তৈমুরের অভিশাপ -৯

নয়.

নুকুস মিউজিয়ামের প্রবেশপথটা মন ভাল হয়ে যাবার মত সুন্দর। দু’পাশে ঘাস বিছানো সবুজ লন। লনের ফাঁকে ফাঁকে গাছ লাগানো আছে। অচেনা মনকাড়া সব ফুল ফুটে আছে। মাঝখানের প্যাসেজটা লাল টালির নকশা বিশিষ্ট। সামনের চত্বরেই সুদৃশ্য ফোয়ারা। ফোয়ারার তিনপাশে চত্বর পেরিয়ে তিনটা ভবন। মূল মিউজিয়াম ভবনটির স্থাপত্যকর্ম চোখে পড়ার মত আকর্ষণীয়। ভবনের সামনে উজবেকিস্তানের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি কারাকালপাক এর প্রাদেশিক পতাকাও উড়ছে।

রাশিয়ান চিত্রকর ইগর সাবিৎস্কির হাতেই গোড়া পত্তন হয় মিউজিয়ামের। তিনি একাধারে চিত্রকর, সংগ্রাহক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিলেন। সাবিৎস্কি ঊনিশশ পঞ্চাশ সালে খোয়ারেজমের প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে সেখান থেকে নুকুস চলে যান এবং আমৃত্যু সেখানেই বসবাস করেন। ঊনিশশ চুরাশিতে মস্কোয় মৃত্যু বরণ করেন তিনি।

ষাটের দশকে সাবিৎস্কি স্থানীয় প্রাচীন মুদ্রা, কাপড়, মূল্যবান রত্ন আর আর্টিফেক্ট সংগ্রহ শুরু করেন যা এই মিউজিয়ামের প্রাথমিক সংগ্রহ। নুকুস মিউজিয়াম বর্তমানে শুধু উজবেকিস্তান নয় সমগ্র মধ্য এশিয়ার অন্যতম মিউজিয়াম ও সংগ্রহশালা।

রূপক আর জারা দেখল ঢোকার মুখে রিসিপশনে মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পিতলের ফলকে খোদাই করা আছে। সাথে টাঙ্গিয়ে দেয়া আছে সাবিৎস্কির বড় একটা ছবি। ছবি তোলার সময় তিনি মধ্যবয়সী ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে। ভদ্রলোকের ঠোটের নীচে মাঝারি গোঁফ। চ্যাপ্টা নাক আর চৌকোনা মুখ বিশিষ্ট মানুষ। কপালের কিনার থেকে দুইপাশ দিয়ে টাকের আভাস মাথার দিকে প্রবেশ করেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভারী লেদার জ্যাকেট পড়নে। বাম হাতে একটা প্রাচীন কাঠের ফলক ধরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন।

মিউজিয়াম ঘুরে দেখছে ওরা। ছবি, সংগৃহিত বস্তু আর অন্যান্য আর্টিফ্যাক্টের জন্য আলাদা আলাদা গ্যালারি করা আছে। সব জায়গার নিজস্ব বৈশিষ্ট দৃশ্যমান। ছবির গ্যালারিতে আলেক্সান্ডার নিকোলায়েভ, ক্লিমেন্ট রেডকো, লিউবভ পপোভা, ইভান কুড্রিয়াকভ আর রবার্ট ফক এর মত চিত্রশিল্পীদের পেইন্টিং ঝুলছে। অবশ্য এদের অনেকের ছবির প্রদর্শণী স্টালিনের শাসনামলে নিষিদ্ধ ছিল। শুধু উগ্র সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এমন নামীদামী চিত্রকরদের ছবিও তখন গ্যালারি থেকে অপসারণ করতে হয়েছিল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে। স্টালিনের মৃত্যুর পর তা আবার নুকুসের গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে। রাজনীতি এমনই জিনিস, শিল্পকলাও এর কোপানল হতে মুক্ত নয়।

মিউজিয়ামের পুরো মেঝে ধূসর মার্বেলের তৈরী, তার মাঝে মাঝে চওড়া কালো নকশা করা। ক্ষুদ্র আর মাঝারি সাইজের আর্টিফ্যাক্ট এরিয়াতে আছে ওরা এখন। শত শত গ্লাসকেসে অসংখ্য আর্টিফ্যাক্ট রাখা। ক্ষুদে ইন্ট্রোডাকশন বোর্ডে আর্টিফ্যাক্ট সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে দর্শনার্থীদের জন্য। আর্টিফ্যাক্ট রাখা হয়েছে গ্লাসকেসের ভিতরে বসানো কালো মখমলের তাকে । সিলিং থেকে প্রতিটি কেসের উপর স্পট লাইট সেট করা।

এই মুহুর্তে মিউজিয়ামে দর্শনার্থীর সংখ্যা খুব বেশী নয় আর পরিবেশটাও যথেষ্ট নিঃশব্দ। সকালের দিকে ভীড় কম থাকে, আসল জম-জমাট অবস্থাটা তৈরী হয় বিকেলে। প্রদর্শিত সকল সংগ্রহ মধ্যএশীয় সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা জুয়েলারীর দিকে গেল।

ফ্লোরের ঠিক মাঝামাঝি এসে রূপক আচমকা একদম থেমে গেল। জারাও দেখল এতক্ষণ যে ধারাবাহিক গতি ছিল তার ছন্দ পতন হয়েছে। প্রাচীন মুদ্রা ও গহণার পাশপাশি আরও নানাবিধ রত্ম বা মূল্যবান সামগ্রীর প্রদর্শণী এই অংশে। রূপক যেখানটাতে দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে একটা বড় ষড়ভুজ কেস। তবে এটা সারিবদ্ধ কেসগুলির একটি নয়। রুমের মাঝামাঝি মেঝে থেকে উঠে আসা পাথরের স্তম্ভ সদৃশ একটা পাদদেশের উপর কেসটা স্থাপিত। সাড়ে তিন ফুট ডায়ামিটারের স্তম্ভ আকৃতির ভিত্তিটা মেঝে থেকে তিন ফুট উঁচুতে এসে থেমেছে । তারপরের অংশ কাঁচের তৈরী। সেটি স্তম্ভের শেষ থেকে উঠে গেছে আরও চার ফুট উঁচুতে। কেসটা তৈরীতে যে কাঁচ ব্যবহৃত হয়েছে তা আর সবগুলি কাঁচের মত যে নয় তা দেখেই বোঝা যায়। কাঁচ অন্তত দশ মিলিমিটার পুরু। কেসের তুলনায় ভেতরে প্রদর্শিত বস্তুটা যথেষ্টই ছোট। বস্তুটা মখমলের উপর রাখা একটা জেড পাথরের ভগ্নাংশ, যার মধ্যে কিছু খোদাই করা রয়েছে। হালকা সবুজ রঙের হলেও স্পট লাইটের আলো প্রতিফলিত হয়ে হালকা রঙটাই ঠিকরে বের হচ্ছে । পাশে যে পরিচিতি বোর্ডটা রাখা আছে তাতে এটিকে পঞ্চদশ শতকে প্রাপ্ত বলে উল্লেখিত আছে। এবং এর অরিজিনাল বয়স কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে আনুমানিক সাড়ে চার হাজার বছর। পরিষ্কার বোঝা যায় এটি একাধিক কোণা বিশিষ্ট কোন কৌণিক চ্যাপ্টা ফলকের খণ্ডিত অংশ। চ্যাপ্টা টুকরোটার পুরুত্ব সোয়া ইঞ্চির কম হবেনা। যে প্রান্ত মূল ফলক থেকে আলাদা হয়েছে তা অমসৃণ, আর অপর দুই প্রান্ত মসৃণ। ইংরেজী এল অক্ষরের মত মসৃন প্রান্ত দুইটির একদিক প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হবে এবং অপর দিক হবে তিন ইঞ্চির কাছাকাছি।

জারা জানতো না রূপক ব্যাগে করে একটা ক্যামেরা নিয়ে এসেছে, সাথে আছে উচ্চক্ষমতার অতিরিক্ত লেন্স। রূপক খানিক ব্যাগ হাতড়ে একটা ক্যামেরা বের করে লেন্স জুড়ছে দেখেই জারা আৎকে উঠে বলল
-রূপক ক্যামেরা বের করেছ কেন?
রূপক বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল
-ছবি তুলতে হবে।
-তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি জানোনা মিউজিয়ামে ছবি তোলা নিষেধ?
– জানি তো, জানবনা কেন?
-জানো, তাহলে ক্যামেরা বের করেছ কোন বুদ্ধিতে?
-এই মুহুর্তে কোন বুদ্ধির কারণে ক্যামেরা বের করছিনা। বুদ্ধিটা গত পরশুদিনই খরচ করে ফেলেছি।
-তার মানে?
লেন্স জুড়তে জুড়তেই রূপক কথা চালিয়ে যাচ্ছে
-তুমি তো জানোই, প্রথম যেদিন আমি আসলাম, আমি সমরখন্দের ফ্লাইটে না এসে তাসখন্দ হয়ে এসেছিলাম।
-হ্যাঁ, তো? এসবের সাথে মিউজিয়ামে ছবি তোলার কী সম্পর্ক?
-এয়াপোর্ট থেকে আমি সোজা হোম মিনিস্ট্রিতে যাই আগে। সেখান থেকে এ দেশে আমার যা যা করা লাগতে পারে তার অনুমতি কনফার্ম করিয়ে নেই। আমার সাথে ইউ.এস গভর্নমেন্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের অনুরোধপত্র ছিল।
-আচ্ছা!
-আমাকে যেসব অনুমোদন দেয়া ছিল, তার মধ্যে একটা ছিল, স্বাভাবিক ভাবে অনুমোদিত নয় এমন সব স্থানেও আমি ছবি তুলতে পারব। তারই সূত্র ধরে আমি পরশুদিন মিনিস্ট্রির মাধ্যমে নুকুসে মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম। খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই আমি ঢোকার পথে কাউন্টারে টিকিট জমা দেয়ার সময় অতিরিক্ত একটা কাগজ দিয়ে এসেছি?
-হুঁ।
– সেটা ছিল আমার পরিচয়, যাতে তারা তা নিশ্চিত হতে পারে যে সরকারি ভাবে অনুমোদন দেয়া ব্যক্তিটি আমি । সিসি ক্যামেরায় তারা কনফার্ম হয়ে নেবে যে অনুমোদিত ব্যক্তিটিই ছবি তুলছে। সুতরাং তোমার উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই?
-তাহলে তুমি আমু দরিয়া দেখতে এখানে আসনি? তোমার আসল উদ্দেশ্য ছিল নুকুস মিউজিয়াম অব আর্ট?
-আমার কোন উদ্দেশ্যই নকল নয়, সব উদ্দেশ্যই আসল। আমু দরিয়াতেও আমার কাজ আছে, সেটা তোমাকে বলেছি। আর নুকুসের বিষয়টা আগে জানাইনি, কারণ আমি কনফার্ম ছিলামনা ট্যাবলেট এর টুকরোটা এখানে আদৌ পাওয়া যাবে কীনা।
-ট্যাবলেটের টুকরা মানে? এটা কোনো ট্যাবলেটের টুকরা তা তোমাকে কে বলল?
-কে বলেছে, সেটা বিষয় নয়। তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি। আপাতত কাজটা সারতে দাও। চেয়েছিলাম ছবিটা ঝটপট তুলে ফেলি। যত দেরী হবে তোমার মত অন্যান্য দর্শনার্থীরাও তত কৌতুহলী হয়ে উঠবে। বুঝতে পারছ?
-হুঁ , ঠিক আছে কাজ শেষ কর।

রাজি হলেও জারাকে অসন্তুষ্টই দেখাল। চেহারা বলছে মোটেও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। তবু অনিচ্ছা স্বত্তেও চুপ করে রইল। নিজেকে সংযত রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। রূপক তার কাজে খুব মনযোগী। ক্যামেরায় লেন্সটা যুক্ত করে বেশ কয়েকটা ক্লোজ শট নিয়ে নিল। তবে দ্রুত কাজ শেষ করার সুবিধার্থে এবং মানুষকে কৌতুহলী হবার সুযোগ না দেবার জন্য ছবি যা উঠেছে তাই বিশ্বাস করে ক্যামেরা ব্যাগে রেখে দিল। ক্যামেরার ডিসপ্লে চেক করে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন বোধ করলেও তা হতে বিরত থাকতে হচ্ছে। ছবি ভাল না উঠলে পরে পস্তাতে হবে। তবে করারও কিছু নেই।

ছবি তোলা শেষ হতেই রূপক জারার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল, দ্রুত মিউজিয়াম ত্যাগ করা দরকার। মধ্য এশীয় সংস্কৃতি দরকারের চেয়ে বেশীই দেখা হয়ে গেছে। এখন মানে মানে কেটে পড়া দরকার। জারা তখন থেকে চুপ। কোন কথা না বলেই রূপকের সাথে সাথে মিউজিয়াম কমপ্লেক্সের প্যাসেজ ধরে বের হবার পথ ধরে হাঁটছে।

গাড়ীতে উঠে জারা চুপচাপ বসে রইল, গাড়ী স্টার্ট করবার কোন আলমত নেই। রূপক বুঝতে পেরেছে কাজের লুকোচুরি ভাবটা জারা মেনে নিতে পারছেনা। একদম বাঙ্গালী মেয়েদের মত অভিমান করে বসে আছে। রূপক ভেবেছিল কয়টাদিন উজবিকস্তানে থাকলে হয়তো এখানকার আচার আচরণ কিছু আমদানী করে দেশে বা কানাডায় নিয়ে যাবে, এখন তো দেখা যাচ্ছে উল্টো জারার কাছে দিব্যি বাঙ্গালী অভিমান রপ্তানী করে বসে আছে। হাসিটা অনেক কষ্ট করে আটকে রাখতে হল রূপককে। অভিমানী চেহারায় জারাকে দেখতে ভালই লাগছে। কোলের উপর দু’হাত একটার উপর আরেকটা রেখে বসে আছে। পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে । মাথাটা নীচু করে থাকায় ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে চুল পিঠ থেকে সামনে চলে এসেছে, ঝুলছে মসৃণ রেশমের মত ।

অনুসন্ধান করে প্রাচীন রহস্য আর প্রশ্নের উত্তর আবিষ্কার করতে এদেশে এসেছে রূপক, কিন্তু রহস্যময় আর সীমাহীন উথাল পাতালের আধার স্বয়ং নারী হৃদয়। এই যে নির্ভেজাল অভিমানী রূপ এও তো কম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নয়। নারী হৃদয়ের রহস্য তো আরও প্রাচীন, আরও দূরহ। মনে মনে নিজেকে বোঝাল ও – তৈমুরের অভিশাপের যাই হোক, আপাতত জারার অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া জরুরী। নইলে আম ছালা সবই যাবে। এমনিতে যে কাজটা করার কথা চিন্তাই করতো না সাহস করে সেটাই করে বসল রূপক। বাম হাতটা আলতো করে জারার ডান কাঁধে রাখল। তাতেও জারার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। রূপক বলল
-কী হয়েছে জারা? চুপ করে আছ যে।
নীচের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল জারা
-না কিছু হয়নি।
-কিছু হয়নি? তুমি জান যে তুমি সত্যিটা বলছ না।
রূপকের হাতটা এখনও জারার কাঁধে রাখা, জারা মুখ তুলে রূপকের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টি অনেক বেশী গভীর আর স্থির। বলল
-তোমার কাজে কি তুমি আসলেই আমাকে সঙ্গে নিয়েছ?
রূপক অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
-এটা কেমন প্রশ্ন হল? তোমাকে সঙ্গে নিয়েছি মানে? তুমি তো আমার সঙ্গেই আছ এবং আমরা একসাথে কাজ করছি।
-আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা?
-কী বলছ এসব? তোমাকে বিশ্বাস করতে না পারার কোন কারণই নেই। কেন অবিশ্বাস করব?
-তুমি অনেক কিছুই বলছ না। আমি তোমার মত রহস্যপ্রিয় নই। তবে এভাবে আমাকে অন্ধকারে ফেলে তুমি যদি আমাকে সাথে রাখ, তাহলে মনে হবে হয় তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা, অথবা নিতান্তই তোমার প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করছ। কিন্তু রূপক আমি ব্যবহৃত হতে চাইনি, সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি অন্তত বিষয়টাকে সেভাবেই জানতাম।
-তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ। হ্যাঁ, এটা সত্যি তোমাকে সব কিছু আমি এখনও খুলে বলিনি। তবে তোমাকে অবিশ্বাসের কারণে এমনটা করেছি তা নয়। আমি জটগুলো তোমার কাছে পর্যায়ক্রমে খুলতে চেয়েছিলাম। ঠিক আছে তুমি যদি বিষয়টাকে অবিশ্বাস মনে করে,তবে আমি তোমাকে আজই সব খুলে বলছি। এমনিতেও বলতাম, হয়তো একবারে নয় এই আরকি।
-রূপক আমার কথায় বা আচরণে কিছু মনে করোনা। আমি মনে হয় আমার সীমা বুঝতে পারছিনা। এরকম করা আমার ঠিক হয়নি। তুমি তোমার মত কাজ করে যাও, আগ বাড়িয়ে আমাকে কিছু বলতে হবেনা। বল এখন কোথায় যেতে হবে।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কাঁধ থেকে রূপকের হাতটা নামিয়ে দিল জারা। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে রূপকের চোখের দিক তাকিয়ে আছে পরবর্তী গন্তব্য জানার জন্য। জারার এই হঠাৎ বদলে যাওয়া রূপকের ভাল লাগেনি। মনে হচ্ছে একটু খানি প্রচ্ছন্ন আড়াল রয়ে গেল কোথায় যেন। কিন্তু সেসব জারাকে বুঝতে না দিয়ে বলল
-আগেই তো বলে রেখেছিলাম। এখন পশ্চিমে যাও, মাযিয়াব ক্যানালের উপর দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেটা ধরে। তবে আমরা আমু দরিয়ার উপর যে ব্রীজ সেখানে যাবার আগেই ডানে নেমে পড়ব, শহরতলী পেরিয়ে নদীর তীরের পরিত্যাক্ত অংশটাতে যাব। তুমি এদেশীয়, আশা করি বাকীটা বুঝে নেবে।

একটা শব্দও আর উচ্চারণ না করে জারা গাড়ী ছেড়ে দিল। মোটামোটি ছয় কিলোমিটারের মত পথ যেতে হবে। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে দক্ষিণে এসে মাযিয়াব ক্যানালের রাস্তায় উঠল গাড়ী। রাস্তা বেশ ফাঁকা। জারা বা রূপক কেউ কোন কথা বলছে না। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রীজের গোড়ার সংযোগ সড়ক পেরিয়ে চলে এল গাড়ী, এখন পাশের কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়েছে। আরামদায়ক ভ্রমণ বেশ কষ্টদায়ক ঝাকুনিতে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটা উত্তাল সাগরে ছোট জেলে নৌকায় বসে থাকার মত বা দৌড় প্রতিযোগীতার উটের পিঠে জকিদের যে অবস্থাটা হয় সেরকম। শেভ্রোলেট এর সাসপেনশন সিস্টেমের উপড় দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রূপক ভাবছে আজকের চোটে গাড়ীর বয়স আর ফিটনেস সুলেইমান আদহামের কাছাকাছি চলে যাবে। ঝাকুনিতে ওদের সিট বেল্ট ছিড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাবার দশা হয়েছে।

গাড়ী মানুষের চলাচলের জায়গা পেড়িয়ে নদীর কোয়ার্টার কিলোমিটার পূর্বে চলে এসেছ। এখানটা বসতি বা মানুষের বিচরণ বর্জিত। নেমে এল ওরা। আজও তেমন একটা শীত নেই। আবহাওয়াটা বসন্তকালের মত আরামদায়ক হয়ে আছে। রূপক জারাকে পথ দেখিয়ে পশ্চিমে হাঁটতে লাগল, যেন জারা নয় রূপকই এই দেশের মানুষ, যেন তার সব চেনা আছে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা যেখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা বালিয়াড়ীর মত জায়গা। রূপক জারার দিকে তাকিয়ে বলল-
-যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছ তার বিশেষত্ব কি জান?
জারা মুখে কিছু না বলে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়ল। মনের ভেতর কিলবিল করতে থাকা কৌতুহলগুলিকে চাপা দিয়ে রাখছে। আগ বাড়িয়ে আর খুব বেশী কিছু বলতে চায়না। রূপক বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করল। বলল
-ঠিক এখানটাতে তৈমুর ক্যাম্প করেছিলেন চৌদ্দশ পাঁচ সালের আনুমানিক জানুয়ারীতে। কেন করেছিলেন সেটা নিয়ে অবশ্য রহস্যের অন্ত নেই।
আর কথা না বলে থাকতে পারলনা জারা
-কিন্তু রূপক, কেউ বাপের জন্মেও শোনেনি তৈমুর উজবেকিস্তানের পশ্চিমে এসেছিলেন। ইতিহাস বলে তিনি পশ্চিমের সিরদরিয়া তীরবর্তী এলাকায় ক্যাম্প ফেলেছিলেন, যেটা বর্তমান কাজাখস্তানে পড়েছে। সেখান থেকেই তৈমুর চীনা মিং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তবে হ্যাঁ, তিনি ক্যাম্পে থাকা কালীন সময় মিং সাম্রাজ্যের একজন দূতকে আটক করেছিলেন যেটা তৈমুরের মত একজন বড় মাপের শাসকের নীতির সাথে যায়না। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।
-হুম, এতক্ষণে তুমি একদম ঠিক জায়গায় চলে এসেছ। তিনি কেন চীনা দূতকে আটক করলেন? আর পরে তার পরিণতিই বা কী হল? জনো নাকি কিছু?
-না।
-কেন তোমাদের ইতিহাসে এসব কথা নেই নাকি?
-আশ্চর্য ! আমাদের ইতিহাস মানে? আমি যা বলছি প্রচলিত ইতিহাস থেকেই বলছি। তোমার পছন্দ না হলেও আমার কিছু করার নেই। তুমি এমন কটাক্ষের সুরে কথা বলছ যেন আমি ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি এবং সেই ঐতিহাসিক ভুলের পুরো দায় আমার।
-না না। তা বলছিনা। তবে এখানে একটু খেয়াল করার বিষয় আছে। তোমার জানা থাকার কথা যতদিনে তৈমুর সির দরিয়ার পাশে ক্যাম্প ফেলেছিলেন, তিনি তখন রীতিমত অসুস্থ। শারিরীক অবস্থা ভাল ছিলনা। সময়টা ছিল চৌদ্দশ চারের নভেম্বর-ডিসেম্বর। তখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কোন বিষয়ই ছিলনা অথচ সেই ডিসেম্বরের হাঁড় কাঁপানো প্রচণ্ড শীতে তিনি মধ্য এশিয়ার প্রতিকূল আবহাওয়ায় চীন অভিযানে কেন বের হলেন? তাছাড়া যেখানটায় তার ক্যাম্প ছিল সেখান থেকে নদী পূর্বে, পূর্ব দিকে শীতের বাতাস ক্যাম্পের প্রতিটি মানুষকে কাঁপিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এর পর তিনি কিন্তু আর দু’মাসের বেশী বাঁচেননি।
-তাতে কী প্রমাণ হল?
-গুরুতর অসুস্থ একজন শাসকের বিশেষ পরিস্থিতিতে না পড়লে বৈরী আবহাওয়ায় রাজ্য জয়ের জন্য বের হবার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।
-আচ্ছা? তিনি কী বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন?
-তো আসল কথা হল, তিনি ডিসেম্বরের শেষ দিকে সির দরিয়া ছেড়ে পুরো উজবেকিস্তানকে আড়াআড়ি অতিক্রম করে পশ্চিমে আমুদরিয়া পর্যন্ত আসেন, এবং তখন তার সাথে বিশ্বস্ত কয়েকজন সৈনিকের একটি দল ছিল। আমু দরিয়ার নিকটবর্তী ক্যাম্পে তিনি সর্বোচ্চ সপ্তাহখানিক অবস্থান করেন, অতঃপর আবার পূর্বে অবস্থিত ক্যাম্পে ফেরত যান। এই অসুস্থ অবস্থায় মাত্রারিক্তি দূরত্ব অতিক্রমের ক্লান্তি তার শরীর সইতে পারেনি। তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চীন সীমান্তে পৌঁছাবার দু’দিন আগেই মারা যান।
-তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।
-আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। মানচিত্রে খেয়াল করলে দেখতে পাবে উজবেকিস্তানের পশ্চিমাংশ পেরোলেই তুর্কমেনিস্তান, তারপর ইরান ও ইরাক, ইরাক পেরোলেই সিরিয়া। তৈমুর খুব সম্ভবত কোন স্পেশাল পার্সেল আরব অঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং এটা এতটাই স্পর্শ কাতর ছিল যে তিনি গুটিকয়েক বিশ্বস্ত সৈনিকসহ অসুস্থ শরীরে আমু দরিয়ার পারে এসে ক্যাম্প ফেলেছিলেন। কোথায় সে ক্যাম্প? আমার ধারণা ঠিক এই মুহুর্তে তুমি আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানটায়।
-রূপক এসব কি সত্যি ?
-এখনও পুরো সত্যি নয়; প্রায় সত্যি। কারণ অনেক কিছুই যুক্তি আর হিসাবের বিচারে বলছি। তবে হয়তো খুব শীঘ্রই নিশ্চিতও হতে পারব। আমরা এখানে আর বেশী সময় থাকছিনা। এখন সাড়ে এগারটা বাজে, বারটার মধ্যে হাইওয়েতে উঠতে পারলে রাত দশটা নাগাদ সমরখন্দ পৌঁছে যাবো। তুমি যদি ড্রাইভিং এ সমস্যা বোধ না কর তাহলে ফেরা যাক।
-আমার কোন সমস্যা নেই। চলো আর দেরী না করি। তবে আমার দেশেই পড়ে থাকা এসব রোমাঞ্চকর বিষয়ের সাথে তোমার মত একজন ভীনদেশীর মাধ্যমে পরিচিত হবো কখনো ভাবিনি।

বালিয়াড়ী ধরে ওরা গাড়ীর দিকে হেঁটে চলল। রূপক খেয়াল করেছে জারার গম্ভীরতা এখন আর নেই। আবার সহজ আর প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠছে মেয়েটা। ফিরতি পথে ক্যনাল পেরিয়ে নুকুস শহরে ঢুকতেই রূপক জারাকে বলল
-দশ মিনিটের জন্য একটু থামাও, আমি এই শুধু একটু যাব আর আসব। তুমি বসো।
গাড়ী ব্রেক করার পর রূপক জারাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়ীর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। জারা বুঝতে পারলনা ঘটনা কী। অস্বস্তি নিয়ে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে করতে দেখল ছোট একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে রূপক গাড়ীতে উঠল। গাড়ী চলছে। জারা জিজ্ঞেস করল
-হুট করে কী আনতে গেলে? প্যাকেটে কী আছে বলা যাবে?
-যাবে, নুকুসের হস্তশিল্প খুব ভাল আমি জানি। তোমার জন্য পোঁড়া মাটির পুতি দিয়ে তৈরী একটা মালা এনেছি। নাও।
বলেই প্যাকেটটা জারার দিকে বাড়িয়ে দিল রূপক। আচমকা ব্রেক কষল জারা। ঝাকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শেভ্রোলেট। ঘাড় ঘুরিয়ে রূপকের দিকে অবাক চোখে চাইল। বলল
-এসবের মানে কী? তোমার ব্যপারটা কী বলতো।
– কোন মানে নেই। ব্যপারটা হল আমাদের নুকুস ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখা। মালাটা পরলে বা দেখলে তোমার মনে পড়বে একটা অচেনা বাঙ্গালী ছেলের সাথে তোমার অদ্ভুত কিছু সময় কেটেছিল- এই আরকি।
জারা এক দৃষ্টিতে রূপকের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপক ভেবেছিল কিছু বলবে জারা। কিন্তু না। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে গাড়ীর ড্যাশবোর্ডে রেখে দিল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার গাড়ী ছেড়ে দিল। ড্রাইভিং এ অত্যন্ত মনযোগ। যেন একটু আগে কিছুই ঘটেনি। রূপক গাড়ীর স্পিড মিটারে দেখল ঘণ্টায় প্রায় পঁচাত্তর কিলোমিটার বেগে সমরখন্দের দিকে চলছে ওরা।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত