ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—১৫

১৫
খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে এল। সন্ধ্যার সাথে সাথে কেরামত আলীর মনে ঘনিয়ে এল মালেকা বিবির ভয়। সে আজকে শুক্রাবাদের পেছনে বেশি সময় দিয়ে ফেলেছে। তাই তার মন ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছে।
মনে মনে ভাবছে, মালেকা বিবিকে কী বলবে? কী বললে মালেকা বিশ্বাস করবে?
ভাবতে ভাবতে সে একটি বুদ্ধি পেয়ে গেল। পেল মানে কাঁঠালবাগান ক্রস করার সময় দেখতে পেল রাস্তার ধারে এক জবুথুবু বৃদ্ধ আমলকি বিক্রি করছে। দেখামাত্র রিকশা থামিয়ে বৃদ্ধের কাছে গেল এবং ১০০ গ্রাম আমলকি দিতে বলল।
বৃদ্ধটি রসিক মনের মানুষ। বলল, ‘২০০ গ্রাম নেন ছার। ম্যাডাম মহব্বত দিব।’
কেরামত আলী ফিক করে হেসে ফেলল এবং বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে ২০০ গ্রামই দেন।’
বৃদ্ধটি তার কম্পমান হাতে আমলকি মাপতে শুরু করল।
কেরামত আলী বলল, ‘এত মাপামাপির দরকার নাই চাচামিঞা। আন্দাজ করে দিয়ে দেন। না-হয় একটা বেশি বা কম হবে।’
বৃদ্ধ জিহ্বায় কামড় কেটে বলল, ‘না না। এই কাজ করলে কাল-হাশরের মাঠে জওয়াব দিমু কী? দয়ালে আটকায়া দিব না?’
কেরামত আলী বুঝতে পারল, বৃদ্ধ শুধু রসিক নয় কড়া মনেরও মানুষ। খুব ভালোলাগল তাকে।

আমলকি মালেকা বিবির খুবই পছন্দের ফল।
কেরামত আলীর কাছে ভালোলাগে মালেকার আমলকি খাওয়ার দৃশ্য। আমলকি খাওয়ার সময় মালেকার ঠোঁট ও চোখ কুঁচকে আসে। তখন ভারী সুন্দর লাগে দেখতে।
আমলকি দেখে মালেকার মন শান্ত হতে পারে—এই কথা ভাবতে ভাবতে কেরামত বাসায় ঢুকল।
কিন্তু না। কেরামত আলী যেমনটা ভেবেছিল ঘটনা তেমনটা ঘটল না।
মালেকা বিবি তাকে বাসায় ঢুকতে দিল বটে তবে ড্রইং রুমে দাঁড় করিয়ে রাখল। বলল, ‘এখানেই থাকবে। ভুলেও বেড রুমের দিকে পা বাড়াবে না।’
কেরামত আলী অপরাধী বালকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল, কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো মালেকা বিবির রাগ কমবে এবং সে বেড রুমে যেতে পারবে।
কিন্তু তা হল না।
মালেকা বিবি বলল, ‘এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে।’
কেরামত আলী বলল, ‘জামা-কাপড় ছাড়তে হবে তো!’
‘না, ছাড়তে হবে না।’
‘ফ্রেশ হব না?’
‘হবে না।’
কনিষ্ঠা দেখিয়ে বলল, ‘এটাও করব না?
‘ওটাও না।’
‘প্যান্ট ভিজে যাবে তো। ড্রইং রুম গন্ধ হয়ে যাবে।’
মালেকা বিবি দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘না।’
কেরামত আলী হতাশ হল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। দীর্ঘশ্বাস পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোটবেলার স্মৃতি। খেলাধুলা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ঘোরসন্ধ্যা হয়ে গেলে তার মা তাকে অনেকটা এভাবেই শাস্তি দিতেন। মা তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন।
ছেলেবেলার স্মৃতিকাতর মিনতিভরা চোখে কেরামত আলী মালেকা বিবির দিকে তাকাল। বলল, ‘তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি।’
‘আমি ঘুষ খাই না।’
‘না না ঘুষ না। আমি ভালোবেসে কিনে এনেছি।’
‘কী জিনিস?’
‘আমলকি।’
মালেকা বিবি বলল, ‘দাও।’—সে কেরামত আলীর ব্যাগ থেকে আমলকি নিল।
কেরামত আলী বলল, ‘আমলকি দেখে তোমার কেমন লাগছে? খুশি হও নি?’
‘বলব না।’
মালেকা বিবি সোফায় বসল। রিমোট ঘোরাতে লাগল কিন্তু কোনো চ্যানেলে থামল না।
কেরামত আলী আবারো কনিষ্ঠা দেখিয়ে মিনমিন করে বলল, ‘যদি খুশি হয়ে থাকো তাহলে অন্তত এটা করার অনুমতি দাও।’
মালেকার মনে দয়া হল নাকি—এই ভয় পেল যে, কেরামত আলী বসার ঘরেই হিসু করে দিতে পারে, কে জানে! বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাও।’
অনুমতি পাওয়া মাত্র কেরামত আলী চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে প্রক্ষালন কক্ষে ঢুকল। 
কিন্তু প্রক্ষালন কক্ষ থেকে ফেরার পর তার শাস্তি আবার শুরু হল।
মালেকা বিবি বলল, ‘নড়বে না। আমি আমলকিগুলো ধুয়ে ফ্রিজে রেখে আসছি।’—বলে মালেকা বিবি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
কেরামত আলী ভাবল—এটাই সুযোগ। সে চটজলদি সোফায় বসে একটু আরাম করে নিল। আরাম করতে করতে গলা বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে বারবার তাকাল—যেন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, শিক্ষক কিছু সময়ের জন্য রুমের বাইরে গেছেন—এই সুযোগে ছাত্র নকল করে নিচ্ছে।

আমলকি খেতে খেতে ড্রইং রুমে এল মালেকা বিবি। বলল, ‘আজকের আমলকিগুলো বেশ টাটকা।’
কেরামত আলী খুশি হল। এ ধরনের কথাই তো দরকার। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
মালেকা বিবি সাধারণত কেরামত আলীর কিনে আনা কোনো জিনিস দেখে প্রশংসা করে না। বেশিরভাগ সময় নাক সিটকায়। মাছ আনলে বলে—পঁচা মাছ। তরকারি কিনে আনলে বলে—দুই দিনের পুরনো। নতুন জামা- কাপড় কিনে আনলে বলে— কেরামত আলীর কালার সেঞ্চ নেই। কিন্তু আজ সে যেভাবে আমলকির প্রশংসা করছে আর মজা করে খাছে—তা দেখে কেরামত আলীর খুব ভালোলাগল। মনে মনে ভাবল, এ-রকম হলে স্ত্রীর-দেওয়া শাস্তি ভোগ করা কোনো ব্যাপারই না। গুরুজনেরা বলেছেন, স্ত্রীর শাস্তি খাওয়া স্বামীর জন্য আশির্বাদস্বরূপ।
কেরামত আলী মনে মনে খুব খুশি হল যদিও মুখাবয়বে কেদারনাথবাবু মার্কা একটা ভাব ফুটিয়ে রাখল—যাতে এক্ষুনি তার শাস্তি মওকুফ হয় এবং সে এক ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারে। সারাদিনের অফিস শেষে শুক্রাবাদে গোয়েন্দাগিরি করে তার অবস্থা হালুয়া টাইট। এখন একটু বিশ্রাম না করলেই নয়।
কেরামত আলী এইসব চিন্তা যখন করছিল তখন মালেকা বিবি আড়চোখে একবার তাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘কী ভাবছ!’
কেরামত আলী বলল, ‘না, মানে—ভাবছি তোমার বাতের ব্যথা তাহলে ভালো হয়ে গেল কি-না! যদি ভালো হয়ে যায় তো আমাকে আর পা টিপে দিতে হবে না।’
মালেকা বিবি অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি তো এ-রকমই ভাববে। স্ত্রীর প্রতি যাদের কোনো দয়ামায়া নেই তারা এমনটাই ভাবে।’
‘না। আমি মোটেও এত স্বার্থপর স্বামী নই।’
‘তাহলে কীভাবে ভাবলে যে আমার বাতের ব্যথা ভালো হয়ে গেছে?’
‘ভাবছি তোমাকে দেখে। তুমি যেভাবে হাঁটছ, যেভাবে কথা বলছ—এমনকি যেভাবে আমলকি খাচ্ছ—তাতে মনে হচ্ছে না তোমার বাতের ব্যথা বলে কিছু আছে।’
‘ভুল। এটা তোমার একেবারেই ভুল ধারণা।’—বলে ধপাশ করে সোফায় বসে পড়ল।
‘তারমানে এখন তোমার পা ব্যথা শুরু হল বুঝি?’
‘অবশ্যই শুরু হয়েছে। তুমি যেভাবে আমার বাতের ব্যথাকে একেবারে নেই করে দিচ্ছ তাতে আমার উচিত পুরোদমে ব্যথা শুরু করে দেওয়া। যদিও এখন ব্যথা কিছুটা কম আছে।’
‘ও আচ্ছা। তারমানে হল—এখন তোমার পা টিপে দেওয়ার দরকার নেই।’
‘দরকার হলেই বুঝি তুমি টিপে দেবে?’
‘দেব না কেনে? বিলক্ষণ দেব।’
‘আমি অত বোকা নই সাহেব। আমি এখন তোমায় পা টিপে দিতে বলি আর অম্নি তুমি পাকা আমটির মতো ঝুপ করে পড়ে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু কর। আমি তোমার চালাকি ঠিক ঠিক ধরতে পারি।’
কেরামত আলী পা টেপার নাম করে শাস্তি থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হল না। কারণ মালেকা বিবি বরাবরই কেরামতের চাইতে বেশি চালাক। তাই কেরামতের যেকোনো চালাকি সে ধরে ফেলতে পারে।
কেরামত আলী বলল, ‘আজকে অফিসে বাড়তি কাজের চাপ ছিল। বড়কর্তা আসতে দেন নি।’
‘এসব বললে হবে মনে করেছ? কস্মিনকালেও না।’
‘বিশ্বাস কর—যা বলছি সত্যি বলছি? এক বিন্দুও মিথ্যে নেই।’
আমি কি একবারও বলেছি তুমি মিথ্যে বলেছ? তুমি তো সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। মিথ্যে কখনো তোমার মুখে ফোটেই না।’
তারমানে কেরামত আলী যে টাটকা মিথ্যেটি বলল তা মালেকা বিবি ধরে ফেলেছে। তাই বড় কর্তার দোহাই দিলেও সে নমনীয় হল না।
‘একটু ভুল হয়েছে। বড়কর্তা নয়, ম্যানেজার স্যার আসতে দেন নি। মাছ বিক্রি কেন কমে যাচ্ছে—এই মর্মে তিনি সবাইকে ধমকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন—বিক্রি বাড়াতে না পারলে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘এটাও বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত। কিন্তু এতে তোমার শাস্তি কমছে না।’
কেরামত আলী বুঝল কিছুতেই কিছু হবে না। তাই প্রসঙ্গ ঘোরাল। খোশগল্পের মুডে বলল, ‘জানো, আজ আমার অফিসে কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে?’
‘আলমারির মধ্যে অনেকগুলো ইঁদুর পাওয়া গেছে। ইঁদুরগুলো অনেকদিন যাবত ডিস্টার্ব করছিল। আজ হঠাৎ মনে হল—ড্রয়ারটা একবার খুলে দেখা যাক। ড্রয়ার খোলার সাথে সাথে চার/পাঁচটা ইঁদুর দিকবিদিক ছুটে পালাল। একটাও মারতে পারলাম না। এর মধ্যে একটা ইঁদুর পড়িমড়ি করে বড়কর্তার রুমে ঢুকল। এবং ভুল করে বড়কর্তার প্যান্টের পকেটে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বড়কর্তা লাফাতে লাগল আর বলতে লাগল—ও মাগো! বাঁচাও বাঁচাও। তখন আমাদের দুষ্টু পিয়নটা লাঠি নিয়ে ছুটে গেল। বড়কর্তা তার প্যান্টের পকেট দেখিয়ে বললেন, এদিকে। এদিকে মারো। বড়কর্তার অনুমতি পেয়ে পিয়ন এমন একটা বাড়ি মারল বড়কর্তা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। আমরা সবাই সদলবলে ছুটে গেলাম। তাঁর পায়ে আদর মালিশ করলাম। চোখে-মুখে পানির ছিটা দিলাম। তিনি বললেন, মরেছে? ইঁদুরটা কি মরেছে? এই কথা বলতে না বলতে ইঁদুরটা তাঁর পকেট থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে রুমের বাইরে চলে গেল—হা হা হা!’
কেরামত আলী একলাই হাসল। শ্রোতা হাসল না। হাসতে হাসতে বলল, ‘কী ব্যাপার? এত মজার গল্প শুনেও তোমার হাসি পেল না?’
মালেকা বিবি বলল, ‘আর দশ মিনিট পরে যখন এক ঘণ্টা পূর্ণ হবে তখন তোমার শাস্তি শেষ হবে। তোমার শাস্তি শেষ হলে আমি হাসব।’
‘আর কখনো দেরি করব না—এই তোমাকে কথা দিলাম।’
‘যে কথা রাখতে পারবে না সে কথা দেওয়ার দরকার নেই বাপু। তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নাও। আর তাছাড়া শাস্তির বেশিরভাগটাই ভোগ করে ফেলেছ, এখন বন্ধ করে লাভ কি!’
কেরামত আলী চিন্তা করে দেখল, মালেকা ঠিকই বলছে। তাই সে আর কথা বাড়াল না।

এক ঘণ্টা শাস্তি ভোগ পর কেরামত আলীর পায়ের রগ টনটন করতে লাগল। দুচোখে ঝাপসা দেখতে লাগল। অবস্থা এমন হয়েছে, এখন আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। হয় বসতে হবে নয়তো শুতে হবে।
মালেকা বিবি বলল, ‘কেমন লাগছে গো?’
কেরামত আলী মুখে হাসির রেখা টেনে বলল, ‘এ আর এমন কি! এ তো খুবই সামান্য ব্যাপার।’
‘তাহলে আমার পা-টা একটু টিপে দাও দেকিনি।’
‘পা টিপে দিতে হবে?’— কেরামত আলী সোৎসাহে বলল, ‘চল—শোবার ঘরে চল।’
দুজনে শোবার ঘরে গেল।

পা টিপে দিতে দিতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কেরামত আলী ঘুমের কাছে যখন পরাস্ত হয়ে মালেকা বিবির পায়ের কাছে এলিয়ে পড়ল তখন তার মোবাইলখানা বেজে উঠল।
রিঙটিউনের কড়া শব্দেও কেরামত আলীর ঘুম ভাঙল না। অগত্যা মালেকা বিবি মোবাইলখানা হাতে তুলে নিল। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করা ঠিক হবে কি? শেষে আবার কোন বিপদ এসে জুড়ে বসে কে জানে! এসব ভাবতে ভাবতে প্রথম বার রিঙ শেষ হয়ে দ্বিতীয় বার রিঙ হওয়া শুরু করল। মালেকা বিবি ভাবল, যেহেতু অপরিচিত নাম্বার সুতরাং রিসিভ করা যায়। সে রিসিভ করল।
ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলল পুতুল নাম্নী একটি মেয়ে। মালেকা বিবি মেয়েকণ্ঠ শুনে যারপরনাই আঁৎকে উঠল। তার মনে একটা দুশ্চিন্তা বয়ে গেল বিদ্যুত গতিতে। সেটা হল—তার স্বামীটি কি এরই মধ্যে গোপনে ডুগডুগি বাজানো শুরু করে দিয়েছে? ঘটনা যদি সত্যি হয় তো বেটার চামড়া ছিলে লবণ দেওয়া হবে।

মেয়েটির সাথে সংক্ষিপ্ত কথা শেষ করে কেরামত আলীকে গুতিয়ে ঘুম ভাঙাল। বলল, ‘তা কবে থেকে ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে বল দেকিনি?’
ঘুমভরা চোখে-মুখে বোকার মতো তাকিয়ে রইল কেরামত আলী। বলল, ‘জল? কিসের জল?’
মালেকা বিবি বলল, ‘প্রেমের জল।’
কেরামত আলীর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বসল। বলল, ‘ছি ছি! এসব কী বলছ!’
মালেকা বিবি রহস্য করে বলল, ‘আর লুকোতে পারবে না। আমি সব জেনে গেছি।’
কেরামত আলী বলল, ‘বিশ্বাস কর—আমি কখনো মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি না। মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলি। সুতরাং আমার সাথে কারো প্রেমঘটিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।’
‘বলছ?’
‘হ্যাঁ।’
কেরামত আলী নিজের চোখ ছুঁয়ে বলল, ‘এই আমি আমার দুচোখ ছুঁয়ে কিরা কেটে বলছি।’
মালেকা বিবি বলল, ‘তাহলে বল—পুতুল কে?’
কেরামত আলী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘পুতুল! তারমানে পুতুল ফোন দিয়েছিল?’
‘ও মাগো! তলে তলে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছ! নাম বলতেই এত গদগদ অবস্থা। তা কতদিন হল—এই লটরপটরের বয়েস?’
‘আরে কী বলছ আবোলতাবোল! তুমিই তো আমার লটরপটর। অন্যের কাছে যাব কোন দুঃখে? তাছাড়া লটরপটরের বয়স কি আমার আছে?’
‘আলবৎ আছে। নাই যদি থাকবে তো ফোন আসছে কেনে? পুতুল নামের মেয়েটি তোমার খোঁজ করছে কেনে?’
‘তা পুতুল কী বলল—শুনি?’
‘আগেই তো সে কথা বলব না। আমার কথার জবাব দাও, তারপরে বলছি।’
‘আছে—একটা ব্যাপার আছে। সব তোমাকে বলব। আগে বল—পুতুল তোমাকে কী বলেছে?’
‘সেটা শুনতে হলে তোমার গোপন ব্যাপারখানা আমার কাছে ফাঁস করতে হবে।’
‘তেমন গোপন কিছু নয়।’
‘তুমি বললেই আমি বিশ্বেস করব কেনে? তুমি তো পুরুষ মানুষ, নাকি?’
‘পুরুষ মানুষ তো কী হয়েছে?’
‘পুরুষ মানুষকে কস্মিকালেও বিশ্বেস করতে নেই। চাঞ্চ পেলে এরা মরবার আগেও একচোট লটরপটর করে নেয়।’
‘এতই যখন অবিশ্বাস তাহলে বলছি শোনো। এই পুতুল ছিল—আমাদের বশিরুল্লাহর হবু স্ত্রী।’
‘তা সে তোমাকে ফোন করছে কেনে?’
‘হয়তো বশিরুল্লাহর খুনীর সন্ধান পেয়েছে।’
‘বশিরুল্লাহর খুনীর সন্ধান সে তোমায় দেবে কেনে?’
‘কারণ—আমি দিতে বলেছি।’
মালেকা বিবি গোয়েন্দাদের মতো কেরামত আলীর দিকে তাকাল। বলল, ‘যা বলছ সত্যি বলছ তো?’
‘এক বিন্দুও মিথ্যা বলছি না। বিদ্যা কোরান বিদ্যা।’
‘কিরা কাটলেই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব মনে করেছ? কস্মিকালেও না।’
‘তাহলে কী করতে হবে বল? কী করলে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’
‘আমার সামনে পুতুলকে ফোন করতে হবে। লাউড স্পিকার দেবে। আমি তোমাদের দুজনের কথা শুনব।’
‘ঠিক আছে—তাই হবে।’

কেরামত আলী পুতুলের নাম্বারে কলব্যাক করল। রিঙ হতে হতে শেষ হয়ে গেল, ফোন ধরল না।
মালেকা বিবি বলল, ‘আবার ফোন কর।’
কেরামত আলী তাই করল।
এবার ফোন ধরল, ‘হ্যালো আসসালামালাইকুম।’
‘অলাইকুম সালাম।’
‘কে বলছেন?’
‘আমি কেরামত আলী, এ্যাসিসটেন্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা।’
পুতুল ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘এখন বেশি কথা বলতে পারব না। যা বলি—শুনেন।’
‘কেরামত আলী বলল, ‘হ্যাঁ, বল।’
‘আপনি কি কালকে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?’
‘পারব। কখন, কোথায়?’
‘সকাল ১১ টায় শুক্রাবাদ কাঁচাবাজার।’
এই পর্যন্ত বলে পুতুল লাইন কেটে দিল।

কেরামত আলী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মালেকার দিকে তাকিয়ে রইল।
মালেকা বিবি বলল, ‘নাটক তো ভালোই চালাচ্ছ।’
কেরামত আলী বলল, ‘বিশ্বাস কর—এটা কোনো নাটক নয়। পুরোটাই বাস্তব।’
মালেকা বিবি বলল, ‘তোমার উপর আমার আর কোনো বিশ্বাস নেই।’
‘আমি বিশ্বাস হারানোর মতো কিছুই তো করি নি।’
‘আমি তোমার সাথে আর কথা বলতে চাই না। তুমি দূরে থাকো।’
কেরামত আলী বেকুবের মতো মালেকা বিবির দিকে তাকিয়ে রইল।
মালেকা বিবি বলল, ‘লাভ নেই। কাকতিমিনতি করে কোনো লাভ নেই। আজ তুমি শোবার ঘরে ঘুমাতে পারবে না।’
‘তাহলে কোথায় ঘুমাব?’
‘কেনে আমাদের একটা বসার ঘর আছে না? আজ রাতে তুমি সেখানে ঘুমুবে।’
‘শোবার ঘরে কেনে, এ ঘরের মেঝেতে ঘুমাই?’
‘না। তা হবে না। তুমি এখান থেকে ভাগো।’
কেরামত আলী আর কথা বাড়াল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘কী হল? যা বলছি শুনছ না? এখনো দাঁড়িয়ে রইলে কেনে?’
‘না ইয়ে মানে এখন তো কেবল সন্ধ্যা। এখন গিয়ে কী করব? তারচে বরং এখানেই আর থাকি কিছুক্ষণ!’
‘এত আল্লাদ দেখানোর দরকার নেই। তুমি যাও।’
‘ও ঘরে গিয়ে কী করব?’
‘কেনে, টিভি দেখবে। পেপার পড়বে।’
‘তোমার সাথে আর কিছুক্ষণ থাকি না! তোমার সাথে থাকতে বড় ইচ্ছে করছে।’
‘না। তোমাকে আর এ ঘরে দেখতে চাই না। এক্ষুনি বেরোও। না-হলে কিন্তু আমি চিল্লাপাল্লা শুরু করব।’
‘না না চিল্লাপাল্লা করতে হবে না। আমি যাচ্ছি।’
কেরামত আলী চলে গেল।

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত