তৈমুরের অভিশাপ -১১

এগার.

পনজব স্কয়ার। সমরখন্দ,উজবেকিস্তান। সুলেইমান আদহামের স্টাডি রুম।
স্টাডিতে বসে আছে স্বয়ং স্টাডির কর্ণধার সুলেইমান আদহাম, জারা আর রূপক। একটু আগেই কফি পরিবেশন করা হয়েছে। বাড়ীতে আলাদা কোন গৃহপরিচারিকা নেই, আপ্যায়নের কাজ জারার ফুপুই করে থাকেন সব সময়। ভদ্র মহিলার বয়স বড়জোর পঞ্চাশের কোঠায় , কিন্তু চোখে মুখে অবর্ণনীয় বিষাদের ছাপ। রূপক খেয়াল করে দেখেছে সৌজন্যের হাসিতে সে বিষাদ ঠিকমত ঢাকা পড়েনা। বৃদ্ধ আগ্রহ নিয়ে রূপকের দিকে তাকালেন, বললেন
-তা মি. রূপক, নুকুস গিয়ে কতদূর কী করলেন?
-উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, তবে আপনার কাছ থেকে এখন আমার কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে নেয়া প্রয়োজন।
-বলুন, আমি তৈরী।
-তৈমুরের সমাধিতে একটা পাথরের ফলক ছিল। আমি সেই ফলক সম্পর্কে জানতে চাই, মানে যতটুকু আপনার জানা আছে।
-আসলে ফলক দুইটা ছিল। তৈমুর সেটা পেয়েছিলেন কোনভাবে। কিন্তু তিনি তার জীবনের শেষ দিকে এসে নিজের সন্তানদের সেসব হস্তান্তর করতে চাননি। ইতোমধ্যেই আপনি জেনেছেন যে একটা কলসি আকৃতির পাত্র আর দুইটা ফলক মিলেই দৈব বা ঐশ্বরিক বস্তুর বান্ডিল, যা হাজার হাজার বছর ধরে চীনা সভ্যতার বিশ্বাসে মিশে আছে।
-আপনি বলে যান।
-ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তৈমুরের সন্তান বা তার পরের প্রজন্ম শাসক হিসেবে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রাখতে পারেনি। ইতিহাসে তাদের স্থানও উজ্জল নয়।
পাশ থেকে এবার জারা কথা বলে উঠল দাদুকে উদ্দেশ্য করে
-কিন্তু কেন এমন হল? কেন তৈমুর চাইলেননা যে তার পরবর্তী প্রজন্মও পৃথিবী শাসন করুক?
আদহাম জবাব দিলেন
-সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন, যেহেতু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তৈমুরকে আমরা হাতের কাছে পাচ্ছিনা।
রূপক মুচকি মুচকি হাসছে। বুড়োর রসবোধ এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ভালই মজা করছে জোয়ান নাতনির সাথে। জারা বলল
-কিন্তু তৈমুরকে পাচ্ছিনা বলে আমার প্রশ্নের কোন উত্তর পাবনা? দাদু, তুমি তো কিছু না কিছু জানো, বলতো বিষয়টা কী হতে পারে।
-আসলে সত্যি কথাগুলি একে একে বলার সময় এসেছে এখন। আমি অনেকদিন ধরে শুধু অভিশাপ আর বদদোয়া দিয়ে যা আড়াল করতে চেয়েছি আর নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি তার আর প্রয়োজন নেই।
-বুঝতে পারছি, এত ঘনিষ্ঠ হয়েও এখনও আমি প্রায় কিছুই জানিনা।
-জারা, আমাকে ভুল বুঝনা। আমি যা বলব তা শুনলেই বুঝতে পারবে কেন এসব কথার চর্চা বা এমনকি স্মৃতিও মানুষের স্নায়ুকে প্রচণ্ড রকমের পীড়া দেয়।
-তুমি বল দাদু। পৃথিবী একটা মূর্তিমান হুমকির মুখে, অন্তত রূপকের কাছ থেকে আমরা যেমনটা জানতে পেরেছি। তাই এখন খোলামেলা পদক্ষেপ প্রয়োজন।

বুড়ো আদহাম ত্রিশ সেকেন্ড স্থাণুর মত নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। মস্তিষ্কের আগল খোলার সময় এসেছে। রূপক অত্যন্ত মনযোগী ছাত্রের মত তাকিয়ে আছে। বুড়ো বললেন
-সবাই জানি, সমাধি থেকে প্রাপ্ত দৈব বস্তু গেরাসিমভের নেতৃত্বে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হয়। স্টালিন সেসবের কারণে হোক আর যেকারণেই হোক দোর্দণ্ড প্রতাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করে যাচ্ছিলেন। আমি গেরাসিমভের প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সর্বকণিষ্ঠ উজবেক সদস্য ছিলাম। তখনকার প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীতে আমাকে আত্মীকরণ করা হয় আমার প্রত্নতাত্ত্বিক বিদ্যাকে স্বার্থোদ্ধারের কাজে লাগানোর জন্য। আমিও পুরো বিষয়টি পছন্দ করছিলাম না। একজন স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাবান নাগরিক হিসাবে আমিও সেই অভিশপ্ত ভাণ্ড উদ্ধারের বিপক্ষে ছিলাম মনে মনে। সে যাই হোক। কমিউনিজমের পতনের পর যখন রাশিয়াতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। তখন রাষ্ট্রের প্রায় সকল গোপন সংগঠন ও পুলিশী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়। আর আমার দৃষ্টিতে অতি ঘৃণ্য সেই দৈব বস্তুটি কে.জি. বি-র ভল্ট থেকে হাওয়া হয়ে যায়। এ বিষয়টি আগাগোড়াই এত গোপনীয়তার সাথে রাখা হয়েছিল যে এমনকি খোদ সোভিয়েত রাশিয়ার বাছাই করা কিছু লোক ব্যতিত কোন সরকারী ব্যক্তিও জানতো না যে কে.জি.বি-র ভল্টে এমন একটা কিছু আছে। মূলত মস্কোয় আনার পর স্টালিন তার রাষ্ট্রীয় বাসভবনের সিন্দুকে এটিকে রাখতেন। যখন ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসেন তিনি এসব পাগলামীকে প্রশ্রয় দিতে চাননি বিধায় কে.জি.বির একজন সিনিয়র জেনারেল এটিকে পলিটব্যুরোর চেয়ারম্যানের বাসভবন থেকে সরিয়ে অফিসিয়াল ভল্টে স্থানান্তর করেন। পরে তা বিশৃঙ্খলার সময় ভল্ট থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়।
রূপক একটু উসখুস করছে। তাই দেখে সুলেইমান আদহাম বললেন
-রূপক আপনি কিছু বলতে চান?
রূপক প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে সস্তি বোধ করল। বলল
-মানে বলতে চাইছিলাম যে আপনি তো প্রত্নতাত্ত্ববিদ। কে.জি.বি র গোপন ভল্ট থেকে কোন বস্তু হারাবার মত অতি গোপনীয় সংবাদ আপনি জানলেন কেমন করে?
-দেখুন। সবাই জানে এই সমাধি খনন পর্যন্তই আমার ভূমিকা আছে। তবে বাস্তবতা হল আমি সোভিয়েত প্রত্মতত্ত্ব বিভাগে কর্মরত ছিলাম সেই সময় থেকে ঊনিশশো বিরাশি সাল পর্যন্ত , আমার আনুষ্ঠানিক অবসরের সময় হলে মন্ত্রণালয়ের একান্ত আগ্রহে আমি ছিয়াশি সাল পর্যন্ত থেকে যাই। তার পর আর কোনক্রমেই আমি সরকারী চাকুরী করতে রাজী ছিলাম না। কিন্তু দৈব বস্তুর সাথে আমার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি দায়িত্বপ্রাপ্ত হাতে গোণা দুয়েকজন কে.জি.বি কর্মকর্তা জানতেন। তারা আমার সাথে অফ দ্য রেকর্ড নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। বলতে গেলে নব্বইয়ের দশকে সমাধি অভিযান দলের যে দু’চারজন জীবিত ছিল তার মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম । সেই সূত্রেই এক ধরনের যোগাযোগ আমার সাথে চলমান ছিল। যেটা বাইরের কেউ তো দূরের কথা, সরকারী লোকজনও জানত না। গোলযোগের সময় বাক্স হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টাও আমাকে একজন কে.জি.বি তথা এফ.এস.বি জেনারেল অবহিত করেন। তিনি সেসময় এফ.এস.বি’র তৃতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি ছিলেন। তিনি জানতেন বাক্সটির ঝুকি কোন পর্যায়ের, তাই নিজের ক্যারিয়ারের চেয়ে দৈব বস্তু সংরক্ষণের বাক্সটি নিয়ে বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন। যেহেতু দৈব বস্তু সম্পর্কে অল্প কয়েকজনই জানত তাই এর হারিয়ে যাওয়ার মত অতি ভয়ঙ্কর ঘটনাও চাপা পড়ে যায়। তবে আমি সব জানতাম বিধায় স্টালিন আর গেরাসিমভকে নিয়মিত অভিশাপ দিতাম। কিন্তু তবুও আমার মনে সস্তি আসতো না। কিন্তু কে বা কারা কেন এমন একটা কাজ করল তা আজও রহস্যে আবৃত হয়ে আছে। সে বা তারা কি আদৌ জানে যে কী চুরি করেছে? এসব নিয়ে ভাবলে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসত….

ঘরভর্তি নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অল্প শীতের সুন্দর একটা সকাল যে স্নিগ্ধ অনুভূতি দেয় তা মিলিয়ে যেতে লাগল। বৃদ্ধ এমন ভাবে কথাগুলি বলে গেলেন যেন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলি দেখতে পাচ্ছেন। তার ফর্সা মুখটাতে উদ্বেগের ছাপ পড়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী লালচে হয়ে আছে। ঘরটা যেন একটা আতঙ্কের শীতল স্রোতে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। জারা এতদিন যতটুকুই দাদুর সংস্পর্শে থেকে জেনেছে তা আজকের বলা ভয়াবহতার তুলনায় কিছুই নয়। সে পালা করে একবার সুলেইমান আদহামের দিকে একবার রূপকের দিকে তাকাচ্ছে । যেন একটা আশ্বাসবাণী শুনতে পাবে-‘না কোন ভয় নেই; সব ঠিক হয়ে যাবে’। ওদিকে সুলেইমান আদহাম জানতেন যে দৈব বস্তু একটা না একটা ধ্বংসের পথ খুলবেই। তবে এতে যে জীবাণু জাতীয় কোন বিষয় আছে তা ধারণা করেননি, আর তাছাড়া এসব তার প্রত্নতত্ত্বের বিষয়ও নয়। সব চেয়ে বড় কথা গত সাতষট্টি বছর ধরে চেপে রাখার আতঙ্কটা এই শেষ বয়সে তার সামনে এমন ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। যদিও শুরু থেকেই কখনো বিষয়টা একবারের জন্যও ভুলতে পারেননি।

রূপক বিষয়টাকে ভাবছে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। দুশ্চিন্তা করে সময় পার করা তার লক্ষ্য নয়। সে ছিঁড়ে যাওয়া সুতোর প্রান্ত জোড়া দিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো ঘটনাপ্রবাহের জালটা পূণনির্মাণ করার চেষ্টা করছে। আচমকা মুখ খুলল রূপক
-আমি একটু অতিরিক্ত তথ্য যোগ করতে চাই, তাতে আমাদের সবার জন্য বিষয়টা বুঝতে সুবিধে হবে। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে একটা সন্দেহজনক ও বড়জোড় আকস্মিক দুর্ঘটনা মনে হলেও এই ঘটনার লেজ আমাদের ধারণার চাইতে আরেকটু বেশী বিস্তৃত।
জারা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল
-মানে?
-মানে হল কোন বিক্ষিপ্ত নিখোঁজ হবার ঘটনা এটা নয়। কে.জি.বি বা এফ.সি.বি’র ভল্ট থেকে এটা কোন অবুঝ লোক চুরি করেনি। সবার অবগতির জন্য বলছি, চেঙ্গিস খানের কাছে দৈব বস্তুর বাক্সটা আসে কোত্থেকে তা তো আমরা জেনেছি, যিন সম্রাটের কাছ থেকে তাইনা? এখানে একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে যে, একজন মঙ্গোলীয় বিজেতা চীনাদের ধর্ম আর দর্শনের আশ্চর্যতম বস্তুটি দখল করে শুধু চীন নয় বরং গোটা পৃথিবীর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তারপর থেকে তা মঙ্গোলীয় দখলদারিত্বের ডাল বেয়ে এগিয়েছে। ভাল কথা; কিন্তু পরাজিত যিন সাম্রাজ্যের লোকেরা বা আরও স্পষ্ট করে বললে সম্রাটের কোন উত্তরসুরি এ বিষয়টা স্রেফ দুর্ভাগ্য ভেবে ভুলে যাবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই।
সুলেইমান আদহাম বললেন
-মি. রূপক, বিষয়টা বুঝলাম না। আরেকটু বুঝিয়ে বলুন তো।
-বলছি। সোজা কথায় , যিন সম্রাটের এক প্রপৌত্র দৈব বস্তু পূণরোদ্ধারের জন্য শপথ নেয় এবং সময় ও প্রজন্ম পরম্পরায় সে চেষ্টা অব্যহত রাখার জন্য একটা গোপন সংগঠনের সৃষ্টি করে। সে সংগঠনের মূলনীতিই হল যে কোন মূল্যে সেই দৈব বস্তু দখল করে আবার চীনে নিয়ে আসা এবং যিন সামাজ্য পূণ:প্রতিষ্ঠিত করা। আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও এই সংগঠনটির অস্তিত্ব প্রায় আটশ বছরেরও বেশী সময় ধরে বিদ্যমান।

রূপক যা বলল, তাতে সুলেইমান আদহাম আর জারার চোখ কপালে উঠবার জন্য যথেষ্ট। জারা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে জিজ্ঞেস করে বসল
-এত বছর ধরে একটা গুপ্ত সংগঠন নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে? আর তুমি এসব জানলেই বা কোত্থেকে?
-পৃথিবীতে অনেক অনেক গুপ্ত সংগঠনই নিজের অস্তিত্ব বলিষ্ঠ অথবা দূর্বল ভাবে ধরে রেখেছে। হয়ত আমরা সেভাবে খুঁজে দেখিনা বলে সন্ধান পাইনা। আমাদের আলোচিত সংগঠনটি চীনে বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিল। পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে তাড়া খেয়ে আস্তানা গাড়ে তাইওয়ানে। চীনা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা অভিযানে সংগঠনের কয়েকজন লোক ধরা পড়ে আর হাতে আসে তাদের মূল্যবান কিছু নথিপত্র। সেখান থেকে চীন সরকার তা জানতে পারে। শুরুর দিকে যখন চীনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল তখন চীন সরকার রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য মস্কোকে অবহিত করে। এমনকি এটাও জানায় যে যিন সাম্রাজ্যের অধিকারে থাকা কথিত দৈব বস্তুটি যে বর্তমানে মস্কোতে আছে তা ওরা জানে, এবং সেখান থেকে তা উদ্ধারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব খবর অনেক বছর যাবত মস্কোর কাছেই ছিল, ইউরোপ আমেরিকা তা জানতো না। দক্ষিণ এশিয়ায় অজ্ঞাত বায়োলজিক্যাল এজেন্ট এর আক্রমণের ঘটনার বিবরণ ও সংক্রমণের নমুনা যখন ইউরোপীয়দের হাতে তখন তদন্তের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন সেল গঠন করল, সেখানে তথ্যগুলি উপস্থাপন করা হয় মস্কোর তরফ থেকে। সেই সূত্রে আমার কাছে আসে এসব কথা। এখনও তাইওয়ান নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব আর চীনের মধ্যে টানাপোড়েন আছে, সেই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে নির্বিঘ্নে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিন্তু মস্কোর ভল্টে একটা মাত্র ফলক আর সুগন্ধী ছড়ানো পাত্রটা ছিল। অপর ফলকটার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদিও চীন থেকে জয় করা বাক্সে দুইটা ফলক ছিল। এ জায়গায় এসে ব্যাপারটা খানিকটা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। তবে একটু মিলিয়ে নিলে একটা রাস্তা পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
-যেমন?
-আমরা নুকুসে একটা জায়গা পরিদর্শনের সময় কিছু বিষয় মিলিয়েছিলাম, জারা তোমার মনে আছে?
জারা অবুঝের মত মাথা দুলিয়ে সার দিল। রূপক আবার শুরু করল
-তৈমুর তার জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় উজবেকিস্তানের সীমান্তে এসে বিশ্বস্ত লোক দ্বারা একটা কিছু তার রাজ্যের সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল সম্ভবত দ্বিতীয় ফলক যার মধ্যে রয়েছে প্রাণঘাতী জীবাণূ থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। কিন্তু ফলকটা নুকুস থেকে সীমান্তের ওপারে যাওয়ার আগেই এর একটা কোণা ভেঙ্গে যায়, অথবা ভেঙ্গে ফেলা হয়। ফলকটা পাঠিয়ে দেয়া হয় আরব উপদ্বীপে, নিরাপত্তার স্বার্থে। সেখানে কোথাও বহু বছর সংরক্ষিত ছিল তা। পরবর্তীতে ইগর সাবিৎস্কি যখন নুকুস মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠা করেন তখন তার সংগ্রহে আসে দ্বিতীয় ফলকের সেই ভাঙ্গা টুকরা যেটার ছবি আমি তুলেছিলাম।
-আচ্ছা, এবার ধরতে পারছি। টুকরোর ছবি রাতে দেখেছিলে?
-হ্যাঁ, সেটা দেখেছি এবং আমি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন সেল এর বরাবর ইমেজ মেইল করে পাঠিয়েছি। এখন কী দাঁড়াল তাহলে বিষয়টা? সন্ত্রাসীরা যদি নিজেদের বাঁচিয়ে জীবাণু আক্রমণ চালাবার প্ল্যান করে থাকে তবে তাদের দ্বিতীয় ফলকটা লাগবে। আর পৃথিবীবাসীর দুর্ভাগ্য হল তারা সেটা পেয়েও গেছে।
একযোগে আৎকে উঠল জারা আর সুলেইমান আদহাম। বৃদ্ধ বললেন
-ওরা যে দ্বিতীয় ফলকটা পেয়েছে তা কীভাবে জানা গেল। ওরা নিজেরা নিশ্চয়ই তা রেডিও টিভিতে প্রচার করেনি?
রূপক হাসল। যদিও সময়টা হাসির নয়। বৃদ্ধ এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তার রসবোধের জায়গায় পাকা। বলল
-আমরা জানি সিরিয়ায় আই.এস নির্মুলে মার্কিন তথা পশ্চিমা তৎপরতা একটা ভাওতা। সেখানে প্রকৃত পরিবর্তন আসে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর। রাশিয়ার সহায়তায় যখন সিরিয়ার সরকারী বাহিনী একের পর এক অঞ্চল সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করছিল তখন তাদের হাতে একদল সন্ত্রাসী বন্দী হয়। বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদে রাশিয়ান সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকে। সে সূত্রে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে যে আটককৃতদের অনেকেই পালমিরার প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন ধ্বংসের ন্যক্কারজনক অভিযানে অংশ নিয়েছিল। তাদের একজন একটা ফাপা মূর্তির ভেতর থেকে একটা বাক্স পায় যেটা খুলে ভেতরে অদ্ভুত ভাষায় লেখা অথবা চিহ্ন খোদাই করা একটা হালকা সুবজাভ পাথরের ফলক রাখা ছিল। পরে ডেপুটি কমান্ডার পর্যাযের একজন আই.এস সন্ত্রাসী সেটা নিয়ে রাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেও আর তার সন্ধান কোথাও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সেই গুপ্ত সংগঠনের কেউ আই.এস এর মধ্যে আগেই ছিল যে ফলকের বিষয়টা জানত। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে ফেরারী আই.এস ডেপুটি কমান্ডার একজন মধ্য এশীয় এবং তার নাম বাবর আসমেত।

নাম উচ্চারনের সাথে সাতেই বৃদ্ধের মুখ ছাই বর্ণ ধারণ করল আর জারা মুখে হাত চাপা দিল। কিন্তু রূপক কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জারার দিকে তাকাল যার মানে হচ্ছে-আমি কি ভুল কিছু বললাম বা করলাম। জারা রূপকের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির মানে বুঝে নিয়ে মুখে কোন শব্দ না করে মাথা দু’পাশে নেড়ে জানাল-রূপক ভুল কিছু বলেনি। রূপক আবার বলতে শুরু করল
-গুপ্ত সংগঠনের লোকেরা কীভাবে মস্কোর ভল্ট থেকে এসব চুরি করেছিল, চুরি করতে তাদের যে অভ্যন্তরীন ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্য প্রয়োজন হয়েছিল তা কোথায় পেয়েছিল তা নিয়ে রাশিয়ান অথরিটির একটা নিজস্ব বিশ্লেষণ আছে। দ্বিতীয় স্ত্রী নাদিযদা আলিলুয়েভার গর্ভে স্টালিনের একজন ছেলে সন্তান ছিল যার নাম ভ্যাসিলি লোসিফভিচ জুগাশভিলি ওরফে ভ্যাসিলি স্টালিন। সামরিক বাহিনীর লোক হওয়া স্বত্ত্বেও উছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য বিতর্কিত এক চরিত্র। বিদেশীদের কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছেন। তার রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতার সাথে কে.জি.বি ভল্টের বাক্স চুরির একটা জোরালো সম্পর্ক আছে বলে মস্কো বিশ্বাস করে। ষাটের দশকের শুরুতেই তিনি অভ্যন্তরিন স্পর্শকাতর তথ্য আমাদের আলোচিত গুপ্ত সংগঠনের কাছে সরাসরি অথবা পরোক্ষ ভাবে পৌঁছে দিয়ে থাকবেন-এটাই মস্কোর ধারণা।

রূপক খানিকটা বিরতি নিয়ে দাদা আর নাতনীকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর বলল
-আচ্ছা, আমি পলাতক আই.এস সন্ত্রাসীর নাম বলার সাথে সাথেই আপনাদের মধ্যে চোখে পড়ার মত পরিবর্তন আর প্রতিক্রিয়া দেখলাম। যদি সীমালঙ্ঘন না হয়ে থাকে তাহলে আমি কি জানতে পারি বিষয়টা কি?
বৃদ্ধ প্রথমটায় মাথা উপর নীচে দুলিয়ে হ্যাঁ বোধক সায় দিলেন। তারপর বললেন
-বাবর আসমেত আমার একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে। অর্থাৎ জারার কাজিন। যার মা একটু আগে আমাদের কফি পরিবেশন করে গেল।

এবার রূপক এদের অস্বস্তির কারণটা ধরতে পারল। এই তাহলে ঘটনা। এরা জানে যে ঘরের ছেলে আই.এস সন্ত্রাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে। আর সেজন্যই ফুপুর ছেলে মেয়ের কথা রূপক প্রথম দিন জানতে চাওয়ায় জারা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল।

এসব অবমাননাকর কথা এখানে আলোচনায় আনতে চায়নি রূপক, কিন্তু এখনতো দেখা যাচ্ছে বাবর আসমেত বাহ্যত আই.এস সন্ত্রাসী হলেও কার্যত তার চেয়েও বেশী । সে সম্ভবত আলোচিত চীনা গুপ্ত সংগঠনের গোপন কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত। রূপক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুলেইমান আদহামের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ বললেন
-বাবরের বিষয়টা আনন্দ আর বিষাদের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। শুনুন তাহলে…..
এরপর বলে গেলেন বৃদ্ধ বাবরের অতীত।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত