তৈমুরের অভিশাপ -৮

আট.

নুকুস, আমু দরিয়ার পূর্বে অবস্থিত শহর। উজবেকিস্তান।

গতকাল সকাল আটটায় বেরিয়েছিল ওরা নুকুস এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছেছে সন্ধ্যায়। পথে বোখারায় লাঞ্চ করে নিয়েছে। এ-থ্রি এইটি রুট ধরে গাড়ীতে ওদের সাড়ে আট ঘণ্টা লাগার কথা ছিল। কিন্তু লেগেছে আসলে প্রায় দশ ঘণ্টা। এতখানি পথ জার্নি করেও জারা আশ্চর্য রকমের ফুরফুরে আছে। রূপক বিস্মিত হয়েছে ওর এনার্জি লেভেল দেখে।

উজবেকিস্তান-তুর্কমেনিস্তান সীমান্তের পূর্ব পাশে নুকুস শহরের সেন্ট্রাল মার্কেটের একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে জারা আর রূপক। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছে। রেস্টুরেন্টের নাম আজিয়ানা। রেস্টুরেন্ট থেকে চার কিলোমিটার দূরেই আমু নদী। আর ঠিক তেইশ কিলোমিটার পশ্চিমে তুর্কমেনিস্তান সীমান্ত। নুকুস উজবেকিস্তানের ষষ্ঠ বড় শহর হলেও বেশ ছিমছাম আর পরিপাটি, নাগরিক কোলাহল তুলনামূলক কম। স্বায়ত্বশাসিত কারাকালপাকস্তান প্রদেশের রাজধানী এটি। একটি আধুনিক মানের শহরের প্রায় সব কিছুই এখানে রয়েছে।

গতকাল সকালে বাসে করে নুকুস আসতে চেয়েছিল রূপক কিন্তু রাজি হয়নি জারা। ওর জেদের কাছে রূপককে হার মানতে হয়েছে। জারার শেভ্রোলেটে করেই বেরিয়ে পড়েছিল ওরা।
দশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় নয় ঘণ্টাই রূপককে লেকচার দিতে হয়েছে। দু’জনের বোঝা-পড়াটা বেশ এগিয়েছে এই লম্বা ভ্রমণে। ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে রূপকের ছেলে বেলার গল্প শুনতে চেয়েছিল জারা। প্রথমটায় কাজের বিষয় ছাড়া অন্য কথা বলতে চায়নি রূপক, নানা কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু জারা নাছোড়বান্দা। শেষতক শুধু ছেলে বেলা নয়, বড় বেলার কাহিনীও বলিয়ে ছেড়েছে। গল্প করতে করতে এক সময় রূপকও খেয়াল করল অতীতের কথা বলতে তার নিজেরও ভাল লাগছে। আসলে এমন করেতো নিজের কথা কোনদিন কাউকে বলা হয়ে উঠেনি। অতীত জীবনের অদ্ভুত এই মুহুর্তগুলি সময়ের কোন ফাঁক গলে বেড়িয়ে গেছে খেয়াল করা হয়নি।

গাড়ির চাকার ঘুর্ণনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল রূপকের নিজের কথা-
আপাত শান্ত রূপককে যেমন দেখায় ও মোটেও তা নয়। কবি নজরুলের অগ্নিগিরি গল্পের কিশোর নায়কের মত তার ভেতরেও অন্য এক রূপক বাস করে হয়তো। নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনা পরিবারে তেমন একটা ফলাবার সুযোগ ছিলনা। এমনকি নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতেও কয়েকবার কেশে নিতে হত। এমনটাই ছিল মোটামোটি রূপকের শৈশব। বালক রূপক যখন হাইস্কুলে উঠল তখন মা তার আদরের ছেলেকে একা বন্ধুদের সাথে স্কুলে যেতে দিতে চাইতেন না। বড় বোন রাজিয়া সবে কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নাদুস নুদুস রূপককে রাজিয়া সাথে করে বাসা থেকে নিয়ে আসত। আধা কিলোমিটার দূরের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কলেজে যেত। ফেরার সময় অবশ্য রূপক অন্য সহপাঠীদের সাথেই ফিরত।

স্কুলের একমাত্র সুবোধ ছাত্রটিকে ধরে ধরে দিয়ে যেতে হয়; এজন্য বন্ধুদের কাছে রূপকের লজ্জার সীমা পরিসীমা ছিলনা। কিন্তু মায়ের কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে এহেন বেইজ্জতি হাসি হাসি মুখ করে সয়ে যেতে হয়েছে। ক্লাস সিক্সে উঠার পর হাইস্কুল সম্পর্কে রূপকের ধারণাটাই মিথ্যে হয়ে গেল যখন প্রথমদিনেই দেখল ক্লাস ভর্তি ফুটফুটে সব মেয়েরা বসে আছে। পাশেই একটা আস্ত গার্লস হাইস্কুল থাকতে গার্জিয়ানরা কেন যে এদের বয়েজ হাইস্কুলে ভর্তি করিয়েছে তা ই কোনদিন মাথায় ধরেনি রূপকের। আর স্কুল কর্তৃপক্ষেরও তো একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকা চাই। তারাই বা কেন মেয়েদের ভর্তি করাবে? ক্লাসে থাকার সময় কালো অক্ষরগুলির চেয়ে মেয়েদের কালো চোখের ঘন পাপড়িই বেশী টানত রূপকদের। শিশু বয়সের সেকি অদ্ভুত ভাল লাগা না লাগা। মনে পড়লে এখনও হাসি আটকে রাখা কঠিন হয়ে যায়।

রূপক বলে যেতে থাকে । আর জারা এক মনে শুনতে থাকে। তবে মেয়েদের বর্ণনা যখন আসে জারা যে তখন মুখ চেপে হাসে তা রূপক ঠিকই বুঝতে পারে । তবে ও যে বুঝতে পারছে তা জারাকে বুঝতে দেয়না-
নাইনে উঠতেই শয়তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল রূপকদের কাছে। সাজ্জাদ স্যার বলে বদমেজাজী এক স্যার ছিলেন। ইংরেজী পড়াতেন। এই স্যারের পিরিয়ডটা শুরু হলে ছাত্ররা অনুভব করত পড়াশোনা মানব জীবনের জন্য কত জঘণ্য একটা ঘটনা। ‘স্যার’ জিনিসটা এত খারাপ হতে পারে আর ‘ক্লাস’ এত বিরক্তিকর হতে পারে তা আগে জানা ছিলনা। রুপকরা কয়েকজন মিলে পরামর্শ করল অন্তত এই ক্লাসটা বাদ দিতেই হবে। পড়ালেখা আর বিশেষ করে ইংরেজী শেখার জীবনে দরকার আছে ঠিকই। কিন্তু জানটা বাঁচানো আগে দরকার। ওদের ক্লাস বিল্ডিং এর পঞ্চাশ হাত দক্ষিণেই ল্যাবরেটরি বিল্ডিং। সেখানে একটা পুরাতন আমগাছ কাত হয়ে দালানের গায়ে হেলে পড়েছে। ফলে একটু কায়দা করলেই গাছ বেয়ে সোজা ল্যাবরেটরীর ছাদে উঠে যাওয়া সম্ভব। আর এটাই হল সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্লাস বাদ দেয়ার একমাত্র উপায়। যে পরামর্শ সেই কাজ। দিন দুয়েকের মধ্যেই ওরা ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করল। রূপকদের চার পাঁচজনকে আর সাজ্জাদ স্যারের ক্লাসে দেখা যেতনা। ক্লাসের বন্ধুরা জানে ওরা কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে কিন্তু সেটা ঠিক কোন জায়গায় কেউ বুঝতে পারেনি।

কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পিরিয়ড ছাদে বসে এমনি এমনি তো আর কাটানো যায়না। তাই ওরা ঠিক করে নিল প্রতিদিন পালা করে সবাই যার যার ব্যক্তিগত জীবনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করবে। তাতে করে সময়টাও ভাল কাটবে আর একঘেয়েমী থেকেও বাঁচা যাবে।
ভৌতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ফলাফল হল ভয়াবহ। দ্বিতীয় দিনে অনিকের অভিজ্ঞতা শোনার পর থেকেই ঝামেলা বেঁধে গেল। শালা এমন এক গল্প ফেঁদেছে যার মধ্যে সব ভয়ঙ্করতা একটা পুরাতন শ্যাঁওলা পড়া আমগাছকে ঘিরে। তাই পরের দিন আর কেউ আমগাছ বেয়ে ছাদে উঠতে চাচ্ছেনা। গাছটার দিকে তাকালেই ভূত-প্রেত চোখের সামনে ভেসে উঠে। এদিকে নীচে থাকাও নিরাপদ নয়। স্কুলের কোন দপ্তরীর চোখে পড়ে গেলে সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিশেষ করে মজিব দপ্তরীটা তো আস্ত হারামজাদা। সারাক্ষণ ছাত্রদের সর্বনাশ করার ধান্ধায় থাকে। অন্তত রূপকদের তাই ধারণা। ও আবার ল্যাবরেটরীর ডিউটিতে থাকে বেশী। মহাচিন্তার কথা।
বাধ্য হয়ে সবাই ভিন্ন পথ ধরল। পাশাপাশি বানানো টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা দুইটা টয়লেট ছিল। যখনই কোন মানুষজনের আওয়াজ কানে আসত ওরা টয়লেট দুইটার একটাতে তিনজন আরেকটাতে দুইজন করে ঢুকে বসে থাকত। কী বিশ্রী অবস্থা। স্কুলের ছাত্ররা মোটেও পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে সচেতন নয়। ফলে বমি আটকানোটাই ছিল ঐ সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এ পর্যায়ে এসে জারা উচ্চ শব্দে না হেসে পারলনা। গল্প চলতে থাকে আর জারা ড্রাইভিংয়ে থেকেও মন্ত্র মুগ্ধের মত শোনে। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে বসল
– একটা কথা জিজ্ঞেস করি? খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ততদিন পর্যন্ত কোন মেয়েকে ভালবাসনি? এক মুহুর্তের জন্যও কাউকে ভাল লাগেনি?
– গল্পের মাঝে হঠাৎ এ কথা কেন?
-মানুষ ঐ বয়সটাতেই তো ভুল করে প্রেমে পড়ে বেশী এবং ঐ প্রেমগুলির বেশীরভাগই টেকেনা তবে একটা সুক্ষ্ম ক্ষত রেখে যায়। কি ভুল বললাম?
রূপক অবাক হয়ে তাকায় জারার দিকে। চিন্তিত চেহারা নিয়ে বলে
-জারা, তোমার উজবেকিস্তানে জন্ম নেয়া মোটেই ঠিক হয়নি। তুমি একদমই বাঙালী মেয়েদের মত কথা বলছ।
-সে নাহয় মানলাম , কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দাওনি।
-প্রেম ট্রেম তো বলতে পারছিনা। তবে একমুহুর্তের জন্য একবার শিউরে উঠেছিলাম তা বলতে পারি। মানে ঐ বয়স পর্যন্ত আর কি।
-সেটা কীভাবে?
-বলছি। ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর আমার এক কাজিন আসল বাসায়। বড় ভাই বলতে পার। তিনি মাকে অনেক অনুরোধ করে আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন ওনাদের বাসায়। বাসা ছিল পাহাড়ী এলাকায়। ওনার বাবা ফরেস্টের চাকরি করতেন বিধায় ওখানে সরকারী কোয়ার্টারে থাকতেন। কোয়ার্টার এরিয়ার সংলগ্ন নীচু একটা পাহাড়ী টিলার উপর প্রতিরাতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত। ওখানে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট রেডি করা ছিল। লাইটিংএর ব্যবস্থাও ছিল। আমি খেলতাম না। পাশে দাড়িয়ে ভাইয়ার খেলা দেখতাম। ফরেস্ট কোয়ার্টারের বেশ কয়েকটা বাসা থেকে ছেলেরা আসত খেলতে আর খেলা দেখতে। ভাইয়াদের প্রতিবেশী একটা মেয়েও আসত খেলা দেখতে। পরে জেনেছি ওই মেয়েটার বাবা আঙ্কেলের মানে ঐ ভাইয়ার বাবার সহকর্মী। মেয়েটা আমার বয়েসীই হবে। বা দুয়েক বছরের বড়-ছোট হতে পারে, ঠিক বলতে পারছিনা। শীতের সময় পাহাড়ের উপরের দিকে শীত আরও বেশী লাগে। শিরশিরে বাতাস গরম পোশাক ভেদ করে হাঁড়ে গিয়ে লাগে। যেহেতু পাহাড়টা খুব উঁচু নয় তাই নীচ থেকে উঠতে মিনিট দশেক লাগে। একদিন ঠাণ্ডায় জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সে জায়গাটা একটু অন্ধকার ছিল কারণ কয়েক ফুট পেছনেই পাহাড়ী ঘাসের উঁচু ঝোপ। খেলার প্রতি খুব মনযোগ ছিল আমার ফলে প্রতিবেশী সেই মেয়েটা কখন এসে আমার কাছে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ গালে একটা কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই আমি শিউরে উঠলাম। এরকম অভিজ্ঞতা আমার কোনদিনই হয়নি। দেখি মেয়েটা আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ওর পড়নে হালকা গোলাপী রঙের একটা পোশাক। অন্ধকারেও ওর মুখটা উজ্জল দেখাচ্ছিল। ওর চুল ছিল পশ্চিমাদের মত লালচে সোনালী। আমি বিস্মিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকালাম। আমার চোখে প্রশ্নবোধক একটা ভাব। তখনও আমার গালে ও হাত দিয়ে স্পর্শ করে আছে। আমি মুখে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। তবু সে কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল- একটা পোকা বসে ছিল। তারপর আচমকা গাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে হন হন করে হেঁটে কোর্টের অন্যপাশে চলে গেল। আসলেই পোকা ছিল নাকি শুধুই অজুহাত তা আমি আজও জানিনা। তবে এর পরে আমি যতদিন সেখানে ছিলাম আর কোনদিনই মেয়েটাকে দেখিনি। সে আর খেলা দেখতে আসেনি।
এতটুকু বলে থেমে যাওয়ার পর জারা গাড়ীটা রাস্তার এক পাশে থামিয়ে ফেলল। তারপর নিজের বিস্ময় গোপন না করেই বড় বড় চোখ মেলে রূপকের দিকে তাকিয়ে বলল
-ভারী অদ্ভুত তো।
রূপক মৃদু কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল
-গাড়ী থামিয়েছ কেন? মানুষের জীবনটাই তো কতগুলি অদ্ভুত ঘটনার সমষ্টি, নয় কি?
-হ্যাঁ, হয়তো তা ই।
-তারপরও মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। থামার সুযোগ থাকেনা। রবার্ট ফ্রস্টের খুব সুন্দর কয়েকটা লাইন আছেনা ?

The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.

জারা শব্দ না করে মাথা দুলিয়ে রূপকের কথা সায় দিল। রূপক জারাকে হাতে ইশারা করে আবার গাড়ী চালাতে বলে। ততক্ষণে দুপুর হয় হয় । সামনে বোখারা। এর পর বড় শহর আর নেই। তাই একটু আগে ভাগেই লাঞ্চ করে নেবার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা।
বোখারা পার হয়ে আবার দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শুরু হবে। তবে পরস্পরের সঙ্গ ওদেরকে ঠিক ক্লান্ত হতে দিচ্ছেনা। লাঞ্চটা দ্রুতই সারতে হল। আবার বেরিয়ে পড়েছে ওরা। শীতকাল হলেও রোদ বেশ চড়া। পথিকের পিঠে আরাম লাগার সীমা পেরিয়ে গেছে। রাস্তার পিচের স্তর খানিকটা নরম হয়ে এসেছে। সুযোগ আর ফাঁকা রাস্তা পেলেই গাড়ীর স্পিড বাড়াচ্ছে জারা। বোখারা ছাড়িয়ে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার আসতেই আবার রূপককে জেকে ধরল। ওর গল্প শুনতে চায়। রূপক বলতে বাধ্যই হল-
তখন রূপক সবেমাত্র কলেজে উঠেছে। মফস্বল শহরে কলেজের উঠতি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তখন কম্পিউটারের কাজ শেখার খুব উন্মাদনা। আর তাছাড়া ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সবাই বেসিক নলেজটা শক্ত করে রাখতে চাচ্ছে। স্রোতের একজন হিসেবে রূপকও ভর্তি হয়ে গেল। ট্রেনিং একাডেমীর মালিক রাজিব ভাই আবার রূপকদের পারিবারিক ভাবেও পরিচিত। তিনি রূপকের বড় বোন রাজিয়ার ক্লাসমেট ছিলেন। সে সূত্রে আগে থেকেই বাসায় আসা যাওয়া ছিল। রাজিব ভাইয়ের ছোট ভাই রাসেল ভাই ট্রেনিং একাডেমীটা পরিচালনা করতেন। তিনি রূপকের বছর দুয়েকের বড়। মাদ্রাসায় পড়ুয়া লোক। ফর্সামুখে গালভার্তি চাপ দাড়িতে তাকে রীতিমত সুপুরুষ দেখায়। তিনি আবার প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে খুবই আন্তরিকভাবে মিশতেন। একটু অল্পভাষী মানুষ ছিলেন কিন্তু অনেক রসিক প্রকৃতির। কাজ শেখা গল্প-আড্ডা আর নানান পদের দুষ্টামীতে দিনগুলি ভালই কাটছিল। তবে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড  গরমের দিনগুলিতে কষ্ট হতো। মফস্বলের ট্রেনিং একাডেমীতে তখন এয়ারকুলারের কথা কল্পনাও করা যায়না।
মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামলে খুব ভাল লাগত। তীব্র গরমটা আমচকাই বেশ শীত শীত ভাবে রূপান্তরিত হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ নামা আর ক্ষণস্থায়ী এই বৃষ্টির আসল রহস্য আর আকর্ষণ যে অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে তা তখনও রূপকের জানতে বাকী। রূপক দেখল হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামলেই রাসেল ভাইসহ সব কয়জন ট্রেনিং রুমের দক্ষিণ দিকের অব্যবহৃত স্টীলের দরজাটার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দরজাটায় বহুদিনের অযত্নে বেশ কিছু বড় বড় ছিদ্র হয়ে গেছে। রূপক প্রথমটায় বুঝতেই পারতনা ঘটনা কী। সে তার কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ চালিয়ে যেত আর ওদের দরজা ধরে হুড়োহুড়ি করা দেখত। ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষক ছিলেন দুইজন আর প্রতি তিন ঘণ্টার ব্যাচের জন্য প্রশিক্ষণার্থী থাকত চার জন। সাথে থাকতেন রাসেল ভাই। সব মিলিয়ে সাতজনের অবস্থান ঘরটাতে। ট্রেনিং রুমের ঠিক দক্ষিণেই একটু খানি নীচু ফাঁকা মাঠের মত জায়গা। শীতের দিনে ছেলে-পেলেরা খেলাধূলা করে আর বৃষ্টি নামলে বড় বড় ঘাস-আগাছা গজায়, কাঁদা পানি জমে। তখন জায়গাটা পরিত্যাক্তই থাকে। ফাঁকা জায়গাটা প্রস্থে বিশ পঁচিশ ফুটের বেশী হবেনা। তারপরেই স্থানীয় সরকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকা শুরু। প্রথম ভবনটা ছিল একতলা। সেখানে থাকতেন ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের বড় কর্মকর্তা। রাসেল ভাইয়ের কাছে পরে রহস্যটা জানা গেল। সব শুনে তো রূপকের চোখ কপালে উঠবার দশা। রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তার বড় মেয়ে মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়ে। দেখতে বেশ সুন্দর। এই সময়টাতে সে হল থেকে বাসায় চলে এসেছে। গরমের দিনে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে ছাদে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা আর ছোটাছুটি করা তার নিয়মিত অভ্যাস। ভেজা কাপড়ে ওকে দেখার জন্যই ছিদ্র হওয়া দরজার কাছে এই যুদ্ধ চলে।
রাসেল ভাইয়ের মত নিপাট মুসল্লি ভদ্রলোক কেমন করে এ জাতীয় এডভেঞ্চারের আবিষ্কর্তা হয় তা রূপকের মাথায় কিছুতেই আসলনা। ওনার আবার পান খাওয়ার অভ্যাস। লাল টকটকে দাঁত কেলিয়ে ওনি হাসতে হাসতে বেশ কৌতুক করেই রূপককে ঘটনা বুঝিয়ে বললেন। রূপক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে রাসেল ভাইয়ের পৌরুষদীপ্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। আসলে বাইরে থেকে কউকে বিচার করা খুব কঠিন। কিন্তু সব কিছুরই একটা পরিণতি থাকে। যথীরীতি ট্রেনিং রুমেও একদিন নরক ভেঙ্গে পড়ল। ঘটনা হচ্ছে রাজিব ভাই তার অফিস থেকে মাঝে মাঝে ট্রেনিং সেন্টারে আসতেন কাজের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। আবার প্রশিক্ষণার্থীদের সাথেও কথা বলতেন। তিনি খুব মিষ্টভাষী ছিলেন তবে প্রচণ্ড রাগী। সবাই তাকে যমের মত ভয় করে।
একদিন বৃষ্টিপড়া অবস্থায় আচমকা তিনি রুমে এসে দেখেন রূপক ছাড়া প্রায় সবাই দক্ষিণের দরজায় একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছিদ্র দিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। তিনি ‘রাসেল’ বলে ডাক দিতেই সবাই বরফের মত জমে গেল। সব চোরের মত মুখ করে দরজার কাছ থেকে সরেও আসল। তিনি রাসেল ভাইকে জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও কোন সন্তোষজনক জবাব পেলেন না কেন সবাই কম্পিউটার ছেড়ে দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল। পরে তিনি নিজেই দরজার কাছে গিয়ে পুরো দরজা খুলে দিলেন। বিশ ফুট সামনে একতলার ছাদে গোসলের দৃশ্য দেখে তার আর কিছুই বুঝতে বাকী রইলনা। তিনি যখন দরজা আটকে রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকালেন তখন কারও দেহে প্রাণ ছিল বলে মনে হচ্ছিল না।
রূপক কথা বন্ধ করে দিয়েছে। বিরতি নিচ্ছে। জারা গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করল
-রূপক, তারপর কি হল? তোমার রাজিব ভাই তখন সব জেনে কী করলেন?
-বাদ দাও। বাকীটা বুঝে নেবার বিষয়। সব কথা বিস্তারিত জানলে মজা থাকেনা।
-রূপক সত্যি করে বলতো, তুমি কি কখনো ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য দেখেছিলে? বৃষ্টি ভেজা নারীদেহ কী খুব আকর্ষণীয়?
-বাদ দাও। কী এসে যায়। হয়তো দেখেছি, হয়তো না।
-ব্যাপার কি রূপক তুমি মনে হয় এড়িয়ে যেতে চাইছ?
-না , ঠিক তা না, আমি আসলে তখন এর চাইতেও অদ্ভুত এক জগতে বিচরণ করতাম, তাই হয়তো সেসব আমাকে অন্যদের মত টানতোনা।
-অদ্ভুত জগৎ? বুঝলামনা।
-আমার কাছে অদ্ভুত। কী হবে বুঝে? বোঝা কি খুব দরকার?
-বলো, আমার শুনতে ইচ্ছা করছে। তুমি কি বলতে চাইছনা?
-বলতে চাইবনা কেন? কিন্তু তোমার কাছে বোরিং লাগতে পারে। তাই গুরুত্ব দিচ্ছিনা।
-তোমার এসাইনমেন্টের কাঠখোট্টা কথাবার্তা একটানা দীর্ঘ সময় শুনলে বরং বোরিং লাগে। তুমি তোমার গল্প বল, আমি শুনতে চাই।
-প্রথমেই বলে নেই কথাগুলি তুমি সিরিয়াসলি নেবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে নেব না। তুমি বল।
-ওদের সেসব বৃষ্টি ভেজা নারীদেহ দেখার উন্মাদনা আমাকে আকর্ষণ করতনা। আমার মাথায় তখন অন্য রঙের খেলা। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের ক্লাসের একটা মেয়েকে আমার ভাল লাগত। তুমি আবার এটাকে প্রেম ট্রেম ভেবে বসো না। মেয়েটা গড়পড়তা বাঙালী মেয়েদের চেয়ে একটু খাটো ছিল। তবে একহারা গড়নের কারণে সেই ত্রুটি বোঝা যেতনা। আমার সবচাইতে ভাল লাগত ওর গলার আওয়াজ। কিন্তু সেটা শোনার সুযোগ আমার খুব কমই হয়েছিল। আমি যে ওকে পছন্দ করতাম তা কোনদিনও বলতে পারিনি। তবে আমার হাবভাব দেখে ও হয়তো খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিল। ঠিক জানিনা। স্কুল লাইফ পর্যন্ত বিষয়টা মোটামোটি এ পর্যন্তই । আমি যখন ট্রেনিং নিচ্ছিলাম তখন আমাকে বাসে করে বাসায় ফিরতে হত। ও যে কলেজে ভর্তি হয়েছিল সেখান থেকে ক্লাসে শেষে বাসে করে বাসায় ফিরত। মজার বিষয় হল যে বাস স্টপে ও নামত আমি সেখান থেকেই বাসে চড়তাম। বাস স্টপে মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয়ে যেত। সামান্য হাই-হ্যালো হত। পড়াশুনা কেমন চলছে, ফিউচার প্ল্যান কি ইত্যাদি কিছু টুকরো কথাই ছিল সম্বল। একদিন একটু ব্যতিক্রম হয়ে গেল..
-যেমন?
-বাস স্টপে আমি আগেই গাড়ীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম। একটু পর ও আসল। অন্যদিনের মত কুশল বিনিময় না করে ও সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,“বাসায় চল আমার সাথে। প্রতিদিন তো এখানেই কথা হয়। তাও ঠিকমত হয়না”  বলেই ও বাসার দিকে হাঁটা ধরল। আমি কিছু না বুঝেই ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম..
-ইন্টারেস্টিং ! তারপর?
-যদিও চিনতাম তবু আমি কোনদিনও ওদের বাসায় যাইনি। আর আমি ওর তেমন ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেটও নই। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম ওর আচরণে। বাস স্টপ থেকে বাসায় আসতে প্রায় মিনিট পাঁচেক লেগেছিল। এই সময়টাতে ও একবারও পেছন ফিরে দেখেনি আমি আছি কিনা। যেন ধরেই নিয়েছে আমি ওর সাথে যাচ্ছি। আমি ওর কাণ্ডকারখানাতে যথেষ্ট অবাক হলাম। কিন্তু হাঁটতে থাকলাম। ওর পড়নে কালচে সবুজ ছাপার একটা পোশাক ছিল। ভীষণ পাতলা শরীরে পোশাকটা খুব মানিয়ে গেছে। বাসায় ঢুকে ও প্রথমবারের মত পেছন ফিরে আমার দিকে তাকাল। বসার ঘরে তখন আমরা দুইজন। ও আমাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। একটু পর ফিরে আসতে দেখলাম হাত মুখ ধুয়েছে। এমনিতেই অসম্ভব সুন্দর দেখতে, তখন আরও সুন্দর লাগছিল।
-আচ্ছা আচ্ছা।
-তোমার কাছে মনে হয় হাস্যকর লাগছে, থাক বাদ দাও তো জারা। এসব ফালতু প্যাঁচাল কন্টিনিউ করার কোন মানে হয়না।
-আরে পাগল হলে নাকি? আমি কোনক্রমেই বাদ দিচ্ছিনা। তুমি বলে যাও। আমার তো মজাই লাগছে।
-ও আমাকে এসে বলল, “কী খাবে?” স্বাভাবিক ভদ্রতা আর কি। সম্ভবত চা বা কফি টাইপ কিছু বোঝাতে চেয়েছিল। আমি ইচ্ছে করেই বললাম,“ভাত খাব”। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওকে বিব্রত করার জন্যই ভাত খেতে চেয়েছি?
-বল কী? তারপর মেয়েটা কী রিয়েকশন দেখাল?
-আর বলতে ভাল লাগছেনা। বাদ দাও তো প্লিজ। আসলে এসব অর্থহীন গল্পের-ঘটনার কোন পরিণতি বা শেষ থাকেনা। আমি ওর চুল বাঁধার স্টাইল, চাহনি, পোশাকের রং সব কিছু নিয়েই সেসময় অনর্থক মাথা ঘামাতাম। হাসি দেবার সময় মাথাটা একটু পেছন দিকে হেলিয়ে হাসত, আর ওর গালে টোল পড়ত। এসবই তখন আর পাঁচ দশটা উঠতি বয়েসী ছেলের মত আমার কাছে অনেক মূল্যবান ছিল।
-মেয়েটিকে কেন বলনি তোমার মনে কথা? সেটাই কি ভাল হত না?
-কী হত তা জানিনা? এখন সেটা ভাবাও হাস্যকর। তবে কেন কখনো ওকে আমি বলিনি সে প্রশ্ন একটা সময় আমি নিজেকেও করেছি। বহুবার। কিন্তু সত্যি বলতে কি উত্তরটা আমারও জানা নেই। জানো জারা; ক্ষুদ্র ,অতি তুচ্ছ এসব অপ্রাপ্তি আপাত দৃষ্টিতে যেমন কষ্টদায়ক, তেমনি তা আবার জীবনকে বুঝতে ও সঠিক ভাবে উপলব্দি করতেও সহায়ক। আমার মনে হয় অপ্রাপ্তি না থাকলে মানুষের জীবনটা এত মূল্যবান হয়ে উঠতো না।
-এখন কি তোমার জীবন খুব মূল্যবান হয়ে উঠেছে?
-তুমি এমন ভাবে প্রশ্ন করছ যেন, এরকম দুয়েকটা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই তুমি জীবনের সব রহস্য উদঘাটন করে ফেলবে।
-সেটা না, তুমি বললে, তাই প্রাসঙ্গিক ভাবে জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা রূপক, মেয়েটা বর্তমানে কোথায় কী অবস্থায় আছে তুমি জানো?
-জানলে কী হবে?
-আহা! বলই না শুনি।
-ওর সাথে আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ আছে। স্বামীর সংসারে সে ভালই আছে। তার স্বামী মস্ত ধনী। একটা মেয়ে আছে দুই বছর বয়েসী।
-স্বামী মস্ত ধনী বলে ধরে নিয়েছ সুখে আছে?
-আরে নাহ। কারো সুখ ডিটেক্ট করার পদ্ধতি আমি জানিনা। আন্দাজ করে বললাম। যাই হোক।
-তার সাথে তোমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে কতদিন হল?
-ছ’ সাত বছর হবে হয়তো। কেন বলতো।
-এমনি জানতে চাইলাম।
-না; তুমি এমনি জানতে চাওনি। একটু বেশীই কৌতুহল দেখাচ্ছ। আমি কিন্তু শুরুতেই বলে নিয়েছিলাম কথাগুলি সিরিয়াসলি বিবেচনা না করতে। তুমি মনে হয় ভুলে গেছ।
-না না। ভুলে যাইনি। ইটস ওকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবনা ওই মেয়ে সম্পর্কে। তবে আমার কি মনে হয় জানো?
-কী?
-ওই মেয়েটার বিষয়ে তোমার মনের গহীনে একটা সুক্ষ্ম অনুভূতির অস্তিত্ব রয়ে গেছে।
-কেন তোমার এমন মনে হল?
-গল্পটা বলার সময় আমাকে শর্ত দিয়ে নিয়েছ এবং তোমাকে প্রশ্ন করলে ডানে বায়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। অর্থাৎ তুমি ঠিক যতটুকু বলবে বলে ঠিক করেছ তার বাইরে অতিরিক্ত কোন কথাই বলতে রাজি নও। জিজ্ঞেস করলেও অপ্রস্তুত বোধ করছ। তাতে মনে হল সচেতন ভাবে অথবা অবচেতনে তোমার মনে তার জন্য একটুখানি জায়গা এখনও রয়ে গেছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনটা হতেই পারে। ঠিক আছে, রিল্যাক্স।
-আরে আমি ঠিকই আছি। তুমি ব্যস্ত হয়োনা। তবে এটাও তো সত্যি, আমার ক্লান্তিকর আর একঘেঁয়ে কাজে তোমার সঙ্গ সব বিশ্রী অনুভূতিকে দূর করে দিয়েছে। এটাকে তুমি কী বলবে?
জারা এক মুহুর্ত চুপ করে রইল। স্টিয়ারিং হুইলে হাতের আঙ্গুলগুলি শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। রূপক আড়চোখে তা ঠিকই দেখতে পেল। কিন্তু এর মানে কি তা বুঝলনা। জারা বলল
-এটা কিছুই না। তুমি প্রসঙ্গ বদলে আমাকে আটকাতে চাইছো।
-না, মোটেই না। আমি আমার একটা সত্য অনুভূতির বিষয়ে তোমার মন্তব্য চেয়েছি মাত্র।
-শোন, আমাদের রাস্তা খুব বেশী নেই আর, আমরা বিরুনী পার হয়ে এসেছি। এখানটায় রাস্তা খুব বেশী ফাঁকা হয়তো পাব না। এটুকু যেতে ঘণ্টা খানিক লেগে যেতে পারে। কালান্দারখানা পার হয়ে আবার ফ্রি হাইওয়ে পাওয়া যাবে। তখন যতটুকু পারি সময় বাঁচাবো।
-এবার প্রসঙ্গটা কে বদলেছে শুনি?
-মানে?
-মানে, আমি তোমাকে একটা কিছু জিজ্ঞেস করেছি, আর তুমি আমাকে বিরুনী আর কালান্দারখানার ট্রাফিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছ।
-আরে উজবেকিস্তানে তোমার কাজে আমি গাইড এর ভুমিকায় আছি না? আমিতো তোমাকে প্রয়োজনীয় ইনফর্মেশন দেবই। এটাই তো স্বাভাবিক।
-তুমি গাইডের ভুমিকায় আছ নাকি? জানতামনা তো।
-হ্যাঁ, আছি তো। এখন বল কী জানতে চেয়েছিলে।
-ইয়ে মানে….., মনে নেই। তোমার প্যাঁচালে ভুলে গেছি।
দুইজনই হেসে উঠল। যদিও ড্রাইভিংয়ের সময় বিষয়টা সস্তিদায়ক নয়, তবুও রূপক দেখল জারা মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে হাসছে, আর হাসবার সময় মাথাটা মৃদু কাঁপছে। ডানগালে টোলও পড়ল মনে হল। রূপক ভাবছে  অতীত আর বর্তমান;সময়ের এই দুই প্রান্ত কখনো কখনো কি এক হয়ে যায়? সাত-আট বছরের ব্যবধানে একটা দৃশ্য কি ঠিক একই ভাবে আবার ফিরে আসতে পারে? পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দিল, এসব ভুল। আবেগী মন নিজের মত করে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করতে চাইছে। এসব চিন্তা প্রশ্রয় না দেয়াই ভাল। নিজেকে নিজের প্রকৃত লক্ষ্যের দিকে মনযোগী করতে চাইল ও। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধল ব্যস্ত জনপথ।
জারার কথা সত্যি হতে চলেছে। রাস্তাটা অসম্ভব ব্যস্ত। আসলে একটানা কয়েক ঘণ্টা খোলা রাস্তায় ফ্রি স্টাইলে এসেছে ওরা, তাই হয়তো এই ব্যস্ততাকেই খুব বেশী মনে হচ্ছে। দেড় ঘণ্টার বেশী লেগে গেল কালান্দারখানার তিন রাস্তার মাথায় পৌঁছাতে। নুকুস যাবার আলাদা দুইটা হাইওয়ে শাখা কালান্দারখানায় এসে একত্রিত হয়েছে। এর পর থেকে আবার সিঙ্গেল হাইওয়ে। বেলা পড়তির দিকে। পশ্চিমের হেলে পড়া সূর্যের আলো উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে জারার কোমল মুখে পড়েছে। ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও কোন অদ্ভুত আকর্ষণে বার বার বামে তাকাচ্ছে রূপক। শেষ বিকেলের লালচে আলোয় জারাকে যে কত সুন্দর লাগছে তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। জারা বাঙ্গালী মেয়ে হলে হয়তো বোঝানো যেত ‘কনে দেখার আলো’ কেন বলা হয় এই সময়ের সূর্যালোককে। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রূপকের ভেতর থেকে। জারা এসবের কিছুই দেখল না। খোলা হাইওয়ে দিয়ে আবারো ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে শেভ্রোলেট কোবাল্ট। সন্ধ্যা হয় হয়। ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে। সামনেই নুকুস।

আজিয়ানায় সকাল সকালই যথেষ্ট খদ্দেরের ভীড়। খাবারের জন্য এর সুনাম আছে এই অঞ্চলে। জারা আর রূপক বসেছে জানালা ঘেষা একটা কেবিনে। কেবিনে ঢোকার মুখটা নকশা করা পাতলা পর্দা দিয়ে ঘেরা। চার চেয়ার দেয়া ছোট টেবিলটায় মুখোমুখি বসে আছে দু’জন। কফি মগে চুমুক দিতেই হাসি হাসি হয়ে গেল জারার মুখ। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি একরাতের উদ্বিগ্ন বিশ্রাম দূর করতে পারেনি। কফিটাই ভরসা। মুহুর্তেই চাঙ্গা করে দিতে জুড়ি নেই এ্যারাবিয়ান কফির। ওদিকে রূপকের অনুভূতি জারার একদম উল্টো। মশলা আর অতিরিক্ত উপকরণ মিশ্রিত কফিটা রূপককে মোটেও সস্তি দিচ্ছে না। কফিটা দেখতে যতটা তামাটে হওয়ার কথা ততটা নয়, বরং একটা ফ্যাকাশে হলদে-মেটে ভাব আছে। রূপক বলেই বসল
-এই জিনিসটার নাম কফি?
-কোন সন্দেহ?
-বলছিলাম কি চমৎকার একটা ব্রেকফাস্টের পর এই অখাদ্যটা মুখে না দিলে হতো না?
রূপকের চাহনিটা নেহায়েতই করুণ। জারা সেসব একদমই গায়ে মাখলনা। যেন পুরো বিষয়টা রূপকের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। নির্বিকার ভঙ্গিতে অনেকটা মতামত প্রকাশের সুরে বলল
-তুমি একটা এক্সট্রাঅর্ডিনারী কফি ভেরাইটিকে অবজ্ঞা করছ।
-কী বলতে চাও?
-তুমি বোর ফিল না করলে সামান্য ইতিহাস আওড়াতে চাই।
রূপক গলায় যথেষ্ট কটাক্ষ ফুটিয়ে বলল
-শুরু করুন ম্যাডাম। আমি মনযোগ সহকারে অপেক্ষা করছি। বিশেষ করে এই মগে ঢালা দ্রবণটি খাওয়ার চেয়ে ইতিহাস শোনা অনেক তৃপ্তিদায়ক এই মুহুর্তে।
জারা কটাক্ষের দিকে কর্ণপাত না করে শুরু করল
-কফির এই এ্যারাবিয়ান ভ্যারাইটির উদ্ভাবক ইয়েমেনী আরবরা। বার শতকের কিছু রাজকীয় নথিতে এই তথ্য পান ইতিহাসবিদেরা। তবে ইয়েমেনীরা প্রাগৈহিতহাসিক কাল থেকেই কফি চাষ করত কীনা তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। কেউ মনে করে এর অরিজিন ইয়েমেন। আবার কারও কারও মতে ইথিওপিয়া থেকে এই কফি ইয়েমেনে এসেছে। আমরা জানি হাজার হাজার বছর ধরেই পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলির সাথে লোহিত সাগর দিয়ে আরব উপদ্বীপের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ইথিওপিয়া থেকে কফি অরিজিন আসার ধারণাটি সত্য হবার পর্যাপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কফিকে এই মুহুর্তে তুমি যেই ফর্মে খাচ্ছ সেই ফর্মে আনার পুরো কৃতিত্ব কিন্তু ইয়েমেনীদের।
-আচ্ছা। চমৎকার ইতিহাস। কিন্তু তাতে কফির বিশ্রীপনা এতটুকুও কমেছে বলে মনে হচ্ছেনা আমার কাছে।
-কথা শেষ হয়নি আমার।
-ওহ। ঠিক আছে, ঠিক আছে। শেষ কর।
-ইয়েমেনীদের আগে মানুষ কফি বীনকে আগুনে রোস্ট করে খাওয়ার প্রক্রিয়া জানতো না। তোমার মশলার ব্যবহার পছন্দ হোক বা না হোক, তুমি আজকের পছন্দনীয় কফির মূল প্রক্রিয়াটি কিন্তু পেয়েছো এই ‘তোমার ভাষায় অখাদ্য’ কফির আবিষ্কারকদের কাছ থেকেই। মিশরীয় ও তুর্কি শাসকগণ আরব উপদ্বীপ দখল করলে পরে তাদের মাধ্যমে বাইরের বিশ্ব রোস্টেড কফি বীনের অপূর্ব স্বাদের সাথে পরিচিত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম শাসনের ঐতিহ্যগত কারণে আমাদের এখানে এ্যারাবিয়ান কফি ভ্যারাইটির গ্রহণযোগ্যতা বেশী। আশা করি কফিটাকে পছন্দ না করলেও এর প্রতি তোমার অশ্রদ্ধা অন্তত কমেছে।
-আরে কী যে বলনা। আমি তো এই কফির প্রতি মোটেই অশ্রদ্ধাশীল নই বরং অনেক শ্রদ্ধাবনত। শুধু দুয়েক চুমুক খাওয়ার পর থেকেই পেট থেকে সমস্ত খাবার বেরিয়ে আসতে চাইছে, এই যা। এছাড়া কোন সমস্যা তো নেই। আর এর গন্ধটাও তো …….বুঝতেই পারছ, নাড়ীভুড়ি গড়াগড়ি করবার মতই। আমি আমার অবলা পেটকে দোষ দিতে পারিনা। পেট তো আর ইয়েমেনের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা বা আরবদের অবদানের কথা জানেনা।
জারা পরিষ্কার বুঝতে পারছে রূপক কফি মুখে দিয়ে ক্ষেপে ভুত হয়ে আছে। ঠাণ্ডা  মাথার ছেলেটা সামান্য কফি নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে উঠল কেন তা মাথায় আসছেনা। বাঙ্গালীরা কি এমনই হয় নাকি? জারা বাজে প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। বলল
-নুকুস তো এলাম। তোমার উদ্দেশ্য কী? কোথায় যেতে চাও আর কী করতে চাও এখন?
-প্রথমেই যাব ‘নুকুস মিউজিয়াম অব আর্ট’-এ। হতে পারে সেখানে আমাদের জন্য কিছু আছে। আর তারপর উল্টো পথ ধরব, মাযিয়াব ক্যানালের উপর দিয়ে যে রাস্তা আমু দরিয়ার ওপারে ন্যাশনাল ব্যাংক এর দিকে গেছে সে রাস্তায় নদীর পারের একটা পরিত্যাক্ত এলাকায় যাব।
-তুমি দেখি আমার চেয়েও উজবেকিস্তানের লোকেশন ভাল জানো!
-আরে না না । আমার কোন বাস্তব জ্ঞান নেই তা তো জানোই। আমার বিদ্যা কিছু এক্সক্লুসিভ ডকুমেন্ট আর ইন্টারনেট পর্যন্তই। পরশুরাতেই আমি এ এলাকার ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে একটু হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলাম।
-আচ্ছা, গুড। তোমাকে তাহলে বদখৎ কফি থেকে রেহাই দেয়া যাক। চলো বেরিয়ে পড়ি।
-আল্লাহ। চলো চলো। এখনি চলো।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত