগ দেখিয়ে বলল, এক ঘন্টা ধরে একা বসে আছি আমি। তোমার কি আক্কেল বলো তো?

 

আসিফ হেসে বলল, আহা! প্রথম দিনই ঝগড়া শুরু করে দিওনা ডার্লিং। শাহেদ আর নীলা গল্প জুড়ে দিয়েছিল। এক ঘন্টা হয়ে গেছে টেরই পাইনি।

 

রিমা বলল, ঠিক আছে। অনেক ধকল গেছে আজ, শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি।

 

আসিফ হাই তুলতে তুলতে বলল, আরে তুমি কি পাগল হলে? বাসর রাতে ঘুমাবা? এই রাত জীবনে একবারই আসে। বাসর রাত নিয়ে আমাদের কি প্ল্যান মনে নাই?

 

রিমা মুখ নীচু করে হাসল। তারপরই আবার মুখ গম্ভীর করে বলল, উঁহু সারাদিন অনেক ধকল গেছে এখন রেষ্ট নিতে হবে।

 

সে জানে আসিফ তার কথা শুনবে না। বাসর রাত তারা কি করবে সেটা আগেই ঠিক করে রেখেছিল দুজন মিলে। সারা রাত গল্প আর ঘন ঘন চা খাওয়া- এই ছিল তার প্ল্যান। গল্পের নিয়মও ঠিক করা আছে, তারা নিজেদের জীবনের মজার ঘটনাগুলো নিয়ে গল্প করবে,শৈশব থেকে শুরু হবে,একজন তার শৈশবের একটা গল্প বলবে তারপর আরাকজন বলবে। এভাবে সারারাত গল্প করে কাটানোর প্ল্যান তাদের। আগে থেকেই ঠিক করা আছে যত ক্লান্তই থাকুক তাদের গল্প চলবে।

 

আসিফ রিমার পাশে খাটে শুতে শুতে বলল,উঁহু আজ আমরা সারা রাত গল্প করব। তুমি শুরু কর, তোমার পিচ্চি কালের একটা হাসির ঘটনা বল,শুনি।

 

রিমা খাটে হেলান দিয়ে বসল। তার এই মুহুর্তে কোন হাসির ঘটনা মনে পড়ছে না। অথচ সে এই রাতে বলবে বলে তার জীবনের কিছু হাসির ঘটনা ভেবে রেখেছিল। তার স্কুলের প্রথম প্রেমপত্র পাওয়ার ঘটনাটা বললে কেমন হয়?

 

কি গল্প বলবে ভেবে নিয়ে রিমা আসিফের দিকে ঘুরে অবাক হয়ে গেল। আসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে। কি আশ্চর্য ছেলে! ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘুম! অথচ সারা রাত তারা কত গল্প করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। রিমার কিছুটা অভিমান হলো। সে লাইট নিভিয়ে দিয়ে আসিফের পাশে শুয়ে পড়ল। তার মনে হল রাতে নিশ্চয়ই আসিফের ঘুম ভাঙ্গবে,ঘুম ভাঙ্গলে সে চেস্টা করবে রিমার ঘুম ভাঙ্গাতে। সারারাত গল্প করার প্ল্যান আসিফ ভুলবে না।

 

 

রিমার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। পাশে তখনও আসিফ ঘুমিয়ে আছে। তাদের বাসর রাত কেটে গেল ঘুমিয়ে,অথচ কতকিছু করার কথা ভেবে রেখেছিল তারা। আসিফ ঘুমাচ্ছে উল্টোপাশে কাত হয়ে। রিমা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। আসিফ একই ভঙ্গীতে ঘুমাচ্ছে। সে কয়েকবার আসিফকে ডাকল,আসিফ এই আসিফ। ওঠ। আসিফ।

আসিফের ঘুম ভাঙ্গল না। কুম্ভকর্ণের ঘুম একেবারে। ধাক্কা দিলেও নড়ছে না দেখে বিরক্ত হয়ে রিমা দরজা খুলে বের হলো। নীলা ভাবি নিশ্চয়ই এতোক্ষনে উঠে পড়েছে, রিমারা এখনো ঘুমাচ্ছে দেখে কি ভাবছে কে জানে!

 

রিমা রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে চমকে গেল।  নীলা ভাবি আর শাহেদ ভাই সোফাতেই ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ভঙ্গীটা অস্বাভাবিক। ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বলছে, সাউন্ড বক্স থেকে এখনও বাজছে …

“কজ নাথিং লাস্টস ফর এভার, ইভেন কোল্ড নভেম্বর রেইন…………”

 

সে দুএকবার জোরে ডাক দিল, ভাবী! ভাবী!

 

কেউ সাড়া দিল না।

 

রিমার ভয় ভয় করতে লাগল।  দিনের এই সময়ে বাসার লোকজনের এই অস্বাভাবিক ঘুমের মানে কি? সে আবার রুমে ঢুকে আসিফকে জোরে জোরে ধাক্কালো, আসিফ এই আসিফ … উঠে পড়। তার জোর ধাক্কায় আসিফ খাট থেকে গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল।

 

রিমা আতংক নিয়ে আসিফের কাছে গিয়ে দেখে আসিফের শরীর ভীষন ঠান্ডা। বুকে আর নাকে হাত দিয়ে বুঝল আসিফ মারা গেছে।

 

সে কোন মতে উঠে খাট ধরে দাঁড়াল। মনে হলো ভয়ানক কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে । চারিদিকে একবার তাকালো।  খাটের চারপাশে সাজানো ফুলের মালা শুকায়নি এখনো । গতরাত তার বাসর ছিল, সেটা তারই সাক্ষী দিচ্ছে। সে বিয়ে করেছে, নতুন বউ। বাসর রাত শেষে এখন ঘুম ভেঙ্গে দেখে বাসার সবাই মরে পড়ে আছে।  কি ভয়ানক বাসর রাত!  রিমা একবার গতকালের অদ্ভুত দিনটা ভাবার চেষ্টা করল তারপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

 

 

 

রিটায়ার্ড জাজ আনোয়ার হোসেন উদ্বিগ্ন মুখে মোহাম্মাদপুর থানায় বসে ছিলেন। থানা থেকে যে খবর পেলেন তাতে তার মনে হল দুঃস্বপ্ন দেখছেন। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তার একমাত্র মেয়ে রিমা ট্রিপল মার্ডারের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে গাজীপুর পুলিশের হাতে। কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পুলিশ বলছে রিমার বয়ফ্রেন্ডসহ তিনজন খুন হয়েছে গাজীপুরের এক বাসায়। বিষ প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে তাদের, সেই বিষের ছোট শিশি পাওয়া গেছে রিমার হ্যান্ড ব্যাগে। আনোয়ার হোসেনের মনে হচ্ছে তিনি যে কোন সময় অজ্ঞান হয়ে যাবেন।

 

তিনি জানেন তার সৎ উপার্জনের টাকায় মানুষ করা সন্তানের পক্ষে এইকাজ করা অসম্ভব,কেউ তাকে ফাঁসিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটা প্রমান করার উপায় দেখছেন না কোন। সারাজীবন মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছেন, আজ তার মেয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াবে, কিভাবে প্রমাণ করবেন সে অপরাধী না? আচ্ছা রিমা কি সত্যিই নির্দোষ? কিভাবে জানা যাবে? পুলিশের কে তদন্ত করবে কে জানে!

 

হঠাৎ করে তার এক জোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মালিকের কথা মনে পড়ল। বহুদিন কথা হয় না তবু মনে হলো কেউ যদি বের করতে পারে আসল ঘটনা তবে সে-ই পারবে। আনোয়ার সাহেব মোবাইল ফোন বের করে ডায়াল করলেন।

ওই পাশ থেকে ফোন ধরে একটা ভরাট কন্ঠ বলল, হ্যালো । গুলজার হোসেন বলছি।

 

সেই কন্ঠ। তিনি বললেন, গুলজার, আমি জাজ আনোয়ার বলছি, আমার কথা মনে আছে তোমার? আমার ভীষন বিপদ। তোমার সাহায্য দরকার, প্লীজ।

 

(চলবে………)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত