ফ্যোয়া একটি দ্বীপের নাম

গৃহী মানুষের যাযাবর জীবন

ভিক আউফ ফ্যোয়াতে মানুষ গরমের সময় সৈকতে পা ডোবাতে যায়। উত্তর সাগরের একাংশে  অবগাহনের জন্যেও যায়।

শীতেও যে যায় না তা না।

যেমন আমার ফ্যোয়ার সাথে প্রথম দেখা কড়া শীতের ভেতর। তীব্র লিকারের কড়া চায়ের চেয়ে বেশী কড়া শীত। এই শীতের বাতাসে এমন তেজ, সূর্যের দেখা পাওয়ার জন্য চোখে জ্বালা ধরে যায়। একটুখানি উষ্ণতার জন্য ইচ্ছেরা বেসামাল ছলকে ছলকে ওঠে।

হিমযুগে পথের বিবাগী না হবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থেকেও সব ভুলে আবার সংসার গুছিয়ে ভাঁজ করলাম। আর আড়মোড়া ভাঙ্গা একটা ছুটির দিনের মহাশীতসকালে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিলাম। যাচ্ছি একটা দ্বীপে। আমরা দু´ জন যাচ্ছি ভিক আউফ ফ্যোয়াতে। শুধু ফ্যোয়া ডাকলেও অসুবিধা নাই। তিতাস একটি নদীর নামের মত ফ্যোয়া একটি দ্বীপের নাম।

জার্মানির মোট ষোলটা ফেডারেল স্টেট আছে। যেমন হামবুর্গ, বার্লিন, মিউনিখ। এখন হামবুর্গের পাশের ফেডারেল স্টেটের নাম রেখেছে শ্লেসভিক হলস্টাইন। ফ্যোয়া হচ্ছে  এই শ্লেসভিক হলস্টাইনের অন্তর্গত একটি নর্থ ফ্রিজিয়ান দ্বীপ।

সাদরি ভাই আর ডায়না আমাদের ফ্যামিলী ফ্রেন্ড এবং ফ্যোয়ায় বাঙালিদের গোঁড়াপত্তন ইতিহাসের দুইজন মহান অংশীদার। শুধু বাঙালি না, হিসেবটা উপমহাদেশ ধরেই হবে। সে সময় বোধহয় তারা  ছাড়া আর একটি মাত্র দক্ষিণ এশীয় পরিবার ওখানে বাস করত। তাও ওদেরই আত্মীয়। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে চারে এসেছে। এবং এরা এখনো সবাই সবার আত্মীয়।

আমরা সড়কপথে আড়াই থেকে তিনঘণ্টা লাগিয়ে আরও উত্তরের দাগেব্যুল গেলাম। মাঝে ছিল কিয়েল, ফ্লেন্সবুর্গের তুষারে মোড়া ল্যান্ডস্কেপ। যথারীতি উইন্ডটারবাইনের ঘোরাঘুরি তো ছিলই। পুরো জার্মানিতে ছাব্বিশ হাজারেরও বেশী উইন্ডটারবাইনের দেখা মিলবে। এরা সবাই মিলে বাতাসের শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে পুরোদেশে মোটের ওপর প্রায় আঠারো শতাংশ বিদ্যুৎ সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। খারাপ না।

ভালবাসার রাইন নদীটার ওপর ছিল ছোট্ট একটা সেতু। পরিচিত কাউকে দেখলে আমরা যেমন দূর থেকে হাত নেড়ে এবং গলা উঁচু করে কুশল জিজ্ঞেস করি, “কি অবস্থা? কেমন চলছে?” সেতু পাড়ি দেবার সময় রাইনের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। রাইনও জানিয়েছে যেন, “বোলোনা আর! শীত যা পড়েছে! জমে যাচ্ছি একদম। হাত পা খুলে বইতে পারছিনা কত দিন হল!” সমব্যথি হলাম, তবে শীতার্ত হাতদুটো  ছুঁয়ে দেখা গেল না। দাগেব্যুলে অপেক্ষা করছে ফেরী।

ফেরীবন্দরের ওখানটায় গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করেও ফেরী চড়া যাবে, আবার গাড়ি সাথে নিয়েও যাওয়া যাবে। ইচ্ছা। সাথে নিলাম না। আমরা দুই সদস্যবিশিষ্ট ক্ষুদ্র দল। সাদরি ভাইয়ের গাড়িতেই এঁটে যাব। তাছাড়া দরকার পড়লে মাত্র সাড়ে বার কিলোমিটার দ্বীপে আদর্শ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট  হিসেবে ট্রেন না চললেও বাস তো চলবে।

দুইদিনের জন্য একটা হোটেলের নীচে আমরা গরীবের পঙ্খীরাজটাকে রাখার বন্দোবস্ত করলাম। দেড়শ মিটারের মত দূরত্বে ফেরীঘাট। ফেরী ছাড়তে খুব বেশী বাকি নেই। পুরনো অভিজ্ঞতা বলছে আমরা সম্ভবত এই ট্রিপেও লাস্ট মিনিট প্যাসেঞ্জার হতে পারি। আবার ফেরী মিস করতেও পারি। পরেরটা পাওয়া যাবে অন্তত দুই ঘণ্টা পরে। ঝেড়ে দৌড় দেয়া দরকার।

নোঙ্গর ফেলি ঘাটে ঘাটে 

পার্কিং প্লেস থেকে ফেরিঘাট পর্যন্ত দেখার মত জিনিসপত্র খারাপ ছিল না। আমার তো এইসব দেখতেই ভাল্লাগে। এই যে ছোট ছোট পুরনো দিনের আবহ ধরে রাখা একতলা- দোতলা হোটেল, রেস্তোরাঁ- ক্যাফে, পাথরের ঢিবি, ন্যাড়া মাথার উৎকর্ণ গাছ, সেই সঙ্গে বারো রকমের মানুষ তো বটেই। আমার বাঁ পাশ দিয়ে আবার বন্দর পর্যন্ত চলে গিয়েছে রেল লাইন। অল্প কয়েকটা বগি নিয়ে রেলগাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল পানির সীমানার একটু আগে। দ্রুত পায়ে হাঁটার সময় সময় ফ্রিজিয়ান স্পেশাল ছাদ দেখতে গিয়ে সামান্য গতি মন্থর হল। লাল টালির গতানুগতিক ছাদের বদলে খড়, নলখাগড়া দিয়ে বানানো কালো ধরণের থ্যাচড ছাদগুলো এখনো হারিয়ে যায়নি। অনেকেই আবার গাঁয়ের পল্লীপনাকে ভালবেসে নতুন করে খড়গাদার আচ্ছাদনের নীচে বাসা বাঁধতে পছন্দ করছে।

ঐ দূর থেকে নাম ধরে ডাকাডাকি শুনলাম। গুরুতর অভিযোগও শুনলাম। আমি নাকি রাস্তার ওপর তথ্যচিত্র টাইপ ধীরগতির সিনেমা দেখে বেড়াই। অভিযোগ সত্য হলেও এমনিতে পাত্তা দিতাম না, তবে ফেরী ছাড়ুক সেটা এই মুহূর্তে চাচ্ছি না। উত্তর সাগরের ইন্টারটাইডাল এলাকার নাম ওয়াডেন সী। এই ওয়াডেন সীতে ভাসার অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য কফিশপে বসে অপেক্ষা প্রলম্বিত করতেই বরং আপত্তি লাগছিল। তাই আর কি, সিনেমার মাঝখানে সামান্য বিরতি দিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড়াতে হল।

এবং ঠিক তিন মিনিট বাকি থাকতে ফেরীটা ধরতে পারলাম। আমরাই কিন্তু লাস্ট প্যাসেঞ্জার ছিলাম না। আমাদের পেছনে আরও দুইজন ছিল। প্রায় সাড়ে ছয়ফুট লম্বা একজন মাঝবয়সী বোহেমিয়ান ধরণের ভদ্রলোক আর তার প্রিয় গ্রেট ডেন প্রজাতির কুকুরটা। এই কুকুরের উচ্চতা আবার অবিস্মরণীয়। আমার কুকুরভীতি আছে। নেকড়ে ভীতিও আছে। উচ্চতার কারণেই সম্ভবত একে নেকড়ে নেকড়ে লাগছিল। দ্বিগুণ ভীতির কবলে পড়ে একটু কাঠ হয়েই লাইন ধরে এগুচ্ছিলাম। তবে ব্যবহারের দিক থেকে এ বেশ নির্লিপ্ত ধরণের। লাইনের আরেকটু সামনে মিস্টার হার্জের সেই স্নোয়ির মত দেখতে আরেকটি ছোট্ট দুষ্টু কুকুর সেই তখন থেকে কেঁউ কেঁউ করেই যাচ্ছিল- করেই যাচ্ছিল! দুই কুকুরের দেখা হলে কঠিন ঝগড়া হবার নিয়ম। কিন্তু গ্রেট ডেনটা পাল্টা খেঁকিয়ে না উঠে মন ডুবিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে দেখে মুগ্ধ হলাম।

জলের উদ্বেগ, ছোলম নিয়ে কের্তোন, একটা রেলিঙ

ফেরীর ডেকটা গাড়ি, সাইকেলের জন্য। সাথের এইসব সেইসব রাখার ব্যবস্থা ডেকের ওপর তিন ফ্লোরের নীচতলায়। জিনিসগুলো রাখতে রাখতে ডেক দেখছিলাম। সেখানে কবিতায় পড়া “জলের উদ্বেগ” সত্যিই কিছু ছিল। এই উদ্বেগ বোধহয় সঙ্ক্রমিত হতে হয়। সে কারণে ছাদের ওপর বসার জায়গা দখল হয়ে গেল কিনা তাই মোটামুটি উদ্বিগ্ন- উৎকণ্ঠিত হয়েই সিঁড়ি বাইতে লাগলাম।

সিট খালি নেই। শীতক্লান্ত দ্বীপে নিমগ্ন হবার লোক আমরা ছাড়াও অনেক। তাছাড়া জীবন- জীবিকার প্রয়োজনে প্রচুর মানুষ এই রুটে প্রতিদিন যাতায়াত করে।

চিন্তা করলাম এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে গেলেই তো বেশী ভাল লাগার কথা। ছোটবেলায় নানুবাড়ি যেতাম লঞ্চে করে। লঞ্চের বারান্দায় আমাকে একা যেতে দেয়া হত না। রেলিঙের  চেয়ে আমার উচ্চতা অনেক কম থাকায় আশে পাশে যাবার অধিকারটুকুও কেউ দেয়নি।  তখন লঞ্চের ডেক থেকে কিন্নর কণ্ঠের “দুঃখ আমার…আমার” হয়ত বাজিয়ে দিতেন অচেনা কোন যাত্রী তার শখের ট্রাঞ্জিস্টরে। গানের কথার বিন্দু বিসর্গ অবশ্য কিছু বুঝেছিলাম। এই যেমন যে গাইছে তার মনে খুব দুঃখ। ওনার কাছে সাতনরী নামের বড়লোকী হার আছে। পালঙ্কও আছে। পালঙ্ক মানে আমি জানতাম। রাজাদের পেট ভাসিয়ে ঘুমাইবার বিছানা। কিন্তু এত বড়লোক হয়েও তিনি এরকম মনের কষ্টে গান গাইছেন ঠিক কেন, বুঝিনি। তবে সঙ্গীতায়ন বেশ দুঃখ দুঃখ থাকায় রেলিঙের ওপারে ঢেউ এর অধিকার বঞ্চিত হয়েছি, তাই মান অভিমানবোধ আরও দূরে আকাশ ছাড়িয়েছিল।

এই আমি রেলিঙ ছাড়িয়েছি সেই কবে! মৃদুমন্দ ঢেউ দেখতে এখন আর কোন বারণ নেই। এমন বড় হওয়ার জন্য কত আকুতি ছিল একটা সময়ে! আর এখন আকুতি এসে ঠেকেছে দু হাতে সময়গুলো আগলে রাখায়। থাকছেনা। আঙ্গুলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে কেমন পালিয়ে যাচ্ছে।

শাদা দস্তানা পরা হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মধ্যমা অনামিকাদের মধ্যে ব্যবধান তাই কম দেখাচ্ছে। আহা এভাবেও যদি চঞ্চল সময়গুলো হাটকে মাটকে আটকে রাখা যেত!

মেঘনা নদীর ওপর ঝড়ের কবলে পড়েছিল আমাদের লঞ্চটা। সেই ছোটবেলা। যাচ্ছিলাম নানুবাড়ি। সে কী দুলুনি তখন! নানু প্রচণ্ড শক্ত করে ধরে রেখেছিল আমাকে। এক একবার বিশাল একটা দোল আসছিল আর সবাই ত্রাহি পরিত্রাহি চিৎকার করছিল। তিমি মাছের পেটের ভেতর ইউনুস নবী বিপদমুক্তির দোয়া করেছিলেন। সেই দোয়া আমি শিখেছিলাম। বিপন্ন মানুষের মুখে সম্মিলিত বিপদমুক্তির উচ্চারণ খুব ভয়ার্ত শোনায়। টানা বারান্দার মধ্যখানটায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এত অদ্ভুত  নাগরদোলায় দুলতে দুলতে মানুষকে মরে যেতে হয়!

দুলুনি, ভীতি এবং দোয়া দরুদের মাঝখানে হঠাৎ মৃদু ভৎসনাও কানে এলো “ডুইব্ব্যা মরনের কালেও মনু্গো ছোলোম লইয়া কের্তোন চলতেয়াছে।” দেখলাম আমার চেয়েও ছোট একটা ছেলে লাল ছাপার আঁচলটুকু ধরে ফিচফিচ করছে। ওর গেঞ্জি খামচে ধরে আছে একটি তাবিজ পরা- রগতোলা- শ্যামবর্ণা হাত। আরও ছোট ছেলেটিকে আঁকড়ে ছিল লাল কাঁচের চুড়িতে সেই রগতোলা শ্যামবর্ণা আরেকটি হাত। মেঝেময় ছড়িয়ে থাকা ফল পাকুড়ের টুকরোগুলো নিজের দখলে নিতে বাচ্চাটা প্রানান্ত চেষ্টা চালাচ্ছিল সেই অবেলায়। নানুর দিকে মুখ তুলে আমি জানতে চাইলাম, “আচ্ছা নানু! ছোলোম মানে কি?”

-দোতালার কফি লাউঞ্জটা সুন্দর। লাটে খেতে হবে। তুমি যাবা?

হুট করে খ্যাপাটে মেঘনা থেকে তুলনামূলক শান্ত ওয়াডেনে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় সিদ্ধান্ত জানাতে একটু সময় নিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ধূসর, খুব ধূসর সবকিছু। পানির এই খেলাটা আমার ভাল লাগেনা। এই যে আরেকজনের আনন্দে আনন্দ দেখিয়ে একেক সময় কী উচ্ছল নীলের ভেতর বিলীন হয়! এখন আবার জবুথুবু কুয়াশার সাথে একাত্ম হয়েছে। পানির রঙ তাই ফ্যাকাশে দেখায়। কোথেকে আবার ঝিরঝিরে বরফের বৃষ্টি নেমে রঙ দিয়েছে আরও এক পোঁচ ঘোলা করে। তবু এই খেলা আমি মন দিয়ে দেখি। লাটে মাকিয়াটোর নির্যাস নিতে নিতে জানালার কাঁচে একটি শীতগ্রস্ত সমুদ্র দেখার জন্য দোতালায় নামলাম। পড়ে থাকলো মেঘনা নদীর ভয়দোলনা, বরফের হালকা ছাট আর একটা বিষণ্ণ রেলিঙ; ঠিক অন্য কারো অপেক্ষায়।

একটুখানি ইতিবৃত্ত

জানালা দিয়ে দেখছিলাম দূরের দ্বীপটা সচল হয়ে উঠেছে। একটু একটু করে যেন মানুষের ঘরবাড়ি, সমুদ্রের সাঁকো নিয়ে এগুচ্ছে আমাদের বরণ করে নেয়ার জন্য। ফেরী ঘাটে নামার সময় করিডোরের স্বচ্ছ দেয়ালের ওপাশটা খুব শূন্য ছিল। মনে হচ্ছিল গাঙচিলের দল সমুদ্রকে ঘিরে উঁচু গলায় কথা বললে ভারি মানাতো। কল্পনায় ওদের কথোপকথন শুনতে শুনতে খেয়াল করলাম আবার আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ। এবার একটা মেয়ে। ডায়না দূরের দেয়ালের সীমান্তে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল।

বিকেলের দিকে কি ভেবে হালকা রোদ উঠল। দিবানিদ্রা ভেঙ্গে রোদ আড়মোড়া ভাঙ্গছে একটু একটু। তাতে লাভ যে একেবারে নেই তা না। ফ্যোয়ার সাথে পরিচয়ের আবহ তখন মিষ্টি রোদ্দুর। ফ্রিজিয়ান আদলের ছোট্ট বাসাগুলো কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন। যখন ভাবতে হয়, তখন পৃথিবীর ওপারে শান্তিতে বসবাসের জন্য ভাবনায় জড়োয়া গয়নার নকশায় মোড়া প্রাসাদ আনতে আমার ভাল লাগেনা। বরং সেখানে এমনিতেই এরকম ছোট্ট কুটির ধরণের বাসার বারান্দা আসে; বারান্দায় রোদের কারুকাজ আসে।

সাদরি ভাই- ডায়নাদের বাসা পর্যন্ত যেতে দশ মিনিটেরও কম সময় লাগবে। পথটুকু জুড়ে রয়েছে এমন একটা ভিন্ন অনুভূতি যেটার অর্থ বুঝতে চাইলে হয়ত পানির বুকে জেগে ওঠা দ্বীপেই আসতে হয়। সমুদ্রের আশকারায় প্রবল হওয়া এই ভূমির স্বাতন্ত্রবোধের স্পর্শ খুঁজে পাচ্ছিলাম তার নিজেকে সাজিয়ে তোলার বিভিন্ন পর্যায়ে।

ফ্রিজিয়ানরা একটা এথনিক গ্রুপ। জার্মানির উত্তরাঞ্চলে এদের দেখা দেখা যায়। নেদারল্যান্ডের ফ্রিজিয়া প্রদেশ থেকে এসেছে বলে এরা ফ্রিজিয়ান। জার্মানির একদম উত্তরের সমুদ্রসংলগ্ন  এলাকাগুলোর সমন্বিত নাম নর্থফ্রিজল্যান্ড। য্যুল্ট, আমরুম, ফ্যোয়া, পেলভর্ম, নর্ডস্ট্রান্ড দ্বীপ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দশটি দ্বীপ মিলে গঠিত হালিগেন নর্থফ্রিজল্যান্ডের আওতাভুক্ত। আবার দ্বীপ না হয়েও উপকূলবর্তী শহর দাগেব্যুল, নিব্যুলও তাই। তো সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে জার্মানি যখন ছিল প্রুশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ, তখন এই নর্থফ্রিজল্যান্ডগুলোতে ফ্রিজিয়ানদের গোঁড়াপত্তন হয়েছে বলে প্রত্নতাত্তিকেরা মনে করেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সাগরের ত্রাস ভাইকিংরাও এইভূমে পদধূলি দিয়েছিল একদা। ভাইকিংদের গল্প না হয় আরেকদিন বলব।

এই দশ মিনিটেই কিন্তু দ্বীপের দেখার মত জিনিসপাতির এক ঝলক দেখে ফেললাম প্রায় অর্ধেকটা। দ্বীপই হল সাড়ে সাত মাইল লম্বা আর চার মাইলের কিছু বেশী চওড়া। ফ্রিজিয়ান ঐতিহ্যের একটা প্রাথমিক ধারনাও পেয়ে গেলাম পথে দেখা টুকটাক দোকান, থ্যাচড ছাদের বসতবাড়ি, অষ্টদশ এবং ঊনবিংশ সময়ের ডাচদের আদলে বানানো উইন্ডমিল, একটা ক্যাথেড্রাল, দুইটা  বিরাট দাঁতের পেছনে দাঁড়ানো জাদুঘর থেকে। দাঁত দুটো ধারণা করছিলাম তিমি মাছের। এত বড় বড় দাঁত এই মর্ত্যের বুকে আগে কখনো দেখিনি।

তবে কোন কারণে লোকজন দেখিনি তেমন। পুরো দ্বীপে সাড়ে আট হাজার মানুষের বাস। বন্দরেই যা কিছু ভিড় ছিল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তাই এগুতে এগুতে সব মিলিয়ে দশজনও দেখতে পেলাম না। আক্ষরিক অর্থে এই দ্বীপকে উত্তরের নিঝুম দ্বীপ বললে ক্ষতি কি? অসম্ভব নির্জন অথচ প্রাণহীন না। জীবনের ছাপ আছে সবখানে কিন্তু সবাই নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করছে। দূর থেকে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। বলছে যেন,“আমি আছি; অন্তরালেই আছি। কোথাও হারিয়ে যাইনি।”

ডায়নার বেড়ে ওঠার অনেকটা সময়জুড়ে এই দ্বীপ। সুতরাং তাকে দ্বীপকন্যা বলাই যায়। আমার অর্ধাঙ্গের সংগ্রামমুখর প্রবাসী ছাত্রজীবনের দোসর ছিল ভাইয়া। দ্বীপকন্যার সাথে বিবাহের পর এখন এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা।

লাল ইটের বাড়িটার দোতলায় ওদের সাথে ডায়নার ছোট ভাই ওসমানীও থাকে। সেও এখানেই বড় হয়েছে। তারা তিনজন মিলে অপূর্ব যত্নে গুছিয়েছে ছোট্ট সংসার। আমরা করিডোর পার হতেই দেখি ওসমানী টেবিলের পেছনে বিপুল আয়োজন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় আসতে আসতে জেনেছিলাম দেশী ঘরানার মাছ কেনার জন্য ওরা সাগর পাড়ি দিয়ে তারপর এতটা ঘণ্টা ড্রাইভ করে হামবুর্গ যায় কয়েক মাস পর পর। আশঙ্কা হচ্ছিল, এরকম কষ্টের সংগ্রহের একটা বড় অংশ হামবুর্গবাসী হয়ে আমরাই সব খেয়ে ফেলি কিনা। অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়ায় এই নিয়ে হালকা ঝগড়া করতে হয়েছে। দুই ভাইবোনের ভেতর ডায়নার বাংলা ওসমানীর চেয়ে ভাল। ওরা স্ট্যান্ডার্ড জার্মানে স্বচ্ছন্দ্য বেশী। নর্থ ফ্রিজিয়ান ভাষাও কিছু জানে। সে জন্য মাঝেমাঝে ওদের একটু ভিন্ন  ধরণের ডায়ালেক্টমণ্ডিত যুক্তিখণ্ডন পর্ব বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে।

শীতের কিছু ব্যপার আমার কাছে অনন্য মনে হয়। যেমন এইসব বরফের আলোয়ান গায়ে দেয়া- গোমড়া মুখো দিনের শেষে যখন সন্ধ্যা নামে, বাতাসে নাক ডুবালে অপার্থিব একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এই ঘ্রাণ শুধু শীতের শরীরেই আছে, আর কারো নেই। এশার পর এমনিতেই খুব পবিত্র মনে হয় সবকিছু। ঘরটা একদম অন্ধকার করে জানালা দিলাম খুলে। পরিষ্কার শাদা রঙের কার্পেট বিছানো শহরটায় ছড়িয়ে আছে বিন্দু বিন্দু আলো। গাছেদের পাতার দরজা শীতের অবকাশে রুদ্ধ ছিলনা সে কারণে ছড়ানো ছিটানো দেখার বিষয়গুলো লুকিয়ে থাকছেনা তেমন।  গ্রীষ্মে হয়ত পাতাদের অতন্দ্র প্রহরায় এতটা প্রকাশ পেতনা। খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় ফ্রিজিয়ান বাড়িগুলোর বেশীরভাগই নিপাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কেউ থাকেনা ওখানে।

চায়ের পেয়ালা জানালার খোলা কার্নিশে রাখতে রাখতে ডায়না জানালো, বাড়িগুলোর মালিক সাগরের ওপারের নগরীতে চলে গিয়েছে সারা জীবনের জন্য। এখন শৈশবের ডলস হাউজের মত অদ্ভুত সুন্দর বাসাগুলোর মূল কাজ পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করা। বাড়িওয়ালা হয়ত বছরে এক দুইবার এসে দেখে-শুনে যায়।

বন্দরের কাছে নতুন কিছু অতিথিশালা গড়ে তোলা হচ্ছে। ডলস হাউজের মালিকেরা এটা পছন্দ করছেনা। পর্যটকেরা যদি সব অতিথিশালার আতিথ্য গ্রহণ করে তাহলে এই বাড়িগুলোর কি হবে?

রাত বেশী হয়নি। মাত্র আটটা বেজেছে। বিন্দু আলোগুলো নিভতে নিভতে প্রায় শেষের দিকে। তবু এত স্পষ্ট সব কিছু! সেটা হয়ত অন্ধকারে অভ্যস্ততায় অথবা তুষারের প্রশ্রয়ে।

নিশ্চিত নই।

একাগ্র পুকুর, পুলিশ ভায়া আর খনিজ থেরাপী

সকালের আকাশটা ভীষণ ঝকঝকে। ফ্যোয়ার অলিগলি পাড়ার বন্ধুদের মত দোরগোড়ায় এসে হেঁকে যাচ্ছিল। একছুটে পথে নামার তাড়া। আমার গ্রাম বা মফস্বল অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য। যতটুকু রাজধানীর বাইরে গিয়েছি বাতাসের সাথে বুনো ধরণের শুকনো তৃণের সুবাস নাকে লেগেছে আমার।  ফ্যোয়া দ্বীপে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে সেরকম কিছু একটা টের পেয়েছি।  শস্য ক্ষেত থেকে বুঝি উড়ে আসে এই খড়বিচালির সুন্দর গন্ধ!  বিশুদ্ধ ফুসফুসের অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে জমাট বাঁধা পুকুর পার হলাম। এবারের শীতে তাপমাত্রা মাইনাস পনের/ বিশ নেমে যাচ্ছে কোন ভূমিকা ছাড়াই। জলাধার যেন  হিমাঙ্কের স্টানিং স্পেলে স্টুপিফাইড অবস্থায় আছে। জোরে পা ফেললে একটু ফাটল দেখা যায়। চমকে গিয়ে দৌড়ে পিছিয়ে যাবার সময় তইতই হাঁটতে থাকা হাসের দল সামান্য বিভ্রান্ত হয়ে সরে জায়গা  করে দিল।

আবার সেই ফ্রিজিয়ানদের ক্ষুদে নিকেতনের দিকেই চোখ গেল। বেশ অনেকগুলো দরজার ওপর চার ডিজিটের নম্বর বসানো। প্রথমে ভেবেছিলাম এমনিতেই এভাবে নাম্বারিং করেছে। পরে ভাইয়া বলল যে বাড়িগুলো বানানো হয়েছিল যে বছর, সেই সময়টাকে ওদের অনেকেই বাড়ির গায়ে এভাবে লিখে স্মরণীয় করে রাখে। আমার জন্মের বছর দেখলাম একটা বাড়ি বানানো হয়েছে। সেই বাড়িটাই বোধহয় পক্ষপাতজনিত কারণে আমার বেশী মনে ধরেছিল।

– সাদরি! উনিই কি সেই পুলিশ ভাইজান?

ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে বন্ধুকে উত্তর দিল,

– হুম উনিই সেই, নজর কইরা দেইখা রাখ।

আচ্ছা এই পুলিশ ভাইজানকে নিয়ে এরা এত রহস্য করছে কেন? আর দশজন ইউরোপিয়ান পুলিশের মত চলন বলন। শুধু মুখটাই যা একটু বেশী হাসি হাসি। পুলিশদের স্বভাবসুলভ গটগট করে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।

রহস্য ভেঙ্গে দিল ডায়না তখন। জানালো যে এই দ্বীপে মোট দুইজন পুলিশের ভেতর উনি অন্যতম। দ্যাটস ইট। আরেকজনের সাথে দেখা হলেও তাকে নজর করে দেখে রাখা উচিৎ। এরাও তো ফ্যোয়া সংস্কৃতির অংশ। সাড়ে আট হাজার মানুষের শৃঙ্খলা- নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব এই দুজনের কাঁধে!

হায়! আমার দেশের কথা মনে পড়ল।

গত কয়েক দশকে মনে হয় এক দুইটা খুন খারাবী হয়েছে এখানে। আইনের শাসন বেশী আর মানুষের লুটে পুটে খাওয়ার প্রবণতা কম। চাষবাস আর পর্যটন নির্ভর জীবন নিয়ে ব্যস্ত তারা। ডাকাতির খবর শোনা যায় না। চুরি হলেও চোর পালিয়ে কোথায় আর যাবে? এত ছোট দ্বীপ। সাগর পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনা করলেও দুই বন্দরের যে কোন একটাতে ধরা পড়ে যাবে। এখন অপরাধী যদি সাঁতারু বেন হুপারের কনফিডেন্স নিয়ে সাঁতরে অন্য কোনখানে পালাতে চায়, তবে তার কথা আলাদা।

এখানে অবশ্য আত্মহত্যা কিছু হয়। তীব্র শীতের সময় বিষণ্ণতার ফেরে পড়ে বেশ কিছু মানুষ সমুদ্রে শরীর এলিয়ে দিয়েছে।

পুলিশ ভাই মোড়ের বাকে হারিয়ে গেলেন। তখন তিমি মাছের চোয়ালের দাঁতের সম্ভাষণ পেয়ে গেলাম। আগেই জেনেছি এটা একটা জাদুঘর। নাম ডঃ কার্ল হেব্যারলিন ফ্রিজিয়ান মিউজিয়াম। ডঃ হেব্যারলিন একজন ফিজিশিয়ান এবং ন্যাচারাল হিস্ট্রিয়ান ছিলেন। ক্লাইমেটোথেরাপি এবং থালাসোথেরাপি নিয়ে ভাল ভাল কাজ করেছেন। চিকিৎসাসেবায় জলবায়ু এবং সাগরের পানিকে টেনে এনেছেন।  তবে তার  বড় পরিচয় তিনি ছিলেন ব্যালনিয়োলজিস্ট। ব্যালনিয়োলজিস্টরা বেশীমাত্রার খনিজউপাদান সমৃদ্ধ পানি (লবন এবং সালফার বেশী থাকবে), গ্যাস, বিশেষ ধরণের কাদামাটি অথবা পেলয়েড ব্যাবহার করে আরোগ্যকর্ম করে থাকে।

চিকিৎসাশাস্ত্রটি পদার্থবিজ্ঞান, শৈলবিদ্যা, রসায়ন, মনোবিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান এবং ভূবিদ্যার সমন্বিত নাম। আঠারো শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে ভারতের রাঁচিতে এক খ্রিষ্টান মিশনারিতে জন্ম নেন ডঃ হেব্যারলিন। পরে বহু পথ পাড়ি দিয়ে একসময় ফ্যোয়াতে এসে থিতু হন এবং এখানেই প্র্যাকটিস চালান। ডক্টর সাহেবের খনিজ থেরাপী অথবা পিচ্ছিল কাদামাটি গায়ে মেখে রোগ তাড়ানো পদ্ধতি কিন্তু পিঠ ব্যথায় জর্জরিত আমার সফরসঙ্গীর মত অসংখ্য পর্যটকের কাছে বেশ লোকপ্রিয়তা পেয়ে এসেছে।

জাদুঘরে ফিরে আসি আবার। এখানে ফ্যোয়ার ঐতিহ্য, কৃষ্টি- সভ্যতা বেশ আভিজাত্য নিয়ে সংরক্ষিত আছে। লাল ইটের দেয়াল আর খড়ে বানানো সেই ছাদ। ভেতরে ফ্রিজিয়ানদের ট্র্যাডিশনাল পরিধেয়, তৈজসপত্র, হস্তশিল্প বা অলঙ্কারের টুকিটাকি। লোহা পিটিয়ে আদি ফ্রিজিয়ানদের মাছ মারার সামগ্রীর নমুনা দেখানো হচ্ছে। কোথাও বড় পর্দায় তথ্যচিত্রও চলছে ফ্যোয়াবাসীদের সেইসব দিনের জীবনপ্রবাহ নিয়ে। আর্ট গ্যালারিতে ঝুলে আছে নর্থফ্রিজ এলাকার নানারকমের সমুদ্রসংক্রান্ত বিষয়। অনবদ্য সব চিত্রকর্ম। এদের ভেতর তিমিমাছের ছবি অনবদ্য বেশী ছিল। এই বিরাটদেহীর চেহারাছবি শিল্পীর গুণে অতটা ভয়ঙ্কর তো মনেই হয়নি বরং কিছুটা ফিচেল লেগেছে। মিউজিয়াম প্রাঙ্গণ শীতে একটু নিশ্চুপ থাকলেও বসন্ত এসে গেলে নানারকম সিম্পোজিয়াম,  হাতে কলমে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মুখর হয়ে উঠতে শুরু করে।

আদিবাসী চা এবং ভাল থাকার গল্প

স্থানীয় একজন মাঝবয়সী নারী কফিশপটার স্বত্বাধিকারী। তিনি নিজেই পরিবেশন করলেন আমাদের। পুরো ফ্রিজিয়ানদের চা প্রীতি লিখে রাখার মত। ক্ষেত্রবিশেষে এরা ব্রিটিশদেরও হার মানায়। সুন্দর ছোট্ট ঐতিহ্যবাহী হালকা প্রিন্টের কাপে এই চা পরিবেশিত হয়। যার কারণে চা গরম হলেও দিলের ভেতর ঠাণ্ডা লাগে। যাদের এই বিশেষ চা বাসায় বসে খেতে ইচ্ছে করছে, তাদেরকে আমি রেসিপিটা দিতেই পারি।

১। ফ্রিজিয়ানরা ব্লেন্ড হিসেবে আসামিজ এবং কেনিয়ান শুকনো চাপাতা ব্যবহার করে। শুকনো রোজমেরীও অনেকে ব্যবহার করে। আসামিজ পাতা মোটামুটি সহজলভ্য। বাকিগুলো পেলে ভাল, না পেলে নাই।

কাপের মত টিপটের প্রিন্টও বাহুল্য বিবর্জিত। ওরা ছোট্ট টিপট টাতে এক চামচের মত এই ব্লেন্ড প্রথমে বিছিয়ে দেয়।

২। পানি ভালভাবে ফুটিয়ে একটু উঁচু থেকে টি পটের আধাআধি পর্যন্ত ঢেলে দিয়ে পটের মুখ দেয় একদম বন্ধ করে। ৩-৪ মিনিট ওভাবেই রাখে তারপর বাকি পানি ঢেলে পুরো পট ভরতি করা হয়।

৩। সার্ভিং কাপে আগে রকসুগার (বাংলায় কি পাথর চিনি, প্রস্তরীভূত চিনি এরকম কিছু হবে? ব্রিটিশরা একে ক্যান্ডি সুগারও বলে। রকসুগার একধরণের ক্রিস্টালাইজড চিনি। অস্বাস্থ্যকর রঙিন ও সাদা রঙের এবং তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর বাদামী রঙের রকসুগার বাজারজাত করা হয়) রাখা হয়। তারপর পাতা ও পানির মিশ্রণটি ঝর্ণার মত প্রস্তুরীভূত চিনির ওপর আছড়ে পড়ে।

৪।  এক চা চামচ ফুলক্রিম ঢেলে চুপচাপ বসে কাহিনী দেখতে হবে। নাড়া যাবেনা। নিজেরাই রঙের ঘূর্ণিপাক তৈরি করে মিশে একাকার হবে। যারা ফ্যাটি খাবার নিয়ে নির্বিকার থাকেন তারা আবার চায়ের ওপর হেভী ক্রিমের লেয়ারও দিতে পারেন।

৫। আবহাওয়া যদি এরকম কড়া শীতের হয় তাহলে চেয়ারের ওপর পাতলা কম্বল মুড়ি দিয়ে চায়ের স্বাদ নিতে ফ্রিজিয়ান দোকানদারেরা উৎসাহিত করে।

শেষের পয়েন্টটা আমার নিজস্ব সংযোজন। ভদ্রমহিলার ব্যক্তিপ্রতি আরামকেদারা, পাতলা কম্বল এবং  পেয়ালা ভরা চায়ের মনোহর আয়োজন দেখে আমার একান্ত ভাবনা সংযুক্ত করতে ইচ্ছে হয়েছে ।

দ্বীপের জীবন কেমন লাগে জানতে চাইলাম। উত্তর শুনে বুঝলাম ভাল আছে তারা। যদিও সাধারণ নাগরিক সুবিধাগুলো পেতে গিয়ে বারবার ফেরীর ওপর নির্ভর করে এপার ওপার করতে তবু খারাপ কি? বেলাশেষের পড়ন্ত বয়সী সতীলেখা জানিয়েছিলেন ভালবাসা হচ্ছে একধরণের অভ্যস্ততা। ফ্যোয়ায় থেকে যাওয়া মানুষের ভালবাসার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।

দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজন স্থানীয় ইডিকা, লিডল (সুপার মার্কেট), এর্নস্টিংস ফ্যামিলি (কাপড়ের দোকান) থেকেই পূরণ সম্ভব। কিন্তু ব্রান্ডের ভেরিয়েশন খুঁজতে হলে অনলাইনের আশ্রয় নেয়া ভাল। অল্প যে কয়টা ট্র্যাডিশনাল দোকান আছে, একদম গলা কাটা দাম।

বারো ক্লাস পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা দ্বীপেই পড়তে পারে। এরপর উপকূলের কোন শহরে চলে যায় বা  আরও দূরে। পড়া বা কর্মমুখী প্রশিক্ষন শেষ করে কেউ ফেরে- কেউ ফেরেনা। ডায়না আর তার ভাই যেমন মোহে পড়ে ফিরে এসেছে। এই মোহের নাম খুব সম্ভবত শান্তি।

খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বিষয়ের পর চিকিৎসা আসবেনা এ কেমন কথা? আছে; গাইনোকোলজিস্ট, জিপি, পেডিট্রিশিয়ান ইত্যাদি আছে। হাসপাতালে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয়। কিন্তু আরেকটু ইনটেনসিভ বিষয় যেমন সন্তান প্রসব, এক্ষেত্রে সেই সাগরই পাড়ি দেয়া লাগে। কয়েক বছর আগেও দ্বীপে নবজাতক জন্মাতে পারত। এখন নিব্যুল দাগেব্যুলের ম্যাটার্নিটি হাসপাতালগুলোতে শুধু ফ্যোয়া না, পুরো নর্থফ্রিজল্যান্ডের দ্বীপগুলোর প্রসূতিদের সম্ভাব্য তারিখের সাত দিন আগেই চলে যেতে হয়। সাথে যদি অন্য ছোট বাচ্চাকাচ্চা থেকে থাকে তো সবশুদ্ধ কেবিনে উঠে বসে থাকো! কি এক মহাকাণ্ড!

বাতেন মিয়ার দূরচারী পথিক পাখি- পথিক মানুষ

ওয়াডেন সী র জার্মান নাম Wattenmeer। W  উচ্চারণ কিছুটা V এর মত হয় এখানে। Meer অর্থ সমুদ্র। জার্মানরা শেষের r উহ্য রাখে। তাই হঠাৎ শুনলে মনে হবে বাতেন মিয়া নামের কোন বিশেষ ব্যক্তির দর্শনপ্রার্থী হয়ে আমরা হাঁটছি আর হাঁটছি।

ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের উপকূল ঘেঁষে নিজের মনে বয়ে যাওয়া এই বাতেন মিয়ার নাম আছে তার বায়োলজিকাল ডাইভার্সিটির কারণে। তার লবনাক্ত জলাভূমির ওপর তেইশ হাজারেরও বেশী প্রজাতির প্রানী ও উদ্ভিদ পাওয়া যাবে। নোনাপানিতে বাসা বেঁধেছে হাজার সাতাশের মত নানান জাতের প্রানী। সমুদ্র ছুঁয়ে অন্তত ত্রিশ প্রজাতির পাখি নিয়মিত হট্টগোল করে থাকে।

আমরা যখন বালিয়াড়ির কাছে পৌঁছলাম তখন অবশ্য এই ভরদুপুরেও একজন জনমনিষ্যিও দেখলাম না। ফ্লোরা ফনারাও বুঝি হিমেল দিনের বিশ্রামে ছিল। দেখা দিল না। অ্যালবাট্রসদের কর্কশ চেঁচামেচির বদলে সুনসান ঘুমন্ত সৈকত। পিয়েড অ্যাভসেট, কেনটিশ প্লোভার, লিটল টার্ন বা কমন টার্নরা অতিথি পাখি হয়ে হয়ত উড়াল দিয়েছে উষ্ণতার খোঁজে। আমার বাংলাদেশেও কি তাদের কেউ গিয়েছে অতিথি হয়ে? কেমন আছে তারা সেখানে?

ফ্যোয়ার সমুদ্রতট দেখলে কক্সবাজার সৈকতের আড়ম্বর বোঝা যায়। আসলেই সেটা প্রাকৃতিকভাবেই ভীষণ জমকালো এবং অনন্য তো বটেই। তবে ফ্যোয়াকে খুব ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। সে তার  নিজের মত ছিমছাম সুন্দর। সৈকতের এদিকে সেদিকে তুষার লেপে দেয়া যেন। রোদের আফসুন সেখানটায়। সাগর ঘেঁষে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত কেউ বললোও না যে কী বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য!

সমুদ্রের পানিও স্টুপিফাইড! একেবারেই জমে টমে বরফ হয়ে আছে! এক পা দু পা করে আগাই, আবার মনে হয় এইরে! যদি ভাঙ্গন ধরে যায় তাহলে তাহলে কার্টুনে দেখা বন্ধুসুলভ পেঙ্গুইন মাথা বের করে “গুটেন টাগ” না বললেও ঠিক ঠিক  টুপ করে হাড় কাঁপানো সমুদ্রে পড়ে যাব! আমার সাথের সফরসঙ্গীরা সবাই সাঁতার জানে তবু এই অসম্ভব বরফশীতল পানিতে নামলে, তারা নিজেরাই মুহূর্তের ভেতর তুষার মানব হয়ে যাবেনা না তার নিশ্চয়তা কী? আর বিশ্রামক্লান্ত হর্নসীল আমাকে মাথায় করে স্থলে দিয়ে যাবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

তবু আমরা সামনে যাচ্ছি।

আসলে যাচ্ছিনা, যেতে হচ্ছে। সমুদ্র অদ্ভুত সম্মোহনবিদ্যা জানে। কোথাও কোন তীরের দেখা নেই। তবু মানুষ আরও নিবিড়ে যেতে চায়। আরও পরখ করে দেখতে চায় জলের উচ্ছ্বাস আর ক্ষমতা। উচ্ছ্বাস এখানে নেই; আছে নিবিষ্টতা।

জমাট বাঁধা হিমের ওপর এভাবে অসংখ্য পদচিহ্ন রেখে দেবার আমন্ত্রণকে সমুদ্রের হৃদয়ের দুরভিসন্ধি বলেই মনে হল আমার।

 

 

(ছবি: Akpool.de)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত