লাল রং কৃষ্ণচূড়া

চোখের সামনে ঝুলে আছে লোকটার বিস্তৃত টাক। এরপর কপালের দুই ধারে কালো চুলের গাছি। দুইটা অব্যক্ত চোখের মাঝ দিয়া খাড়া পাহাড় নাকটা নাইমা গেছে। আর কিছু না হোক, লোকটার নাক সুন্দর। সেই নাক হঠাৎ শূন্যে শেষ। সেখানে বাতাসের ওঠানামা কেমন অস্থির। দুই ঠোঁটের মাঝখানে বছর পঞ্চাশেকের পুরানা মুখগহ্বর। সেখান থিকা পরবর্তী কোন কথা বাইর হয় তা বুঝার জন্য আমি তার দিকেই খেয়াল রাখি। মসৃণ চকচকে গালে মাংস আর পিছলা চিবুকের কিছু অংশ আমার চোখে পড়ে। রুমে ফ্যান চলতেছে। চৈত্রের গরমে এই ফ্যান লোকটার জন্যে যথেষ্ট না। অথবা তার প্রেশারও থাকতে পারে। কারণ চিটচিটা ঘাম লেপ্টে আছে গালে। তার আচরণটাও প্রেশার রুগির মতন। ভিতু ভিতু। ভেতরে হয়তো তার কোনো কিছু একটার ছুটাছুটি চলতেছে বা অস্বস্তি।
আমার এমন মনে হবার কারণ আছে। আমি ওনার সামনে বইসা আছি মিনিট দশেক। তিনি আমার দিকে তাকাইতেছেন বারবার, কিন্তু কথা বলতেছেন না। আমি বুঝে নিলাম তিনি প্রস্তুতি নিতেছেন। কিন্তু তাই বইলা দশ মিনিট লাগব ক্যান তার! লোকটার এমন বারবার তাকানোতেও একটা অ¯^স্তি আছে। উনি আমার দিকে তাকায়া থাকলেও পারেন। একবার টেবিলের কাচে, একবার ফ্যানের দিকে, একবার আমার দিকে এইভাবে কোনো লোক যদি দশ মিনিট কাটায়া দেয়, কোনো কথা না বইলা তারে সন্দেহ করাই যায়। চোরা স্বভাব আছে নাকি তার! তা ছাড়া তিনি আমার চোখের দিকে বার দুই তাকায়া সঙ্গে সঙ্গেই নামায়া ফেললেন নিজের চোখ। এইখানে গিয়া আমার প্রথম খটকা লাগে। এমন কিছু উনি না করলেই পারতেন, ক্যান করলেন, ওনার সামনে বইসা বইসা এসব ভাবতেছি।

এই দশ মিনিট শুরুর আগেই আমি কে এবং তার কাছে কেন আসছি, তা জানাইছি। আমার কথা শুইনা তিনি আর কিছু বলেন নাই, খালি বসতে বললেন। আমি যেহেতু একটা কাজে আসছি ওনার কাছে আমারে তাই বসতেই হইল। কতক্ষণ বসতে হবে, তা না বইলা কী যেন একটা ফাইলের দিকে চোখ রাখলেন তিনি। আমি আসলে কোনো ধারণা ছাড়াই তার সামনে বসি। এবং বসার পরই তার উবু হওয়া মাথার টাক আমার চোখে পড়ে। নিজের পরিচয় জানানোর সময় তার বিষয়ে আমার কোনো খেয়াল আছিল না। এর কারণ আছে। এই অফিসে তার চাইতে বয়সে বা ক্ষমতায় ছোট বা বড় যারাই আছেন, যার কাছে সুযোগ পামু তার কাছেই আমি যামু। ফলে আলাদা কইরা আচরণে না হইলে চেহারায় আমি কাউরে মনে রাখার দরকার মনে করি না। আমি খালি জানি আমি ক্যান এনাদের কাছে আসছি আর তারা যা-ই জিজ্ঞেস করুক, উত্তর আমার কাছে আছে। আমার চাইর বছরের অভিজ্ঞতায় আমি দেখছি, হাতে গোনা উনিশ-বিশ প্রশ্ন তারা জিজ্ঞেস করেন। এই কয়টা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য চাইর বছর লাগে না। ফলে কেউ আমারে বসতে বললে আমার ভয় বা সংকোচ হইত না। বাঙালির চিন্তার ঐক্য আমারে অবাক করে। এই জিনিস একটা জাতির জন্য বড় পাওয়া, এই দেশে এখনও একটা ভাত টিপলইে হাঁড়ির বাকি ভাতের খবর জানা যায়। আমার জন্যও সুবিধা হইছে, আমি ফলে নিজে যা করি সেই বিষয়ে ওই উনিশ-বিশটা প্রসঙ্গের বাইরে আর কোনো প্রসঙ্গে আগ্রহ দেখাই না। কাজ করতে করতে আমার আগ্রহ দাঁড়ায়া গেছে কীভাবে এই যে সামনে বসা লোকটার মতো লোকগুলারে কনভিন্স করতে হয় আর আমার কাজ আদায় করতে হয়। ফলে কাজ আদায়ের আশায় আমি তার সামনে টানা দশ মিনিট চুপচাপ বইসা থাকি।

‘তুমি তাইলে ইতিহাসে পড়ো।’
‘জি’
‘ইতিহাস বড় করুণ জিনিস। ভূত হয়ে ইতিহাসরে বেঁচে থাকতে হয়। এ জন্যেই মানুষ ভূতে বিশ্বাস করে, হা হা কী বলো।’

লোকটার এমন কথায় আমি অবাক হই। চোখে কোনো ভাষান্তর না থাক, আমি মনে মনে তারে আবারও বুঝার চেষ্টা শুরু করি। লোকটার উচ্চতা আঁচ করা যায়। পাঁচ ফিট আট বা নয় হবেন। স্বাস্থ্যটা ভালো না, বেদনাকাতর। মানে একেবারে মেদহীন আর কিছুটা মাংসের অভাবও আছে। চেহারার সাথে নাকটা মানানসই। চোখের ভ্রূ মোটা। ঠোঁটও মোটা। মোটা হাড্ডির শরীর তার। শেভ করা গাল। একটা কাঁচা হলুদ আর হালকা আকাশি চেকের শার্ট পরছেন। শার্ট দেখেই বুঝা যায় ইন করছেন। তার নাভি থেকে শরীরের বাকি অংশ চওড়া টেবিলে ঢাকা পড়ছে। তিনিও একবার ফাইল দেখা এবং বারে বারে টেবিলের দিকে তাকানোর ফলে বেশিরভাগ সময় ঝুঁইকা ছিলেন। বার কয়ে সোজা হবার চেষ্টা করলেও সোজা হইতে পারেন নাই। ফাইলটা দেখতে তার মাত্র দুই মিনিট লাগছিল। তারপর থাইকাই উচপিচ করতেছিলেন। তিনি আমারে বসতে বলার সময়ই আমি চিকন কালো বেল্টের সোনালি ডায়াল ঘড়ির রুপালি কাঁটারে দেখছিলাম দুইটা পাঁচের ঘরে। সেকেন্ডের হিসাব অবশ্য করি নাই। মহাকালের হিসাবে সেকেন্ড হইতেছে সেই বিন্দু বিন্দু জল। তার যে দাম নাই, এইটা সবাই বুঝে। সমুদ্রের দাম আছে, অসীম দাম। এক ফোঁটা জলের কোনো দাম নাই। আমারও একই অবস্থা দাঁড়াইল নাকি!

এসব কী খাজুইরা আলাপ শুরু করছে লোকটা। আর কতক্ষণ বসায়া রাখব। ক্ষুধা লাগছে, সকালেও কিছু খাই নাই। ঘুম থিকা উইঠাই পার্টি অফিস। তারপর একগাদা পত্রিকা বগলে নিয়া বাইর হইলাম। চৈতের রোদ সকালরেও দুপুর বানায়া ছাড়ে। এলিফ্যান্ট রোড আসতে আসতে বারটা বাইজা গেছিল। বাস থিকা নাইমাই এক কাপ চা খাইলাম। প্রেসক্লাব থিকা এলিফ্যান্ট রোড, আই বাপ। তার চাইতে এইভাবে বইসা বইসা চোত মাস কাটান যায়। চা খায়াই একটা বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা জাগছিল চরম। কিন্তু উপায় নাই। আমার লগে কায়সার, নীলা, আর অন্য আসছিল। অন্যের আইজ ক্যাম্পাস জীবনের শেষদিন। এই পত্রিকা বেইচাই হলে গিয়া ব্যাগ-বোঁচকা গুটায়া মিরপুরে যাবে, সেইখানেই সাকিন খুঁইজা পাইছে সে। এরপর কী করবে সে জানে না। চোখের সামনে সে এখন আমাদের জন্য একটা প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন আমাদের মনে যতবার আসে মুখে ততবার আসে না। আকাশে মেঘটেঘ দেখলেও ছ্যাঁৎ কইরা সেই প্রশ্ন আমাদের চোখে ভাসে। তাও আমরা বগলে পার্টির পত্রিকা চাইপা চুপ থাকি। চা খায়া চাইরজন চাইর দিকে ভাগ হই। যে যা বেচতে পারে। তিনটার দিকে সবাই এক জায়গায় হমু। নিজেদের পকেট থিকা পয়সা দিয়া ভাত নইলে চা-রুটি-কলা খামু। আজ অন্য ছাড়াও কায়সার বাসায় চলে যাবে। ও পার্টি অফিসে যাওয়ার সময় পায় না। তার এক বোন আছে, অসুস্থ, অটিজম। বোনটারে সে খুব ভালোবাসে। সে এমন কাজ বা মিছিল শেষ কইরা বাসায় চইলা যায় প্রায় সময়। নীলা যাবে তার নোট জোগাড় করতে। কাল ওর টিউটোরিয়াল। পার্টি অফিসেই আমরা নিজেদের গন্তব্য জাইনা নিয়া ক্ষুধা পেটে পত্রিকা বেচতে বাইর হই।

চা খায়া আমি গাউছিয়ার দিকে হাঁটতে থাকি। বগলতলার পত্রিকার প্রথমটা যেন ঘামে ভিইজা নষ্ট না হয়, তার জন্যে ব্যাককভার হিসাবে একটা নষ্ট পত্রিকা রাখছি। এই পত্রিকা বগলে নিয়া হাঁটতে হাঁটতে আমার ছোটবেলার স্কুল ফাঁকি দেয়ার ঘটনা মনে পড়ল আইজ। যদিও আমি এই থিওরি অ্যাপ্লাই করি নাই, তবু সেই থিওরি আইজ মনে পইড়া গেল। এক মামাতো ভাই কইছিল, বগলে রসুন চাইপা রোইদে দাঁড়ায়া থাকলে জ্বর আসে। এট্টু পর জ্বর ভালো হয়া যায়। তুই স্কুলে যাইতে না চাইলে এই বুদ্ধি করতে পারস। না সেই বুদ্ধি আমি করি নাই। আমি কোনোদিন স্কুল পালাই নাই, কলেজ পালাই নাই। অথচ আইজ আমি বিশ্ববিদ্যালয় পালাই। এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ার। আর এক বছর, তারপর। জানি না। জানি না বইলাই পত্রিকা বগলে চাইপা হাঁটতেছি। জ্বর জ্বর লাগে কেমন। পত্রিকাগুলা কী রসুন হয়া গেল নাকি। কাইল রাইতেও একবার জ্বর মতো আসছিল। সকালে মাথাটা একটু ভার ভার লাগতেছিল। তবু এই যে এরে-ওরে পায়া, এইটা-ওইটা নিয়া হাসি কথা কইতে কইতে, পত্রিকা বেচতে বেচতে মাথা হালকা হয়া গেল। এখন মনে পড়ল গত রাইতের জ্বরের কথা। কিন্তু তখনই তিনি আমার সামনে তার দশ মিনিটের বিরতির পর নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করলেন। আমি ফলে এত ভাবনার জটাজাল থেকে তার ইতিহাসবিষয়ক এমন গভীর বাণী তালাশ করার আগে তার বিষয়েই আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়া পড়ি। নিজের ভিতরে যা সন্দেহ ছিল, এই গভীর তাত্ত্বিক বাক্য আমারে মনে করায়ে দিল যে আসলে সন্দেহ না, আমি তার বিষয়ে বিভ্রান্ত। কিছু খুঁইজা না পায়া আমি হাসি।

‘হা হা’
‘হা হা হা তা কী করব আমি এই পত্রিকা দিয়ে।’
‘জি পড়বেন। পত্রিকা দিয়ে মানুষ আর কী করে।’
‘প্রথমে পড়ে, তারপর প্রয়োজন হলে সংগ্রহে রাখে না হয় ফেলে দেয়। কোন ইয়ারে পড়ছ।’
‘অনার্স ফাইনাল।’

আমি বিভ্রান্তি কাটাইতে পারি না। এ লোকটা এতক্ষণ এমন করতেছিল কেন। এখন তার কথা শুইনা তারে স্বাভাবিকই মনে হইতেছে। এখন সে আমার চোখের দিকেই তাকায়া আছে, মাঝে মাঝে গাল চিবুক, বুকের দিকেও তাকাইতে পারে। আমি অবশ্য একটা চওড়া শাদা ওড়না পরছি। তাতে আমার বুকের অস্তিত্ব বাইরে টের পাওয়ার সুযোগ নাই। লোকটা হুট কইরা আমার গলার দিকেও তাকায় বারকয়েক। নারী মনের সংশয় মাঝে মাঝে বিদঘুটে হয়া ওঠে। লোকটারে লোলুপ ভাবতে শুরু করছিলাম। বাস্তবিক যাবতীয় পুরুষ সম্পর্কে আমার কাছাকাছি রকম ধারণা আছে। যত যা-ই হোক পার্টির লোকগুলারে আমার পুরুষই মনে হয়। পুরুষ বিষয়টাই কেমন জানি। কিন্তু অন্য আলাদা, কেন আলাদা আমি জানি না। ভাবছি, প্রেম ছাড়া আমার কিছু মনে হয় নাই। এর ফলে যেটা হইছে পুরুষসম্পর্কিত চিন্তা আমার কাছে জটিল রূপ নিছে। আমি তাই পুরুষ নিয়া আর ভাবি না, পার্টি অফিসেও না। কিন্তু অন্যরে নিয়া আমি ভাবি। ওর সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা আছে কিন্তু মেশা হয় নাই তেমন। মানে আমাদের দুইজনের যোগাযোগে একটা স্বচ্ছন্দ আছে, হয়তো কিছুটা নির্ভরতাও। মাঝে মাঝে কিছু রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচ আমি তারে দিয়া মিটাই। তার কথা বলার ঢং এত মৃদু আর নরোম কিন্তু স্লোাগান দেয় গলা ফাটায়া। তার সম্পর্কে আমার কৌতূহল আছে, ছোটবেলায় দেখা টিয়া পাখির মতন। যারে আমার পাওয়ার ভাবনা নাই, কিন্তু চোখে চোখে রাখার ইচ্ছা আছে। আর কেউ পার্টি অফিসে না আসুক, অন্য না আসলে আমার চোখে লাগে। আমি হয়তো দলের কাজ নিয়া সারা দিন খুব ব্যস্ত কিন্তু হলে আসলে আমার মনে হয় অন্যর সঙ্গে দেখা হইল না। মাঝে মাঝে তারে ফোন দিই। সেই তার নরম গলা। কী করলা সারা দিন, আমি যাইতে পারি নাই, কাইল পরীক্ষা তো। আর নইলে মাঝে মাঝেই সে অসুস্থ হয়া পড়ত। হয়তো জ্বর বা মাথা ব্যথা। সে কী প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। প্রথমবার যেদিন দেখলাম সে পার্টি অফিসের বেঞ্চিতে শুইয়া কাতরাইতেছে, সেদিনই আমি তারে খেয়াল করি। এর দিন দুই পর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি মাথা ব্যথার খবর জিজ্ঞেস করি। একটা সাদা সকালের মতো হাসিতে সে আমারে আশ্বস্ত করে, মাঝে মাঝেই নাকি তার এমন হয়। এটা অনেকটা মানসিক, টেনশন অথবা মানসিক কোনো অস্থিরতা থেকে এই ব্যথা হয়। ওর হাসির দিকে আমি তাকায়া ছিলাম। সরল হাসি, হয়তো শুধু হাসির জন্যই হাসি, কিন্তু কোনো ফাঁক বুঝা যায় না। পার্টি নেতারা ভুলের জন্য যে ঝাড়ি দেন, তার উত্তরে যে হাসি আর আমারে দেখলেও সেই একই হাসি। একটা হাসির এত রকম অর্থ থাকতে পারে। আমি অবাক হইতাম। তার হাসিতে কী যেন আছে। কিম্বা হোয়াট ইজ টু বি ডান এর মীমাংসায় ব্যস্ত আমাদের হাসি-গানের খেয়াল থাকত না। এই হাসিও আসলে উপরিতল, পায়ের পাতা কই ঠেকায়া রাখছি সেইটাই বিবেচ্য। কিন্তু সব অবস্থায় একই রকমের হাসি ধরে রাখা অন্যরে দেখলেই আমি বরং বেশি বিব্রত হইতাম, হোয়াট ইজ টু বি ডানবিষয়ক ভাবনা আরো জটিল মোড় ধারণ করত। এই লোকের সামনেও আমার এখন একই অবস্থা।

‘বাড়ি কোথায়?’
‘মানিকগঞ্জ।’
‘কত দাম এই পত্রিকার?’
‘পাঁচ টাকা।’
‘কেন রাজনীতি করো তুমি?’

এইবার আমার মুখস্থবিদ্যা ঝাড়ার পালা। আমাদের জন্য এসব প্রশ্ন নিতান্তই মামুলি। গরুরে কেউ কখনো হাল চাষের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে না। বা মাঝ দরিয়ায় যে নৌকা ভাসমান, তারে ভাইসা চলার কারণ জিজ্ঞাস প্রশ্নকর্তার কৌতূহলের বিষয় হইলেও ওই নৌকার যাত্রীদের জন্য তা নিতান্তই একটা প্রশ্ন এবং তা বিরক্তি উদ্রেকও করতে পারে। নৌকার চলার কারণ পানির বহমানতা। পানি না চললে নৌকা চলে ক্যামনে। ফলে এই প্রশ্ন নৌকারোহীর পথ বিভ্রাটকে আরো সংকটময় করে তুলতেও পারে। আমারও বিরক্তি জাগে মাঝে মাঝে। এই সমাজে কত লোক কত কিছু করে, আমি রাজনীতি করি। আমি বিরক্ত হই উত্তর জানা নাই বইলা না, আমি নিজেও এখন এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হই।

সমাজ এত বড় আর বিচিত্র যে আমার দলের নেতার মুখের কথা সেই সমাজের অলিগলিতে গিয়া অনুরণিত হইলেও কানা গলিতে গিয়া হারায়া যায়। আর নইলে প্রেসক্লাবের ধুলাবালি গায়ে ভালোভাবে মাখতে পারলে আমার মনে হয় বিপ্লব কিছুদূর আগাইল। অথচ গোসল-টোসল কইরা পরিষ্কার হইলে আমি সবসময় বুঝতে পারি না কী করলাম। এই যেমন কায়সারের বোনরে দেখলে আমার মায়া লাগে। শোষিতের তরেও এমন একটা বোধ জাগে। এই বোধ আসলে মায়া, মানবিকতা। এর সঙ্গে সম্পর্ক তালাশ আর এর থেকে উত্তরণের কর্মকাণ্ডরে যদি রাজনীতি বলি, তাইলে আমি রাজনীতি করি। কিন্তু কায়সারের বোনের বেলায় স্ববিরোধিতা আছে। ওর প্রতি কোনো রাজনীতি নাই। এই বোধ আসলে নির্বোধের, কিন্তু অনিবার্যভাবেই মানবিক। কায়সারের বোনের এই রকম চরিত্র আমারে সমস্যায় ফেলে। আমি বুঝতে পারি না, আসলেই সবকিছু রাজনৈতিক কি না। আমাদের পার্টি প্রধানের সঙ্গে বৈঠকগুলা যখন হয় তখন তার সামনে আমরা সারি সারি টবে লাগানো চারাগাছের মতো বইসা থাকি। তার কথা বলার ভঙ্গিতে তোড়েজোড়ে আমাদের শাখা-প্রশাখা দোলে। আমরা আসলে শরীরের ভঙ্গিতে মুরিদ হয়া উঠি। তিনি যখন আমাদের বয়ান করেন শীত প্রাসাদের আন্দোলনের কথা। আমার মনে হইত কোনো রাজ্য জয়ের গল্প পড়তেছি। যেকোনো নতুন বিষয় আমার জানা হইলে প্রথমে এই অনুভূতিটাই আসে। এইটা ছোটবেলার অভ্যাস। আমি নেতার কথা শুইনা যাই। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার বিষয়ে তার আলোচনা আমার ভিতরে প্রথম প্রথম পার্টি অফিসে যাওয়ার অনুভূতি ফিরায়া নিয়া আসে। প্রথম যে দিন আসছিলাম অফিসে, তখন আমি খালি নেতারেই দেখছিলাম–কেন্দ্রে। তার হাসি আর বয়ানই বোধহয় গণতন্ত্র। তিনি কেন্দ্রে, পরিধির লোকেরা তারে যথাযথ মেনে চলাই গণতন্ত্র।

আমিও কেন্দ্রের প্রতি আচ্ছন্ন আছি, গণতন্ত্র কম বুঝি। অথবা কী জানি, আমার ঘোর কাটত না প্রথম প্রথম। গণতন্ত্র আদতেই একটা রাজনৈতিক বিষয়। নিজের জীবনের-চিন্তার আর রাস্তাঘাটের চলাফেরার গণতন্ত্র বিষয়ে কোনো পাঠ না থাকায় আমি বাসে চাইপা অস্বস্তিতে পড়ি। কারণ ভদ্রতা আর গণতান্ত্রিক আচরণের ঘোলা চাঁদের পূর্ণিমাতে আমার চোখ বেশি কিছু দেখতে পায় না। জোছনার মায়া আছে, কিন্তু পরিষ্কার না কোনো কিছুই। ফলে আমি যখন লোকটারে রাজনীতি কেন করি, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকি তখন আমার নিজের ভেতরটারে কেমন ফাঁপা মনে হয়।

‘আমি আসলে বলতে পারেন সামাজিক দায় আর মানবিক বোধ থেকে রাজনীতি করি। বিষয়টা এমন যে আসলে আমার অবস্থান রাজনীতির বাইরে না। এই সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমি আমার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করি। তা ছাড়া কত জন কত কিছু করছে। কেউ গান গাইছে, ছবি আঁকছে, ছবি তুলছে দিনভর আমি রাজনীতি করি। আমি আসলে একজন অ্যাকটিভিস্ট, যার দলীয় পরিচয় রয়েছে।’

লোকটা এবার আরো খানিক চুপ করে। আমি রাজনীতি করার কারণ ব্যাখ্যা করার পরই একবার ঘড়ির দিকে তাকাইছিলাম। কারণ তিনটা বাজতে কত বাকি দেখা দরকার। মাত্র বিশটা পত্রিকা বিক্রি হইছে। এই লোক পরিমাণে বেশি টাকা না দিলে এই প্রায় তেরো মিনিট আমার লস। এবং এর আলাপ যেখানে আছে, না-জানি কখন ছাড়া পাই। ফলে আমারে উঠতে হবে। কিন্তু উঠবার উপায় নাই। আমি মুখে একটা বিরক্তির ভাব শুরু থেকেই ফুটায়া রাখছি। কাঠ কাঠ জবাব দিতেছি তারে। মুখাবয়বে কোনো প্রশ্রয় নাই।
মুখে এমন ভাব ধইরা রাখার কারণ অবশ্য অন্যটাও হইতে পারে। এই সামাজিক প্রেশারে পইড়া নিজেরে দিনের মধ্যে এতবার নারী মনে হয় যে লোকটার প্রাথমিক আচরণে তারে সন্দেহ করতে এতটুকু বাঁধে নাই আমার। আইজ অবশ্য নিজেরে নারী ভাবার কারণও আছে। আমার পিরিয়ড শুরু হইছে। কাইল অমন একটা লম্বা মিছিলের পরে পার্টি অফিসে আইসাই বিপদে পড়লাম। তলপেটে একটা ব্যথা আর প্রস্রবণের চাপ টের পাইলাম। ভাগ্যিস, ব্যাগে টিসু আছিল। তাড়াতাড়ি অফিস ছাইড়া হলে আইসা পড়ি। সারা দিনের ঘাম-নুন আর রজঃস্রাবের রক্ত ধুয়া সাফসুরত হইতে হইতে শরীরে আর শক্তি পাইলাম না। না খায়াই ঘুম। রাইতে খুব মায়ের কথা মনে হইতেছিল। টাকাও শেষ। এই শুক্রবারেই বাড়ি যাইতে হইব। পার্টির কামে গত শুক্রবার মিস করছি। এই এক সপ্তাহ চলতে বহুত কষ্ট হইছে। ভাগ্যিস, রুমে কিছু চাল আছিল। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম। তারপর এই লোক আমার আজকে দিনের আলোচিত চরিত্র হয়া থাকবে নিশ্চিত। তারে সন্দেহ করার কারণ আমার মাসিকজনিত মনোভাবও হইতে পারে। এই সময়ে প্রথম দিকে আমার মধ্যে কেমন জানি একটা সন্দেহ কাজ করে। একটা মেজাজ মেজাজ ভাব আসে, ভ্রূ কুঁচকানো থাকে। ফলে লোকটারে কী কারণে সন্দেহ করছিলাম, এইটা নিয়া আমি আরো বেশি দ্বিধায় পড়ি। আমার উত্তরে তার চুপ হয়া যাওয়াতে কিছুটা অবকাশ পাই ঠিক বললাম কি না তা যাচাই করার। এই ফাঁকে আমি একটা সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতার কূটাভাস পাই। আমি খানিকটা অবাক হই নিজের মেজাজের ওপর। লোকটারে সন্দেহ করছি বইলা আমার ভিতরে একটা হীনম্মন্যতা দেখতে পাই। এবং এই হীনম্মন্যতারে জয় করবার জন্য আমি লোকটার যেকোনো প্রশ্ন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দেওয়ার মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। লোকটা আবার ফাইলের পাতা ওল্টায়। ফাইলের একটা পাতা দেখতে বোধহয় দুই মিনিট বা তার কাছাকাছি সময় লাগে। কারণ দুই মিনিট আঠারো সেকেন্ড পরেই তিনি আবারও কথা বলে ওঠেন।

‘আমাদের ভূখণ্ডে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস বিষয়ে তোমাদের মতামত কী। এই দেশের শ্রেণি সংগ্রামের ধারা কোনটা। রাজনীতি সম্পর্কিত আমাদের বোধগুলো কী রকম। যেমন এই যে তুমি এখন রাজনীতি করছ। তোমার দশ বছর আগে যারা তোমার দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কাজ করেছেন তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম তোমার সময়ের চাইতে ভিন্ন। তাদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কেমন। এমনি করে ধরো আরো যুগ পরিক্রমায় এই দেশের পরিবর্তনগুলো তোমরা কীভাবে মূল্যায়ন করো।’

প্রশ্ন বুঝতে আমার সময় লাগল। এবং আমার মেজাজরে চাপায়া দেয়ার জন্য এই প্রশ্ন যথেষ্ট ছিল। এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমার হাতে না থাকায় আমি পিছু হটি এবং তার সঙ্গে ঠিক দ্বন্দ্ব নয় এইবার বোঝাপড়ার দিকে ঝুঁকি। কারণ পত্রিকা বেচাই আমার মূল কাজ, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা বেড়াই না।

‘আসলে এই সমস্ত প্রশ্নের আলাপ অনেক লম্বা। আপনি একদিন আমাদের অফিসে আসতে পারেন বা আমি আরেক দিন সময় করে আসব। তখন লম্বা আলাপ করা যাবে। এখন শুধু এটুকুই বলতে পারি যে আমাদের সংগ্রাম শ্রেণি সংগ্রাম এবং আমরা সর্বহারা শ্রেণির পক্ষে। আমাদের দেশের মানুষ অনেক লড়াকু। একদিকে পরিবেশ অন্যদিকে রাষ্ট্র। এই দুই পক্ষকে মোকাবিলা করতে পারে কেবল সংগঠিত জনগোষ্ঠী। এবং এই জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে যে দল আর মুক্তির পথ হিসেবে মার্ক্সবাদকে বেছে নেয় এবং যথাযথ প্রয়োগ ও সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, তাকে বিপ্লবী পার্টি বলে। আমাদের পত্রিকা সেই পার্টির মুখপত্র। আপনি যেকোনো সমালোচনার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’

এইবার লোকটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। মুখের কুঞ্চিত রেখায় বিরক্তি আর হতাশা। এইবার তার চোখের ভাষাও আমি বুঝতে পারি। আমার উত্তর শুইনা চোখ দুইটা খানিক নিষ্প্রভ হয়। আমিও সংকুচিত হই। আমি আসলে এত জটিল সব বিষয় নিয়া কখনো ভাবি নাই। নেতার সব পাঠচক্রেই আমি আছিলাম। বলা যায় যুক্ত হওয়ার পর থিকা ছিলাম না এমন প্রোগ্রাম কম আছে। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের জোর কম। খালি দুশ্চিন্তা করতে আমার ভাল্লাগে আর কাজ করতে। আমি ক্যান জানি সুন্দর খুব পছন্দ করি। মানে আমার চোখে যা সুন্দর আরকি। আমি সারাক্ষণ সেই সুন্দর নিয়া ভাবি। শ্যামাদির মুখটা যেমন। বয়েস চল্লিশ, মুখে বোঝা যায় না। মুখে কেবল শ্যামলা-গম্ভীর-সজীবতা। কুষ্ণচূড়াও সুন্দর। তবে আমি সুন্দর কিছু ইদানীং আর খুঁইজা পাই না। আমি ডিক্লাসড হওয়াও বুঝি না। আমার কাছে মনে হয় ডিক্লাসড হওয়া মানে পানির মতোন কিছু একটা। আমাদের নেতার স্বভাবটা তা-ই। তিনি যখন জগে থাকেন তখন জগের মতো, তিনি যখন বোতলে থাকেন তখন বোতলের মতো, আবার যখন রাস্তয় থাকেন তখন তিনি রাস্তার মতো। অতএব তিনি পুরাপুরি ডিক্লাসড হয়া পড়ছেন, এইটা নিশ্চিত। আমরা হইতে পারলাম না। আমি ফলে কী নিয়া আমারে ভাবতে হবে, কেবল তা-ই ভাবি। কিছুই যেন ভাবতে না হয়, এর জন্য আমি খালি কাজ করতাম। আমার কোনো প্রশ্ন-ট্রশ্ন থাকলে অন্যরে জিজ্ঞাস করতাম। ও অনেক কিছু জানে। রাইত ভর তারা অনেক ছেলে কর্মীরা আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে নেতাদের সঙ্গেও অনেক রাত পর্যন্ত এইটা-ওইটা আলাপ চলে। কিন্তু পার্টির মেয়েরা এসব থেকে বঞ্চিত। যারা হলে থাকে তারা হলে আর যারা বাসায় থাকে তাদের বাসায় ফিরতে হইত সময়মতো। বাসায় বা হলে ফিরার পর আমাদের স্বভাব মতো রুমটুম গোছানোর কাজ করতে হইত। তা ছাড়া শরীরের ক্লান্তিটারে অস্বীকার করা যায় না। বোধহয় নারী বইলাই ঘরের টান বিষয়টাও কাজ করত। এইটা অবশ্য কায়সারের ক্ষেত্রেও সত্য। সেও রাজনীতি কম বুঝে। কিন্তু এখন অন্য ছাড়া এই লোকরে আমি কী বুঝ দেই, ভাইবা পাই না।

‘তুমি ভেব না। আমি তোমার সময় লস করব না। আমার আসলে তোমাকে দেখে মানে তুমি আর তোমার পত্রিকা দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল। এটা-ওটা অনেক প্রশ্ন। আমি জানি না আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তুমি বাধ্য কি না। আমি যেমন তোমার পত্রিকা রাখতে বাধ্য নই। তবু যদি মনে করো, তাহলে খানিক আলাপ করতে পারো। আমি তোমার পার্টির জন্য এই মুহূর্তে আমার পক্ষে যা সম্ভব সহযোগিতা করব।’

লোকটার এই কথায় আমি আসলে আশ্বস্ত হই। এইটা আমার স্বভাব দাঁড়ায়া গেছে। তিনি যে বললেন আমার পত্রিকা রাখতে তিনি বাধ্য নন। এইটা সত্য। আমি লোকটার কাছে আসছি রাজনীতির প্রয়োজনে, দলের প্রয়োজনে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তাত্ত্বিক। মানে আমি তারে হয়তো আর কোনো দিন দেখলে চিনব না। তিনি হয়তো কান পর্যন্ত ছাঁটা চুলের আমারে দেখলে চিনবেন। কিন্তু জনগণের সঙ্গে কারবার বইলা সব জনতার মুখচ্ছবি একই আদলে আমার চোখে বিরাজ করলে আমি এনাদের কাউরেই আলাদা কইরা চিনতে পারি না। আমাদের নেতা আমাদের কখনো গল্প শোনান নাই। কোনো মানুষের গল্প, সম্পর্কের গল্প। ফলে আমরা গল্পহীন এক সামষ্টিক আঁটি। আঁটি হয়ে স্লোগানে-অবরোধে আমরা মুক্ত দিনের সোনালি সূর্যের ঝিলিকে লালমেঘ দেখি আকাশে। আর তার নিচেও লাল বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে অন্য অথবা নীলাকে আমি চিনতে পারি। আরো যারা আসেন সেই লাল বাতাসে ফেস্টুন উড়িয়ে তাদের আমি চিনতে পারি না। কায়সারের বোনের মতো যে আসতে পারে নাই তারে আমার মনেই পড়ে না। এই লোকরেও আমি এরপর চিনবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু এখন সে আমার সামনে দারুণ এক বাস্তব হয়া বইসা আছে। একটা প্রচ্ছন্নতার আড়ালে আমি নিজেরে ঢাকতে থাকি। তার এই কথায় আমি ঘড়ি দেখি। আমাদের ভূখণ্ডের প্রথম শ্রেণীসংগ্রাম কোনটা, এই প্রশ্নের উত্তর আমারে কে দিবে সেই প্রশ্ন পরে, এখন আমারে উদ্ধার করে কে। ঘড়ি ছাড়া আর কেউ না। আমি ঘড়ি দেখার প্রচ্ছন্ন ভঙ্গি করি। এইটা আমি ভাইবা করি না অভ্যাসবশত করি সেই আলাপ বাদ।

তবে তিনি বলতে থাকেন–

‘আমাদের ভূখণ্ডে ধর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখনও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এবং একইভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয়গুলোও দলের অভ্যন্তরে পরিষ্কার নয়। সাধারণ অর্থে বাজার নিয়ন্ত্রিত সামাজিক সংস্কৃতিকে মোকাবিলা করতে পারার মতো সাংস্কৃতিক সংগ্রাম অনুপস্থিত। ফলে রাজনৈতিক বোধও ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের এক অংশের জনগণ আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরেক অংশ ঘুরপাক খাচ্ছে রাস্তা হাতড়ে বেড়ানোতে। জনগণের কাছে যাওয়ার রাস্তা কেবল রাজনৈতিক না সম্পর্কেরও বটে, অনুভূতির আদান-প্রদানের। দল একই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক। মানুষ প্রেমিকও বটে। তার প্রেম করারও সময় চাই। একইভাবে উপার্জনের, অর্থ অথবা মেধার উপার্জন। দল আর শ্রেণী এক হতে পারে না। দল মানেই তার নিজস্ব রাজনৈতিক মত ও পথ থাকবে। সেই পথের পথিক গোটা জনগোষ্ঠী হবে না। কিংবা যারা সেই পথে হাঁটবে তারাও ছন্দে কথায় হুবহু একই হবে না। ভিন্নতা থাকেই। বৈচিত্র্য পৃথিবীরই বৈশিষ্ট্য। ফলে পার্টি আর পরিবার এক নিক্তিতে মাপা যায় না। তোমার পরিবারের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন আমি জানি না। কিন্তু এখনকার সময়ের রাজনীতি কেন যেন পরিবার থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।’

আমি এতক্ষণ লোকটার কথার অলিগলিতে ঘুরতেছিলাম। আবার আমি লোকটার মুখ চোখের পরিবর্তনটাও খেয়াল করতেছিলাম। আমি আসলে এক সঙ্গে এত কিছু খেয়াল করার ঘোরে তার কথা শেষ হওনের ক্ষণটা বুঝতে পারি নাই। এবার তার কথা শেষ হইলে আমি বরং কিছুক্ষণ চুপ কইরা থাকি। বেশিক্ষণ না হইলেও তা চোখে পড়ার জন্য যথেষ্ট। লোকটা হয়তো আমার এই স্থির মুহূর্তটারে খেয়াল করে। হয়তো লোকটা কিছুটা লজ্জা পায় আমারে এত কথা শোনানোর জন্য বা শেষে আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়া প্রশ্ন করার কারণেও তিনি লজ্জা পাইতে পারেন। তিনি এরপর ব্যাক পকেটের মানিব্যাগে হাত দেন। একটা পাঁচ শ টাকার নোট বাইর কইরা আমার দিকে বাড়ায়া দেন। আমি এত ধীরে হাত বাড়াই যে ওনারে একটু আগায়া আসতে হয় তার উল্টা দিকে। টাকাটা হাতে নিয়া আমি হাতেই গুটায়া ফেলি। এরপর কোলের ওপর হাত আইনা বাকি হাত দিয়া টাকার পইড়া না যাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করি। উনি প্রথমবারের মতো পত্রিকা হাতে নিয়া দেখতে শুরু করেন। আমি কিছু না বইলা বইসা থাকি।

তবে এইটা আমার কৌশলও হইতে পারে। ভাংতির কথা বলি না মানে আমি আসলে পুরো টাকা নিতে চাই। আবার উঠতে পারি না কারণ আমি নিশ্চিত হইতে পারি না তিনি পুরা টাকা আমারে দিয়া দিছেন কি না। আমি উঠবার ভান করি। এতক্ষণ টেবিলে রাখা বাকি পত্রিকাগুলা হাতে নিতে থাকি। তিনি আমারে পুরা পাঁচ শ টাকা রাখতে বলেন। আমি একটা ধন্যবাদ দিয়া চেয়ার থিকা উঠি। তিনি এবার আবারও ব্যাক পকেটে হাত দেন এবং খুব দ্রুত তার ভিজিটিং কার্ড আমার সামনে মেইলা ধরেন। আমি কার্ড হাতে নিয়া দেখি। শাহেদ রহমান লোকটার নাম। এই অফিসের মার্কেটিং প্রধান। ভালোই বেতন-টেতন পায় লোকটা। অফিস, কার্ড এসব দেইখা মনে হইল। তা ছাড়া আমারে যেমনে টাকা দিল, বেতন বেশি না হইলে ক্যান দিব এত টাকা। তিনি আবারও আমার দিকে মুখ বাড়ায়া কথা শুরু করেন।

‘আমার বোন তোমাদের দল করত। আমার ছোট বোন। আরেক বোন আছে আমার। ওর নাম কলি। আর যে তোমাদের দল করত, আমার ছোট বোন কাকলি। আমার নাম কল্লোল। খালি নামেই না, আমরা তিন ভাইবোন সব বিষয়ে একই রকম ছিলাম। আমরা মানসিকভাবে যমজ হয়েছিলাম আসলে। আমার সেই ছোট বোন কলেজে উঠেই তোমাদের দল করা শুরু করল। আরে যে মেয়ে সারদিন হা হা হি হি করে। এই বয়সেও আইসক্রিম খাব বলে প্যান প্যান করে। সারা জীবনে ঈদের জামার জন্য যে মেয়েটা কাঁদেনি একবার, এক ভিক্ষুককে টাকা না দেওয়ায় সে যে কী কান্নাটাই কেঁদেছিল, সেই ছোটবেলায়। আমাদের আদরের সেই ছোট বোন নাকি রাজনীতি করবে। শুনে আমি তো অবাক। আমি সঙ্গে সঙ্গে কলেজে গিয়ে কী রাজনীতি করে, কাদের সঙ্গে করে, কোন দল, নেতা কে, সব খোঁজ নিলাম। আমার জন্যে এটা কোনো কষ্টের বিষয় ছিল না। সে ভিন্ন আলাপ। তো আমি কাকলির সঙ্গে পার্টি অফিসে যেতাম। তার নেতাদের সঙ্গে আলাপ করতাম, আড্ডা দিতাম। আমার অনেক বিকেলের আড্ডার সঙ্গী তোমার দলের অনেকেই। আমি জানি আমার বোনকে সে এত নরম, এত অনুভূতিপ্রবণ, তার রাজনীতি করার কারণ আমি বুঝি। তারই এক বান্ধবীর অকালমৃত্যুর কারণ ছিল এই সমাজ। এই সমাজ ভালো করার আবদার ভাইয়ের কাছে না, এর জন্য সংগ্রাম প্রয়োজন। আমার বোন এত বড় সত্য কীভাবে জানল। আমি খুব অবাক হতাম। আমি ওর সঙ্গে পার্টি অফিসে গেলেও আলাপ হতো অন্যদের সঙ্গে। দেখা গেল বাসায়ও ওর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে না, দেখা হচ্ছে না। আমরা বাসায় সবাই নামাজ পড়তাম। এখনও মা আর বোন পড়ে। রাজনীতি শুরুর আগে কাকলিও পড়ত। পরে যখন ছেড়ে দিল মা খুব বকত। মায়ের বয়েস হয়েছিল, প্রায় সময় বিছানায় থাকতেন। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই আমাদের সব। কাকলির নামাজ না পড়ার বিষয়টা মাকে বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না। মা কাকলিকে কিছু বলতেন না। সব আমাকেই বলতেন। কিন্তু কাকলিকে আমি এসব বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। তার সঙ্গে আমার দেখাই হতো না পরের দিকে। সে সকালে বেরিয়ে যেত ফিরত রাতে। যেহেতু তার রাজনীতি করা আমরা মেনে নিয়েছিলাম ফলে তাকে কিছু বলতাম না। মাকেও জানাতাম না তার রাজনীতি করার বিষয়টা। সে এই রাজনীতিতে আসল কী করে, তার রাজনৈতিক জ্ঞানের বিকাশ কতটা হচ্ছে এসব খেয়াল রাখতে শুরু করলাম। আমি এটা-সেটা অনেক বই কিনে তার সঙ্গে পড়তাম। এতে করে আমি আবারও ওর ঘনিষ্ঠ হই। এবং তখনই বুঝতে পারি আমার বোন আসল প্রেমে পড়েছে, দল এবং ব্যক্তি উভয় রকম প্রেম। আমি বুঝতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করি। সে আমাকে নয়নের বিষয়ে জানায়। নয়ন কবিতা পড়ত আর খুব ভালো বক্তৃতা দিত। কলেজের প্রথম দিনেই প্রকাশ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখে নয়নের প্রতি আসক্তি জন্মে আমার বোনের। কাকলি নিজে যেচে নয়নের সঙ্গে আলাপ করে। রাজনীতি করার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে প্রেমও। আমি অবাক হই এত কিছু শুনে। আমার বোনের এত সাহস আছে আমি জানতাম না। আসলে ও কখনো বাধা পেতে শেখেনি। কখনও চেয়ে পায়নি এমন কিছু ছিল না। ও সব সময় সব কিছুকে ওর খেলনা বা চকলেট মনে করত। বেশি কিছু প্রত্যাশা তার ছিল না বলে যা চাইত তা-ই হাজির করতে হতো তার সামনে। কিন্তু নিজে নিজে জোগাড় করার ক্ষমতা আমার বোনের কীভাবে হলো, এটা ভেবে আমি অবাক হই। আমি নয়নের সঙ্গে মিশতে শুরু করি। ওর সঙ্গে আড্ডা, ওদের বাসায় যাওয়া, সময় কাটানো। আমি আসলে এখানে নিছকই স্বার্থপর আর ধুরন্ধর। আমি আমার বোনের প্রেমিক সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য নয়নের ঘনিষ্ঠ হই। কিন্তু আমি হতাশা বোধ করি। আমার বোন সুখী হতে পারবে না ওর সঙ্গে থাকলে। এক ধরনের শোয়িং ছিল নয়ন, আর ছিল তার খবরদারির মানসিকতা। আমি তাকে টাকা সাধলেও সে নিয়েছে। আমি আসলে সে লোভী কি না তা বুঝতে চাইছিলাম। নয়নকে লোভী প্রমাণ করতে পারলে আমার জন্যে সুবিধা। কাকলিকে তাহলে আলাদা করার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। নয়নদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না, আমি সুযোগটা নিলাম। তা ছাড়া ছেলেটা খুব ভালো রাজনীতি বুঝত না। ওর ভেতর প্রেম ছিল হয়তো। এটা হয়তো কেবল আমার বোনই বুঝত কিন্তু আমার সন্দেহ হতো। আমি আসলে বোনের ওপর আস্থা পাচ্ছিলাম না। আমি বোনকে আমার মতো করেই চাইছিলাম। সে রাজনীতি করুক, কিন্তু অন্যভাবে। সারাক্ষণ দল, কাজ, মিছিল এসব করতে করতে বোন আমার শুকিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে এসেই ঘুম। নয়ন মাঝে মাঝে ফাঁকি দিত। ওর অন্য রকম কিছু বন্ধু ছিল। ও আসলে দলের বাইরেও একটা ভালো সময় এনজয় করত। আমার বোন নয়ন আর দল ছাড়া অন্য কিছু বুঝত না। আমি আর কলি শঙ্কিত হয়ে পড়ি। ওকে নিয়ে আমরা আলাপ করি। আমি নয়ন সম্পর্কে কাকলিকে জানাই। নয়ন আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না কাকলি। আমি বুঝতে পারি নাই আমার এই ছলনার কী পরিণতি হতে পারে। দিন কয়েক পর কাকলি এক সন্ধ্যার পরে বাসায় আসে যখন সে কারুর সঙ্গে কথা বলে না। কান্নাকাটির ছাপ তার চেহারায়-চোখে-গালে নোনা দাগ। আমি বুঝতে পারি, নয়নকে ফোন দেই, নয়ন বলে সে কাকলিকে থাপ্পড় দিয়েছে। আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয় নয়ন। সে ভেবেছিল আমি তার রাজনৈতিক ক্ষতি করব হয়তো। নয়নের ধমকের সুর আমাকে আঘাত করে। আমি মুষড়ে পড়ি। সারা রাত আমি নিজের বিছানায় শুয়ে থাকি। সেদিন কলি বাসায় ছিল না। সে হলে গিয়েছিল, তাদের কী যেন একটা প্রোগ্রাম ছিল। আমি লজ্জায় আর হীনম্মন্যতায় কাকলিকে রাতে একবার দেখতে যাওয়ার সাহসও পাই নাই। পরদিন সকাল আমি যখন দেখতে যাই অনেক সাহস আর শক্তি সঞ্চয় করে। তখন, তখন, তখন আর কিছুই করার নেই আমার। আমি আজও তার লেখা চিরকুটটা মানিব্যাগে নিয়ে ঘুরি। এই চিরকুট আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার ওড়না গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়ার জন্য কেউ দায়ী নয়। নইলে আমি হয়তো নানা পুলিশি ঝামেলায় ফেঁসে যেতাম। আমি ওই চিরকুটটা সঙ্গেই রেখেছি। যতবার আমার কাকলির কথা মনে হয়, চিরকুটটা আমাকে একটা করে চড় দেয়। আমার বেঁচে থাকাকে এত মারাত্মক উপহাস করে। তোমাকে দেখার পর আমি অনেক অস্বাভাবিক ছিলাম। আমার বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছিল কাকলির কথা।’

লোকটা বোধহয় কাঁদছে। কিংবা কাঁদার উপক্রম হচ্ছে তার। মাথা নিচু করে আবারও ফাইল দেখতে শুরু করেন তিনি। এতক্ষণ আমার দিকে তাকায়া থাকা তার ছলছল চোখজোড়া মসৃণ টাকটায় লেগে আছে যেন। আমার হুট করেই কাকলির চেহারাটা মনে পড়ে। সেদিন পার্টি অফিসে ওঠার সিঁড়িতে কাকলির সঙ্গে আমার দেখা হইছিল। ও হুড়মুড় কইরা নামতেছিল। আমি ওর কাঁধে হাত দিয়া দাঁড় করাই। আমার দিকে না তাকায়া কথা বইলা যায় কাকলি। ও আমার গায়ে হাত তুলছে, ভাইয়ারে অশ্লীল গালি দিছে, আমি ওরে খুন করব। বইলাই আমার হাত থিকা ছুইটা আবার দৌড় দেয়। এরপর আর জীবিত কাকলির দেখা আমি পাই নাই। শাহেদ রহমান জানেন না কাকলির মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী না। দায়ী এক পার্টি নেতা। সেই নেতা কাকলিরে প্রেমসহ যৌনতার অথবা প্রেমহীন যৌনতার অফার দিছিলেন। নয়ন এসব নিয়া কাকলিরে অনেক বাজে কথা শুনাইতেছিল। শেষদিকে কাকলির আর বাঁধ মানে নাই। আমি এ সব ঘটনা পরে শুনছি। আমার কিছু করার ছিল না। আমি দলটাও ছাড়তে পারি না। কারণ মনের ভেতরে-বাইরে আমারও সংকট আছে। আমি মানি, বিপ্লবের প্রয়োজনে এমন ক্ষুদ্র বিষয় এড়ায়া যাইতে হয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ হইতেছে মূল উদ্দেশ্য।

এখন ঝুঁকে থাকা শাহেদ রহমানের কপালে ছল ছল চোখজোড়া নিয়া কাকলি বিরস বদনখানি ঝুলায়া রাখছে। আমি আর দাঁড়াই না। স্বয়ংক্রিয়ের মতো আমার হাত জামার পকেটে ঢুকে যায়। সন্তর্পণে পাঁচ শ টাকার নোটটা রেখে দিই। বের হয় আসি অফিস থেকে। আজ আর বিক্রি করা হবে না। শাহেদ রহমান আমাকে ক্লান্ত কইরা দিছেন। আমার মাথায় কাকলি-বিপ্লব-রাজনীতি এতকিছু ঘুরতেছে যে কাল রাতের জ্বর আইসা হাজির হইছে শরীরে।

রাস্তায় আসতেই চোত মাসের রোদ আমারে ঝাপট মারে। হাঁটতে হাঁটতে বাটা সিগন্যালের মোড়ে আইসা হাজির হই। একটু পর কায়সার আসে। বাকি দুইজনের টাকা আর অবিক্রীত পত্রিকা নিয়া আসছে সে। অফিসে গিয়া সব হিসাব-নিকাশ বুঝায়া দিয়া আমি হলে যাব। গোসল-টোসল কইরা কী করব, আইজ হাকিম চত্বরে আড্ডা দেয়া যাবে। অন্য অনেক আগেই চইলা গেছে। ও কি ফ্রি থাকব। ওর লগে আড্ডা দিতে পারলে ভাল্লাগত। কায়সারের কাছ থিকা সব বুইঝা নিয়া আমি পল্টনের বাস খুঁজি। হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ শ টাকার নোটটারে মনে পড়ে।

শাহেদ সাহেব, কাকলি, নয়ন, তাদের হাসিকান্না সব কেমন পাঁচ শ টাকায় পরিণত হইছে, আমার পকেটে আইসা আশ্রয় নিছে। আমি পকেটে হাত দিয়া রাখি। পাঞ্জাবির পাতলা পকেট। অনেক টাকা। তার মধ্য থেকে আমি পাঁচ আঙুলে ওই পাঁচ শ টাকার নোট খুঁজি। সব টাকাই এক, খালি ইতিহাস ভিন্ন। ভরদুপুরের রোইদ আমারে নেশাগ্রস্ত কইরা দিতাছে না তো। শিশু পার্কের পাশ দিয়া বাস ছুইটা চলতেছে। কৃষ্ণচূড়া ফুটছে, লাল কৃষ্ণচূড়া। আর আমার মাথায় চোতের আগুন জ্বলতেছে, জ্বর ঘোলা চোখ। লাল আগুন চোত মাসের রোদে দাউ দাউ কইরা জ্বলে। আমার দিনের বাকি সমস্ত ঘটনা লাল আগুনে পুইড়া যায়। কাকলিও, এই আগুনে সে ঝাঁপ দিছিল। লাল আগুনের একটা নেশা আছে। কাকলি, শাহেদ, নয়ন, দল, পত্রিকা, পাঁচ শ টাকা সব কৃষ্ণচূড়ার ভিতরে গিয়া কেমন একটা লাল আগুন জ্বালায়া দিছে। তাদের জ্বালানো আগুন আমার চোখে ধিকি ধিকি জ্বলে। এই আগুন কত বছর ধইরা জ্বলতেছে। এই বাস, বাসের ভেতরের মানুষ, তারা কি দেখে এই আগুন। না কি বৃথাই জ্বলে এই লাল আগুন। কিন্তু আমার যে চোখে লাইগা গেছে এই আগুন। মানুষের জীবনে আর কিছু না হোক, দুই-একটা দিন আসে, লাল আগুনের দিন। লাল আগুনের আঁচ আমার চোখে লাগে, লাইগাই থাকে। পার্টি অফিসেও আমি লাল আগুন চোখে মাইখা হাজির হই। নেতা আমারে কী যেন জিজ্ঞেস করতে গিয়াও করেন না। হলে ফিরবার পথে অন্যরে মনে পড়ে। আমি অন্যরে ফোন দিই। পকেট থেকে ফোন বাইর করি, অন্যর নাম্বারে ডায়াল করি। রিং হয়, ও ধরে না।

**এপ্রিল ২০১০**

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত