তৈমুরের অভিশাপ -৬

ছয়.

তৈমুরের সমাধি কমপ্লেক্সকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় গোর ই আমীর। সমাধি কমপ্লেক্সে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড়।

এশীয় পর্যটক তেমন একটা চোখে পড়ছেনা। অধিকাংশই পশ্চিমা। জারার কাছে রূপক জানতে পেরেছে সমরখন্দে ইউরোপীয়ান পযর্টকই বেশী আসে।
সমাধি কমপ্লেক্সের নির্মাণ শৈলীতে পারস্য স্থাপত্যকলার প্রভাব লক্ষণীয়। তৈমুরের পৌত্র মোহাম্মদ সুলতান এর নির্দেশে চৌদ্দ শতকে এই সমাধি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সমাধির অভ্যন্তর ভাগে তৈমুর ছাড়াও তার পুত্র শাহরুখ, মিরান শাহ ও পৌত্র উলুগ বেগ, মোহাম্মদ সুলতান এর কবর রয়েছে। আরও রয়েছে তৈমুরের শিক্ষক সৈয়দ বারাকার কবর।

কমপ্লেক্সের ভিতরে মূল দেয়ালের পর খানিকটা পরিদর্শন প্যাসেজ বাদ রেখে আরেকটা হাঁটু সমান নকশা করা নীচু দেয়াল দেয়া আছে, যেটাই মূলত আসল কবরখানার প্রাচীর। প্রাচীরের ভেতরে কবরগুলি অবস্থিত। তৈমুরের কবর মাঝের দিকে। কালো পাথরের চৌকোণা আয়তাকার কবর। মেঝে থেকে ফুট খানিক উচু পর্যন্ত হালকা সুবজাভ সাদা পাথরের পাদদেশ, তার উপর অবশিষ্ট কালো পাথরের কবর। কবরের উপরের দিকে পার্শ্ব দেয়াল জুড়ে সামান্য নকশার কাজ।

পুরো কমপ্লেক্সে তৈমুরের কবরটা আলাদা করে চোখে পড়ার মত। যেমন অপার্থিব সৌন্দর্য এতে আছে তেমনি আছে রহস্যময় বিভীষিকা। পর্যটকদের চোখে সে বিভীষিকা ধরা না পড়লেও রূপক ঠিক তা উপলব্ধি করতে পারছে। অতীত খোঁড়াখুড়ির কোন স্মৃতি চিহ্নই বর্তমানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। একটা বিষয় রূপককে ভাবিয়ে তুলেছে। ও নিজেও বুঝতে পারছেনা আসলে বিষয়টার কোন গুরুত্ব আছে নাকি নিছকই তা মনের সন্দেহ। তৈমুরের কবরের দুই পাশে অন্য দুইটি কবর আছে, তবে কবর দুইটির সাথে তৈমুরের কবরের দূরত্বে একই সমান নয়। বাম দিকের কবর আর তৈমুরের কবরের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা ডানদিকের চেয়ে দেড়গুণ বেশী। এটা কবর যারা দিয়েছিল তাদের মাপ-জোকের হেরফের নাকি এর মধ্যে অন্য কিছু আছে? মঙ্গোল আর তৎপরবর্তী জেনারেশন মোঘলদের সমাধি ক্ষেত্রগুলির আলাদা একটা ঐতিহ্যবাহী বিশেষত্ব আছে। যেখানে বাহ্যিক দর্শনীয় কবরটি হয়ে থাকে মূল কবরের প্রতিরূপ মাত্র, প্রকৃত কবর থাকে আরো নীচের স্তরে। তাজমহলে মমতাজ এর কবর এবং লালবাগে পরীবিবির সমাধি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। উপরন্তু বাম পাশে ফাঁকা জায়গা দেখে আরেকটা কথা মাথায় আসছে।

চেঙ্গিস খানের উত্তর পুরুষদের ধারাবাহিকতায় চীনা পীত সম্রাটের দৈব বস্তু তৈমুরের হাতে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণও রয়েছে। ইতিহাসবিদদের কারও কারও মতে চেঙ্গিস খানে পঞ্চম পূর্ব পুরুষ আর তৈমুরের নবম পূর্বপুরুষ একই ব্যক্তি। বংশ পরম্পরার দিক থেকে চেঙ্গিস এবং তৈমুর একই ব্যক্তির দুই সন্তানের দ্বারা সৃষ্টি সমান্তরাল ব্লাড লাইনের উত্তর পুরুষ। এ সংক্রান্ত বাড়তি তথ্য আশু মামার সূত্রে ইতোমধ্যেই রূপকের হাতে এসেছে। তা নিয়ে রূপক যথেষ্ট পড়াশুনাও করেছে। আশু মামার দেয়া তথ্যে উল্লেখ আছে প্রার্থনায় পীত সম্রাটের পাশেই বাম দিকে বস্তুটি রাখা হত । আর এ ঐতিহ্য পীত সম্রাটের সময়কাল হতে ধারাবাহিক ভাবে অনুসৃত হয়ে এসেছে বলেই চাইনিজদের রাজকীয় ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে।

চেঙ্গিস খান দৈব বস্তু লাভের পর তিনি নিজেও যে বিশ্বক্ষমতার অধিকারী হবার জন্য অনুরূপ চর্চা করে থাকবেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সুতরাং ধরে নেয়া যায় সেই একই ধারাবাহিকতা তৈমুর পর্যন্ত চলে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেজন্যই কী তৈমুরের সমাধিতে এমনকি মৃত্যুর পরও মরদেহের বাম পাশে দৈব বস্তুটি স্থাপন করা হয়েছিল? বাম দিকের অতিরিক্ত ফাঁকা জায়গা রাখার এটি একটি সম্ভাব্য কারণ হলেও হতে পারে।

রূপক আর জারা চারপাশের প্যাসেজ ধরে খুব ধীর গতিতে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে আর সবার অগোচরে অত্যন্ত মনযোগ সহকারে সামধিক্ষেত্রটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। তবে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। অতীতের শাসকরা বংশ পরম্পরায় তাদের উত্তর পুরুষদের দৈব বস্তু হস্তান্তর করেছিলেন ধরে নেয়া গেলেও তৈমুর কেন তা নিজ পুত্রদের দিয়ে যাননি? তিনি কি চাননি তার ছেলেরা বিশ্ব বিজেতা হোক? যদি চাইতেনই তবে কেন তা পূত্রদের অধিকারে থাকার পরিবর্তে তৈমুরের সাথে সমাধিস্ত হল? রূপক আকাশ পাতাল ভাবনায় ডুবে গেল। সমাধি কমপ্লেক্সে যতখানি ওর চোখ দুটো ছুটছে তার চেয়ে হাজার গুণ গতিতে মাথার ভেতর ওর চিন্তাগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। জারা রূপকের হাত ধরে টেনে দৃষ্টি আকর্ষণ করল
-কী ব্যপার মি. রূপক, তুমি মনে হয় হারিয়ে গেছ। দেখেই বোঝা যায় বর্তমান সময়ে নেই।
-মানে ? কী বলতে চাচ্ছ?
-তোমার মধ্যে একটু অস্বাভাকি অন্যমনষ্কতা দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে।
-না না , তেমন কিছু নয়।
-তুমি বললে তো হবেনা। আমার চোখকে আমি যথেষ্ট বিশ্বাস করি।
-আসলে আমি সমাধিস্থল দেখে তৈমুরের কবর আর পার্শ্ববর্তী কবরগুলির অবস্থানের প্যাটার্ন লক্ষ্য করছিলাম। বুঝতেই পারছ, ছোট খাট বিষয়ও এখন আমার অনুসন্ধানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
-তা বুঝতে পারছি। তবে তুমি মনে হয় চৌদ্দ শতকে চলে গিয়েছিল। তোমার চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক স্থির হয়ে গিয়েছিল। এত গভীর ভাবনায় ডুবলে তো হবেনা। ধাতস্থ হও ম্যান, জাস্ট কন্ট্রোল ইউরসেলফ।

পরিচয় খুব সামান্য সময়ের হলেও জারার কথা বার্তায় যথেষ্ট আন্তরিকতার ছাপ আছে। মনে হয় কত দীর্ঘ সময়ের চেনা জানা। অবশ্য শুধু সে ই নয়। বুড়ো সুলেইমান আদহামও যথেষ্ট আন্তরিক। অন্তত এখন পর্যন্ত রূপক যতটুকু দেখতে পেয়েছে। নিজেকে জারার দিকে মনযোগী করে রূপক বলল
-আমি একদম ঠিক আছি জারা। আর বেঠিক হলেও তেমন সমস্যা হবেনা মনে হচ্ছে।
-কেন সমস্যা হবেনা?
-ধাক্কা দিয়ে হুশ ফিরাবার জন্য তুমি তো সাথে আছই।

রূপকের কথায় ওরা দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল। প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় ধরে ওরা কবরঘেরা প্যাসেজে হাঁটল আর দেখল। অবশ্য অন্য পর্যটকরা খুব বেশী হলে এপাশে পনের বিশ মিনিট সময় ব্যয় করেছে। রূপক বলল
-জারা, এখানে আর এ মূহুর্তে আমার দেখার তেমন কিছু নেই। চল বেরিয়ে পড়ি। পথে যেতে যেতে কথা হবে। জারা লক্ষী মেয়ের মত ঘাড় কাত করে সায় দিতেই ওরা সমাধি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসল। গাড়ীতে চড়েই জারা জিজ্ঞেস করল
-এখন কোথায় যাব তাহলে?
-হোটেলে ছাড়া আর কোথায়?

আগেরবার হোটেলের মেইন গেটের কাছেই রূপককে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল জারা। ভেতরে আসেনি। আজ ভেতরে ঢুকে পার্কিং এরিয়াতে চলে এল। রূপক অবাক হলেও কিছুই বললনা। মনে মনে ভাবছে, জারা কি ওর রূমে আসবে নাকি?

আন্দাজটা সত্যি হল, একসাথে গাড়ী থেকে নেমেই রূপকের হোটেল রুমের দিকে সাথে সাথে চলল জারা। রুমে ঢুকেই ব্যাচেলর এর বসবাসের আলামত দেখতে পাচ্ছে । তেমন কোন পোশাক আশাক বা ব্যবহার্য জিনিস না থাকলেও ইতিমধ্যেই রুমটা অগোছালো হয়ে উঠেছে। জারা ঢুকতেই রূপক তড়িঘড়ি কাষ্ঠ হাসি হেসে এখানে সেখানে গোছাতে শুরু করেছে। রূপকের ব্যস্ততা দেখে জারা মুখ টিপে হাসতে হাসতে রিডিং টেবিলের সামনের চেয়ারটা বেডের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বসে পড়ল। কিছুটা গোছগাছের অভিনয় করে রূপক বলল
-তুমি একটু বসো, আমি জাস্ট ফ্রেশ হয়ে আসছি।
জারা আবারও ঘাড় কাত করে লক্ষী মেয়ের মত সম্মতি জানাল। অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’বার জারাকে এমন করতে দেখে রূপক আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। এক প্রকার ছুটে ওয়াশরুমের দরজার দিকে চলে গেল।

বসে বসে জারা গুন গুন করে একটা গানের সুর গলায় তোলার চেষ্টা করছে আর রুমের এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। ভাবছে,বাঙ্গালী ছেলেটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান তবে খানিকটা ছেলেমানুষি ভাব আছে। রূপকের নীরিহ চেহারার সাথে কেমন করে যেন ছেলেমানুষি ভাবটা মানিয়ে গেছে। খানিক বাদেই ওয়াশরুমের দরজার ফাঁকে রূপকের চাঁদমুখটা দেখা গেল। এখন তাকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। জারাকে বলল
-তুমিও একটু ফ্রেশ হয়ে নেবে নাকি। সকাল থেকে ড্রাইভ করছ। মুখটা একটু ধুয়ে নিলে হতো না?
-আরে না না। ভাল করে তাকিয়ে দেখ আমি একদম ঠিক আছি। আমার লাগবে না।

রূপক ঘড়িতে দেখল সাড়ে বারটা বাজে। দুইটায় লাঞ্চ করলেও হাতে দেড় ঘণ্টা সময় আছে। সময়টা জারার সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলে কাজে লাগানো যায়। উজবেকিস্তানে আসার পর থেকে জারাদের ওখানে রূপক যথেষ্ট আপ্যায়িত হয়েছে। ইচ্ছে আছে আজ জারাকে লাঞ্চ অফার করবে ও। একটু কেশে নিয়ে পরিস্থিতিটা কথা শুরুর অনুকূলে আনবার চেষ্টা করল রূপক। তারপর জারার দিকে তাকিয়ে বলল
-জারা, তোমার সাথে কয়েকটা কাজের কথা সেরে নিতে চাই। অবশ্যই বর্তমান অনুসন্ধানগুলির সাথে এসব কথার সুসম্পর্ক রয়েছে।
-বল। আমি শুনছি। সত্যি বলতে কি তোমার এই অদ্ভুতুড়ে অনুসন্ধানে যুক্ত হয়ে আমার বেশ মজাই লাগছে।
-সেটা কীরকম?
-নিরীহ নাগরিক হলেও আমাদের কাজের মধ্যে কেমন একটা পুলিশ পুলিশ গন্ধ পাচ্ছি আমি। অবশ্য এটা একান্তই আমার অনুভূতি।
-তা এক অর্থে ঠিক ই বলেছ।

রূপক আসলে ভাল করেই জানে কাজটা একরকম পুলিশিং ই বটে। আর তাছাড়া ইন্টারপোল ছাড়াও এখানে মার্কিন সরকারী সংস্থাগুলির একটা ভূমিকা এক সময় এসে পড়তে পারে। তখন হয়তো বিষয়টার এরকম নিরীহ চেহারা আর থাকবেনা। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলির সম্মিলিত অভিযান বা অনুসন্ধান পরিচালিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। সেরকম অভিযানের সম্ভাবনার কথা আশু মামা রূপককে জানিয়ে রেখেছে। আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়া এড়াতে রূপক যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ছত্রছায়ায় কাজ করছে তা উজবেক সরকারের খুব উঁচু পর্যায়ে জানানো আছে। আপাতত সেসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়াই সঙ্গত মনে করল রূপক। বলল
-জারা , আমি অনুসন্ধানের কাজে তোমাদের দ্বারস্থ কেন হলাম তা তো তুমি জানোই।
-হুঁ, সম্ভবত জানি।
-এসবে তোমার দাদু সোলেইমান আদহামের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। তাও তুমি জানো।
-জানি।
-তোমার দাদু একজন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের গবেষক । তৈমুরকে নিয়ে সারা দুনিয়ার গবেষকদের কাজ একত্র করলেও তাঁর কাজের সমান হবেনা। এছাড়া প্রত্মতত্ত্বের বিষয়েও তিনি উজবেকিস্তানের হাতে গোণা নির্ভরযোগ্যদের একজন।
-হুঁ, তারপর?
-কিন্তু এসব ছাড়াও একটা বিশেষত্ব আছে তাঁর যেটা আমাকে এখানে টেনে এনেছে।
-মানে?
-আপাত দৃষ্টিতে আমার কাছে তৈমুরের সমাধি যতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলে তুমি ভাবছ তার চাইতে জনাব সোলেইমান আদহাম অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ; তা কি তুমি জান?
-না তো। সেটা কীভাবে?
-তৈমুরের সমাধি নিয়ে প্রথম যে দলটি খোড়াখুড়ির কাজ করে সেটির নেতৃত্বে ছিলেন মিখাইল গেরাসিমভ। সেদলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, যিনি ছিলেন আবার সমরখন্দের স্থানীয় তিনি তোমার দাদু সোলেইমান আদহাম, তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়?
-জানি কম বেশী।
-কম বেশী মানে?
-দাদু আসলে এসব নিয়ে কারো সাথেই তেমন একটা কথা বলেন না, অন্তত আমি যতদূর জানি। আর তিনি এই প্রসঙ্গটাও পছন্দ করেন না।
-পছন্দ করেন না বলতে কী বোঝাতে চাইছ?
-তুমি জানো না রূপক, আমি জ্ঞান হবার পর থেকে একটা জিনিস দেখে আসছি। দাদু প্রায়ই স্টালিন কে অভিশাপ দেন তৈমুরের সমাধিতে অভিযান প্রেরণের জন্য। তখন দাদুকে অনেক গম্ভীর দেখায়। কাজটা দাদু একা একা যখন স্টাডি তে থাকেন তখন করেন। তুমি তো জানোই স্টাডিতে সবার প্রবেশাধিকার নেই।
-বল কি?
-হ্যাঁ, তাছাড়া আমি দাদুকে তার দলের নেতা মিখাইল গেরাসিমভকেও অভিশাপ দিতে, দায়ী করতে শুনেছি। সমাধি খননকালীন সময় গেরাসিমভ কোন এক আরবীয়দের মত দেখতে রহস্যময় বৃদ্ধের সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দেননি, সেটা নিয়েও দাদুর অসন্তুষ্টির শেষ নেই।
-হুম। আচ্ছা জারা, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই। আমাকে শীঘ্রই উজবেকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের দিকে একটু যেতে হবে। হিসেব করে দেখেছি সড়ক পথে প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টার রাস্তা। ট্রেনে করে যাওয়াই মনে হয় ভাল হবে। দীর্ঘ রাস্তা বাসে যাওয়াটা ক্লান্তিকর প্রমাণিত হতে পারে। কী বল?
-কবে যেতে চাও আর কেনই বা সেখানে যেতে হবে?
-সম্ভব হলে কাল পরশুই রওনা হতে চাই। আর কারণটা যদি বলি তাহলে বলতে হয়: আমু দরিয়া। আমু দরিয়া সম্পর্কে একটু জানতে চাই। তুমি মনে হয় এ ব্যাপারে আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পার।
-উজবেকিস্তানে নদীকে দরিয়া বলে। এটা সম্ভবত পারসি ভাষারীতির প্রভাব। পুরো মধ্য এশিয়ায় দুইটা উল্লেখ যোগ্য নদী আছে। একটা সির দরিয়া যেটা পরেছে বর্তমান কাজাখস্তানে। আরেকটা আমু দরিয়া। সির দরিয়ার নামে আমাদের একটা রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে, যেটা হয়ে আমরা তাসখন্দ থেকে সমরখন্দ এসেছিলাম। তোমার মনে থাকবার কথা।
-হুঁ, মনে পড়েছে। বলে যাও।
-আর আমু দরিয়া আফগানিস্তানে উৎপন্ন হবার পর প্রথমে তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান হয়ে পরে উজবেকিস্তানের ভিতর দিয়ে আরল সাগরে পড়েছে। এ নদীটি পারসি কিংবদন্তির সাথে নিবীড় ভাবে সম্পৃক্ত। আমি শাহনামার কথা বলছি; তুমি নিশ্চয়ই পড়েছ?
-ঠিক পড়েছি বলা যায়না। একটু আঁধটু জানি শাহানামা সম্পর্কে। মহাকবি ফেরদৌসির অমর রচনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
-বুঝলাম। শাহনামা প্রধানত রাজকাহিনী আর বীরকাহিনী এই দুই অংশে বিভক্ত। বীরকাহিনী অংশের প্রধান চরিত্র রুস্তম। তিনি ইরানের প্রধান সেনাপতি। অপর দিকে শত্রুরাজ্য তুরানের প্রধান সেনাপতি আফ্রাসিয়াব। উভয় পক্ষের সবচাইতে বড় যুদ্ধের সৈন্য সমাবেশ হয়েছিল আমু দরিয়ার দুই পাশে-অন্তত শাহনামায় সেরকমটাই বলা হয়েছে। তুমি শুনেছ নিশ্চয়ই পিতা রুস্তমের হাতে পুত্র সোহরাবের মৃত্যুর করুণ সেই কথা?
-হ্যাঁ। শাহনামার সবচাইতে হৃদয় বিদারক অংশ বোধহয় এটাই। আর শাহনামা সম্পর্কে বেশী কিছু জানে না এমন লোকেরাও কমপক্ষে সোহরাব-রুস্তমের এই করুণ কাহিনীটুকু অন্তত জানে।
-সেই করুণ কাহিনীর সাক্ষী আমু দরিয়া। একটা বিষয় খেয়াল করেছ রূপক?
-কী?
-তোমার কাজ-কর্ম, পরিকল্পনা কেমন কেমন করে যেন শুধু কিংবদন্তীগুলির সাথে গিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তৈমুরের অভিশপ্ত বস্তু এরপর আমু দরিয়া আর শাহনামা। আশ্চর্য! হাসব না অবাক হব বুঝতে পারছিনা।
-কোনটাই করতে হবেনা। আপাতত জেনে রাখ যে মৃত্যুর পূর্বে তৈমুর্র অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এমন একটা বিবৃতি ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেসময় তিনি সির দরিয়ার তীরবর্তী কোন অঞ্চলে তাবু ফেলে অবস্থান করছিলেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা তা নয়। মাঝখানে ভিন্ন একটা ঘটনা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
-সেটা কেমন?
-এই একটা ঐতিহাসিক ভুল সব হিসেবকে খাপছাড়া করে তুলেছে। তিনি একটা নির্দিষ্ট সময় অন্য কোথাও অবস্থান করছিলেন। জায়গাটা সির দরিয়ার তীরে ছিলনা।
-তাহলে?
-সেটা ছিল আমু দরিয়া। আর আমার সেখানে যাবার এই হল আসল কারণ।
জারা ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রূপক প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যা বলছে তা হজম হচ্ছে না ওর। বিস্মিত কণ্ঠে বলল
-রূপক,তুমি যা বলছ জেনে বুঝে বলছ তো?
-হ্যাঁ, জারা। আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব। আগে চল লাঞ্চ সেরে আসি। আজ আমি তোমাকে লাঞ্চ অফার করছি। আমি হোস্টের ভুমিকায় থাকব।
জারা একটু খানি স্মীত হেসে সম্মতি জানাল। তবে মনে হচ্ছে রূপক কথার প্রসঙ্গটা পাশ কাটাবার জন্যই আচমকা লাঞ্চের অফার সামনে নিয়ে এসেছে। রূপকের সঙ্গ ওর খারাপ লাগছেনা। আর তাছাড়া অনুসন্ধানের কাজটাতেও একটু একটু করে ওর আগ্রহ বাড়ছে। বলল
-জো হুকুম মহারাজ। চলুন।

হোটেলের ডাইনিং হলে লাঞ্চ করতে চলে এসেছে ওরা। রূপক এর মধ্যেই পশ্চিমা আইটেমের বদলে স্থানীয় ডিশের ভক্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য অবশ্য জারাদের পারিবারিক আপ্যায়নই দায়ী। তবে সে খুশি। টেবিল ভর্তি হরেক পদের খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল ওয়েটার।

আগেই খেয়াল করেছে রূপক খাওয়ার সময় জারা তেমন একটা কথা বলেনা। জারার সুয়েটারে মালার মত অর্ধচন্দ্রাকারে বসানো বড় বড় সাদা পুতিগুলির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপক। অনেক কথাই ছাড়া ছাড়া ভাবে মনে আসছে। কানাডা থেকে হুট করে দেশে আসা। মায়ের বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি, বোনের পাত্রী দেখা, বন্ধুদের বেসামাল টিটকারী আর আশু মামার ফোন কল। কেমন করে কয়দিনের মধ্যেই সব ঘটে গেল। আর এখন সে একটা ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে জড়িত রহস্যের সমাধান খুঁজতে উজবেকিস্তানে সুন্দরী এক তরুণীকে সামনে নিয়ে বসে আছে যার শরীরে পারস্যের শাসক নাদির শাহের রাজকীয় রক্ত বইছে। জীবনটা বড় অদ্ভুত তো!

খাবারটা খুব তৃপ্তিদায়ক ছিল। খেয়ে ওঠার পর নিজেকে কেমন ভারী ভারী বোধ হচ্ছে। রূপক ভাবছে,একটু বেশী খাওয়া হয়ে গেল নাকি? সুন্দরী সঙ্গীনী আর মজাদার খাবার নিজের নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসকে জলে ফেলল নাকি?

জারা আর রূমে ফিরে যেতে চাইলনা। রুপকও বেশী জোর দিয়ে বলেনি। বরং জারাকে এগিয়ে দিতে পার্কিং এরিয়া পর্যন্ত নেমে এল। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিল জারা। মেইন গেট দিয়ে না বেড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত গাড়ীর দিকে তাকিয়ে রইল রূপক।

আগামী পরশু দিনই আমু দরিয়া দেখতে যাবে বলে ঠিক করল। আসার পর মা’র সাথে দু’বার রাতের বেলায় কথা হয়েছ রূপকের। বিয়ে করতে বিদেশ থেকে ডেকে নিয়ে আসা ছেলে আবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এটা তাঁর একদমই ভাল লাগেনি। তিনি খোলাখুলিই নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ছেলের কাছে। রূপক অনেক করে বুঝিয়েছে যে এই অনুসন্ধান কাজটা শেষ হয়ে গেলে সে বিয়ের বিষয়টা সত্যিই সিরিয়াসলি দেখবে। এই কথায় মা খুব একটা উৎফুল্ল না হলেও আপাতত চুপ মেরে গেছেন। একবারে মুখের উপর না করে দেয়া ছেলে যে এতদূর বলেছে তাও অনেক। আশু মামার সাথে এর মধ্যে কথা হয়নি। তাকেও এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলি আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলে রাখা দরকার। যদিও মামা নিজের কাজ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে আছেন। তবে রূপকের কাজের গুরুত্ব আর ভয়াবহতা সম্পর্কে তার চেয়ে ওয়াকিবহাল আর কে আছে? রূপক রুমে ফিরে বেশ লম্বা সময় নিয়ে একটা মেইল টাইপ করল। তার পর মামার এড্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে নিল।

সোভিয়েত নেতা যোসেফ স্টালিনের বিষয়ে আলাদা একটা বড় ডকুমেন্ট পাঠিয়েছিলেন মামা। সেটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ভরপেট খাওয়ার পর এখন আর রিডিং টেবিলে বসতে মন চাইছে না ওর। স্ট্যাপল করা প্রিন্টেড ডকুমেন্টটা বত্রিশ পৃষ্ঠার। গুটি গুটি অক্ষরে পৃষ্ঠাগুলি ভর্তি। তবে বিরক্তিকর একঘেয়েমিপূর্ণ কথার পাশাপাশি আগ্রহী হবার মত কিছু তথ্যও আছে তাতে। রূপক একমনে পড়ে যেতে লাগল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খুটিয়ে পড়ে ডকুমেন্টটা শেষ করল। সাথে করে হাইলাইট পেন নিয়ে বিছানায় এসেছিল। শোয়া অবস্থাতেই কিছু কিছু লাইন আর শব্দ আলতো হাতে হাইলাইট করে নিল। এ লাইনগুলি রূপকের মনযোগ আকর্ষণ করেছে। চিহ্নিত করে রাখছে ও যাতে রাতের বেলায় ইন্টারনেটে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাতে পারে। ডকুমেন্টটা পড়ে রূপকের মনে হচ্ছে এতদিনের জানা তথ্য ছাড়াও এখানে বাড়তি কিছু আছে। স্টালিন শুধুই ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি তৈরীর জন্য তৈমুরের সমাধি খননের কাজে হাত দিয়েছিলেন এটা নিছকই ছেলে ভোলানো কথা। একজন ক্ষমতাশালী একনায়ক শুধু ছেলে মানুষি দিয়ে এতদূর আসতে পারতেন না। এখানে একটা কিছু না থেকে পারেই না।

আবার গোড়া থেকে ডকুমেন্টটা পড়তে শুরু করল রূপক। ঊনিশ পৃষ্ঠার কাছাকাছি আসতে আর চোখ মেলে রাখতে পারলনা। শীটের বান্ডিলটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

অজ্ঞাত প্রাণঘাতী জীবাণুর সংক্রমণের খবর এক যোগে সারা বিশ্ব-মিডিয়াগুলিতে প্রচারিত হচ্ছে। ভারত ও চীনের মত ঘণবসতিপূর্ণ দেশগুলির এক তৃতীয়াংশ লোক এর মধ্যে ফুসফুসের সংক্রমণে নিহত হয়েছে। আর কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। আমেরিকার মেইনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল, দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় অর্ধেক দেশ, পূর্ব ইউরোপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সত্তর ভাগ দেশের জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালগুলি আর রোগীর ভার নিতে পারছেনা। অনেক অনেক ফিল্ড হসপিটাল খুলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছেনা। বেড ছাড়িয়ে মেঝে,বাইরের করিডোর এবং খোলা মাঠে পর্যন্ত অগণিত রোগী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আর কাতরাচ্ছে। তাদের যন্ত্রণা কাতর চিৎকার পুরো পৃথিবীকে নরকে পরিণত করেছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক আর নার্স পাওয়াও কঠিন হয়ে গেছে। তারাও কমবেশী সংক্রমণের শিকার হচ্ছে। রূপকের মা রুশিয়া বেগম আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত রূপক আর তার বড় বোন হাসপাতালে ছোটাছুটি করছে। রূপকের মা শ্বাস নিতে পারছেন না। মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে চোখ দুইটা বেড়িয়ে আসবে। মায়ের কষ্ট দেখে রূপক রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়ছে। হাসপাতালে এত রোগীর ভীড় যে ডাক্তাররা আলাদা করে ওর মায়ের দিকে মনযোগ দেবার সময়ও পাচ্ছেন না। হঠাৎ একজন নার্স এসে রূপকে বলল ওর মাকে ভেতরে নিয়ে যেতে, ডাক্তার দেখবেন। রোগীর ট্রলিটা ঠেলে নিয়ে রূপক আর ওর বড় বোন নার্সের দেখানে পথ ধরে দ্রুত যাচ্ছে। কিছু একটা করা দরকার। হঠাৎ খেয়াল করল একটা কোমল হাত রূপকের ট্রলি টানা হাতটাকে ধরে আছে। পাশ ফিরে দেখতে পেল জারা। সেও রূপকের সাথে হাসপাতালে করিডোর ধরে দৌড়াচ্ছে। তবে মুখটা আশ্চর্য রকমের শান্ত। রুপক ভেবে পাচ্ছেনা এখানে বাংলাদেশে জারা আসল কখন আর ওরা যে এখানে আছে জানলই বা কীভাবে? কিন্তু এত কিছু পরে ভাবলেও চলবে। ডাক্তারে চেম্বারে চলে এসেছে ওরা। রূপকের মায়ের চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন ডাক্তার। ইমার্জেন্সী চেম্বারের পাশের জানালা দিয়ে হাসপাতালের সামনের পার্কিং এরিয়া আর গেট দেখা যায়। রুপক দেখল একসাথে আট দশটা এম্বুলেন্স আরও রোগী নিয়ে প্রবেশ করল। এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার দশা। প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে।

আচমকা জেগে উঠল রূপক।
বেড সাইড টেবিলে মোবাইল ফোনে এলার্ম বাজছে।
এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল! উফ্ , সারা গা ঘেমে গেছে। ঘামের কারণে মাথার চুলও ভেজা ভেজা হয়েছে। বুকটা এখনও ধরফর করছে। বিছানা থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল রূপক। মাথাটা বেশ ভার ভার লাগছে। মনে হয় গোসল দিলে ভাল লাগবে। চুপচাপ মিনিট পাঁচেক বসে থাকল। শরীরটা একটু স্থির হয়ে আসতে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমের দিকে চলল। দীর্ঘ সময় ধরে শাওয়ারের নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। আস্তে আস্তে শরীরটা শান্ত হয়ে আসছে। অস্থিরতাটা কমে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত