মহুয়া মলুয়ার দেশে (দ্বিতীয় পর্ব)

 এসথার সুন্দরীর হারায়া যাওয়ার কাহিনী পড়তে পড়তে কখন বই হাতে ঘুমাই পড়ছি মনে নাই।  

 

হঠাৎ ঘুম ভাঙলো দুই ঠোঁটের ফাঁকে সুড়সুড়ি খাইয়া। চোখ মেলে দেখি শাহিন ফাজিলটা গালের ভিতর ওয়েফার ঢুকাই দিচ্ছে, এসথার নয়। ততক্ষণে ট্রেন কুমিল্লা রেলস্টেশনে চইলা আসছে। আরো কতগুলা মানুষ হুড়মুড় কইরা উঠে পড়লো আমাদের বগিতে। পানিওয়ালা, আমড়াওয়ালা উঠলো। আবার শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি।

“এই আমড়া আছে, আমড়া…”  

 

“এই পানি, পানি, পানি…”  

 

“এই চিপস আছে, চিপস…”  

 

আমি, শাহিন আর জোবায়ের তিনজন নেমে স্টেশনের এমাথা ওমাথা হেঁটে আসলাম একবার। ট্রেন আবার ছেড়ে দিলো। এই ট্রেনটা অনেকগুলো স্টেশন ধরে। এরপর কসবা, আখাউড়া হইয়া ভৈরব। ভৈরব আসার পর ট্রেন দাঁড়ালো বিশ মিনিট মতো। এখান থেকে আরো কিছু মানুষ উঠলো। ট্রেনের ভিতর নিশ্বাস ফেলা যায় না এ রকম অবস্থা।  

 

ভৈরব থেকে রেল লাইন দুইদিকে ভাগ হইয়া গেছে। একদিকে পরিচিত রাস্তা নরসিংদী হয়ে ঢাকা যাওয়ার লাইন। আরেকটা সিঙ্গেল লাইন চলে গেছে কিশোরগঞ্জ হয়ে গৌরিপুর, ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জের এই লাইনে আগে কখনো আসা হয় নাই। দুই পাশে ডোবা টাইপ বিল। মাঝখান দিয়া একটু উঁচু হইয়া চলে গেছে রেল লাইনটা। কিছুক্ষণ পর পর বড় বড় পুকুর। আর কিছু মাছ ধরার ভেসাল জাল উপরে উঠানো। ঘরবাড়ি তেমন একটা নাই। অনেক দূরে দূরে হঠাৎ একটা দুইটা ঘর চোখে পড়ে উঁচু জায়গায় উপর। একই রকম একটা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর দিয়ে গাড়ি চলতেই আছে, চলতেই আছে। এই পথ যেন আর ফুরাবে না।   

 

অবশেষে ভৈরব কিশোরগঞ্জ রাস্তা শেষ হলো। ট্রেন আইসা থামলো কিশোরগঞ্জ স্টেশনে। দুয়েক মিনিট দাঁড়াবার পর আবার ছাইড়া দিলো ট্রেন। এবার গন্তব্য গৌরিপুর জংশন। আমি মনে মনে ঘুরার প্ল্যানটা নিয়া বসলাম। ট্যাবে কয়টা স্ক্রীনশট আছে নেত্রকোনার ম্যাপের। এখানে নেট কাজ করে না দেখেই এই ব্যবস্থা। আমরা চারজনের কেউই আগে নেত্রকোনা আসি নাই। এই প্রথম আমাদের আসা। তাও কিছুদিন আগে সাঈদ ভাইরা আইসা খালিয়াজুরি হাওরে ঘুরে গেছিলেন পুর্ণিমার সময়। উনাদের খুব ভালো লেগেছে এই হাওরটা। সেই থেকে নাফিজ ভাইকেও পায়া বসছে এই হাওর।   

 

নাফিজ ভাই যখন খালিয়াজুরির কথা বললেন, তখন এক বাক্যে রাজি হইয়া গেলাম। তারপর নেটে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলাম। পরে দেখলাম এই জেলায় শুধু হাওর-ই না, আরো অনেক মাল আছে। বাংলাদেশে দুইটা আদিবাসী কালচারাল একাডেমী আছে। তার মধ্যে একটা নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি গ্রামে। দুর্গাপুরে আরো আছে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় চিনামাটির পাহাড়। আছে টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। বাংলাদেশের প্রথম ক্যাথলিক চার্চ এইখানে। এই জায়গায় না গিয়া তো নেত্রকোনা ঘুরা সম্ভব না।  

 

কিভাবে ট্যুর প্ল্যান করি এইটা নিয়া ফোন দিলাম ইভানকে। এই ছেলেটা গত রমজানেই ওখানে ঘুরতে গেছিলো। কিন্তু ইভানের কাছ থেকে যা শুনলাম তা শুনে তো হতাশ। আমরা যেইসব জায়গায় ঘুরার প্ল্যান করছি সেইসব জায়গা আমাদের নির্ধারিত দুইদিনে ঘুরা সম্ভব না। জায়গাগুলা অনেক দূরে দূরে। ইভান তার দুইটা বন্ধুর নাম্বারও দিলো। তাদের সাথে কথা বলেও বুঝলাম, দুইদিনে এতসব জায়গা কাভার দেওয়া আসলেই সম্ভব না। তার উপরে রাস্তা নাকি খারাপ। রাস্তা যে আসলে কতো খারাপ সেই বর্ণনায় পরে আসবো। 

 

নাফিজ ভাইকে জানালাম, “ভাই, একটা তো প্রবলেম হইয়া গেছে?”  

 

নাফিজ ভাই বললেন, “কি প্রবলেম?”  

 

“আমরা যে দুইটা জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান করছি, একটা তো এক এক জায়গায়। দুইদিনে তো মনে হয় কাভার দেওয়া সম্ভব না।” 

 

“একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে নাকি?” 

 

“হ ভাই।”  

 

“আমাদের মুল টার্গেট কিন্তু খালিয়াজুরি। এইটা মনে রাখিস। ওইখানে আমরা পুর্ণিমা দেখবো।”  

 

“এক কাজ করলে কেমন হয়? আমরা আজকেই খালিয়াজুরি চইলা যাই।” আমাদের প্ল্যান ছিলো প্রথম দিন দুর্গাপুর ঘুরবো। তার পরদিন খালিয়াজুরি। এইখানে আবার পুর্ণিমা নিয়েও একটা গন্ডগোল হইয়া গেছে। আমরা ভেবে রাখছিলাম পুর্ণিমা শুক্রবার রাতে। এখন দেখতেছি পুর্ণিমা একদিন আগে, বৃহস্পতিবার। আমাদের চিন্তা ছিলো শুক্রবার রাতে আমরা খালিয়াজুরি থাকবো।  

নাফিজ ভাই বললেন, “না। আজকে দুর্গাপুরেই যাই। কাল দুপুরের দিকে খালিয়াজুরি চইলা যাবো।”  

 

এর মধ্যে ট্রেন আইসা থামলো গৌরীপুর জংশন। আমার ভেতরে এই স্টেশন দেখার একটা তাড়না ছিলো অনেক আগে থিকা। এখন বলি কিসের তাড়না। অনেকদিন আগে হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস পড়ছিলাম ‘গৌরীপুর জংশন’ নামে। এই উপন্যাসের ভুমিকায় লেখক লিখছিলেন–আমি আমার উপন্যাসের নামকরণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের ধারস্ত হয়েছি। কিন্তু এই উপন্যাসটা শেষ হওয়ার পর কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজ থেকেই নাম দিলেন ‘গৌরীপুর জংশন’। সাধারণ একটা কাহিনী। জয়নাল নামে একজন রেল কুলি আর তার স্ত্রী অনুফার কথা বলা হইছে এই উপন্যাসে। কোন এক বিচিত্র কারণে জয়নালের স্ত্রী অনুফা বাজারের মেয়ে হয়ে যায়। বাজারে একটা ঘর নিয়া থাকে। খারাপ মানুষজন তাদের জৈবিক চাহিদা মিটাতে অনুফার কাছে আসে। এক সময় জয়নাল চারটা কমলা নিয়া অনুফাকে দেখতে যায়। এই রকম একটা কাহিনী। খুবই সাধারণ। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনার গুণে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলা আমার মাথার ভিতরে ঢুকে যায়।  

 

অনেকদিন পর্যন্ত গৌরীপুর জংশন বইটা আমার বিছানার কাছে ছিলো। জয়নালের জন্য আমার কষ্ট হতো। অনুফা মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হতো। ইচ্ছা হতো একদিন গৌরীপুর জংশন যাই। অনুফা মেয়েটার সাথে দুয়েকটা কথা বলে আসি। মেয়েটা বড় দুঃখী। এই দুঃখী মেয়েটার জন্য আমি বেশ কয়বার কান্নাও করছিলাম। এই সেই গৌরীপুর জংশন। এখানে কোথাও জয়নাল আছে। ট্রেনে পা কাটায় বেচারা এখন আর ভার বহন করতে পারে না। পাছা চেঁছড়াই চেঁছড়াই স্টেশনের এমাথা ওমাথা ভিক্ষা করে। আমি এদিক ওদিক তাকাই। কোথাও জয়নালের দেখা পাই না। স্টেশন থিকা কিছু দূরে পড়ে আছে পুরানা ওয়াগন। ওয়াগনগুলোর কাছ দিয়া একবার ঘুরে আসলাম। স্টেশনের মানুষগুলার কাছে একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়–এইখানে জয়নাল নামে কোন কুলি ছিলো কিনা? কি মনে করে আর জিজ্ঞেস করি না।   

 

একজনের দোকানে গিয়ে কলা দরদাম করি। দোকানদার এক ডজন কলার মুল্য চায় পঞ্চাশ টাকা।  

 

বললাম, “আপনারা ভাই কলার দেশের মানুষ। আসার সময় দেখলাম সব কলা গাছ। তাও কলার দাম এতো কেন?”  

 

দোকানদার বললো, “কলা তো এখানে সস্তাই থাকে। কিন্তু এই বছর যে বন্যা হইলো, সব তো গেছে। এই জন্যে কলা একটু দাম।” পরে পঁয়ত্রিশ টাকায় রাজি হইল। এরপর কলা খেতে খেতে দোকানদারের সাথে গল্প জুইড়া দিলাম।  

 

দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, “কোথ থেইকা আইছেন ভাই।”  

 

বললাম, “চট্টগ্রাম থেকে।”  

 

“তা তো মেলা দূর। কই যাইবাইন।”  

 

“দুর্গাপুর যাবো। তারপর খালিয়াজুরি।”  

 

“খাইল্যাজুরি যাইবাইন? হেই তো মেলা দূর।”  

 

“হা। দুর্গাপুর কেমনে গেলে সুবিধা হয় ভাই?”  

 

“এখান থেকে অটোতে কইরা যাইবেন শামগঞ্জ। হেই খান থেকে ডাইরেক গাড়িতে দুর্গাপুর। কিন্তু রাস্তা তো ভাই বহুত খারাপ। যাইবাইন কেমনে?”  

 

দোকানদারের সাথে আরেকজন আইসা যোগ দেয়। “কই থেইকা আইছে গো?”  

 

দোকানদার জবাব দিলো, “চিটাগাং থেইকা। দুর্গাপুর যাইবো।” 

 

“দুর্গাপুর?”  

 

“হে তো মেলা দূর।”  

 

“হয়। কোনদিক দিয়া গেলে ভালো হয়? বাসে না টেরেইন?”  

 

“টেরেইনে গেলে নামবো জাইরা। জাইরা থেকে আবার মাহিন্দ্রায় যাওন লাগবো। কিন্তু টেরেইন তো এখন নাই। হেই বিকালে।”  

 

দোকানদার বলে, “হয়।” 

 

দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের বাসে গেলেই ভালো হবে। ট্রেন আসতে দেরি হবে। তারপর দোকানদার বলে, “ ভাই আপনারা এক কাজ করেন, ওই পাশ থেইকা একটা অটো নেন। অটো নিয়া চইল্যা যান শামগঞ্জ। শামগঞ্জ থেইকা বাসে যাবেন দুর্গাপুর। মটর সাইকেলেও যাইতে পারেন। মটর সাইকেলেই ভালো হবি।” আমার আর দোকানদারের কাছে জয়নালের কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয় না। আমরা রেল লাইন পার হইয়া এসে একটা অটো নিই। অটো নিয়ে শ্যামগঞ্জ যাবো। 

 

নাফিজ ভাই অটোওয়ালার সাথে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা শুরু করে। বেচারা কিছুই বুঝতে পারে না। খালি ‘হ’ ‘হ’ করে। আমরা মুচকি মুচকি হাসি। একটু পর নাফিজ ভাই অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, গৌরীপুর দেখার কি আছে?”  

 

অটোওয়ালা বললো, “গৌরীপুর দেখার কিছু নাই।”  

 

“কোন রাজা টাজা ছিলো না তোমাদের এখানে?”  

 

“ছিলো তো। কতো রাজা আছিলো!”  

 

“ওই রাজাগুলার রাজবাড়ি-তাজবাড়ি নাই?”  

 

“থাকবো না ক্যা। আছে তো। অইসব এখন স্কুল কলেজ হইয়া গেছে।”  

 

“চলো তাইলে, রাজবাড়ি দেখাই আনো।”  

 

“রাজবাড়ি দেখবেন?”  

 

“হা।”  

 

“আইচ্ছা চলেন তাইলে। আমগো এলাকায় আইছেন। রাজবাড়ি ঘুরায়া দেহাই।” অটোওয়ালা রাজবাড়ির দিকে অটো চালানো শুরু করলো।  

 

১৪ নভেম্বর, ’১৭। কার্তিকের রাত। 

রহমান নগর, চট্টগ্রাম। 

 

( চলবে… )  

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত