তৈমুরের অভিশাপ -৭

সাত.

ঊনিশশ একচল্লিশ সাল। মস্কো। সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ক্রেমলিনের অভ্যন্তরে পলিটব্যুরো চেয়ারম্যান তথা সোভিয়েত নেতার অফিস রুম। জোসেফ স্টালিনের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন নীতি নির্ধারক বসে আছেন। বাইরে আজকের তাপমাত্রা মাইনাস তিন ডিগ্রি। ঝড়ো হাওয়ার সাথে নিরবিচ্ছিন্ন তুষারপাত চলছে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও স্টালিনের মাথার মগজ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। সেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশী।

মিটিং টেবিলে স্টালিনের ঠিক মুখোমুখি উল্টোদিকে বসে আছেন এডমিরাল নিকোলাই কুযনেস্তভ। অফিসিয়ালি কৃষ্ণ সাগর আর ককেশাস অঞ্চলের সমুদ্রসীমার দায়িত্বপ্রাপ্ত । তবে তিনি স্টালিনের অনেক আস্থাভাজন একজন সমরনেতা। ডানে বসে আছেন প্রথমে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ। তারপর বসেছেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আর্টিলারী প্রধান লিওনিদ গভরভ। বামে আছেন প্রথমে ফিল্ড মার্শাল জর্জি জুকভ। তার পরে রয়েছেন স্টালিনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচাইতে উচ্চপদস্থ নেতা মিখাইল কালিনিন। পদমর্যাদা অনুসারে তাঁর বসার কথা স্টালিনের পাশেই। সেটিই বরং বেশী শোভন হত। কিন্তু তিনি একটু নিভৃতে অবস্থান করতে পছন্দ করেন। পর্দার অন্তরালে থেকে কৌশলী ভূমিকা রাখতে পছন্দ করেন। বাহ্যিক ভাবে তাকে দেখলে মনে করাই কঠিন তিনি কতটা ক্ষমতা নিয়ে আছেন।

স্টালিনের চেহারায় এমনিতেই একটা ক্রোধ ফুটে থাকে সবসময়। আর বাকানো ডগার গোঁফ তাঁর মধ্যে একটা অতিরিক্ত নির্দয় ভাব যোগ করেছে। স্টালিন সমাজের একেবারে প্রান্তিক শ্রেণী থেকে বুদ্ধি আর কৌশলের জোরে উপর তলায় উঠে আসা মানুষ। ভণিতা একদম পছন্দ করেন না এবং নিজের চিন্তাধারা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা তাঁর মধ্যে প্রবল। পলিটব্যুরোর প্রায় সবাই তা জানেন। সেজন্য পারতপক্ষে স্টালিনকে কেউ ঘাটান না। তবে আজকের বৈঠকটি ঠিক পলিটব্যুরোর বৈঠক বলা চলেনা। স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীকে এড়িয়ে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন।

উপস্থিত সবার মধ্যে একটা চাপা অসস্তি কাজ করছে। নির্দয় ব্যক্তিটিকে সবাই সমঝে চলার চেষ্টা করেন। সবার থমথমে চেহারাকে একদমই পাত্তা না দিয়ে কথা শুরু করলেন স্টালিন
-জেন্টলম্যান। আমি আপনাদের সাথে বিশেষ একটা পরিকল্পনা শেয়ার করার জন্য ডেকেছি। আমার ধারণা পরিকল্পনা আপনাদের অপছন্দ হবেনা। আমি আশা করছি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আপনাদের আন্তরিক সহযোগীতা সব সময়ের মত বহাল থাকবে। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি কথা শুরু করতে চাই।

কালিনিন ভাবছেন, শুরু হয়ে গেল একরোখামি। আলোচনা শুরুর আগেই মতামতের জাত মেরে দিয়ে সমর্থন চাইছেন। স্টালিন একজন একগুয়ে একনায়ক এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই বলে তা এমন নোংরা প্রক্রিয়ায় প্রকাশ না করলেও হত। কথার ধরণই বলে দিচ্ছে তিনি কারও মতামতের ধার ধারবেন না এবং ওজর আপত্তি থোরাই কেয়ার করবেন।

স্টালিন তার স্বভাব সুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন
-আপনাদের নীরবতাকে সমর্থন মনে করে আমি ধরে নিচ্ছি কারও আপত্তি নেই, তাই শুরু করছি। কথা হল, আপনারা জানেন জার্মান নেতা হিটলারের সাথে ঊনিশশো ঊনচল্লিশ সালের তেইশ আগস্ট আমাদের অনাক্রমণ চুক্তি সম্পন্ন হবার পর থেকেই তার পররাষ্ট্রনীতিতে উদ্বিগ্ন হবার মত পরিবর্তন এসেছে। জার্মানীর কার্যকলাপ আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রদখল মনে হলেও এর সুদূর প্রসারী লক্ষ্য কিন্তু আলাদা।

উপস্থিত ব্যক্তিরা কেউ কিছু বলছেন না। তাঁরা ভাল করেই জানেন স্টালিন নিজেও একই পথে হাঁটছেন। ইতোমধ্যেই জবরদখল এর মাধ্যমে পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার আংশিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । আর লাটভিয়া, লিথুনিয়া ও এস্তোনিয়ার মত বাল্টিক রাষ্ট্রগুলিও সোভিয়েত ইউনিয়ন হজম করে ফেলেছে। অথচ স্টালিন নিজের অজ্ঞাত পরিকল্পনার বৈধতা দিতে হিটলারের অপকর্মের দোহাই দিচ্ছেন।
স্টালিন বলছেন
-হিটলারের কুনজর পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরীর উপর পড়েছে। এছাড়া আমাকে যে বিষয়টি সবচাইতে ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে তাঁর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি। আমরা গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছি যে হিটলার তার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে ব্যপক ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন করার দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। জার্মান বিজ্ঞানীরা দিন রাত এক করে এ ব্যাপারে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এত অল্প সময়ের মধ্যে তা কীভাবে সম্ভব হল জার্মানদের দ্বারা? আপনারা জানেন ক্ষমতালোভী হিটলার শুরু থেকেই অতিপ্রাকৃত শক্তির অনুসন্ধানে বিশেষ মনযোগ দিয়েছেন?

ঠিক এ পর্যায়ে এডমিরাল কুযনেস্তভ স্টালিনের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অসহায় ভঙ্গি করলেন আর ডান হাত সামান্য উপরে তুললেন। তিনি কিছু বলতে চান। স্টালিন ভুরু উঁচু করে আর মাথা সামান্য ডানে হেলিয়ে এডমিরালকে বলতে সুযোগ দিলেন। কুযনেস্তভ বললেন
-মি. চেয়ারম্যান, স্যার। আমরা জানি এডলফ হিটলার স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের প্রাচীন গির্জাসমূহে, পর্তুগালের উপকূলে আর তিব্বতের বৌদ্ধ মঠে অভিযান পরিচালনা করে চলেছেন অতীত উপকথায় বর্ণিত দৈব শক্তির উৎস সংগ্রহের চেষ্টায়। এমনকি এন্টার্কটিকার দূর্গম অঞ্চলেও চেষ্টা করছেন আটলান্টিস নামক কাল্পনিক শহরের অতিপ্রাকৃত এনার্জি সোর্স খুঁজতে। আপনি কি সেসব বিষয়ে বলছেন?
স্টালিন তার গুরু গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন
-হ্যাঁ, কেন?
কুযনেস্তভ বললেন
-মি. চেয়ারম্যান, স্যার। আপনি এ পৃথিবীর একমাত্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের তথা সবচাইতে বড় রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা। আমাদের এই আদর্শ গড়েই উঠেছে ঈশ্বর বিশ্বাসের মত অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে বাদ দিয়ে। আমরা বাস্তবতা দিয়ে সমাজকে বদলবার শপথ নিয়েছি। আর আপনি প্রাচীন ঈশ্বরের শক্তি অনুসন্ধানকে সিরিয়াসলি বিবেচনা করছেন? আমার কিন্তু ব্যপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

সবাই জানে এডমিরাল যথেষ্ট সাহসী এবং স্টালিনের সংগে আলোচনায় এর আগেও অনেকবার তিনি তাঁর যুক্তি নির্ভয়ে উপস্থাপন করেছেন। তার সব কথা যে স্টালিন রাখেন তা নয়, তবে যোগ্যতা আর বিশ্বস্ততার জন্য তাকে সমীহ করেন। তাই এডমিরালের এরূপ খোলা মেলা প্রশ্নে কেউ অবাক হননি।
স্টালিন বললেন
-প্রিয় এডমিরাল, আপনার কথায় যুক্তি আছে বটে। তবে জেনে রাখুন, ঈশ্বরে আমার কোন প্রয়োজন নেই এবং তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেও না। আমি আসলে গুরুত্ব দিচ্ছি ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সেই সব ক্ষমতাকে যা দিয়ে এক সময় তারা অতীত পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম কানুনকে করায়ত্ব করেছিল। সেসব ক্ষমতার উৎস তথাকথিত ঈশ্বর নাকি অন্য কেউ তা নিয়ে আমি ব্যস্ত নই। আমার প্রয়োজন ক্ষমতার সেসব উৎস যার দ্বারা মাদার রাশিয়ার গৌরবময় অতীত ও সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে পূর্ণতা দেয়া যাবে। আশা করি আমার মনোভাব আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

পুরো কক্ষে হিটারের একটা সামান্য গুঞ্জণ ছাড়া আলাদা কোন শব্দ নেই। বামে বসা মার্শাল জুকভ এতক্ষণ তার মোটা ভুরুর নীচের অন্তর্ভেদী চোখ দিয়ে স্টালিনের দিকে দেখছিলেন। পুরো ইউনিফর্ম তাঁর মেডেল আর পদকে ঝলমল করছে। তিনি খুব ঠাণ্ডা সুরে বললেন,
-মি. চেয়ারম্যান, আপনি কি উল্লেখিত স্থান সমূহে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আলাদা অভিযান প্রেরণ করতে চাইছেন?

স্টলিন বললেন
-না, তা নয়। আমার লক্ষ্য ভিন্ন। ইতোমধ্যেই হিটলারের কার্যকলাপ আমাদের নজরে যেমন এসেছে তেমনি বৃটিশ বা আমেরিকানদের নজরেও এসেছে। বৃটিশ সাম্রাজ্য আর মার্কিনিরা যে নিরেট শয়তান সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষাই রাখেনা। শীঘ্রই যে তারাও সেসব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। আর কোন মাত্রাছাড়া শক্তি হিটলারের হাতে পড়ার চেয়ে ইঙ্গো-মার্কিনিদের হাতে পড়াকে আমি অধিক বিপজ্জনক মনে করি। তাই আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা অভিযানের পরিকল্পনা করেছি।

এবার কথায় অংশগ্রহণ করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ। ক্লীন শেভ করা মুখে গোঁফটা তাঁর চেহারায় একটা বাড়তি সরলতা এনে দিয়েছে। তাঁর কপাল খানিকটা কুচকে রয়েছে। অনাক্রমণ চুক্তির তিনি অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। বেশ উদ্বিগ্ন গলায় তিনি বললেন
-মি. চেয়ারম্যান। আপনি যদি এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহলে কমিউনিস্ট আদর্শ আর আপনার ভাবমূর্তি মাটিতে মিশে যাবে। আর তাছাড়া পশ্চিমা মিডিয়ার কুকুরগুলি তারস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করবে। এমনিতেই ওরা কমিউনিজমের দোষ খোঁজার জন্য সর্বক্ষণ ওঁত পেতে আছে।

স্টালিনের মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল। দৃশ্যটা দূর্লভ বটে। তিনি বললেন
-মি. মলোটভ , আপনার আশঙ্কাকে আমি সম্মান করি। তবে, পুরো অপারেশনটা ছদ্মাবরণেও তো হতে পারে। আমরা এর সামরিক বা রাজনৈতিক দিকটাকে সম্পূর্ণ অদৃশ্যে রেখে অন্য নামে কাজটা করে যাব। আমরা যেভাবে চাইব স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ বিষয়টাকে সেভাবেই জানবে। তাহলে চিন্তার আর কোন কারণ থাকবেনা।

মিখাইল কালিনিন বিরক্তির সাথে কথাগুলি শুনছিলেন। শুরু থেকেই স্টালিনের হাব ভাব তার পছন্দ হচ্ছিল না। লোকটা তার মোটা মাথা থেকে যা বেরোয় তাই করে। শুধু মাত্র নির্দয়তাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পলিটব্যুরোর উপর একক কর্তৃত্ব ধরে রেখেছেন। সব জেনেও কিছু বলা যাচ্ছেনা। কালিনিনের রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা স্টালিনের বিপরীত। তাই প্রতিটা কাজে আত্মসংবরণ করতে তাঁকে রীতিমত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন
-মি. চেয়ারম্যান, স্যার। আপনি কিন্তু আমাদের এখনও বলেননি ঠিক কোথায় আর কীভাবে অভিযান প্রেরণের মনস্থ করেছেন আর তার দ্বারা ঠিক কী লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে বলে মনে করছেন । আমার মনে হয় সব জানলে আমরা আরও বাস্তবসম্মত মতামত দিতে পারব।

স্টালিন মুখ ঘুরিয়ে কালিনিনের দিকে তাকালেন । স্টালিনের ডান ভুরুটা অনেক বেশী উঁচু হয়ে আছে। এর মানে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। স্টালিনের অভিব্যক্তি দেখে কালিনিন খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করছেন। স্টালিন বলতে শুরু করলেন
-আমাদের অভিযান পরিচালিত হবে মধ্য এশিয়ায়। সুনির্দিষ্ট করে বললে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে।
মার্শাল জুকভ জিজ্ঞেস করলেন
-মি. চেয়ারম্যান। উজবেকিস্তানকে বেছে নেয়ার নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে?
স্টালিন বললেন
-হ্যাঁ। কেজিবির সাথে রুটিন ব্রিফিং এর সময় সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট একটি ফাইলের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেটা কবেকার ঘটনা তা আমাদের এই বৈঠকের বিষয় নয় বিধায় সে কথায় যাচ্ছিনা। ফাইলটার শিরোনাম ছিল ‘নাদির শাহ ও তৈমুর কানেকশন’। এতটুকু বলার পর সবার মধ্যে বাড়তি মনযোগের ছাপ দেখা গেল।

স্টালিন বলে যাচ্ছেন
-সতেরশ চল্লিশ সালে ইরানের সম্রাট নাদির শাহ উজবেকিস্তানে বিশেষ একটা অভিযান প্রেরণ করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল সমাধি হতে তৈমুরের কফিন উঠিয়ে ইরানে নিয়ে আসা। ওঠাবার সময় কফিনের পাথরের ঢাকনিটা ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেলে বিজ্ঞ উপদেষ্টারা বিষয়টিকে অশুভ ভেবে এ কাজ থেকে নাদিরকে বিরত হতে অনুরোধ করেন। পরে ব্যপারটা আর এগোয়নি। উপদেষ্টারা জানিয়েছিলেন তৈমুরের দেহাবশেষকে শান্তিতে থাকতে দেয়া উচিত। নাদির শাহের উপদেষ্টাদের মধ্যে অন্তত একজন সিরীয় আরব ছিলেন। অতঃপর আবার কফিনটা সমাধীস্ত করে অভিযান অসমাপ্ত রেখেই সংশ্লিষ্টরা ফিরে আসে। সতের শতকের পরে উজবেকিস্তানের ঐ অঞ্চলটা এখন পর্যন্ত প্রায় পরিত্যাক্তই আছে। কেজিবি-র এ বিষয়ে মনযোগী হবার কারণ হল-নাদির শাহ কী জন্য তৈমুরের কফিন ইরানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন? ইতিহাস একে শুধুই আদর্শিক ভক্তি বললেও একটা অজানা অধ্যায় গোপনই রয়ে গেছে।

এরপর আর কুযনেস্তভ চুপ থাকতে পারলেন না। বললেন
-গোপন অধ্যায়টি কি মি. চেয়ারম্যান,স্যার?
স্টালিন জবাব দিলেন
-নাদির জানতে পেরেছিলেন তৈমুর বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হয়েছিলেন কোন এক দৈব শক্তির নেপথ্য সহায়তায়। আর সেই দৈব শক্তি তৈমুর তার মৃত্যুর আগে কাউকে হস্তান্তর তো করেনইনি উপরন্তু তা তৈমুরের মৃতদেহের সাথে সমাধিস্ত হয়েছিল। সেটি সংগ্রহই ছিল নাদিরের উদ্দেশ্য। আপনারা জানেন নাদির খুব বেশী সময় ক্ষমতায় থাকেননি।

একটু বিরতি নিয়ে স্টালিন বললেন
-এ পর্যায়ে আমি বলব, আজকে অভিযানের বিষয়টি আপনাদের প্রাথমিক ভাবে জানালাম। আমি কেজিবির ঐ ফাইলটির পাঁচটা কপি তৈরী করিয়েছি যা এখন আপনাদের দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে প্রচলিত ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশী তথ্য আপনাদের দৃষ্টিগোচর হবে। আজ ও আগামীকাল আপনাদের জন্য এক্সক্লুসিভ হোমওয়ার্ক থাকল এই ফাইল। আগামী পরশু ঠিক এখানেই আমাদের দ্বিতীয় ও সমাপনী মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেই মিটিং এ আমরা অভিযানের রূপরেখা চুড়ান্ত করব। জেন্টলম্যান। আজকের মিটিং এখানেই শেষ হচ্ছে।

স্টালিন ড্রয়ার থেকে সবাইকে ফাইলের একটি করে কপি সরবরাহ করে বিদায় জানালেন। ফিরে গিয়ে ফাইলের তথ্য বিস্তারিত পরে সবাই চমকে উঠলেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এমন সব বর্ণনায় ভরা। জানা গেল নাদিরের অভিযানে তৈমুরের কফিন ভাঙার পর যখন সবাই কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিল, তখন নাদিরের অভিযান উপদেষ্টাদের সাথে তিন জন আরব বৃদ্ধ দেখা করেন, এবং ছিন্ন প্রায় প্রাচীন একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে তাদের নিষেধ করেন কফিন স্থানান্তর করতে। নাদিরের অভিযান উপদেষ্টাদের একজন সিরীয় আরব ছিলেন যিনি অল্প আরামায়িক ভাষাও জানতেন। তিনি আরব বৃদ্ধদের কথা অনুবাদ করে পারসীদের বুঝিয়ে বলেন এবং ছিন্ন পাণ্ডুলিপির লেখা পড়ে বুঝতে পারেন সেখানে সতর্কবাণী লেখা রয়েছে। তারপর সেই আরব উপদেষ্টার ব্যপক চেষ্টা তৎপরতায় অভিযান স্থগিত করতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে অভিযাত্রীরা ফেরত যান।

মাঝখানের একদিন বিরতি দিয়ে তৃতীয় দিনের বৈঠক যথারীতি বসল। সেখানে অভিযান চুড়ান্ত করা হল। কেজিবি’র কাছে একজন বিশেষজ্ঞের সন্ধান আছে যার নাম মিখাইল গেরাসিমভ। তিনি প্রত্মতত্ত্ববিদ এবং কারও দেহাবশেষ দেখে ও বিশ্লেষণ করে তার জীবন্ত চেহারার ছবি বা ভাস্কর্য তৈরী করতে পারেন। তাই সিদ্ধান্ত হল গেরাসিমভের নেতৃত্বে একটা প্রত্মতাত্ত্বিক অভিযান প্রেরিত হবে উজবেকিস্তানে। সেখানে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য গোপন রেখে কাজ চালানো হবে। সবাই জানবে তৈমুরের কোন প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য না থাকায় সেটি করার উদ্যোগ নিয়েছে সোভিয়েত প্রশাসন। তাই সংশ্লিষ্ট কাজের প্রয়োজনেই স্বল্প সময়ের জন্য সমাধি খোড়া হবে, এবং কাজ শেষে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া হবে।

মার্শাল যুকভ ও কেজিবি প্রধানের সমন্বিত বিবেচনায় কয়েকজন সামরিক সদস্যকে বেসামরিক পরিচয়ে অভিযাত্রী দলের অন্তর্ভুক্ত করা হল। বিষয়টি শুধু এই বৈঠকের সদস্যরাই জানবেন। প্রকৃত উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারী বা বেসরকারী কোন ব্যক্তি বা এমনকি গেরাসিমভ এর দলের অন্য সদস্যরাও জানবে না। গেরাসিমভও আংশিক জানবেন। সংশ্লিষ্ট দৈব শক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব হলে তা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে মস্কোয় নিয়ে আসা হবে।

স্টালিন সবাইকে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে স্মরণ করিয়ে দিলেন এই অভিযানের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে। প্রথমত এর উদ্দেশ্য নিরাপত্তা জনিত কারণে এবং পশ্চিমাদের কাছে আড়াল করার প্রয়োজনেই প্রকাশ করা যাবেনা। আর তাছাড়া সোভিয়েত জনগণকে কমিউনিজম এর আদর্শের বিষয়ে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতেও এর গোপনীয়তার প্রয়োজন রয়েছে। চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সদস্যরা সভাস্থল ত্যাগ করলেন। তারা নিজেরাও নিশ্চিত নন আসলে ঠিক কি নিয়ে তারা খেলতে নামছেন। যদি ফাইলের তথ্যগুলির অর্ধেকও সত্য হয়ে থাকে তাহলে এই অভিযান স্টালিনকে তার স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করবে, অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নে একটা অশুভ কালোছায়া বিস্তারের রাস্তা তৈরী করবে।

মিটিং রুম ছেড়ে সবাই চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ স্টালিন তার চেয়ারে বসে রইলেন। পশ্চিমাদের টেক্কা দেয়ার এটা একটা উপায় হলেও হতে পারে। চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। মাথাটা একটু হেলিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন। সমস্ত মনযোগ যেন মিটিং রুমের মেঝের দিকে। দুপুর একটা বাহান্ন বাজে। ঠিক দুইটা দশে তাঁর লাঞ্চ করবার কথা। কয়েকটা ফাইলও সই করা বাকী। কিন্তু অন্য কোনদিকেই মন দিতে পারছেননা তিনি। উজবেকিস্তানের সমরখন্দের এখন আর তেমন জাঁকজমক নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন বসতী ছাড়া শহরটা তার প্রাচীন জৌলুস হারিয়েছে। বিশেষত সিল্ক রোডের বিস্মৃতির পর থেকে পূর্ব ইউরোপ আর দূর প্রাচ্যের এই সংযোগ স্থল আগের মর্যাদায় নেই। এর অবশ্য একটা সুবিধাজনক দিক আছে। গুরুত্বহীন জায়গায় অভিযান পরিচালনা ও তার মূল উদ্দেশ্য গোপন রাখা তুলনামূলক সহজ,স্টালিন ভাবছেন।

দেখা যাক এ অভিযান সোভিয়েত ইউনিয়ন আর তার নিজের জন্য কী ফলাফল নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত