তৈমুরের অভিশাপ -৪

চার.

পনজব স্কয়ার। বাড়ী নম্বর- বি তের। সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ।

সুলেইমান আদহামের স্টাডিরুম যথেষ্ট ছিমছাম। ঊনিশ ফুট বাই তের ফুটের একটা আয়তাকার ঘর। দেয়াল জুড়ে সাড়ে সাত ফিট উচু আর পাঁচ ফুট চওড়া চারটা কাঠের তৈরী বুক শেলফ দেখা যাচ্ছে। থরে থরে বই সাজানো। বড় একটা টেবিলের পেছনে বসেছেন বৃদ্ধ। টেবিলের বিপরীত দিকের ভিজিটর চেয়ার দু’টোয় জারা আর রূপক বসে আছে। টেবিলের উপর কয়েকটা বই রাখা। রুমের মেঝেতে ইটের মত ফ্যাকাশে লাল রঙের কার্পেট পাতানো আছে।

গতকালের গুড়ি বৃষ্টি রাতেই থেমে গিয়েছিল যদিও কিন্তু আকাশে তারা দেখা যায়নি। আজ সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার। স্টাডিরুমের পূর্ব দিকের দেয়াল জুড়ে বড় কাঁচঘেরা জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঝকঝকে সূর্যের আলো রুমে এসে পড়ছে। স্টাডিরুমটা দোতলায়। স্টাডি রুমটা জনাব আদহামের একান্ত বিচরণের জায়গা। তাই অতীতে জারা ব্যতিত আর কারও এখানে প্রবেশাধিকার ছিলনা। তবে আজকের প্রেক্ষাপট আলাদা।

রূপকের মনে হল আবহাওয়ার প্রভাব বৃদ্ধের চেহারার উপরও পড়েছে। গতকালের চেয়ে আজকে সুলেইমান আদহামকে বেশী প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। গায়ের রঙও যেন আজ একটু বেশী টকটকে। গায়ে ওলের ভারী কোট চাপিয়েছেন । তবে রূপকের মনে হচ্ছে আজ শীতের প্রকোপ গতকালের চেয়ে কম। সুলেইমান আদহাম সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রসঙ্গে গেলেন; রূপকের দিকে তাকিয়ে বললেন
-তা মি. রূপক, কোথা থেকে এবং কীভাবে শুরু করতে চান বলুন।
কথাটায় এক মুহুর্তের জন্য রূপক একটু অস্বস্তি বোধ করল। কারণ ও যা বলবে তা আনন্দময় কোন ব্যপার নয়। বরং বিপদের কথাই। খানিকটা দম নিয়ে রূপক বলল
-আমি ক্ষমাপ্রার্থী! কিছু খারাপ প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করছি। মি. আদহাম, ইতিহাসের প্রায় সব অধ্যায়েই মহামারীর কথা পাওয়া যায় আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন?
সুলেইমান আদহাম মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন। তা দেখে নিয়েই রূপক বলল
-মোজেস এর যুগের যে মহামারীর কথা খৃস্টান মিথলজিতে পাওয়া যায় তাকে ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তাছাড়াও আমরা অনেক মহামারীর কথা অতীতের পরতে পরতে দেখতে পেয়েছি যেগুলি মানবসৃষ্ট এবং সমগ্র পৃথিবীবাসীকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছিল। মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত মহামারীকে প্রতিরোধ করেছে ঠিকই কিন্তু মহামারী নিয়ে অহেতুক ও সীমালঙ্ঘনকারী কৌতুহলও কম দেখায়নি। খৃস্টপূর্ব পনের শতক থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ঐতিহাসিক রেফারেন্স ঘাটলে আপনি অন্তত শতাধিক উল্লেখযোগ্য মহামারীর কথা পাবেন। কিন্তু সেসব মহামারীর ভয়াবহতা দেখেও মানুষ থামেনি। মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে খেলার চীরায়ত ঘাতক মানসিকতা আধুনিক মানব সমাজ বরাবরই পোষণ করে এসেছে। ক্ষতিকারক সব দিক জেনেও উন্নত রাষ্ট্রগুলি জীবাণুযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে অতীতে। করেছে ঘাতক ব্যধির জীবাণু আর জীবাণু বহনকারী জীবের লালন-পালন। এমনকি এও শোনা যায় যে খোদ আমেরিকানরা নিজেদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিার স্বার্থে ঘাতক ব্যাধির জীবনাণুসঙ্ক্রমিত কম্বল নেটিভ আমেরিকানদের দিয়েছিল যাতে করে চীরতরে রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করা যায় । প্রযুক্তি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এগিয়ে থাকা এসব দেশের কার্যকলাপ দেখেই অনুন্নত দেশসমূহের অবিবেচক শাসকরাও ধ্বংসাত্মক বাড়াবাড়িতে আগ্রহী হয়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক ভাবে সচেতন জনগোষ্ঠী এখন এসব তৎপরতার বিরূদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদ মূখর হওয়ায় প্রায় সব দেশই বায়োলজিক্যাল অস্ত্র পরিত্যাগ করেছে। কাগজপত্রে তার ইতি ঘটলেও সর্বাংশে তা নির্মূল হয়েছে কীনা আমরা কেউ জানিনা। তবে বিষয়টা পূণরায় কৌতুহলীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় তালেবানদের দ্বারা এনথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর পর। শান্তিপূর্ণ চিত্রপটটা আস্তে আস্তে বদলাদে শুরু করে।
সুলেইমান আদহাম হাতের তালু ট্রাফিক পুলিশের মত করে রূপকের দিকে দেখিয়ে থামতে ইশারা করলেন। বললেন
-আপনার কথাতো ঠিক আছে কিন্তু আমি যতদূর জানি আপনি প্রত্মতাত্ত্বিক একটা প্রয়োজনে এখানে এসেছেন। তাহলে মহামারীর কথা আসছে কেন? মহামারী তো প্রত্মতত্ত্বের বিষয় হবার কথা নয়।
রূপক হেসে ফেলল। বলল
-বলছি; আমি আসলে বোঝাতে চাইছিলাম, যে হুমকিটা আগে মাথামোটা রাষ্ট্রগুলি তৈরী করেছিল কিন্তু চাপে পড়েই হোক বা সুবিবেচনার জন্যই হোক পিছিয়ে এসেছে সেই একই হুমকি এখন সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে আসছে। জীবাণু ঘটিত মহামারীকে এখন সন্ত্রাসীরা তাদের মতলব হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
এতক্ষণ চুপ করে থাকা জারা এবার ঘাড় ঘুরিয়ে রূপকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
-মানে?
-মানে হল এ কে ফরটি সেভেন টাইপের সেমি অটোমেটিক গান দিয়ে সন্ত্রাসীপনার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। দুয়েকটা ঠুস ঠাস দিয়ে সাময়িক আতঙ্ক সৃষ্টি করা গেলেও বড় আর স্থায়ী লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেসব নিছক খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়। পৃথিবীকে চমকে দিতে হলে দারুন কিছু চাই। সেই দারুণ কিছু হতে পারে একটা পারমানবিক বোমা, হোয়াইট ফসফরাস ভর্তি কতগুলি ক্যান অথবা ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম জীবাণু। হ্যাঁ আমরা এমন এক ঘাতকের কথা বলছি যে শত্রু-মিত্র, সামরিক-বেসামরিক নির্বিশেষে সব উজাড় করে দেবে।
সুলেইমান আদহাম চিন্তিত মুখে বললেন
-মি. রূপক, এনথ্রাক্সের পর আমরা তো আর এরকম কোন হুমকির কথা এখনও শুনিনি। তাহলে আপনি কেন এরূপ অশুভ ধারণা করছেন যে সন্ত্রাসীরা এখন ঘাতক ও মহামারী সৃষ্টিকারী জীবাণুকে দাবী আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে?
-সম্প্রতি বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে কিছু রোগী সনাক্ত করা হয়েছে যাদের ফুসফুস বিরল প্রজাতির জীবাণুর সংক্রমণে আক্রান্ত। তাদের মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট বিস্তারিত গবেষণা করেও স্থানীয় চিকিৎসকরা প্রথমটায় রোগ এবং সংক্রমনের কারণ নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছিলেন না। পরে ব্যপক যাচাইয়ের জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক সন্দেহের তথ্যসমূহসহ নমূনা পাঠানো হয়েছিল ইউরোপীয় দুইটা দেশে । তাতে ভয়াবহ কথা বেড়িয়ে এসেছে।
ইতিমধ্যেই সুলেইমান আদহাম ও জারার ভ্রু কপাল বেয়ে উপরে চুল ছুঁই ছুঁই করছে। পরিষ্কার উপলব্ধি করা যাচ্ছে এখনি রূপকের মুখ থেকে নার্ভাস হওয়ার মত কোন কথা হয়তো শোনা যাবে।
রূপক নির্বিকার ভাবে বলে যাচ্ছে
-সত্যি বলতে আমরা সম্ভবত একবিংশ শতাব্দির সম্পূর্ণ নতুক আঙ্গিকের জীবাণু হামলার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। ইউরোপীয়রা জীবাণুটির নামকরণ এখনও করেনি। এটিকে গবেষকদের ভাষায় প্রাথমিকভাবে সি ওয়ান এইট ওয়ান নামে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটির প্রভাব ভয়াবহ। তাদের দেয়া তথ্য মতে মানুষ এটির দ্বারা ফুসফুসের অথবা অন্য যে কোন আন্ত্রিক সংক্রমণের শিকার হতে পারে। এখন তারা এর অবিশ্বাস্য সংক্রমণ সক্ষমতা দেখে এটিকে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপর প্রয়োগ করে তার প্রভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। রহস্যময় ও চিন্তার বিষয় হল এই জীবাণুটির ডি.এন.এ গঠন ইউরোপে যত রকমের অণুজীবের ডি.এন.এর নমুনা সংরক্ষিত আছে তার কোনটির সাথেই মেলেনি। এমনকি পরিচিত কোন পার্থিব জীবের ডি.এন.এ স্যাম্পলের সাথেও তার মিল নেই। এরকম অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট ও এর ছড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতি দেখে গবেষকরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সবকয়টা দেশই বিষয়টা এখন পর্যন্ত চেপে রেখেছে।
জারা ভ্রু উঁচু করে রেখেই বলল
– কিন্তু রূপক, প্রাচ্যের কয়েকটা দেশে এমন ধরণের জীবাণু সংক্রমণের শিকার কিছু রোগীর বিষয় নিয়ে তুমি কেন প্রত্নতাত্তিক্ব অনুসন্ধান চালাবে? জীবাণুসন্ত্রাস তো প্রত্নতত্ত্বেরও বিষয় নয়। আর এর সাথে সন্ত্রাসী তৎপরতার সম্পর্কই বা কোথায়?
-তুমি নিশ্চয়ই পূর্ব এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের নাম শুনেছ?
-হ্যাঁ, শুনেছি, কেন বলতো?
-তাহলে তোমার জানার কথা গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল হল চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য। তারা এই রুট ব্যবহার করে লাওস, ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড এবং মায়ানমারে তাদের অপকর্ম চালায়। চীন ছাড়া পশ্চিমের দিকে তাদের পার্সেল ডেলিভারীর জন্য যে রুট ব্যবহৃত হয় তা হল- মায়ানমার হতে বাংলাদেশ, ভারত , পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে হয়ে মধ্য এশিয়া দিয়ে পূর্ব ইউরোপ, বলকান অঞ্চল ও ককেশীয় দেশসমূহ। অথবা ইরান, ইরাক, তুরস্ক হয়ে পশ্চিম ইউরোপের দেশ সমূহ। তাদের প্রধান চালান হচ্ছে ড্রাগ আর সোনা। ভয়ঙ্কর কথা হল ড্রাগের মত ক্যামিকেল কম্পোজিশন যে ক্যান বা কন্টেইনারে করে আদান প্রদান হচ্ছে তারই কোন না কোন আপগ্রেডেড কন্টেইনারেই জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব পূর্ব ও পশ্চিমের দেশ সমূহে। চেরাকারবারীদের এই রুটটাই জীবাণু সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
-কিন্তু ড্রাগ চোরাকারবারী আর জীবাণু আক্রমণকারীদের আদর্শ আর মোটিভ তো সম্পূর্ণ আলাদা। তাহলে নিয়মিত পাচারকরীরা কেন সন্ত্রাসীদের এক্ষেত্রে সাহায্য করবে?
-তোমার কথা ঠিক আছে। চোরাকারবারীরা তাদের চ্যানেলে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে একটা পর্যায়ে ঠিকই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। আর তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে জীবাণু আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যের মিল না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এমনটা হয়ে থাকতে পারে যে, ড্রাগ হিসেবেই জীবাণূ আদান প্রদান চলছে, এবং সন্ত্রাসীরা তাদের মৌলিক পরিচয় চোরাকারবারীদের কাছে গোপন রেখেই শুধু অর্থের বিনিময়ে তাদের চ্যানেল ব্যবহার করে তাদেরই অজান্তে নিজেদের লক্ষ্য হাসিল করে নিচ্ছে। পূর্ব এশিয়ায় যে জীবাণুর সংক্রমণ ওরা শুরু করেছে তা পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেও ড্রাগ চোরাকারবারীরা জানবেই না যে এসবের মধ্যে তাদেরই সহযোগী সন্ত্রাসীদের কোন প্রকার ভুমিকা আছে। হয়ত নিজের অজান্তেই তারা সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্র চলাচলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
সুলেইমান আদহাম বললেন
-এসবই কি আপনার বা আপনাদের ধারণার কথা?
রূপক বলল
-শুধুই ধারণা নয়। ড্রাগস চোরাকারবারীদের উপর ইন্টারপোলের নজরদারী সবসময়ই থাকে। তাদের পুরো গোষ্ঠী ও তৎপরতার খবরও নিয়মিত সংগৃহীত হয়। সম্প্রতি ইন্টারপোল সেখানে নিয়মিত জনবলের বাইরে বহিরাগতদের তৎপরতার আলামত চিহ্নিত করতে পেরেছে। ইন্টারপোল থেকে আক্রান্ত দেশগুলির সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় খবরাখবর এসেছে।
-ও আচ্ছা। কিন্তু আপনার বলা সমস্ত তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে এসব কর্মকাণ্ড নেহায়েতই প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয় কেবল নয়। রীতিমত পুলিশি কর্মকাণ্ড। তাহলে মি. রূপক আমি একটা প্রশ্ন করতেই পারি-আপনি এসবের মধ্যে কেন?
বৃদ্ধের কথাটার মধ্যে জিজ্ঞাসার চেয়ে কৌতুক বেশী।
রূপক ধীর স্থির ভাবে জবাব দিল
-দেখুন মি. আদহাম, আপাতদৃষ্টিতে এসব পুলিশি বিষয় মনে হলেও,আমি কেন এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ সীমিত। আমি দুঃখিত। তবে আপনি আপনাদের মন্ত্রণালয় এর তরফ থেকে আমাকে সহযোগিতা করার যে অনুরোধ পেয়েছেন সে অনুযায়ী আমাকে সাহায্য অব্যহত রাখলে খুশি হব।
জারা দেখল হঠাৎ করেই পরিস্থিতিটা কেমন থমথমে হয়ে উঠেছে। শুরুর দিকের সেই সহজ ভাবটা আর নেই। সে অস্বস্তি কাটাবার জন্যেই রূপককে প্রশ্ন করল
-ঠিক আছে সেসব সরকারী বিষয় নিয়ে আমরা ব্যস্ত হওয়া জরুরী মনে করছিনা। তা মি. রূপক এখন তো তোমার কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা খানিকটা আভাস পেলাম। ধরে নিচ্ছি অবিবেচক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কর্তৃক ভবিতব্য জীবাণূ আক্রমণ হতে পৃথিবীর বসবাসরত মানবসমাজকে বাঁচাতে তুমি ত্রাতা রূপে দায়িত্বরত আছ এই মূহুর্তে। তো এখন তোমার পরবর্তী করণীয় কী যেখানে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
-হুম, আমি তৈমুর লং এর সমাধিস্থলটা একটু দেখব শুরুতে। জারা,তুমি আমার সাথে থাকলে সুবিধে হয়। সত্যি বলতে কি তোমার সঙ্গ আমার কাজের একঘেয়েমিও দূর করবে আশা করি।
এতক্ষণে সুলেইমান আদহাম কিছুটা সহজ হয়ে এসেছেন। কিছুক্ষণ আগে যে বিব্রতকর অবস্থাটা জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে তৈরী হয়েছিল তার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। স্বভাব সুলভ আন্তরিকভাবেই আবার তিনি রূপককে জিজ্ঞেস করলেন
-মি. রূপক যদিও অনেক বেজে গেছে, আপনি কি সকালের ব্রেক ফাস্ট আমাদের সঙ্গে সারবেন? খাওয়া হয়ে গেলেই বের হতে পারবেন। আমাদের খাওয়া এখনও হয়নি।
বৃদ্ধের কথার বাহ্যিক ভঙ্গিটা প্রশ্নবোধক হলেও তিনি যে মন থেকে চাইছেন রূপক এখানেই খেয়ে নিক তা পরিষ্কার উপলব্ধি করা গেল তার অভিব্যক্তিতে । আর যাই হোক এদের আপ্যায়ন মানসিকতায় রূপক অভিভূত। রূপক বলল
– আমি তো খেয়েই তারপর এসেছি। অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলাম তাই প্রচণ্ড খিদে ছিল।
রূপকের কথায় জারা বা সুলেইমান আদহাম কেউই টলল না। বাধ্য হয়ে রূপককে তাদের সাথে খেতে বসতেই হল। খাওয়ার ইচ্ছে যদিও ছিলনা কিন্তু স্বাদের কাছে অন্য সব যুক্তি পরাজিত হল।
এই সকাল বেলায় বেশ ভারী খাবারের আয়োজন। টেবিল ভর্তি হরেক রকমের আইটেম। প্রত্যেকটাই রঙে রূপে আর সুগন্ধে পরিপূর্ণ। চোরবা নামক এক প্রকারের স্যুপ পরিবেশিত হল যার স্বাদ অনেক দিন মনে রাখার মত। এ খাবারটা মধ্য এশিয়া, বলকান, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপেও আছে। তবে উজবেকিস্তানের চোরবা সবসময়ই স্পেশাল। ভরা পেটে নতুন করে ভারী খাবার খাওয়া চলেনা। ফলে রূপক আর সব এড়িয়ে গিয়ে ল্যাগমেন খেল। ল্যাগমেন ভেরার মাংস আর নুডলস এর সংমিশ্রণে তৈরী এক ধরণের খাবার।

আজ আবহাওয়া বেশ ভাল। উজ্জল নীলাকাশ। তাপমাত্রা আঠারো ঊনিশ ডিগ্রীতে আপ ডাউন করছে। ঝলমলে রোদে বাহিরটা বেশ সুন্দর হয়ে আছে। ভারী কোটের বদলে আজ জারা সাদা উলের পাতলা একটা সুয়েটার পরেছে। সুয়েটারে বুক বরাবর দুই কাঁধ সংযোগকারী একটা পুতির মালা অর্ধ চন্দ্রাকারে আটকে দেয়া। পুতির রঙও সাদা। মনে হয় যেন তুষার রাজ্যের রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। মোটা কাপড়ের প্যান্টের সাথে গোড়ালী ঢাকা জুতা। মাথায় কোন ক্যাপ নেই। মসৃণ চুল চেহারার দুইপাশে পাহাড়ী ঝর্ণার মত নেমে এসেছে।

বাসা থেকে ফিরদৌসি স্ট্রিট দিয়ে ইউনিভার্সিটি বুলেভার্ড হয়ে তৈমুরের সমাধিতে যেতে হবে। শেভ্রোলেটে বসে আছে জারা আর রূপক। রাস্তার দুই পাশে ঐতিহ্যবাহী আর আধুনিক দালান-কোঠার অদ্ভুত সহাবস্থান। ঐতিহ্যগতভাবে এখানকার স্থাপত্যে পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান। বিশেষত আঠারো শতক পর্যন্ত যেসব নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে। উজবেকিস্তান ঊনবিংশ শতাব্দিতে তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। এর অব্যবহিত আগে তা বোখারা, খিভা, কোকান্দ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আমির ও খান শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। ঊনিশশো সতেরর রুশ বিপ্লবে জার শাসনের পতন হলে ঊনিশশো চব্বিশ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় উজবেকিস্তান। এর পর ঊনিশশো একানব্বই সালের একত্রিশ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে ঠিক তার পরদিন পহেলা সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তান স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাচীন যে সিল্ক রোড পূর্ব কে পশ্চিমের সাথে জুড়ে দিয়েছিল তা গেছে এই উজবেকিস্তানের সমরখন্দ শহরের উপর দিয়েই। ফলে দূর অতীত হতেই এ দেশ সংস্কৃতি আর ইতিহাসে সমৃদ্ধ। সমরখন্দ উজবেকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি। ধারণা করা হয় খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতকে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহরে জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ তাজিক। গ্রীকবীর আলেক্সান্ডার তাঁর ভারত অভিযানের প্রাক্কালে খৃস্টপূর্ব তিনশ ঊনত্রিশ সালে শহরটি জয় করেন। এ পথেই আলেক্সান্ডার হিন্দুকুশ পৌঁছান।

রাস্তায় গাড়ীর ভীড় যথেষ্ট। উপচে পড়া পর্যটক। শীতের এই সময়টাতে পর্যটক বেশী আসে। কারণ ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন ছাড়াও উজবেকিস্তানের তুষারাবৃত পাহাড়ী অঞ্চলে স্কি করার সুযোগ রয়েছে।

শেভ্রোলেট সমাধি কমপ্লেক্সের গেটের কাছে এসে থামল। গাড়ী থেকে নেমে অভিভূত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল রূপক। পারস্যরীতিতে তৈরী সমাধির উজ্জল নীল রঙের প্রায় একচল্লিশ ফুট লম্বা গম্বুজ গর্বের সাথে দাড়িয়ে আছে। তৈমুর ভাল কি মন্দ সে বিশ্লেষণের ভার ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিলেও একটা বিষয় নিশ্চিত যে তিনি সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী, প্রভাব বিস্তাকারী আর রহস্যময় চরিত্র ও শাসক হিসেবে বিশেষ মনযোগের দাবীদার। সমাধি কমপ্লেক্সের মিনার দুইটি যেন তৈমুরের দুই দিগন্ত বিস্তৃত রাজ্য শাসনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করছে।

জারা আর রূপক আস্তে আস্তে মূল সমাধির দিকে হাঁটা ধরল। রূপকের মনে বিচিত্র রকমের চিন্তা খেলে যাচ্ছে। পৃথিবীর ধ্বংসের প্রাচীন এক সংরক্ষণ পাত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। যে অদ্ভুত রহস্যের পিছনে ছুটতে এখানে এসেছে ও সেই কাজ এবার সত্যিই বুঝি শুরু হল। কী অপেক্ষা করছে সামনে কে জানে!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত