চোর দমন কমিশন

সাম্প্রতিক সময়ে বেশি বেশি  চুরি যাওয়ার ঘটনায় সাদিক সাহেব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে দেশ থেকে চোর দমনের জন্য সমমনাদের সাথে পরামর্শ করে একটি জাতীয় সংগঠন খুলে বসলেন। চিন্তাভাবনা করে সংগঠনটির নাম দেয়া হল চোর দমন কমিশন (চো.দ.ক)। এর প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হল বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আজাদ সাহেবকে। আজাদ সাহেবও তার নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে চোর দমনে নিজের সর্বোচ্চটা দেবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। দেশ থেকে চোর দমনের জন্য তিনি একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করলেন যেটির নাম দেয়া হলো ‘চোর দ্বারা চোর ধরা’। তিনি প্রথমে ভাবলেন দেশের বড় বড় মশহুর চোরদের ধরা তো খুব সহজ কাজ না তাই আগে ছিঁচকে চোরদের টার্গেট করে এগিয়ে যেতে হবে। এই ছিঁচকে চোরদের দিয়েই একসময় বড় বড় চোরদের ধরা হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কাজ এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে আজাদ সাহেব দেশের সব ছিঁচকে চোরদের নামের একটি তালিকা প্রণয়ন করলেন এবং প্রত্যেক চোরকে নিয়ে একটি প্রীতি ভোজের আয়োজন করলেন। এজন্য অবশ্য চোরদের প্রত্যেকের ঠিকানায় চমৎকার ও মার্জিত সম্ভাষণসহ চিঠি পাঠাতে হল। চোর হলেও তাদের বিনা দাওয়াতে খেতে আপত্তি আছে কিনা তাই।

 

আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পেয়েছেন সাদিক সাহেব। খুব ভালো একটি ভোজনপর্ব সমাপ্তির পর শুরু হল চোরদের নিয়ে আলোচনা সভা। সভায় বক্তৃতা রাখার সুযোগ পেলেন ছেঁচড়া চোরদের মধ্যে সম্মানিত পর্যায়ের দুইজন। তারা কেন চুরি করে তার বিশদ ব্যাখ্যা থাকল তাদের বক্তব্যের মধ্যে। এর পর শুরু হলো প্রধান অতিথির বক্তব্য। সাদিক সাহেব চোরদের বর্তমান দুরবস্তার জন্য গভীর সমবেদনা জানালেন। যেন উপস্থিত চোরেরা কোনভাবে বুঝতে না পারে যে সামনে তারা যা করতে যাচ্ছে তা তাদের জন্য আত্বঘাতী কার্যক্রমই বটে। প্রধান অতিথি সাদিক সাহেব প্রচুর পড়াশোনা জানা লোক। তবে আজকে তিনি চোরদের পটাতে সাহায্য নিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিড়াল’ প্রবন্ধের বিড়ালের উক্তিগুলোর। মূহুর্তেই তার কথার জোশ এত উথলে উঠল যে, চোরেরা ‘সাদিক সাহেবের জয় হোক’ বলে স্লোগান দিতে আরম্ভ করল। সভার শেষে সভাপতির বক্তৃতা দিতে উঠলেন আজাদ সাহেব। উঠেই তিনি জ্বালাময়ী সম্মোহনী গলায় বললেন— “ভায়েরা আমার,,, আপনারা চোরেরা এদেশের সম্পদ। রাষ্ট্র যদি আপনাদের ঠিক মত কাজে লাগায় আপনাদের দ্বারা বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদ চুরি করে আনা সম্ভব,,,।” ইত্যাদি জাতীয় অনেক কথা। এরপর তিনি তার পরিকল্পনার কথা বললেন। তিনি জানালেন চোরদের জন্য একটি ‘চোর কল্যাণ সমিতি’র প্রয়োজন যাতে দুঃসময়ে চোরদের পাশে দাঁড়ানো যায়। চোরেরা একবাক্যে তার এই কথা স্বীকার করে নিল। কিন্তু এর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন সে জন্য অর্থের যোগান চোরদেরকেই করতে হবে— এই কথা যখন বললেন তখন চোরদের আগ্রহে খানিকটা ভাটা পড়ল। কিন্তু পরেক্ষণেই আজাদ সাহের এই সমস্যার একটু চমৎকার সমাধান হাজির করলেন। বললেন, “ টাকার চিন্তা আপনাদের করতে হবেনা, তবে আপনাদের একটা কাজ করে দিতে হবে।” চোরেরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ী করত লাগল। “আপনাদের বড় বড় চোরদের কাছে যেতে হবে আর তাদের চুরি করা মাল আপনাদের চুরি করে আমাদের সমিতিতে দিতে হবে তাহলেই হয়ে গেল।” ছিঁচকে চোরেরা প্রত্যেকই নিজেকে বড় চোর মনে করে। কিন্তু আজ এই শত শত চোরের মাঝেও সভাপতি কোন বড় চোরের হদিস না পাওয়ায় উপস্থিত চোরেরা খানিকটা অপমানিত বোধ করল। যদিও তারা মুখ ফুটে কিছু বললনা। সভা আজকের মত সমাপ্ত হল।

 

চোরেরা দুই সপ্তাহ ঘুরেও কোন বড় চোরের সন্ধান পেলনা। আসলে বড় চোর বলতে কত বড় চোর তারা সেটা জানত না। এর মধ্যে দেশে মহামারী শুরু হওয়ায় সরকার উদার হস্তে জনগণকে বিপুল পরিমান ত্রাণ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিলেন। টনকে টন চাল, ডালসহ অন্যান্য মালামাল আসতে লাগল জনপ্রতিনিধিদের হাতে। এসব জনপ্রতিনিধিদের সাথে কিছু ছিঁচকে চোরের খুব ভালো পরিচয় থাকে। এবারের রিলিফ বিতরণে সহায়তার জন্য এই চোরেরা  ডাক পেল। রিলিফ বিতরণ শুরু হল। এক বস্তা বিতরণ আর ৩ বস্তা এই সব চোরদের ঘাড় মারফত নির্দিষ্ট গুদাম ঘরে ঠাঁই পেতে লাগল। এর আগেও বেশ কয়েকবার এই একই কাজ করে দিয়েছে চোরেরা কিন্তু সেটা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখে এসেছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে বড় চোর খোঁজার চিন্তা মাথায় নিয়ে এই কাজ করতে গিয়ে ঘাড়ে বস্তা নিয়েই চোরেরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বাঁকা ঠোটে খানিকটা হেসে নিল। যেন তারা এই মুহূর্তেই গুপ্তধনের সন্ধানটি পেয়ে গেছে।

 

আজাদ সাহেব বড় একটা গুদাম খুলে বসে আছেন। বড় চোরদের মালামাল আসবে আর সেখানে ভরবে। পরে মিডিয়া ডেকে ছিঁচকে চোর কর্তৃক জবানবন্দি নিয়ে বড় চোরদের মুখোশ উন্মোচনপূর্বক সরকারের কাছে মাল হস্তান্তর করে চোর দমন কমিশনের সফালতায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী সারাদেশ থেকে ট্রাকে করে মালা আসাও শুরু হয়েছে। ট্রাকের খরচ বহন করছে  তরুণ কলাম লেখক ফোরামের সভাপতি জাহানুর সাহেব। তারও খুব ইচ্ছা এই চোরদের নিয়ে তার সংগঠনের লেখকেরা গণ্ডায় গণ্ডায় কলাম লেখার সুযোগ পাক। মাল জড়ো হতে লাগল। একদিনের মধ্যেই নির্দিষ্ট  গুদাম ভরে গেল বড় চোরদের মালামালে। ছিঁচকে চোরেরা এসে আজাদ সাহেবের পায়ের ধুলা নিতে লাগল আর এত দিন পর বড় চোর দর্শনের ব্যবস্থা করে দিয়ে জীবন ধন্য করার জন্য তারা আজাদ সাহেবের দীর্ঘায়ু কামনা করে গেল।

 

পরদিন ভোরে সংবাদ সম্মেলন হবে। তাই সাংবাদিকরা কী কী প্রশ্ন করতে পারে সেগুলোর উত্তর ঘুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলেন আজাদ সাহেব। রাতে ছিঁচকে চোরদের একাংশ নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করে নতুন ‘চোর কল্যাণ সমিতি গঠন’ করে সব মালামাল গুদাম থেকে সরিয়ে  স্থানীয় এক আরৎদারের নিকট কম দামে বিক্রি করে দিল। অনেক মালামাল তাই কম দামে হলেও মোটামুটি অঙ্কের টাকা হয়ে গেল। দেশের জনপ্রতিনিধিরা বড় চোর। তাদেরকে সবাই সম্মান করে। সেজন্য এই ছিঁচকে চোরেরা সিদ্ধান্ত নিল তারাও বড় চোর হবে। তবে একসাথে তো আর সবার বড় চোর হওয়া সম্ভব নয় তাই একজনকে আগে হতে হবে। তারা টাকা গুলো নষ্ট না করে আগামী নির্বাচনে একজনকে বড় চোর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাতে কাজে লাগবে বলে জমা রেখে দিল। 

 

সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ, চোরদের বাকি অংশ এসে উপস্থিত। কিন্তু আজাদ সাহেবের খোঁজ নেই। তিনি নির্জন রুমের মধ্য জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। আজাদ সাহেবের আসতে দেরি দেখে বাকি চোরেরা ধরে নিয়েছে আজাদ সাহেব তাদের ধোঁকা দিয়েছে। তাদের দিয়ে মালামাল চুরি করিয়ে এখন সেই মাল নিজে বিক্রি করে বড় চোর হতে চাইছে। বিরাট হট্টগোল বেঁধে গেল মূহুর্তের মধ্যেই। ‘বড়চোরের বিচার চাই’ বলে স্লোগান দিতে লাগল ছিঁচকে চোরেরা। টেলিভিশন মিডিয়ার লোকগুলো সেই স্লোগান উৎসাহের সাথে সরাসরি সম্প্রচার করতে লাগল। একজন ছিঁচকে চোরের অতিরিক্ত লাফালাফি দেখে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন— “আচ্ছা ভাই,আপনি যে বড় চোরের বিচার চাচ্ছেন, এই বড় চোরটা আসলে কে?” ছিঁচকে চোর খেঁকিয়ে উঠে উত্তর দিল, “কে আবার! আজাদ মিয়া।”

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত