বাবার হুন্ডা

 

আব্বার একটা লাল রঙের বাইক ছিল।সেটা ঠিক কত আগে কেনা বলতে পারব না। আমার স্মৃতিতে যতদূর মনে পরে সেটা ছিল জাপানি হোন্ডা কম্পানির।লাল রঙের বডিতে লেখা ছিল HONDA CD 80 । তখন হান্ড্রেড সি.সি. বাইকের সচারাচর প্রচলন ছিল না।ছিল 80 এবং 50 সি.সি.র বাইক। এত এত বাইক কোম্পানিও তখন ছিল না।আর ঘরে ঘরে সবার বাইক থাকবে এমনটা তখন কল্পনাও করা যেত না।

আমি স্লিভলেস ফ্রক পরে ডায়না কাট চুলে ঝুঁটি বেধে বাবার সাথে হুন্ডার সামনে বসে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম।বাইকের গতিময়তা আর কাপড় চোপড় উড়ানো বাউলা বাতাসে দেহ মন আনন্দে আন্দোলিত হত।নিজেকে উড়ন্ত পাখির ছানা মনে হত। কিন্তু সমস্যা হল কিছুসময় হুন্ডায় চড়লেই বাতাসের তোড়ে চোখ জোড়া ঘুমে ঢুলুঢুলু করত।আমি শরীর শিথিল করে কাদার মত বাবার গায়ে ঢলে পড়ার আগেই কেমন করে যেন আব্বা বুঝে ফেলতেন ব্যাপারখানা ।বারবার ডেকে ডেকে সাবধান করতেন যেন ঘুমিয়ে না পড়ি। মাঝে মাঝে এটা সেটা গল্প করে আমাকে জাগিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন তিনি।

তখন আমাদের টিন আর কাঠের তৈরি দোতালা ঘর ছিল।ঘরের সামনে শান বাঁধানো বৈঠকখানা ছিল।বরিশালের ঘরবাড়িতে সাধারণ ভিটে থাকে উঠানের চেয়ে দুই তিন ফুট উঁচু। প্রতিদিন বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফিরে হুন্ডাটিকে ঘরে তুলে রাখতেন। যেহেতু ঘর ছিল মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু তাই বৈঠকখানার সিঁড়ির মাঝ বরাবর এখটা পুরু কাঠের তক্তা বিছানো হত।বাবা সামনে থেকে জোরেশোরেই ধাক্কা দিয়ে হুন্ডাটিকে উপরে তুলত এবং আমি আর আমার ছোট ভাই শান্ত পেছন থেকে ঠেলে ধরতাম যেন হুন্ডাটি পিছনের ঢলে নেমে না আসে। এটা ছিল আমাদের নিত্যদিনের কাজ।তারপর সেটিকে ঘরে তুলে কাঠের খুঁটির গোড়ায় যে সিমেন্টের কিল্লা থাকে তার সঙ্গে লোহার বিশেষ ছিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত।শুনে এখন হাসি পেলেও তখন এটাই স্বাভাবিক ছিল।সকালে ফের ছিকল খুলে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে হুন্ডাটি বাহিরে নামানো হত।আমার ছোটবেলার সেই কাঠের ঘরের এটিই একমাত্র স্মৃতি যা আমার এখনও মনে আছে।

এরপর বহুদিন গত হয়েছে।সময়ের ব্যবধানে সেই ছোট্ট মেয়ে আমিও অরেকটি মেয়ের মা হয়েছি।সেই পুরানো বাইকটিও এখন আর নেই।আট/দশ বছর আগে সেটি বিক্রি করে নতুন একটি বাইক কিনেছেন আব্বা।নতুন হুন্ডাটিও লাল রঙের। বরাবরই লাল রঙটার প্রতি আব্বার একটা বিশেষ প্রিয়তা রয়েছে।

সেদিন বহু বছর পরে আবার আব্বার সাথে হুন্ডায় চড়লাম। কারন আমার একজন ডেন্টিস্টের কাছে সাক্ষাতের জন্য সিরিয়াল দেয়া ছিল।
বরিশাল মূল শহর থেকে আমাদের বাড়ি হুন্ডায় যেতে পনের বিশ মিনিটের পথ।এই পথটুকু আমার ছোটভাই হুন্ডা চালিয়ে আমাকে অবলীলায় নিয়ে যেতে আসতে পারত।কিন্তু আব্বা ওর সাথে আমাকে ছাড়তে চাইলেন না।যদি ও একটা এক্সিডেন্ট ফ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলে এই ভয়ে।
অথচ আব্বা নিজে যখন কোন প্রয়োজনে দূরে কোথাও যান তখন ঠিকই ওকে সাথে নেন বাইক চালানোর জন্য। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সাহস হয়তো কমে যায়।কিন্তু আমার মেয়ে কে নিয়ে কাছে পিঠে কোথাও গেলে আব্বা শান্তর সাথে আমাদের ছাড়তেই চান না। যদিও বা ছাড়ে তাহলে হাজার বার বলবে ‘সাবধানে চালাস‘ ‘ওভারটেকিং করবি না‘ ‘রিক্সার পিছনে পিছনে থাকবি‘ ইত্যাদি।শান্ত যারপরনাই বিরক্ত হয়। আমি মুখ টিপে হাসি চাপা দিয়ে রাখি। যদিও আমর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি শান্ত অনেক মসৃণ ভাবে ড্রাইভ করে।আমি আর আম্মা দুজনে একজোট হয়ে ওর দক্ষতার ব্যপারে ভোট দিলাম।আব্বা হালকা ধমকের সুরে বলল,দাত তোলা একটা ছোটখাটো আপারেশন।ও পোলাপান মানুষ এসবের কি বুঝবে?
আম্মা বললেন ,ওর বোঝার দরকার কি? শান্ত‘ তো আর দাত তুলবে না। দাত তুলবে ডাক্তার।
আব্বা বললেন, তারপরও আমি থাকলে কোন ঝামেলা হলে সামলে নিতে পারব। ওকে পাঠানোর চেয়ে আমার যাওয়াই ভালো।
আমি আর আম্মা দুজনে চোখ চাওয়া চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসলাম।আব্বার কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমি ছোট বাচ্চা।দাঁত তোলার ছুরি কাঁচি দেখে কান্নাকাটি শুরু করব।তিনি সাথে থাকলে আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে কান্না থামাতে পারবেন।

যাইহোক শেষমেশ আব্বার সাথেই গেলাম।ওয়েটিং রুমে কিছুসময় বসে থাকার পর যখন আমি ডাক্তারের সার্জারি রুমে ঢুকলাম তখন আব্বা পেছন থেকে ডেকে বললেন ভয় পাবিনা , বুঝলি। আমি পাশের রুমেই আছি।কোন সমস্যা নেই।ডাক্তার অবশ করে নিবে, কিছুই টের পাবি না।
কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম।কারন চিরকালই তিনি অতি সাবধানী মানুষ। আব্বার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি নিজেই চিন্তিত। আমার নয় ,তার দাত তোলা হবে।

যাইহোক, ডেন্টিস্টের কাছে থেকে দাত তুলে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বাসায় ফিরছি।রাত সাড়ে নয়টার মত বাজে।গ্রামে এটা অনেক রাত। তার উপর প্রচন্ড শীতে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছে।শীতের রাত বলে রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া কম।লাকুটিয়া বাজারের পর আমাদের বাড়ির স্টেশন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তার মাঝে আর কোন দোকানপাট নেই। দুপাশের খোলা ফসলের মাঠ থেকে আসা হুহু করে কুয়াশাসমেত ঠান্ডা বাতাস রাস্তার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে।সাদা কুয়াশার ধোয়ায় রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে আমারা সিন্দবাদের মত দুষ্টু জ্বীনদের সেই কোহকাফ নগরে ঢুকে পড়েছি।আব্বাও কিছুটা ভরকে গেছেন মনে হয়।নিজেকে শান্তনা দিতে আমাকে বললেন, দেখছিস কি সাংঘাতিক কুয়াশা!
দাতের গোড়ায় তুলা গোঁজা থাকার কারনে আমি প্রতিউত্তরে কিছুই বললাম না। ঠান্ডায় এতটা জমে গেছি যে হুঁ হ্যা পর্যন্ত করতে পারলাম না।

আব্বা ডেকে উঠলেন; এই মুন,মুন……
আমি কোনমতে কাপতে কাপতে হুঁ বললাম।
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ঘুমাইছিস নাকি?
উ- হুম।
যার অর্থ না , ঘুমাইনি। আমি কি বাচ্চা মানুষ নাকি?যে ঘুমিয়ে পড়ব! মনেমনে কিছুটা ত্যাক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারছিলামনা।সম্ভবত অবশ ছেড়ে গেছে।কপালের একপাশ ,মুখ আর গলার ভেতরে একটা ব্যথার অনুভূতি কুন্ডলি পাকিয়ে উঠতে শুরু করছে ক্ষনেক্ষনে।

এরপর আব্বা একমিনিট পরপর আমাকে ডেকে ডেকে পরীক্ষা করছেন আমি ঘুমিয়েছি কিনা।
আব্বা বললেন, ঘুমাইস না।এইতো চলে আসছি।আর অল্প কিছু দূর।
এবার আমি ত্যাক্ত হওয়ার বদলে হেসে দিলাম।গালটা ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল। হাঁসির লাগাম টানতে চোখে এলো জল! আব্বা সেই ছোটবেলার মতই আমার ঘুম তাড়াতে প্রবোধ দিচ্ছেন। আমি কি বাড়ি চিনিনা? আমি কি এখনো ছোট্টটি আছি?
আমি বড় হয়েছি।বাবা বড় হয়নি।
বাবারা বড় হয় না।তারা সবসময় একই রকম থাকেন।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত