ডাঙ্গার খোঁজ

(এক)

শ্যাওলা ধরা পুকুরটায় সুখীর পড়ে যাবার আগে আগে। একদম কোন কিছু টের না পেয়েই জন্মের রঙ আর মইরা যাওনের রঙ নিয়ে কিছু জ্ঞানের কথা বলছিল রাশেদ। কামরাঙ্গার ডাঁট চিবুতে চিবুতে। অন্যদিকে সুখী বলতে চেয়েছে জনম আর মরণ এদের কারো কোন রঙ আসলে হয় না। কিন্তু রাশেদ সায় দেয় না তাতে। জঠর ছেড়ে আসার পর পরই সে তো চোখ মেলেছিল আর আসমান ভাসানো কাজল মেঘের রঙ দেখে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল! ড্যাব ড্যাব করে ছাই পিতলের চাষবাস দেখছিল মাচানের ফুটো দিয়ে, তাদের আঁতুড় ঘরটায়। মফির দাদী তাই বলে, ভাঙ্গাফুফুও।

ভাঙ্গাফুফুর আর কোন নাম আছে কিনা জানা নেই রাশেদ কিংবা সুখীর। তারা কেবল জানে বহুদিন আগে আগাছার জঙ্গল, এলোপথের চিরুনি আর ঢ্যাপানো বরষা পার করতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু চাঁছাছোলা বাঁশের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বেগুন টোকানোর উত্তেজনাটা কপালে মোটে সইলো না। পানি মেশানো কাদায় সাঁতলে উঠেছিল হাড় গোশত। হাঁটুর বাটিও যেন সরে গিয়েছিল এক ছটাক। তো গুণগুণ গলায় সেই ভাঙ্গাফুফু জানিয়েছিল রাশেদের জন্ম মুহূর্তের নিস্তব্ধতার কথা। চাটাইয়ের ধামা বুনতে বুনতে। বিরানদিঘী থেকে যেন তখন স্মৃতিগুলো উঠে আসে লেপটানো শরীরে। পানি ঝরে ফোটায় ফোটায়। ভাঙ্গা ফুফুর ক্ষয়িষ্ণু আঙুলের ওঠা নামায়, নোখের কাদায় রাশেদের সেই মেঘের রঙ গিয়ে দাঁড়ায় ডাস্টারে ঘষা স্লেটে। রাশেদ তখন মনের মধ্যে জোর পায়। ফিরতি পথে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতেও আকাশে তাকায়, তাকাতে গিয়ে বেভুলে ফসলে নেমে যায়। ভুল ভাঙলে চট করে আবার উঠে পড়ে ক্ষেতের সীমানায়। আর তুলোমেঘ- মালাইমেঘ- হাওয়াই মিঠাই মেঘদের বড় গরাসে মেটে মেঘেরা যখন খায়, রাশেদের নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ে, বুকের ভেতরে দোলে ডমরু।

এইসব শুভক্ষণে বিড়বিড় করে চাইতে হয় সব না পাওয়া। নদীর বুকে, ঘাসের বুকে, আকাশের বুকে যার যেমন জন্ম রঙগুলো ফিকে হয়ে যাবার আগেই চাইতে হয়। স্বপ্নে দেখেছে মফি। সেই সূত্র শিখিয়ে দিয়েছিল কেবল রাশেদকেই, তাদের শিশুশ্রেণীর বারান্দায়। পাঁচ ক্লাসে উঠে এখনো মফি সূত্র ভাঙ্গেনা। মফির অবশ্য জন্ম রঙ লাল। রক্তের জটলার মধ্যে ছটফট করতে করতে মরে গিয়েছিল তার মা। ভাঙ্গাফুফু, আতিক কাকা, রুস্তমের নানী যদি নাওও জানিয়ে দিত তবু সব মনে থাকতো তার … সওওব। টান করে ধরা বকরির গলায় দায়ের কোপেও ভুসভুসিয়ে ওঠে স্মৃতির গ্যাঁজলা। মফি তখন চোখ বন্ধ করে আকুলি বিকুলি চাইতে থাকে। রোদ চশমা চায়, গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট চায়, গুঠিয়ার সন্দেশ কিংবা লেচু শাহের দধি চায়, মোবাইল ফোনে গান দেখতে চায়, লালে ডুবে মরা মা ফেরত চায়। দু হাত তুলে বদদোয়াও করে এন্তার। ‘আল্লাগো! তুমি নয়া আম্মার জিবলায় ঘাও দ্যাও, একছের মিত্যা কতা য্যান না কইত পারে, কাইজ্জা বাজাইতে না পারে… লগে মোর আব্বার আত পাও লুলা কইর‍্যা দেও, মোরে ক্যাল পিডাইতে য্যান না পারে!’

রাশেদ জানে সেসব খবর। নারহইল পাতার বাঁশি বাজিয়ে বাতাস এসে চটচটে ঘাম বয়ে নিয়ে যায় যখন, মেঘের ভারে আকাশ বুঝি নেমে আসে আসে পায়ের কাছে, রাশেদের কুচি চুলগুলো উড়ে উড়ে পুরো শরীর ধরে তাকেও নিয়ে যায় কোথাও। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে ছেলেটা, কে জানে অলীক কোন সুখে! তার চাওয়াগুলোর খবর কেউ জানতে পারেনা। মফিও না। গোপন কোন চিঠি যেন, মেঘের খামে ঠেসে পুরোপুরি সীলগালা।

(দুই)

বাতাসে দুলে ওঠে ধানী জমি। তার মধ্যে চিরচেনা তোতা কিসিমের ছেলেটাকে ঠায় দাঁড়িয়ে কীরকম চোখ বোজা আওয়াজ ছাড়া হাসি হাসতে দেখেছিল সুখী। তাদের পালা গোলগাল অবাধ্য মোরগ দুটোকে বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল কাঁচা রাস্তায়। বাম দিকে চোখ পড়তে দেখে কতগুলো মাথাল নড়ছে দ্রুত, বৃষ্টির ভয়ে। ঠিক একটা কাকতাড়ুয়া হয়েই কেবল অনড় ছিল রাশেদ। সুখীর শঙ্কা হচ্ছিল, মনে মনে কে যেন বলে ওঠে, এ্যাকছের তুফান ছাড়ছে! ওই দ্যাক কোলার মইদ্দে খাম্বার লাহান খাড়াইয়া রইছে! আচুক্কা মাতার উপর ঠাডা পড়লে বোজবেয়ানে!

সুখী রাশেদের একদিনের বড়। লম্বাতেও একটু বড়। স্বভাবে সে বড় হতে চায়। নিত্যদিনের সাংসারিক কাইজ্যা- কের্তোনের ভেতর ধীরমতি আর মন হু হু করা মেয়ে সে। ভীতুও। কান্নার উপলক্ষ্য হলে সকলের অলক্ষ্যে কোথাও চলে যেতে চায়, বাঁশঝাড়ে বসে টিপটিপিয়ে কাঁদে। রাইসুল, বকেয়া, মফি, বাচ্চু,পারভীন, রাশেদদের সাথে বৈকালিক খেলাধুলায় বরাবর হারে। কখনো নিজ দোষে, অন্যের জালিয়াতির শিকার হয়ে কখনো, আবার শান্তি বজায় রাখার জন্য স্বেচ্ছায়।

মফি রাশেদের রহস্যময় সঙ্ঘে সুখীর ঢুকে পড়তে ইচ্ছে হয় খুব। কিন্তু তাকে নেয়া হয়না। কারণ হিসেবে সুখীর সামনে এসে দাঁড়ায় তার কোন জন্ম রঙ না থাকার বিষয়টা। বকেয়া, বাচ্চু কারোর এ ব্যপারে কোন মাথাব্যথা নেই। ওরা বলে, বোগদা ছ্যাম্রারা কী কয় না কয়! মার কাছে ঘুমুতে যাবার আগে প্রায়ই জানতে চায়। মা কুপির আলো একটু বাড়িয়ে দাঁতে সুতা কাটতে কাটতে বলে,
তোমার বাবায় গ্যালহে ঢাহা। হারা রাইত খাডের তলে বিলইর ছাও ম্যাও ম্যাও হরতে আছিলে, মোনে লইছিলো পাছাড় দ্যা মারি। সইজ্য হরলাম, বেইন্নাকালে হাগ টোহাইতে গেছেলাম নামায়, ও মোর খোদা! খাইলাম পাছাড়। খাতা – কোম্বোল প্যাচইয়া হুইয়া কানতে আছিলাম বাঙ্গা মাজার বিষে। তোর ছোড কাহা কাকি আছেলে গরে। হ্যারা শিক্কিতো মানু। ভ্যান ডাইক্কা লইয়া গেলহে মেডিকোলে। মাজার ব্যতায় উদিশ পাইনাই। এক্কালে মেডিকোলে নাইম্যাই হুনি তোর কান্দোন।

‘হেইকালে মুই পেরথমে কোন রোংডা দ্যাকছিলাম মা?’ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায় সুখী। এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে একবার করেওছিল কিন্তু মা বিরক্ত সুরে বলেছিল ‘ছেমড়ি কী কয় না কয়!’

সুখী মাকে বড় ভয় পায়। শক্ত পোক্ত মাটি ছানা হাত মায়ের। রেগে গিয়ে গালে পিঠে চোপাড় বসালে এই রাত্তির বেলায় বাঁশঝাড়ে যাওয়া যাবেনা। শীত নেই অত তাই লেপ কাঁথার বালাই নেই যে মুখ ডুবিয়ে কাঁদবে একটু। তিলতেলের গন্ধে ভেজা চ্যাপটা বালিশে শুয়ে সুখী তার অচেনা রঙের কথা ভাবে প্রায়ই। তখন ঝটকা মেরে রোমশ এক দাগ এসে দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। গৌরনদীর ভয় নৌকার কথা মনে পড়ে। হিসহিসিয়ে ওঠে দুটো পুঁতির মতন চোখ – ফুলে ওঠা দাঁতাল মাছের আঁশটে গন্ধে আগাগোড়া শরীর ভিজে যায়। নিজের এখানে ওখানে ছুরি চালালে বুঝি শীতল হওয়া যেত।

মায়ের উদরের দিনগুলোর মত গুটিসুটি মেরে এরপর সুখী ভাবে তার কাহা কাকীর কথা। তারা এখন থাকে খানিক দূরে- সদরে কোথাও। তাদের সাথে অত দেখাও হয়না প্রশ্ন করাও হয়না। ভাঙ্গাফুফুর থেকে যে কিছু জানতে পারবে উপায় নেই। পাছাড় খেয়ে মেডিকেলে যেতে হয়েছিল মাকে, নাহলে হয়ত আঁতুড় ঘরেই জন্ম হত তার, আর বাকিদের মতন, পাড়াপড়শির নাগালের ভেতর। রঙটা তার জানার খুব খুব দরকার। একজনের খুব ভয়ঙ্কর শাস্তি হোক চায় সে।

(তিন)
শ্যাওলা ধরা পুকুরটায় সুখীর পড়ে যাবার আগে আগে। কথা ছিল রাশেদ বড় গাঙ্গে মাছ ধরা দেখতে যাবে। এক্কেবারে একা, মফিকেও নেবেনা। লন্ঠন জ্বেলে মাছ ধরাদের পিছু নেবে সন্ধ্যাবেলা। রাশেদের চাপা উত্তেজনায় গোপনে রাখা প্রভূত প্রার্থনা উদোম হয়ে পড়ছিল একটু একটু, সুখীর মত কেউ খুব করে খেয়াল করলে ঠিক দেখতে পেত। সীলগালা খামটা তার কে জানে আসমানে হয়ত পৌঁছে গিয়েছিল। কাজলা মেঘই হয়ত ডাকবাক্সে পৌঁছে দিয়েছিল কিংবা ঘুড়ি ছেঁড়া নাটাইটা।

সুখীর চোখে ভাসে মফির সৎ মায়ের গোর হয়েছিল ভরা বর্ষায়। পানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে অমন ডবকা মানুষটাকে ঠিকানায় পৌঁছে দিতে মেলা কষ্ট হয়েছিল বাহকদের। সৎ বোনের সাথে বাবার অপরিচিত বুকের আদরে বসে মুখরা মফি চুপ মেরে গিয়েছিল কেমন। ভয়ের কেমন ছাপ ছিল চোখে মুখে।

কুশি কুশি মেঘের সেই দিনটায়। নৌকার পাটাতনে আকাশমুখী শোয়া রাশেদের কপালের কুচি চুলগুলো। বেদম হাওয়া লেগে খুব তোলপাড়। আর কামরাঙা গাছের পাতাও সবুজ ভীষণ। কচুরিপানার ফুল তুলতে তুলতে সুখী করুন গলায় জানতে চেয়েছিল,
যেই মনুগো জন্মের কালে রোং অয়না হ্যারা যেইয়া চায় হেইয়্যা পায়না?
বিরক্ত মুখে রাশেদ জানায়,
দিলি আউলডা বান্ধাইয়া! এ্যড্ডু বাবতে আছেলাম, দেছো ত নউকার তলা ফুডা হইর‍্যা!
সুখী তার ছোট হয়ে আসা আকাশের দিকে একবার দেখে। মফি বলছেলে মরণের রোং আছে হেইলে?
হেইয়া ত আছেই। জম্মের কালের, মরণের কালের; হগল সোমায়ের রোংই আলহে। কেউ ঠিক পায় কেউ পায় না।

(চার)
শ্যাওলা ধরা পুকুরটায় সুখীর পড়ে যাবার কালে। পালা অবাধ্য গোল মোরগেরা পথ চিনে নিতে চাচ্ছিল তাদের কক কক কক শব্দে। মফিদের বাড়ির জানালার পাল্লাটা ভেজানো। পুরনো কাশির শব্দ সেখানটায়। বাঘমতি শীত সামনে। ঘাটলায় বসে বরশীতে টোপ গাঁথে রাশেদ। উজান ভাটির গুণগুণ শোনা যায়। ভাঙ্গাফুফু কার জন্য যেন থানকুনি ছেঁচে ছেঁচে সারা হচ্ছে ক্লান্ত উঠোনে। দুর্বল হাতে ছন্দ পতন ঘটে ঠক ঠক ঠক কাঁকুরে শব্দের। ওশ্যাঘরের কাজ গোটাচ্ছে সুখীর মা। ছাইচাপা ধোঁয়ার ঘ্রাণ। মুড়িসুড়ি দিয়ে পুরো পাড়াটা ঘুমিয়ে পড়বে আর একটু পর।

সুখীর স্মৃতিতে কোন আগমনী রঙ নেই। তবে মস্ত দাগ আছে রোমশ রোমশ। সে চায় কারো ভয়ঙ্কর শাস্তি হোক।

রঙ খুঁজতে খুঁজতে সুখী আর ফেরালো না নিজেকে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত