তৈমুরের অভিশাপ -১৪

চৌদ্দ.

ধুপানিছড়া পাড়া। বান্দরবন। বাংলাদেশ।
চাইনিজ জেড পাথরের অবশিষ্ট অংশটা বাবরের হাতে পৌঁছে গেছে। তাইওয়ানে সংগঠনের গোপন সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে এটাকে সিরিয়ায় পাওয়া ফলকটার সাথে মিলিয়ে তারপর করণীয় ঠিক করাই হত স্বাভাবিক। কিন্তু সংগঠনের বর্তমান প্রধান এত ঝুঁকি নিতে চাননি। তিনি মনে করেছেন এসব নিয়ে তাইওয়ানে ঢুকে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে আবার বাংলাদেশে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। বিশ্ব মোড়লরা উঠে পড়ে লেগেছে। যে কোন মুহুর্তে পুরো কাজটা ভণ্ডুল করে দিতে পারে। তাই কোন সমস্যা তৈরী হওয়ার আগেই যাতে জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি নিজে চলে এসেছেন বান্দরবন। সাথে যিন হো আছে।

বাবর পরে জেনেছে সংগঠনের প্রধান কর্তা হো’র আপন চাচা। হো’র বাবা অল্প বয়সে মারা গেলে তিনিই এর প্রধানের পদ লাভ করেন। তার কোন ছেলে সন্তান নেই, তার অবর্তমানে হো নিজেই ঐ পদের অধিকারী হবে। সংগঠন এখনও যিন রাজবংশের উত্তরাধিকারের প্রাচীন নিয়মের মাধ্যমে চলে। বাবর যখন এসব জেনেছে তখন বেশ অবাক হয়েছে। কারণ হো ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী হয়েও সরাসরি বাইরের দেশে সংগঠনের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে গেছে এবং বাবরের মত অনুগত আর মেধাবীদের দলে ভেরাতে সুক্ষ্ম চেষ্টা চালিয়েছে। হো’র সাথে সুসম্পর্ক আর নিজের মেধা এই দুইয়ের ফসল হিসেবেই বিজাতীয়দের মধ্যে কেবল বাবর এতখানি উঁচু জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, এত মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।

বিশেষ ব্যাগে রাখা বাক্স বের করা হয়েছে। বাবর আর সংগঠনের অন্য দুই এক্সপার্ট তাদের সমস্ত মনযোগ ঢেলে দিয়ে সেসবের অর্থোদ্ধার সম্পন্ন করেছে। অত্যন্ত যত্নের সাথে নুকুস থেকে আনা টুকরোটা পালমিরায় পাওয়া ফলকের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলক দুইটা চাইনিজ জেড। বাবর আরামায়িক এর এক্সপার্ট কিন্তু জেড সম্পর্কে ধারণা নেই। আর তাছাড়া খনিজবস্তু তার আগ্রহের বিষয় ছিলও না। তবুও তার সহকর্মী চীনা এক্সপার্ট দুইজন তাকে জেড সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা দিয়েছেন।

জেড সাদা আর সবুজ রঙের হয় সাধারণত, তবে কখনো কখনো ছাগলের মাংসের ন্যায় হালকা লালচে রঙেরও হতে পারে। চীনাদের কাছে সবুজটার মর্যাদা আর ব্যবহার বেশী। ইউরোপীয়রা গাঢ় সবুজ জেড পছন্দ করলেও চীনারা হাল্কা সবুজই পছন্দ করে। চীনাদের কাছে গয়নায় ব্যবহার যোগ্য বা মূল্যবান যে কোন সবুজাভ পাথরই জেড। তবে এখানে ফলকে যে খনিজ যৌগটি ব্যবহৃত হয়েছে তার আসল নাম নেফ্রাইট। চীনা ঐতিহ্যে এটি আত্মা আর অমরত্মের প্রতীক। জেডকে যখন স্বর্ণের সাথে জুড়ে দিয়ে ব্যবহার করা হয় তখন তা হয়ে উঠে স্বর্গের প্রতিরূপ।

জেড এর সর্বপ্রথম যে ব্যবহার চীনা ঐতিহ্যে আছে তা প্রায় তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অর্থাৎ আলোচিত দৈব বস্তুরও প্রায় পাঁচশ বছর আগে। তখনকার ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী ছয়টি জেড পাথর চিহ্নিত ছিল। তাদের নাম যথাক্রমমে – বি, কং, হুয়াং, হু, গুই, ঝাং। ধর্মগুরুদের মতে এই ছয়টি পাথর আসলে ছয়টি চুড়ান্ত দিক নির্দেশক ছিল। অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-উর্ধ্ব(আকাশ)-অধঃ(ভূমি)। এমনকি চীনা ইতিহাসে পাওয়া যায় হান রাজবংশের রাজকীয় মৃত ব্যক্তিদের জেড পাথরে মোড়ানো পোশাকে আবৃত করে সমাধিস্ত করা হত যাতে তারা স্বর্গীয় আর্শীর্বাদের আওতায় সবসময় থাকেন।

দৈব বস্তুর সাথে জেড পাথরের ফলক থাকা এবং তাতে ব্যবহারের দিক নির্দেশনা খোদাই হওয়ার দুইটি কারণ রয়েছে-
প্রথমতঃ প্রকৃতিতে প্রাপ্ত পাথুরে যৌগসমূহের মধ্যে সৌন্দর্য আর দীর্ঘস্থায়িত্বের দিক থেকে জেড অনন্য।
দ্বিতীয়তঃ জেড পাথর চীনা প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে পৃথবী ও স্বর্গের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে কাজ করে। দেখা যাচ্ছে ‘স্বর্গ আর পৃথিবী এই দ্বৈত’ এবং ‘প্রাণঘাতী জীবাণু আর তা থেকে সুরক্ষার দ্রব্য এই দ্বৈত’ উভয়ের যোগসূত্র হিসেবেই জেড ব্যবহৃত হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই জেড এর ব্যবহার সবচাইতে পারফেক্ট চয়েস ছিল। তাছাড়া সর্বোচ্চ সময় পর্যন্ত যাতে ফলক টিকে থাকতে পারে সেই জন্যে জেড পাথরের ব্যবহারই আদর্শ। সুতরাং যে ভাবেই বিশ্লেষণ করা যাক না কেন, এই পুরো ব্যপারটির মধ্যে ঐশ্বরিকতার উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়।

বাবর আশৈশব নিরেট মুসলিম পরিবারে মানুষ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা আর যুক্তির বিচারে কথাগুলি ফেলেও দিতে পারছেনা। পৃথিবীতে কত আজব ব্যপারই না আছে, তার কতটুকুই বা জানা গেছে।

দিন দুয়েকের মধ্যেই পাত্র থেকে জীবাণু আর সুরক্ষার দ্রব্য পৃথক করা সম্ভব হবে।
ক্ষুদ্র বসতিটায় গোটা দু’য়েক তাবু ফেলা হয়েছে। তাবুর ভেতরে রয়েছে পেট্রোল চালিত ক্ষুদ্র জেনারেটর। বাবরের সঙ্গীরা এই দুর্গম এলাকায় এসব আয়োজনের যাবতীয় সামগ্রী সংগ্রহের মত দুঃসাধ্য সাধন করেছে। মোটামোটি ফিল্ড হসপিটালের মত দেখতে দুইটা তাবুর ভেতরে পরিপূর্ণ মোবাইল ল্যাবরেটরী চালু করে ফেলা হয়েছে। কিছু দুষ্প্রাপ্য ল্যাব উপকরণ তাইওয়ান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল আগেই। এরকম একটা পরিস্থিতি যে আসবে তা জানা ছিল ফলে প্রস্তুতিটা এক অর্থে নিখুত হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে বসতির সাধারণ অধিবাসীরা প্রায় কিছুই জানেনা। তাদের গোত্র সরদার বাবরের দলের সহযোগীদের একজন বিধায় বিষয়টা থেকে তাদের অপ্রয়োজনীয় কৌতুহল দূর করা গেছে। সর্দারের এক কথায় তারা এসব থেকে নিজেদের যাবতীয় মনযোগ আর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। এমনিতেই আদিবাসীরা সর্দারদের সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসাবে মান্য করে। ফলে বিষয়টা সামাল দেয়া পানির মত সহজ ছিল।

ফলকের নির্দেশণা অনুযায়ী জানা গেছে জীবাণু রাখা পাত্রের নীচটা উপরের অংশের সাথে থ্রেড এর মত করে পেচিয়ে আটকানো, যদিও দেখতে একটা আস্ত নিরেট পাত্রই মনে হয়। পাত্রটাকে সোজা অবস্থায় রেখে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে তলাটা ঘোরাবার জন্য খানিকটা জোর প্রয়োগ করতেই দেখা গেল আস্তে আস্তে তা ঘুরতে শুরু করেছে। প্রথমটায় বেশ শক্ত আর অমসৃণ ঘুর্ণন হলেও এক-দেড় প্যাঁচ ঘোরার পরে অনেক সহজ হয়ে এল। আরও গোটা তিনেক প্যাঁচ ঘোরাতে পাত্রের তলাটা উপরের দিকে দেড় ইঞ্চি কার্ণিশসহ খুলে এল।

এখন পাত্রটা দুটো আলাদা পাত্রে পরিণত হয়েছে। খুলে আনা অংশটাতে আছে পুরোটার তিন ভাগের এক ভাগ, উপরিভাগে অপর দুই অংশ। খুলে আসা অংশটার উপরিতলে একটা পাতলা টিস্যুর মত ঢাকনি দেখা গেল, যেটা সরাতেই কালো কুচকুচে জেলির মত জিনিস নজরে এল। এটিই সুরক্ষার বস্তু।

জীবাণুটা মূলত সংক্রমিত হয় শ্বাসনালীতে এবং ছড়াতে সময় লাগে মাত্র আধঘন্টা থেকে পয়তাল্লিশ মিনিট। এর পর উন্মুক্ত বাতাসে জীবাণু আর কর্মক্ষম থাকেনা। সেটা ওরা জেনেছে ট্রায়াল ব্যবহারের সময়ই। তবে তখন গ্যস মাস্ক পড়তে হয়েছে জীবণের ঝুঁকি নিয়ে। এখন তা ছড়িয়ে দেয়া হবে পুরো পৃথিবীব্যপি। তাই দৈব সুরক্ষা প্রয়োজন। থকথকে জেলিটা নাকে পেট্রোলিয়াম জেলির মত লাগিয়ে জীবাণু উন্মুক্ত করলে কোন ভয় থাকবেনা।

ছোট ছোট অনেকগুলি মেটাল সিলিন্ডার আগেই তাইওয়ান থেকে আনা হয়েছে। সেসবের মধ্যে আলাদ আলাদা করে জীবাণু আর সুরক্ষাদ্রব্য ভরে নিয়েছে তিনজন মিলে। এখন তা পাঠিয়ে দেয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরী । ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাপকদের তাইওয়ানের সদর দপ্তর থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আগামী পরশুদিন সিলিন্ডার তাদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়বে। সব জায়গায় পৌঁছাতে বড়জোড় চার বা পাঁচদিন সময় লাগবে, তারপর নির্দেশ এর অপেক্ষায় থাকবে প্রাপকরা। নির্দেশ পেলে একযোগে সব বড় বড় শহরগুলিতে সিলিন্ডার উন্মুক্ত করা হবে। প্রাথমিক টার্গেটে অবশ্যই উন্নত শহরগুলি থাকবে। তথাকথিত মেকি প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আবার ঐশ্বরিক আর প্রকৃতিপ্রদত্ত পবিত্র জীবন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে অবশিষ্ট মানবজাতিকে।

খুব বেশী গুরুতর প্রয়োজন না হলে বাবর তার ফোন বা ল্যাপটপ ডিভাইস চালু করেনা, প্রথমত ঝুঁকি এড়ানোর জন্য, আর তাছাড়া বিদ্যুত না থাকায় সংরক্ষিত স্পেশাল ব্যাটারি ব্যাকআপ ব্যবহার করতে হচ্ছে যার ক্যাপাসিটি খুবই সীমিত। তাই হিসেব করে চলা ছাড়া উপায় নেই। আর ডিভাইসে ইন্টারনেটও পারতপক্ষে সচল করেনা। অথবা করলেও খুবই অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিয়ে বন্ধ করে দেয়। এমনিতেই বিশ্ব প্রযুক্তি খুব উন্নত হওয়ায় ঝুঁকি বেড়ে গেছে। দীর্ঘ সময় অনলাইনে থাকলে কোন ডিটেকটিং সিস্টেমে ধরা পড়ে যাবার ভয় থেকে যায়। কোন ভাবেই এ মুহুর্তে ধরা পড়া চলবেনা। মেইল খুললে, প্রয়োজনীয় মেইল লোড নেবার পর অফলাইনে গিয়ে মেইল পড়ে,তারপর আবার অল্প সময়ের জন্য অনলাইনে গিয়ে দ্রুত লগআউট করে নেয়।

বাবরের ব্যক্তিগত একটা ইমেইল এড্রেস আছে যেটা সে বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করেনা এবং খুলেও দেখেনা। আজ কী মনে করে খুলল। অনেক অনেক মেইল এসে ইনবক্সে জঙ্গল হয়ে আছে। তবে একটা শিরোনামে চোখ আটকে গেল। গত পরশু দিন জারার আই.ডি থেকে একটা মেইল এসেছে দেখা যাচ্ছে। মেইলটাতে ক্লিক করতেই খুলে গেল। সাথে সাথে ইন্টারনেট অফ করে নিল বাবর। মেইলটা পড়ছে-
‘বাবর,
তুমি কোথায় আছো জানিনা। তবে কেমন আছো, কীসে আছো আর কেন আছো তা আন্দাজ করতে পারি। কীভাবে আন্দাজ করতে পারলাম তা বলার সময় এটা নয়। এই বার্তা তোমার কাছে পৌঁছাবে কীনা বা তুমি পড়বে কীনা তাও জানিনা। শুধু এটুকুই বলব-যে তুমি একজন নারীর প্রতি এত বিশুদ্ধ আর পবিত্র ভালবাসা অন্তরে ধারণ করো সে তুমি পৃথিবী ধ্বংস করে দেবার মত হীন আর জঘণ্য আদর্শ ওই একই অন্তরে ধারণ করতে পারনা। দু’টো এক সাথে সম্ভব নয়। তোমাকে কোন কিছু করতে বলব অথবা নিষেধ করব তেমন কেউ আমি নই। শুধু বলব- নিজেকে যা ভেবে নিয়েছ, তুমি তা নও। তুমি অনেক অনেক বড়; বিশাল কেউ একজন। তোমার ভালবাসার যথোপযুক্ত প্রতিদান আমি দিতে পারিনি ঠিকই তবে সেই ভালবাসা ধারণকারী হৃদয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর শুভকামনা সব সময়ই থাকবে।
জারা।’

স্ক্রীণের দিকে বাবর দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। একমুহুর্তের জন্য মনে হল-পাহাড়ের মত কঠিন প্রত্যয় টলে গেছে। সমস্ত চিন্তা পারস্পরিক যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছে যেন। পরক্ষণেই ভাবল,না-ভাবাবেগে আপ্লুত হওয়া চলবেনা। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির উর্ধ্বে এখন বিশাল এক অর্জনে পথে রয়েছে ও। এ অবস্থায় হাল ছেড়ে দিলে চলেনা। দাঁতে দাঁত পিষবার কারণে চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে আছে বাবরের। ল্যাপটপ অফ করে বক্সে রেখে দিয়ে উঠল সে। শেষ মুহুর্তে সিলিন্ডারগুলি আরেকবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কোন ভুল বা খুত থাকা যাবেনা। কোনমতেই না।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত