যা ভাবতে পারিনি

আজ সকালে একটু তাড়াতাড়িই উঠেছি। উঠেই জমিজমা সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে বসলাম। ১০০ বছর আগে আমার পরদাদার জায়গার দলিলপত্র এখন অনেকটা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমি কিছু বুঝার চেষ্টা করছি। বাবা আমাকে কিছু দলিল পড়তে দিয়েছেন। আমি অনেক কিছুই বুঝছি না লেখার দুর্বোধ্যতার কারণে, মনে হচ্ছে আতশী কাচ লাগবে আরো ভালোভাবে পড়ার জন্য।

সকালের নাস্তা করেই আমি দলিলপত্র নিয়ে নামজারি করার জন্য ভূমি অফিস চলে এসেছি।
উপজেলা ভূমি অফিসের ভবনটি আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে। পুরনো দেয়ালগুলোতে নতুন অফ হোয়াইট রঙ দিয়েছে। আমার তো চিনতেই অসুবিধা হচ্ছিল। এটা কি ভূমি অফিস! আগে ভবনটির দেয়ালে ময়লা, পানের পিক, ঝুল এসব যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। রঙ করাতে কিছুটা ভালো লাগছে। আবার এখানে আরেকটা বড় রুমও করা হয়েছে। যাতে মানুষজন এসে বসতে পারে। ভবনের সামনে আবার ছোট একটা বাগান। নানা রকম ফুল লাগানো হয়েছে। ফুলগুলো এখনো ছোট। যখন বড় হবে তখন বেশ সুন্দর লাগবে। আগের ভূমি কর্মকর্তারা বিষয়টিতে নজর না দিলেও এখন যিনি আছেন তিনি সম্ভবত নজর দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, বেশ রুচিশীল। একজন কর্মচারী ফুলে পানি ঢালছে। যে পানি ঢালছে তার চেহারার সাথে আমার এক বন্ধুর চেহারার বেশ মিল দেখতে পাচ্ছি। তবুও আমার মন বলছে, আমার সেই বন্ধুটাতো এখানে কাজ করার কথা না। নিশ্চয়ই একই চেহারার অন্য কেউ হবে।
হঠাৎ দেখি সে আমাকে সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি রাজু?
আমি বলি, হ্যাঁ। তুই সুজন?
সুজন বলে, হ্যাঁ।
কিন্তু তুই আপনি করে বলছিস কেন?
সন্দেহ হচ্ছিল, তুই কিনা! অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছিস। আগে তো আরো মোটা ছিলি এখন অনেক ¯িøম। বেশ ফর্সাও হয়েছিস।
আমি বলি, কিন্তু তুই এখানে কেন?
আমি এখানে চাকরি করি।
কি চাকরি করিস? কোনো কর্মকর্তা হয়ে এসেছিস?
সুজন খুব দৃঢ়ভাবে বলে, আমি ঝাড়–দার এখানকার।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এখানে ঝাড়– দেস!
হ্যাঁ, অফিসারদের রুমও পরিষ্কার করি।
আমি বিস্মিত হলাম। তুই না ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র! তোর তো বড় অফিসার কথা। তুই ভূমি অফিসের পিয়ন তো হওয়ার কথা না। তোর হওয়ার কথা ছিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক অথবা এসিল্যান্ড।

সুজন নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো কাজই ছোট মনে করি না আমি।
আমি ওর অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়েছি কিন্তু কিছুতেই তাকে ছোট করার ইচ্ছে নাই।
বললাম, হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। যে কোনো কাজকেই সম্মান করা উচিত। আমি তা করি। কিন্তু তোর তো আরো ভালো জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো। নাকি তুই আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছিস? এখানে মনে হয় তুই শখের বসে গাছে পানি দিচ্ছিস।
সুজনকে দেখে মনে হবে না সে এখানকার কর্মচারী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শার্ট প্যান্ট পরে এসেছে। তেমন আঞ্চলিকতাও নাই।
সুজন বলে, মিথ্যা না। সত্যি বলছি। আমি ঝাড়–দার।
আমি বললামে, তুই ঢাকা ইউনভার্সিটিতে বিবিএতে ভর্তি হলি না?
হ্যাঁ, তবে সেকেন্ড ইয়ার থেকে ছেড়ে দিয়েছি।
কি বলিস! আজকে ৭/৮ বছর হয়ে গেল, অথচ জানলাম না তুই ড্রপ আউট হয়ে গেছিলি। কেন ছাড়লি পড়াশোনা?
পড়াশোনা আমার কাছে খুব কঠিন লাগতেছিলো। বুঝতেছিলাম না কিছু। ফ্যামিলি সাপোর্টও ছিলো না।
তুই ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হইছিলি না?
হ্যাঁ
তো, পড়াশোনাটা শেষ করতে পারলি না কেন?

সুজন বলল, আমি কি ভালো ছাত্র ছিলাম?
তুই ভালো ছাত্র না হলে ঢাবিতে চান্স পাইলি ক্যামনে?
এখন এত কিছু বলে লাভ নাই। দোয়া করিস।
আমি সুজনের মোবাইল নাম্বার নিলাম। ফেসবুকে আগেই এড ছিলো কিন্তু খুব একটা দেখা যায় না বলে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নাই।

সুজন ছিলো ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ভরাট গলার অধিকারী। ক্লাসে কোনো স্যার কিছু পড়তে দিলে খুব জোরে পড়তে পারত। ভালো ভয়েসের কারণে স্যাররা ওকে দিয়েই পড়াত। কালো শ্যামলার মাঝামাঝি একটা রঙ তার। উচ্চতায়ও বেশ লম্বা। স্যান্ডেল পরে আসত স্কুলে। কোনো ধরনের অহংকার ছিলো না বলে আমি ওর সাথে মিশতাম ও প্রায়ই একই বেঞ্চে বসতাম।
আমি ভেবেছিলম, সুজন হয়তো বিসিএস বা অন্য ভালো চাকরির জন্য পড়ছে। ব্যাচের অনেকের খোঁজ খবরই পাচ্ছিলাম। কিন্তু ওর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। নি¤œবিত্ত পরিবারের ছেলে সুজন দ্বিতীয় বর্ষ অতিক্রম করে আর পেড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির মত জায়গায় চান্স পেয়েও, এটা আমাকে বেশ বিস্মিত করল। যাই হোক, সব কিছু কপাল। ভাগ্য খারাপ হলে আর কি করা!
সুজন আমার সাথে কথা বলে চলে গেল, তার বস তাকে ডাকছে। আমি এখানে একটা বেঞ্চে বসে আছি।
আর আমার মনে পড়ল ক্লাস এইটের একটা ঘটনা। স্কুলে টিফিন পিরিয়ড থাকে ৪০ মিনিট। টিফিন পিরিয়ডে আমরা স্কুলের আশেপাশের দোকান থেকে কিছুু কিনে খেতাম অথবা বাসা থেকে মাঝে মাঝে খিচুড়ি আনতাম। সেটা খেতাম। কিন্তু সেদিন মাথায় কি এক দুষ্টু বুদ্ধি এলো, সেদিন টিফিন না করে আমি আর সুজন সিদ্ধান্ত নিলাম, স্কুল গেইটের পাশে রাখা আজিজ স্যারের সাইকেলটা নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসব। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাইকেলের তালা ভেঙ্গে আমরা স্কুলের সীমানা পার হয়ে নিজেদেরকে খুব স্বাধীন মনে করতে লাগলাম।
স্যারদের মধ্যে শুধু আজিজ স্যারই সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসতেন। আজিজ স্যার হ্যাংলার মধ্যে ফর্সা। প্রচুর সিগারেট খান। টিফিন পিরিয়ডে বা স্কুল ছুটির পরে মনা ভাইয়ের দোকানে বসে বসে তিনি এই কাজটা করেন। যখন কথা বলেন মাঝে মাঝে মুখ থেকে থুতু বেরিয়ে আসে।
আর ইংরেজি গ্রামারে খুব ভালো ছিলেন বলে আমরা অনেকে পেছনে তাঁকে গ্রামার স্যার ডাকতাম। তাছাড়া গ্রামারের রুলস মুখস্ত করে আসতে বলতেন। না পারলে কঠিন বেত্রাঘাত করতেন। আর আমরা কি না সেই আজিজ স্যারেরই সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছি।
আমাদের বই খাতা তখনো কিন্তু স্কুলের বেঞ্চে। আমারা কোনো কিছু চিন্তা করিনি আমাদের কি হবে না হবে!
কিশোর বয়সে সেদিন দশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছি। আমাদের উপজেলা ডিঙিয়ে পাশের উপজেলার এক নদী তীরবর্তী এলাকায় চলে গিয়েছিলাম। কখনো আমি সাইকেল চালিয়েছি আর কখনো সুজন। বাহনটি চালাতে চালাতে পা ব্যথা বা ক্লান্ত হয়ে গেলে আমি সুজনকে দিতাম।
সুজন বলেছিল, বন্ধু স্যার যদি জানতে পারে আমরা তার সাইকেল নিয়ে পালিয়েছি স্যার তো আস্ত রাখবে না আমাদের।
আমি বলি, আরে টেনশন করিস না। স্যার বুঝতে পারবে না। এরকম এডভেঞ্চার আর পাওয়া যাবে না।
সুজন খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে অভয় দিয়েছিলাম।
সেদিন আমাদের দুজনের পকেটে ৬০ টাকা ছিল। স্কুলে থাকতে এই টাকা আমাদের কাছে অনেক মনে মত। আমরা সাইকেল চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে পাউরুটি ও কলা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করি।
খুব রোদ ছিল সেদিন। রোদের মধ্যে আমাদের ঘাম তরতর করে পড়ছিল। তবুও কি এক অজানা সুখে সামান্য সময়ের জন্য আমারা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়টুকু আমার কাছে খুব পরাধীন মনে হত। স্যারদের শাসন আমার কাছে খুবই বিরক্ত লাগত।
দুপুর ১ টার সময় আমরা যে বেরিয়ে গেলাম আর সন্ধ্যা ৬ টার কিছু সময় পর আমরা স্কুল গেইটের সামনে এসে পড়ি। সাইকেলটা কোনো রকম দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রেখে আমরা যার যার বাসায় চলে যাই। কিন্তু আমার মধ্যে কি এক অজানা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। দুজনে বিদায় নেয়ার আগে সুজনকে আমি বলি, বন্ধু স্যার মনে হয় খুব ক্ষ্যাপা। কেউ না কেউ আমাদের সাইকেল নিয়ে পালানোর কথা বলে দিবে।
সুজন বলে, আমারও তাই মনে হয়। কারণ ব্যাগগুলো বেঞ্চে রয়ে গেছে। আমরা তো ধরা পড়ে যাব। স্যার সাইকেল না পেয়ে হয়তো ভেবেছে, কেউ চুরি করেছে।
থাক. যা হবার হবে। আর আমরা যদি কালকে স্কুলে না আসি পরে আবার আমাদের বাবাদের ডাকাবে।
ঠিক বলেছিস।
পরেরদিন আমি আর সুজন ছাড়া সবাই ব্যাগ নিয়ে স্কুলে ঢুকছে। স্কুলগেইটে পা ফেলার পর আমাদের সহপাঠীরা আামাদের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমরা কাউকে খুন করে ফেলেছি এবং কেউ কেউ নানা রকম ভয়ভীতি দেখাতে লাগল।
একজন বলল, তোদের নাম ও রোল আজিজ স্যার টুকে নিয়েছেন। ব্যাগগুলো হেড স্যারের অফিসে।
কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, ক্লাসে গেলে আমাদের ব্যাগ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখন তো আমাদেরকে খুব কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আমি ভাবতে লাগলাম, হেড স্যার মারবে না আজিজ স্যার মারবেন। আজিজ স্যার মারলে একটু বেশি মারবে।
এর মধ্যেই কে জানি আজিজ স্যার ও হেড স্যারকে বলে দিয়েছে গতকালকের আসামি দুজন এসেছে। আমাদের দুজনকে হেড স্যারের রুমে ডাকা হলো। সুজনকে আবার হেড স্যার জনাব আবদুল করিম খুব ভালো করে চিনে। হেড স্যারের এলাকাই সুজনের এলাকা।
আজিজ স্যার হেড স্যারকে বললেন, স্যার এরা গতকাল আমার সাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেছিল। সাইকেলের চাকাও পাংচার করে দিয়েছে। এদের বাবাদেরকে তো চিনেন। হয় গার্ডিয়ান ডাকান নয় এদের বিচার করেন।
হেড স্যার তার পিয়নকে কঠিন হুংকার দিয়ে বললেন, এই বেত আন।
আমরা দুজন ভয়ে অস্থির। গলা শুকিয়ে গেছে। এত বড় অপরাধ কখনো করিনি। আাবেগের বশে সাইকেল নিয়ে পালিয়েছি। তার উপর চাকা পাংচার হয়ে গেছে, যদিও সেটা আমরা করতে চাইনি।
হেড স্যার বললেন, ইচ্ছে হচ্ছে তোদের টিসি দিয়ে বের দিই। তোদের তো সাহস কম না, একজন শিক্ষকের সাইকেল চুরি করে নিয়ে গেছিস।
পিয়ন বাইরে থেকে একটা বেত নিয়ে এলে হেড স্যার আমাকে ১৪ বেত ও সুজনকে ১৮ বেত দেয়।
স্কুলের প্রায় সব ছাত্রছাত্রী হেড স্যারের রুমের সামনে সেদিন জড়ো হয়েছিল। আমরা সেদিন কি এক লজ্জা ও অপমানের মুখোমুখি হয়েছিলাম।
সুজন আমার সেই বন্ধু যে আমার সাথে একই ঘটনায় জড়িত ছিল।

আরেকদিনের ঘটনা। ক্লাসে টেনে পড়ি তখন। জুন মাসের মাঝামঝি সময়। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল কয়েকদিন ধরে। অনেক জায়গায় পানি উঠে গিয়েছিল। ্ওইদন আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থীও কম এসেছিল। আমি আর সুজন চিন্তা করলাম হেড স্যারের কাছে একটা আবেদনপত্র নিয়ে গেলে কেমন হয়। যাতে স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। যেই ভাবা সেই কাজ। একটা আবেদনপত্র তৈরী করলাম। আবেদনপত্রে যা লেখা হয়েছ তার সারসংক্ষেপ হলো, স্যার বৃষ্টির কারণে আমাদের স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসতে পারেনি। তুমুল বর্ষায় অনেক জায়গায় পানি উঠে গেছে। এই অবস্থায় স্কুল ছুটি দিয়ে দিলে বেশ ভালো হয়।
আবেদনপত্রে এই লেখা লিখে সব ক্লাস ক্যাপ্টেনের কাছে গেলাম। ক্লাস ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বললাম, আমরা আজ ক্লাস করতে চাই না। তোমারা কি রাজি আছ? সবাই তো খুশি। কেউই ক্লাস করতে চায় না। ক্লাস ক্যাপ্টেনরা আবেদনপত্রে সাক্ষর দিয়ে সম্মতি জানাল। সব সাক্ষর নিয়ে আমি, সুজন ও অন্য বন্ধুরা মিলে হেড স্যারের কক্ষে ঢুকলাম।
হেড স্যার বলল, কী চাও তোমরা?
সুজন বলল, স্যার দরখাস্তটা পড়–ন।
হেড স্যার আবেদনপত্রটা পড়ল। চোখের চশমা খুলে ফেলল।
খুব রেগে গিয়ে বলল, জুন জুলাই হচ্ছে পড়াশোনার মোক্ষম সময়। এখন স্কুল ছুটি কেন দিব? তোমরা এটা কেন করেছ? সব ফাঁকিবাজ।
আমরা চুপচাপ ছিলাম। কোনো উত্তর দেয়ার সাহস হয়নি।
পাশেই এক স্যার বসে ছিল। তিনিও বেশ আশাবাদী ছিলেন নিশ্চয়ই ভারী বর্ষণে স্কুল ছুটি ঘোষণা হয়ে যাবে।
আমরা হেড স্যারের কাছে আবেদনপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম টিফিন পিরিয়ডের আগে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেছিল আমদের আবেদনে মনে হয় কাজ হয়ে গেছে। এই ভেবে অনেক শিক্ষার্থী টিফিনের সময় বাড়ীতে চলে যায়।
স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমাকে ও সুজনকে হেড স্যার তাঁর অফিসে ডাকায়। অফিসে গেলে হেড স্যার আমাকে ও সুজনকে কঠিন ভাষায় বলে, তোমরা নাকি স্কুল ছুটি দিয়ে ফেলেছ?
সুজন বলে, কই না তো স্যার আমরা তো কাউকে কিছু বলিনি।
হেড স্যার বলে, দেখ তোমরা কিন্তু এর আগেও অকারেন্স ঘটিয়েছ। তোমাদেরকে আমরা কিছু করতেছি না এই জন্য তোমাদের সাহস বেড়ে গিয়েছে। লাস্টবারের মত ওয়ার্নিং দিয়ে দিলাম। ভালো হয়ে যাও।
সেদিন হেড স্যারকে কারা জানি আমাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছিল। যা আমরা করিনি তা রটানো হয়েছে।
সুজন এখন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। সে আমার দিকে তেমন দৃষ্টি দিচ্ছে না। তবে এখন তার কাজ মনে হয় কিছুটা কমেছে।
সুজনকে আমি ডাক দিলাম। সে কাছে এল। জিজ্ঞাসা করলাম, বিয়ে করেছিস?
নাহ, এখনো করিনি।
করবি না?
এখানে যে বেতন পাই, বিয়ে করলে বাসা ভাড়া দিয়ে পোষাবে না।
কত পাস বেতন?
১৪ হাজার।
ও আচ্ছা।
সুজন এখন পান খাওয়া ধরেছে। পকেট থেকে বের করে পান চিবাতে লাগল। মনে হয়, এখানের যারা কর্মচারী তাদের থেকে দেখে পান খাওয়া শিখেছে। সে আমাকে পান খেতে সাধল। আমি না করি দেই। তবে ছোটবেলায় বিয়ে বাড়িতে দুই বা তিনবার পান খেয়েছিলাম শখের বসে। তা-ও মিষ্টি পান।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পান যেহেতু খাস, সিগারেটও খাস নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ তা তো খাই
দিনে কয়টা করে?
বেশি না, ৫ টার মতো খাই। আগে আরো বেশি খেতাম, এখন কমায় দিছি।
তাই!
হ্যাঁ
ভূমি অফিসে লোকজনের ভিড় বাড়তে লাগল। অনেক মানুষ জমি সংক্রান্ত কাজে এেেসছে। দালাল টালালও আছে। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যেতে নাকি প্রচুর ঘুষ দিতে হয়। আমি তো তেমন আসি নাই এখানে তাই আমার অভিজ্ঞতা কম বলতে গেলে নাই-ই।
সুজন কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হেঁটে আমার কাছে এসে বলে, চাকরিটা তো সরকারি না, চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেছি। কোথাও নিয়োগ টিয়োগ হলে আমাকে জানাইস।
আমি বললাম, আমার অফিসে দুজন লোক নিবে। ঢাকায় গিয়ে এমডির সাথে কথা বলে তোকে এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করা যায় কি না দেখবো!
আমার মনে পড়ল, সুজনের বাড়িতে অনেক আগে স্কুলে থাকতে একবার গিয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম, একটা মাঝারি সাইজের রুমে মাঝখানে একটা পর্দা দিয়ে দুটো রুম করা হয়েছে। পর্দার এক পাশের রুমে তার বাবা মা আরেক পাশের রুমে সুজন ও তার ভাই থাকত। রুমের পাশে বাইরে একটা চালা দিয়ে মাটির চুলা বসানো হয়েছে। ওর মা-টা খুব ভালো ছিল। আমাকে সেদিন পিড়িতে বসিয়ে রস দিয়ে ভাপা পিঠা খাইয়েছিল। বাবা তেমন ভালো ছিলো না, প্রচুর মদ খেত, সুজনই আমাকে বলেছিল।
আংকেল আন্টি বেঁচে আছে, সুজন?
বাবা মারা গেছে আজকে তিন বছর। মা আছে, তবে অসুস্থ। মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ লাগে।
তোর ভাই একটা আছে না? ও কি করে এখন?
ফারুক মারা গেছে আজকে অনেক বছর হয়ে যাচ্ছে।
সুজন একটু ভেবে বলল, ৫ বছর হয়ে গেছে সে আর আমাদের ছেড়ে চলে গেছে যে..
আমি কিছুটা সান্ত¡না দিয়ে বললাম, তুই বেঁচে থাক। সামনে সুদিন আসবে।
একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম, ঢাকা আসলে দেখা করিস। একসাথে চা খাব। আজ তো আর সম্ভব না।

আমি আসছিলাম জমির নামজারি করতে। কিন্ত আজ আর সম্ভব হলো না। আমার মনটাও ভালো লাগছে না। তাই আজ আর জমি জমা সংক্রান্ত ব্যাপারে কাজ করতে ইচ্ছে হলো না। কাল এসে আবার দেখি কিছু করা যায় কিনা!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত