অহনা কথা বলে না

মিমি

প্রচণ্ড শীতের বাতাসে একটা আলাদা ঘ্রাণ থাকে। সবাই পায় কিনা জানিনা। আমি পাই। ইমরুলকে বিয়ের পর পর জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ব্যাপারে। সে পাঁচ সেকেন্ডের মত বাইরে মাথা বের করে তারপর কষে জানালাটা বন্ধ করে দিল। খুব সিরিয়াস গলায় বলেছিল, নাক মুখ বরফ হয়ে গেছে। টোকা দিয়ে দেখ টং করে শব্দ হয়, তাই মনে হয় ঘ্রাণ জায়গামত পৌঁছাচ্ছেনা। স্যরি মিমি, আমি কোন ঘ্রাণ পাচ্ছিনা!

পাশের বাসার এমিলিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। দেখি। আসলে এই দেখি পর্যন্তই। আমার হাতে অত সময় নেই এইসব অনুভূতি, ঘ্রাণ, বাতাস টাতাস নিয়ে গল্প জুড়ে দেয়ার। অহনা জীবনে আসার পর থেকে আমার দিন রাত সব এক হয়ে গিয়েছে। তবু পুরনো খেয়াল মাথায় চাপে হঠাৎ হঠাৎ। অহনাকে আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে ঘরের সব জানালা খুলে দিই, আর শীত বাতাসের ঘ্রাণটা একদম হৃদয়ের শেকড় থেকে নিই। কী অসম্ভব ভাল লাগে আমি বোঝাতে পারবোনা! আমার ডেকে ডেকে সবাইকে ঘ্রাণ নিতে বলতে ইচ্ছে করে। সবার নাসারন্ধ্র নিশ্চয়ই ইমরুলের মত বরফবান্ধব না। এখানে অবশ্য আমার খুব বেশী সবাই নেই। বুড়ি এমিলি, বেকারীওয়ালা জরিস আর সব্জীদোকানের নেদা ছাড়া আমাদের নতুন এলাকার কাউকে আমি তেমন চিনি টিনি না। আর আমরা খুব বেশীদিন হয়নি এখানে এসেছি। তিন মাসের বাবু কোলে নিয়ে এসেছিলাম- বয়স এখন কত হল? ছয় মাস? ছয় মাসই তো। এখনই তো একা একা উপুড় হবার কথা, হিজিবিজি কথা শুরু করার কথা।

মেয়েটা ওর বাবার মত অলসের ঝাঁ হয়েছে। ঘুমপ্রিয়ও হয়েছে। পড়ে পড়ে শুধু ঘুমায়। এই যে এখন এই অবেলায় হা করে ঘুমুচ্ছে। আমি ঘুম থেকে তুলে খেলনা সামনে এনে দিলে তবে যদি মহারাণীর মর্জি হয়। বেবীকট থেকে তুলে এনে ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করছে খুব। ইচ্ছে করছে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতে, অ্যাই মা! তুমি কি বাতাসের ঘ্রাণ পাও? শীত বাতাসের? কিন্তু থাক। ঝামেলা করে লাভ নেই। হুটহাট বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলতে নেই। বুক ধুকপুক করবে।

ইমরুল

আজকে যে আমি অফিস ফাঁকি দিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে আছি, মিমি জানে না । রাস্তার ওপাশেই হাসপাতালের আলোগুলো জ্বলে উঠবে। ফিনাইলের গন্ধ মাখা আলো যেন। কাঁচের দরজায় আবছায়া দেখা যাবে যীশু কোলে শ্বেত পাথরের মাতা মেরী। তারারা ভাসবে আরও কিছু পরে। হিম বাতাস গায়ে লাগে। কেঁপে উঠি। মন ভালো না। সাধারণত মন ভালো না থাকলে আমি এখানে আসি। এই বেঞ্চ খালি পেলে বসি নাহয় অন্য বেঞ্চে বসি। দেখি। মানুষও দেখি। মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে আমি খুব যে আনন্দ পাই তেমন না ব্যাপারটা। এই যেমন সামনে বসে দুই বৃদ্ধ দেশ-সমাজ নিয়ে টক শো করছে; আমার আনন্দ লাগছেনা। কিন্তু ওই বিকেলটা চোখের সামনে বারবার আসে।

বিকেলটা এখানেই আসে, তাই উপায়হীন হয়ে আমি আসি। যে মনে করার সে মনে করতেও পারে এই এখানেই বুঝি মিমির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, অথবা আমি ওকে ম্যারি মি এই বেঞ্চের আশে পাশে বসেই বলেছিলাম। এই মনে করা পুরোপুরি ভুল। এখানে আমি আর মিমি প্রথম এসেছিলাম অহনা যখন মিমির পেটে সারাক্ষণ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকত। এক গ্রীষ্মের বিকেলে আমরা সেদিন এদিকটাতে বসেছিলাম। পার্কটা বড্ড গলাবাজ থাকে। সারাক্ষণ এখানে কেউ না কেউ কথা বলছে, জগিং করছে, খেলছে, খেলার ধারাভাষ্য দিচ্ছে। শুধু আমরাই চুপচাপ ছিলাম। আমি চুপ করে আমার প্রথম প্লেনে ওঠার কথা ভাবছিলাম। মাঝখানের আইলে দুই পাশে দুই বিরক্তিকর সহযাত্রী নিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়েছি ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল তবু সাহস করে সিট চেঞ্জের কথা বলতে পারিনি। আমার সাহস বরাবরই কম। আমি ভীতু মানুষ। ভীতু মানুষেরা অনেক সময় বিনা চিন্তায় এমন এমন কাজ করে ফেলে যেটা করতে গেলে মহাবীরেরাও বেশ অনেক সময় নিতেন, সময় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন, মন শক্ত করতেন।

বাম পাশের বুখারেস্টগামী ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জারের মাতাল মুখের গন্ধ স্মৃতির বুকে আস্ত কুঠারাঘাত করার সাথে সাথে সেদিন টের পেয়েছিলাম মিমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। অহনার তখন সাড়ে তিন মাসের কিছু বেশী চলে। আমরা নামও রেখে ফেলেছিলাম। অহনা। কেন রেখে ফেলেছিলাম কে জানে। চাইনি সন্তান সন্ততি নিয়ে আগাম এত কিছু ভেবে ফেলতে। কিন্তু; হয়ে গেল।

চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতাম একটা কোঁকড়া চুলের ছোট্ট মেয়ে মন খারাপ করে টেবিলের নীচে বসে আছে। বাসার গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু যেমন চাবি; ওয়াশিং মেশিনের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল। ধরা পড়ে গিয়ে মায়ের কঠিন বকা খেয়েছে। অপেক্ষা করছে বাবার ফেরার। ফিরলেই ঝপ করে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কি গান শোনানো যেতে পারে সেটাও অবচেতন মন বলে দিত। অন্তরা চৌধুরীর বুলবুল পাখির গানটা।

কোন গাছে কোথায় বাসা তোদের
ছোট্ট কি বাচ্চা আছে তোদের?

লাইন দুটো একটু উঁচুতে উঠিয়েই গাইতে হয়। ওঠাতে গিয়ে গলা বেশী চড়ে গেল বোধহয়। ওই দ্যাখো, কী কাণ্ড! বুড়োরা টক শো বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! হেঁড়ে গলায় ভীনদেশী গান বুড়োদের স্তব্ধ করে দিয়েছে।

মিমি

ইমরুল কিন্তু খুউব খেতে ভালবাসত। এক বাটি স্যুপ নুডলসও ও যে কি রুচী করে খেত! আহারে! অহনার কারণে অনেকদিন ওর জন্য যত্ন করে রাঁধা হয় না। আজকে তাই ছোট বাচ্চা সামলে সুমলে আমি অনেকগুলো খাবার রাঁধলাম। সারপ্রাইজ দেব প্ল্যান করেছি তাই ঘুণাক্ষরেও কিচ্ছু বলিনি। আবার এমিলিকে বলেছি ডিনার করতে। বিকেল থেকে এসে বসে আছে। এখন অহনাকে কোলে নিয়ে রাজ্যের রুপকথা শোনাচ্ছে। আমি বলেছি একটু জোরে শোনাও প্লিজ, কিচেন সাফ করতে করতে আমিও শুনি। সেই কবে ছোটবেলায় মা শোনাতো!
ঝুঁটির দাড়ি রাজার ছেলের গলপ!

ইমরুল

বাসটা বেশ ফাঁকা। ইদানিং আমাকে মিমির রোগে পেয়েছে। মাথার ভেতরে ভেতরে চিন্তার প্ররোচনা, ফিসফিস, সিম্ফোনিয়া ক্রমাগত। এই সিম্ফোনি কিছুটা লাইটমোটিফ। বাতাসের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত রাস্তা আর আমার চারপাশে একই সুরের আদিমতম আখ্যা। আমি চিন্তাকাতর ছিলাম না কখনোই তেমন, আর মেজাজটাও চড়ে যেত না হুটহাট। মিমির টেক্সট পেয়ে সেল ফোনটা আছাড়ে ফেলে দিতে এই যে ইচ্ছে হচ্ছিলো কিছুক্ষণ আগে, এই ইচ্ছেগুলোকে চিনি না আমি। জানালায় প্রতিবিম্ব পড়েছে আমার। অস্বচ্ছ। চোখ পড়লেই চিনে নিতে পারা যাচ্ছে না। আমার দর্শন সবসময় ছিল মাটি। সকল রিপু সমাহিত হবে মাটিতে, বন পেরিয়ে, জল পেরিয়ে, হাওয়ায় ভেসে ছাই হয়েও তো। আমার সকল কাম, ক্রোধ, কৌলীন্য, ঈর্ষার বুদবুদ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ফিনিক্স সেন্টারের স্টপেজে নামার কথা ছিল আমার। টিকে মাক্স- যালান্ডো খুঁটে খুঁটে দেখার কথা। মিমির পয়েন্ট পয়েন্ট করে লিখে দেয়া হাল্কা কমলা দেখে বাচ্চার জামা কিনে বাসায় ফেরার কথা, জুতো কেনার কথা ক্লিপ কেনার কথা।

কিন্তু রিপ্লাইতে লিখেছি, “বেটার ইউ গো উইথ দ্যাট। দ্যাট নিডস ফ্রেশ এয়ার।” তারপর অনেক অনেক জোরে সেল ফোনটা পকেটের ভেতরে ফেলে দিয়েছি। আমার আজকাল মিমিকে সহ্য হচ্ছেনা। কাউকেই সহ্য হচ্ছেনা। আর ওটা ড্যাব ড্যাব করে যখন আমার দিকে চেয়ে থাকে তখন আরও বেশী না। মিমি জেদ করে ওটাকে দু জনের মাঝখানে ঘুম পাড়ায়। ওটার নরম উজ্জ্বল শ্যামলা হাত পা যখন আমার গা ছোঁয় তখন ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। একদম পিষে ফেলতে ইচ্ছা করে! মিমি মরেই যাবে তাই ইচ্ছেটাকে জোর করে চেপে রাখি। কে জানে কিছু প্রেমের কেন প্রয়াণ হয় না কখনো।

মিমি

নাহ! সবকিছু এখন থেকেই নিয়মে বেঁধে ফেলতে না পারলে পরে দুর্ভোগ হয়। ইমরুলের দেরী দেখে এমিলি সামান্য একটু খেয়ে চলে গেল। আমি খাইনি। তবে অহনাটা এমিলি থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ার ওর এই অভ্যাস আমি ধরে রাখতে চাই। রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকা বাচ্চাদের সকালে উঠে স্কুলে যেতে অনেক কষ্ট হয়। আমি একটা বড় মানুষ, এই আমি যখন অর্ধেক রাত দোকানে ডিউটি দিয়ে বাড়ি ফিরে আবার শেষ রাতে বেরোতাম ভোরের ক্লাস ধরার জন্য, ক্লাসে ঢোকার পর কি আমার পড়ালেখা করার কোন অবস্থা থাকতো? কী ভয়ঙ্কর সময় ছিল তখন!

ঠিক এমনই এক সময়ে তুমি এসেছিলে অহনা! তোমার আসার খবর পেয়ে সারাটা রাত কেঁদেছিলাম। ভয়ে। নানান আশঙ্কায়। তোমার বাবা পেল অতিরিক্ত ভয়। সে ভীতু মানুষ। বেশী ভাবলে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনা। তাই একদম আগ পিছ না ভেবেই আমাকে একদিন দুম করে বিয়ে করে ফেলেছিল। ভাবাভাবি করলে যদি বিয়ের সাহস উবে যায়! আমি কিন্তু মোটেও ভীতু না। কিন্তু আমিও কেন ভাবনা চিন্তা ছাড়া দুম করে ওকে বিয়ে করে ফেললাম? বেশী সাহস আর বেশী ভয় একসাথে মিলে কিরকম তালগোল পাকিয়ে ফেলল বলোতো?

ইমরুল

পালিয়ে বাঁচতেই বাসা বদলাতে হল। মিমি রাজী ছিল না। এটা সেটা বলে রাজী করিয়েছি। যেন সব হারিয়ে ফেলা কিংবা না পাওয়ার দোষগুলো ছিল শাদা রঙ দেয়ালের। বারবার বাজে গ্রেড পাচ্ছিলাম। বারবার বারবার। যদি রিকভার করতে না পারি তাহলে লাথি মেরে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দেবে। মিমির গ্রেড অবশ্য মোটামুটি ভালোই ছিল। এরকম হাড়কালি করা কাজ করে, দুই তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে এর চেয়ে বেশী গ্রেড আশাও করেনা কেউ।

আমি পিজ্জা দোকানের ওপরে আর তেমন কাজ পাচ্ছিলাম না। কংক্রিটের খাঁচায় আটকানো শহুরে জীবন পেছনে রেখে আসা এখানে। দিন রাত এক করে বেঁচে থাকা কেমন হয় জানা ছিল না। পিজ্জার দোকানে তেমন সুবিধা করতে পারিনি। ইউনিভার্সিটি লাথি মারার আগে ভুঁড়িওয়ালা দোকানের মালিক মেরে দিল। কাজ খোঁজো কাজ খোঁজো অন্য কোথাও, ভেতরের অনবরত উসকানিতে নাকাল হচ্ছিলাম।

বাসায় ফোন করিনা। আমার এই আকস্মিক অথবা দুঃসাহসিক বিয়ের খবর বাসায় জানাতে পারিনি। মিমির বাসাতেও কেউ জানে না। মিমির বাবা বিশাল এক ব্যবসায়ী পাত্র পছন্দ করে রেখেছিল ওর জন্য। পাত্র যে খুবই টিপটপ আর সারাক্ষণ কমপ্লিট স্যুট পরে ঘোরাঘুরি করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বলছিলো মিমি আমাকে। উইপিং উইলোর নীচে বসে। উইপিং উইলোর হাবভাব আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়াদের মত। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! সময়ের আবর্তে হারিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না কোনকিছু।

স্যুট বুটের ঘনঘটায় মিমির মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছিলো। সে ব্যথা নামাতে এলোমেলো আমাকে একদিন বিয়ে করে ফেলেছিল।

মিমি

তুমি তখন মাত্র এসেছ । কিচ্ছু খেতে পারিনা। কিচ্ছু না। পানিও খেতে পারিনা। পুরো পৃথিবী চোখের সামনে উল্টো হয়ে ঝোলে। রাত বিরেতে দোকানে দাঁড়াতে পারিনা। সেদিন গেলাম মাথা ঘুরে পড়ে। পড়ালেখার নাম শুনলে বমি আসে। বই খাতা দেখলে বমি আসে। মানুষ দেখলেও ঘটনা একই। বমি। তোমার বাবাকে অসহ্য মনে হয়। আচ্ছা, আমি তোমার সাথে খামাখা এত বকবক করছি কেন? তু্মি কি আমার কথা কিছু বোঝো? এখনও পাশ ফিরে ঘুমাতে শেখোনি বাচ্চা! আমার নিজের ছোওট্ট…একদম এইটুক একটা মেয়ে! কবে বড় হবে তুমি? তোমার সাথে গল্প করতে পারার ইচ্ছেটা দিন দিন কত বড় হচ্ছে, তুমি বুঝতে পারো?

ইমরুলের সাথে কথা বলে আমার ইদানিং পোষাচ্ছে না। ও কেমন বদরাগী লোকগুলোর মত ঝামটা মেরে কথা বলে। ও বুঝতে পারছেনা সিরিয়াস অ্যাটিচুট প্রবলেম আছে ওর। এত রাগ, এত রাগ! রাগে পাগলই হয়ে গেল! কোথায় কি রাখে কিছু মনে থাকে না। বাসায় ঢোকার চাবিটাও রেখে দিচ্ছে ওয়াশিং মেশিনের ভেতর! আমার এইটুক বাচ্চার সাথেও আজকাল মেজাজ দেখানো শুরু করেছে! ছোট্ট একটা সোনার মেয়ে! জ্বালায় না, চিৎকার করে না, কাঁদে না। তার সাথে কিসের এত মেজাজ? আজকে দ্যাখো মা, কিরকম দায়সারা রিপ্লাই দিল! বৃষ্টির মধ্যে আমি এখন তোমাকে নিয়ে বাজারে যাই আর কি! মাথা খারাপ হয়েছে আমার? আর আমি এই গোঁয়ার মানুষটার জন্য তোমাকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে দ্যাখো কতকিছু রান্না করলাম! প্রত্যেকটা ওর পছন্দের খাবার। আমি কি আমার পছন্দের খাবার রেঁধেছি একটাও!

ইমরুল

সবকিছু ভেঙ্গে নুয়ে পড়া দিনটায় মিমির জন্য কেন উতলা হলাম সেসব আবার ভাবতে গিয়ে দেখি ছোট্ট নদীতে তরতর করে আলোর আভাস। সেখান থেকে নাকে লাগে ফিনাইলের গন্ধ। লাইটমোটিফে বিহ্বল লাগে। পথে নেমে পড়া দরকার। মিমি মিমি! তোমাকে ভয়ঙ্কর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। পারিনা-পিছিয়ে যাই। কিছু প্রেমের কোন প্রয়াণ হয় না। জামা আমি কিনবো, ক্লিপও। তবে হালকা কমলা না। লাল রঙের। টেবিলের নীচে যে ছোট্ট মেয়েটা মুখ ভার করে বসে থাকে ওর জামার রঙ আমি লালই দেখেছি। কোঁকড়া চুলে আবার ঝুঁটি বেঁধেছে লাল ব্যান্ড দিয়ে। দেখি খুঁজে দেখি পাই কিনা।

কাল স্লেয়ারের সাথে ক্যানিবাল হলোকাস্ট মুভিটা নিয়ে কথা না বাড়ালেই পারতাম। মানুষ কাঠের মত চিরে ফেলে মানুষকে। মাংসপিণ্ডের ক্ষতে যেমন কোন শোক নেই! বল্লমে ফুঁড়লেও অনুতাপ ফেটে বেরোয় না কোন। ভুলতে চাই ওসব, ভুলতে চাই। তারচেয়ে বরং জামা কেনার দিকে মনোযোগ দিই। কি রঙের জামা যেন? ও হ্যা লাল। বারো সপ্তাহ বয়সে আলট্রাসনোগ্রাম করার সময় আমরা দু জনেই ডক্টরকে একদম একসাথে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ফিটাসের ওপর একটা বিন্দু দেখতে পেয়ে। ওটার রঙ কি লাল ছিলো? মনে করতে পারছি না।

হঠাৎ নিজের বুকের কাছে হাত চলে যায়। এলোপাতাড়ি একটা জিনিস খুঁজি।

মিমি

রাত বাজে নয়টা। ইমরুল ফেরেনি। ফোনও ধরছিল না। আমিও হাল ছাড়িনি। ছ্যাঁচড়ার মত ডায়াল করেছি বারবার। ভাল করেছি না?শেষ পর্যন্ত ঘুঘু ঠিকই ফোন ধরেছে। কিন্তু একটা কথাও বলেনি। একটা কথাও না। আমিও জিজ্ঞেস করিনি তুমি কই? কখন আসবা? কেন যেন বুকের ভেতরের অভিমান দলা পাকিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল। আকুল হয়ে বললাম, ইমরুল এই ইমরুল! অহনা কথা বলে না!

ইমরুল

আমি আসলে সময়ে অসময়ে আমার নিজের হৃদয়টাকে খুঁজি। হারিয়ে ফেলেছি মনে হয়, ওটার কোন অস্তিত্ব টের পাইনা। মিমি যখন উন্মাদিনীর মতো প্রতিদিন নতুন করে অভিযোগ জানায় অহনা কথা বলেনা তখন খুঁজে পাবার বিন্দু আশাটাও হারিয়ে ফেলি।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত