তৈমুরের অভিশাপ -৩

তিন.
বারশো এগার খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাস। মধ্য দক্ষিণ চীন।

প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলেছে সর্বগ্রাসী ‘পীত নদী’। সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘের এই ‘প্রাকৃতিক ড্রাগন’ যে কোন দর্শনার্থীর মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। প্রায় একশ কিলোমিটারেরও বেশী পশ্চিমে অবস্থিত বায়ান হের পর্বতে সৃষ্ট এই নদী দু’কূল ছাপিয়ে তার পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
অদূরে ঘন বাঁশবন। আশে পাশের অনুর্বর অঞ্চলের একমাত্র ব্যতিক্রম। যেন প্রকৃতির প্রথাবিরুদ্ধ খেয়াল। বাঁশের কঁচি ডগা পান্ডাদের পছন্দের খাবার হলেও এদিকে তাদের আনাগোনা নেই। তাদের বাস উত্তর পূর্বের দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলে। ফলে নিরুপোদ্রব বাঁশবন ঝকঝক করছে।

বসন্তের শুরুর দিকে চীনের তাপমাত্রা পঁচিশ ডিগ্রীর নিচেই থাকে। বাতাসের আর্দ্রতা পঁয়তাল্লিশ শতাংশেরও কম। তীব্র শীতের সাথে সখ্যতা আর নিবীড় পরিচয় আছে বিধায় বিন্দু মাত্র সমস্যা হচ্ছেনা মোঙ্গল বাহিনীর। এর চেয়ে বৈরী আর জঘণ্য পরিবেশে প্রকৃতির বিরূদ্ধে লড়ে সমৃদ্ধ হয়েছে একেকজন মোঙ্গল সৈনিকের অতীত।
নদীর তীর হতে আনুমানিক কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরে মোঙ্গলদের সামরিক তাবুগুলো ফেলা হয়েছ, এর মধ্যে ‘খান’এর তাবুও রয়েছে। মোঙ্গল রীতি অনুযায়ী তাবুতে কাপড়ের পাশাপাশি খড়ের ব্যবহার আছে। সব তাবু দেখতে একই রকম। খান একদম সাদামাটা জীবন যাপন করেন বিধায় তার তাবুটিকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। শুধু আকারেই যা একটু বড়। অবশ্য তাতে কৌশলগত সুবিধা রয়েছে। দেখতে খুব আলাদা না হওয়ায় শত্রুর দূরবর্তী লক্ষ্যে পরিণত হবার আশঙ্কা কম।

খানের তাবুর বাইরে দু’জন প্রহরী ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ধনুক আকারে ভারতীয় ধনুকের মত খুব বেশী বড় নয় , কিন্তু ছিলার বিশেষত্বের কারণে ক্ষিপ্র গতিতে তীর ছুঁড়তে সক্ষম। প্রত্যেক প্রহরীর তূণীরে অন্তত বিশ থেকে ত্রিশটি তীর রাখা আছে। প্রায় নব্বই সে.মি. দৈর্ঘের তীরগুলি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে একশ পঞ্চাশ গজের মধ্যে থাকা যে কোন সম্ভাব্য শত্রুর জন্য। তীরের গোড়া মঙ্গোলদের ধনুকের ছিলাতেই পড়ানোর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী। ফলে মঙ্গোলদের ছোঁড়া অক্ষত কোন তীর শত্রুরা পাল্টা মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেনা যেহেতু সরু গোড়া বিশিষ্ট তীর মঙ্গোল ধনুক ছাড়া অন্য কোন ধনুকে পড়ানো যায়না। এটি চেঙ্গিসখানের একটি অভুতপূর্ব যুদ্ধ কৌশল। প্রহরীদের টহলের সাথে তাল রেখে হাত আর ধনুক দুলছে বিধায় ক্ষণে ক্ষণে ধনুকে স্থাপিত একমাত্র তীরের ডগাটিতে সকালের মৃদু রোদ লেগে ধাতব মৃত্যু মাঝে মাঝেই সোনালী ঝিলিক দিয়ে উঠছে । অভ্রভেদী করে তোলার জন্য তীরের গোড়ায় পাখির লেজের পালক লাগানো। সাধারণত সারস আর হাঁসের সাদা-কালোর মিশেল দেয়া পালক ব্যবহৃত হয় । শুধু খানের মত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্নদের তীরে ঈগলের বাদামী পালক পড়ানো থাকে। প্রহরীদের কোমরে অবশ্য ঐতিহ্যবাহী মঙ্গোলীয় ছোট আর সরু বাঁকানো তলোয়ার ঝোলানো আছে। নিতান্তাই সাধারণ দেখতে হাতলের তলোয়ারগুলি অসম্ভব ধারালো। সেই ধার মঙ্গোলবাহিনীকে সুদূর মঙ্গোলিয়ার প্রাণহীন চাষের অযোগ্য মালভূমি হতে চীনের সমৃদ্ধ অঞ্চলের দিকে অভিযানে এসে জড়ো হতে সাহায্য করেছে।

ভোর হয়েছে আরও ঘণ্টা খানেক আগে। উত্তর চীনের দুর্গ অবরোধের মাধ্যমে যিন বাহিনীর তৃতীয় সৈন্যদলকে পরাজিত করার পর দক্ষিণে অগ্রসর হওয়ার পথে গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম বিশ্রামের জন্য তাবু ফেলা হয়েছে।
গড় পড়তা মঙ্গোলীয়দের চেয়ে একটু লম্বা আর একহারা গড়নের চেঙ্গিস খান তাঁর তাবুতে ভেঁড়ার পশম দিয়ে তৈরী শক্ত মাদুরের উপর বসে আছেন। হালকা সবুজাভ চোখ আর ঘন মসৃন বড় বড় চুল তার চেহারায় আভিজাত্য এনে দিয়েছে। দেড় ইঞ্চি লম্বা দাড়িগুলি দিচ্ছে সীমাহীন কর্তৃত্বের আভাস। ভেড়ার পশম দিয়ে তৈরী মোটা বুননের মাদুর মঙ্গোলীয়দের জন্য এক ধরণের সৌভাগ্যের চিহ্নও বটে।

একটু আগে একজন সৈনিককে দিয়ে খবর পাঠানো হয়েছে জেনারেল চেনিয়ু লিউর কাছে। জেনারেল লিউ ছিলেন যিন সাম্রাজ্যের একজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। কিন্তু রাজপরিবারের সাথে মত বিরোধের জের ধরে পক্ষ ত্যাগ করেন এবং চেঙ্গিস বাহিনীতে যোগ দেন। তার অপূর্ব রণকৌশল আর যিন বিদ্বেষের ফলেই চেঙ্গিস খানের পক্ষে যিনদের দুর্গে অবরোধ আরোপ করা সম্ভভ হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা এমন একজন সমরবিদ সাথে থাকা মানে আসন্ন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের সমগ্র সামরিক তথ্য ও জ্ঞান নিজের হাতে থাকা।
জেনারেল লিউর ভদ্রতা ও পরিমিতিবোধও খানকে মুগ্ধ করেছে। লিউ খুব বেশী কথা বলেন না এবং যা বলেন তা বেশীর ভাগই বিষয় ভিত্তিক। সোজা কথায় একশভাগ কাজের মানুষ। খান ভাবেন নির্বোধ না হলে কোন রাজকর্তৃপক্ষ এমন একজন গুণী মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়না।

লিউ অনুমতি নিয়ে তাবুতে প্রবেশ করলেন। জেনারেল নিজে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। অন্তত ছয় হাজার সুদক্ষ রাজকীয় সৈনিক নিজ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন। যিন রাজবংশের রাজ্য আর খ্যাতি বিস্তারে লিউয়ের অবদান বহুল প্রচারিত। এতখানি কর্তৃত্ব আর ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেছেন দীর্ঘ সময় তবুও মোঙ্গলদের খানের সামনে আসলেই ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তত বোধ করেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেন না।

চেঙ্গিস খান চোখের ইশারায় মাদুরের সামনের অংশে বসতে বললেন জেনারেল চেনিয়ু লিউকে।
এই সকাল বেলায় চেনিয়ু লিউ পুরুদস্তুর যুদ্ধের পোশাকে আছেন। চাপা পায়জামা আর পাতলা কাপড়ের জামার উপর কারুকার্য খচিত ভারী বর্ম। বর্মের দুই কাঁধের অংশে ড্রাগনের প্রতিকৃতি খোদাই করা। এ মুহুর্তে চুড়ায় লাল রঙের সুতার গুচ্ছ বিশিষ্ট শিরস্ত্রাণটি বাম হাতে নিয়ে আছেন লিউ। ফলে মাথার পেছনের দিকে ঝুটি করে বাঁধা লম্বা রেশমী কালো চুল দেখা যাচ্ছে। জেনারেলের বয়স বাহান্ন হলেও দেখলে মনে হয় বড় জোড় পঁয়ত্রিশ। হালকা পাতলা একহারা গড়নের মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় নড়াচড়া করেন। কোমরে ঝোলানো খাটো তলোয়ারের  ব্লেডের সামনের দিকটা একটু চওড়া। শত্রুর জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। তবে তলোয়ারের মালিকটি আগাগোড়া বিনয়ী।

চেঙ্গিস জেনারেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেন। তার মানসিকতার কথা মাথায় রেখে বললেন
-জেনারেল, আপনি সম্ভবত আমার চিন্তা ধারার সাথে পরিচিত নন। আমি আসলে নিজের মত করে পথ চলতে পছন্দ করিনা। যে যেই বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে তার মতকে গুরুত্ব দেয়াই আমার নীতি। আপনাকে এখানে ডেকে পাঠানোর সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। সকালের খাবারের ডাক আসার আগেই আপনার সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিতে চাই ।
-বলুন মহান খান। আমি পূর্ণ মনযোগের সাথে শুনছি।
-আমার শৈশব কেটেছে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পরিবেশে। কঠোরতা আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়েছি। সুন্দর শৈশব আমার জন্য দুঃস্বপ্ন মাত্র। আপনারা যে নিয়মিত যুদ্ধের কলাকৌশলে অভ্যস্ত আমার অভিজ্ঞতা তেমন নয়। আমাদের অঞ্চলে মোঙ্গলদের স্থায়ী শত্রু হচ্ছে তাতার দস্যুরা। এমনকি আমার বাবার মৃত্যুর জন্যেও ওরাই দায়ী। সবকিছু মিলিয়ে আমার পুরো জীবনটাই অনিয়মিত খণ্ডযুদ্ধ আর টিকে থাকার চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। বুঝতেই পারছেন কোন বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি নিতান্তই শান্তিকামী মানুষদের মত হয়ে উঠেনা।

বিনয়ী লিউ চুপচাপ মন দিয়ে শুনছেন খানের কথা। আর এ মুহুর্তে তাকিয়ে আছেন একদম খানের চোখের মণির দিকে। খান নিজেও মনযোগী শ্রোতা পছন্দ করেন। কথা বলে বেশ আরাম পাচ্ছেন। খান বললেন
-আচ্ছা বলুন তো এসব শুনে আমার সম্পর্কে আপনার মনে কী ধারণা তৈরী হয়েছে।
-মহান খান। আমার ধারণা প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে আপনার চিন্তা চেতনায় এটি স্থায়ী হয়ে গেছে।
মন্তব্য শুনে খান মৃদু হাসলেন। লিউ বললেন
-কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
খান কোন শব্দ না করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। লিউ বললেন
-আপনি চীনে কেন? আসলে আপনার লক্ষ্য কী? যদি আমার জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া সম্ভব হয় দেবেন আর যদি প্রশ্ন করাটা সীমা লঙ্ঘন হয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত।
-আপনি সীমা লঙ্ঘন করেননি। বরং আমি যে উদ্দেশ্যে এই সকাল বেলা আপনাকে ডেকে এনেছি আপনি ঘটনাক্রমে সে প্রসঙ্গের দিকেই চলে গেছেন। আমি আমার নিজের ,পরিবারের, সাথের মানুষদের আর অঞ্চলের সকলের ঐতিহাসিক গোত্রীয় আর যাযাবর জীবনের একটি মৌলিক পরিবর্তন চাই। একটা বৃহৎ সমৃদ্ধ রাজ্য , একটা গৌরবময় জীবন আর ভবিষ্যত সৌভাগ্যের বীজ বপন করতে চাই আমি। আমার পৈত্রিক নাম তেমুজিন। পরবর্তীতে আমি চেঙ্গিস নাম ধারণ করি, সেটা করার একটা কারণ রয়েছে জেনারেল। চেঙ্গিস মানে হচ্ছে ‘আলোকিত সম্ভাবনা’। আমি সে সম্ভাবনা সর্বোচ্চ যতটুকু পারি ছড়িয়ে দিতে চাই। এজন্য আমার প্রথম লক্ষ্য স্থির করি চীন। বর্তমানে আমি চীনের প্রায় মধ্যাঞ্চলে আছি, কিন্তু আমি আরও দক্ষিণ পূর্বে অগ্রসর হতে চাই। চীন আমার আয়ত্বে আসলে আমি উত্তর পশ্চিমে মনোনিবেশ করতে পারব।

নীচে পাতানো মাদুরের নকশার দিকে তাকিয়ে একটানা কথাগুলি বলে গেলেন চেঙ্গিস খান-খানদের খান বা রাজাদের রাজা। সাত বছর আগে এ বিশেষ উপাধি ধারণ করেন তিনি। দিন দিন তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি বেড়েছে, আগ্রাসী হয়েছেন তবে অহংকারী হননি। একটু দম নিয়ে পুরনো কথার খেই ধরলেন গ্রেট খান
-জেনারেল লিউ, আপনি যিন রাজবংশের পুরনো ও উচ্চপদস্থ সেনাপতিদের একজন। পুরো রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, সামরিক শক্তি আর যুদ্ধকৌশল আপনার জানা। আমি আপনাকে যিন রাজ্য জয়ের অভিযানে আমার প্রধান যুদ্ধ উপদেষ্টা নিয়োগ করতে চাই। আমি আমার সম্ভাবনা ছড়িয়ে দেবার জন্য আপনাকে পাশে চাই।
-হে মহান রাজাদের রাজা, আমি যদিও আমার নিজের স্বার্থে আপনার সাথে যোগ দিয়েছি কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব আর চিন্তাধারা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
-হুম্। শুনে ভাল লাগল।
-আমি আপনার সাথে থাকতে পারলে খুশি হব। তবে…
-তবে কী জেনারেল চেনিয়ু লিউ?
-যে কোন প্রচেষ্টার প্রস্তুতি আর আয়োজনও সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিসরে হয়ে থাকে। আপনি যদি মহত্তর কোন লক্ষ্যে অগ্রসর হন তবে আপনাকে প্রস্তুতিও সেই মোতাবেক নিতে হবে।
-বুঝিয়ে বলুন জেনারেল।
-আপনি উত্তর আর দক্ষিণের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল করায়ত্ব করতে ইচ্ছুক তার জন্য শুধু সামরিক আয়োজন যথেষ্ট নাও হতে পারে। তার পাশাপাশি আরও কিছুর প্রয়োজন পড়তে পারে। অন্তত আমার মতে।
-সেটা কী?
-চীনাদের বিশ্বাস আর সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন খান?
-উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই না। কিন্তু কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?
-যদি বিরক্ত বোধ না করেন তবে আপনাকে আমি একটা গল্প শোনাব মহান খান।
তাবুর পর্দা সরে যেতে আলোচনায় ছেদ পড়ল। বাইরে থেকে প্রহরী মাথা ঢুকিয়ে জানাল সকালের খাবার প্রস্তুত। মহান খান অনুমতি দিলে পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হবে। খান মৃদু হেসে প্রহরীকে বললেন
-এখানে আমার আর জেনারেলের খাবার দেবার ব্যবস্থা কর।
আদেশ শুনে প্রহরী মাথা দুলিয়ে চলে গেল।
একটু পরেই তাবুতে খাবার পৌঁছে গেল। প্রচুর পরিমানে বিচিত্র রঙের সবজি একসাথে করে রান্না করা হয়েছে, সবজির সাথে স্বাদু পানির মাছ মিশিয়ে দেয়া। আছে সিদ্ধ করা ডিম আর ঝলসানো হাঁসের মাংসের পাতলা স্লাইস।
গত কয়েক বছরে চীনা খাবারের প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়েছেন খান। খাবারে এখন নিয়মিত চীনা রীতির কোন না কোন পদ থাকছে। দু’জনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবারই দেয়া হয়েছে। চেঙ্গিস খান খাবারের অপচয় পছন্দ করেন না। আর তাছাড়া দীর্ঘ অভিযানে রসদ ব্যবহারে সতর্ক হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।
ঝাল খাবারের শেষে বকরীর দুধের তৈরী ছানা পরিবেশন করা হল। কোন কথা না বলে চুপচাপ অল্প সময়ের মধ্যে চেঙ্গিস খান ও জেনারেল চেনিয়ু লিউ খাওয়া সেরে নিলেন।
খাবারের অবশিষ্ট আর ব্যবহৃত পাত্রসমূহ প্রহরী নিয়ে যেতেই কালবিলম্ব না করে চেঙ্গিস খান অসমাপ্ত আলোচনায় ফিরে যেতে চাইলেন।
-আপনার গল্পটি শুরু করুন লিউ।
-যা বলব আমার কাছে তা সত্যি, তবে আপনার কাছে অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে বিধায় আমি গল্প হিসাবে অভিহিত করেছি।
-সে যাই হোক আপনি বলুন।
-চীনের সংস্কৃতি আর অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাসের ভীত পৃথিবীর আর সব প্রাচীন সভ্যতাগুলির মতই সুন্দর আর অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ। আমাদের বিশ্বাসে পাঁচজন মহান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর কথা বলা আছে যারা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে পৃথিবীকে শাসন করেন। যার অন্যতম হচ্ছেন ‘পীত সম্রাট’। আমরা বিশ্বাস করি তিনি অদৃশ্য ঈশ্বরের পক্ষ থেকে দৈব ক্ষমতা প্রাপ্ত এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে শান্তি ও একতা প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন। তিন হাজার বছর আগে তিনি এই অঞ্চলের নেতৃত্বে ছিলেন আর মানুষকে শিক্ষা দিতেন । তাঁর জন্ম সম্পর্কে বলা হয় যে , পীত সম্রাটের মা ফোবাও একদিন পথ চলার সময় ক্লান্তিতে অচেতন হয়ে পড়েন, আচমকা তার উপর আকাশ থেকে একটা বজ্র আপতিত হলে তিনি জেগে উঠেন আর অনুভব করেন যে তিনি একটা পরিণত ভ্রুণ গর্ভে ধারণ করে আছেন। অবিশ্বাস্য আর অদ্ভুত হলেও ফোবাও তা ঈশ্বরের অনুগ্রহ মনে করে গ্রহণ করেন। ফোবাও অবশেষে জুয়ানইউয়ান পর্বতে তার সন্তান প্রসব করেন আর পর্বতের নামেই পূত্রের নাম রাখেন। পরবর্তীতে তাকে দৈব ক্ষমতার জন্য ‘পীত সম্রাট’ নামকরণ করা হয়। কথিত আছে তার দেহের চারপাশ ঘিরে একটা আধ্যাত্মিক হলুদ আলোকিত আভা সর্বদা বিরাজমান থাকত। পীত সম্রাট একশ বছরেরও বেশী সময় শাসন করেন এবং মানুষকে স্বর্গের আদর্শে অণুপ্রাণিত করতে দীক্ষা দেন। আমাদের বিশ্বাস যেসব রাজা বা অধিপতিগণ পর্যায়ক্রমে বিক্ষিপ্ত চীনকে আজকের চীনে পরিণত করেছেন তারা সবাই পীত সম্রাটের দৈব আশীর্বাদ প্রাপ্ত।
এ পর্যন্ত বলে জেনারেল চেনিয়ু থামলেন। চেঙ্গিস খান জিজ্ঞেস করলেন
-আমি বুঝতে পারছি আপনাদের অতীত সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু সেসবের সাথে আমার ভবিষ্যত অভিযানের সম্পর্ক কী?
মৃদু হেসে জেনারেল চেনিয়ু লিউ বললেন
-দৈব সম্রাটের আশীর্বাদ নিছক কোন মন্ত্র নয় খান, বরং এর সাথে দুইটি অলৌকিক ও ক্ষমতা সম্পন্ন বস্তু জড়িত আছে। চীনের ক্ষমতাসীন রাজারা এ বস্তু দুইটি তিন হাজার বছর ধরে পর্যায়ক্রমিক ভাবে সংরক্ষণ করে আসছেন আশীর্বাদ আর দৈব শক্তির আধার হিসেবে।
-কিন্তু চীনে তো একই রাজবংশের শাসন ছিলনা তাহলে তা কীভাবে পর্যায়ক্রমিক সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল?
-আপনার প্রশ্নটির মধ্যেই আমার গল্প বলার উদ্দেশ্য নিহীত। যে যোদ্ধা তা করায়ত্ব করতে পেরেছে সেইতো ক্ষমতা আর কর্তৃত্বকে নিজের আজ্ঞাবহ বানিয়েছে। তাই আমার মহান খান, আপনাকে বিস্তীর্ণ ভূমি আর জনগোষ্ঠীকে জয় করতে ও তাদের কর্তৃত্বের আওতায় রাখতে সেই দৈব আশীর্বাদ সংগ্রহ আর সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছি আমি।
একটু দ্বিধাগ্রস্ত চেঙ্গিস খান বললেন
-ধরে নিচ্ছি আপনার কথা সত্যি। কিন্তু আমি তা কোথা থেকে আর কীভাবে পাব?
-আমি জানি বর্তমান যিন বংশের ক্ষমতাসীন সম্রাটের কাছে অতি গোপনে বস্তু দুইটি সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি আপনার লক্ষ্য যেন যিন সাম্রাজ্য দখলের পরিবর্তে হয় ওই দৈব বস্তু দুইটি সংগ্রহ করা । আর তাতেই আপনার মহান লক্ষ্য একদিন সুন্দর ভাবে বাস্তবায়িত হবার পথ তৈরী হবে। আপনাকে যিন রাজার গোপন সিন্দুক সংগ্রহের জন্য আলাদা বিশেষ অভিযান প্রেরণ করতে হবে এবং তারা কোন প্রকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগেই তা দখল করে নিতে হবে।
খানিকটা ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত ও বিস্মিত চেঙ্গিস খান জিজ্ঞেস করলেন
-জেনারেল লিউ, বস্তু দুইটি কী বা কেমন আপনি তা জানেন ?
-মহান খান আমি যতদূর জেনেছি, এ বস্তু দুটির একটিতে জগতে ধ্বংস আর অন্যটিতে ধ্বংস প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। আপনার কাছে এসব শুনতে হয়তো অদ্ভুত মনে হচ্ছে যে বিপরীত ধর্মী দু’টি বন্তু কেমন করে দৈব আর্শীর্বাদের উপকরণ হতে পারে। আমাদের ‘তাও’ দর্শনে এ বিষয়ে প্রকৃত ইঙ্গিত পাবেন আপনি। ‘তাও’-এর সারমর্ম হচ্ছে জগতের বিবর্তন আর সে বিবর্তনে শুভ আর অশুভের পাশাপাশি অবস্থানের ও ভারসাম্য রক্ষার অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে নেয়া। ‘তাও’ দর্শনের প্রতীক হিসেবে বিপরীত কিন্তু পরস্পরের সাথে নিবীড় ভাবে সংযুক্ত যে সাদাকালো চক্র ব্যবহার করা হয় তা মূলত ওই বস্তু দুইটির বিপরীত ক্রিয়াশীলতাকে বিবেচনায় রেখেই গড়ে উঠেছে। যেন আলো আর আঁধারের অস্তিত্বের অপরিহার্যতার চিহ্ন।

সব শুনে খানদের খান মহান তেমুজিন অর্থাৎ চেঙ্গিস খানের সবুজ দুই চোখ আগ্রহে চকচক করছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন তিনিই হলেন ভবিষ্যত চীন, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম পৃথিবীর সম্রাট। তার হাতের মুঠোয় জগৎ। যাকে তিনি নিজের চিন্তা আর ধারণার আলোয় আলোকিত করতে চান ।
গত চল্লিশ বছর ধরেই তিনি বিক্ষিপ্ত আর খণ্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন। তবে এবারে শুরু হবে তার জীবনের সবচাইতে মহান আর গৌরবময় অধ্যায়। মহান পীত সম্রাটের আশীর্বাদে কাবুল খানের পৌত্র আর ইয়েসুগি বোরজিগিনের পুত্র চেঙ্গিস খান এবার পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নেবে।

মনে মনে অত্যন্ত আবেগ নিয়ে চেঙ্গিস খান বলছেন-হে আমার মহান পিতা, আমার গোত্রের যে অদূরদর্শি মানুষগুলি আপনার সন্তানকে গোত্র প্রধান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল, তার যোগ্যতাকে অবজ্ঞা করেছিল সে তেমুজিন এবার পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে, আপনার এবং আপনার দুঃসাহসী পিতার অতীতকে আরো বেশী গৌরবোজ্জল করে তুলবে। হে পিতা! হে আমার পিতা!!
(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত