ঠুল্লো (২)

১ম পর্ব:

এবার ২য় পর্ব পড়ুন:

নজরুলের পারিবারিক আয় বলতে যা বোঝায় তা নজরুলের উপার্জিত আয়টাকেই বোঝায়। গ্রামে জমিজমা ছাড়া আর কিছুই নাই। এক সময় প্রচুর সম্পত্তি ছিলো নজরুলের বাবার। প্রচুর নামডাক ছিলো। যদি এখনো সে সম্পত্তি থাকতো তাহলে এই এলাকায় এমন কোনো মদ্দা নাই যে তার উপর কথা বলতো। কিন্তু নাই এখন সেটাই বাস্তবতা। ফলে, নজরুলের বাড়িতে কেউ ইচ্ছা করলেই উঠানে ঘুঘু চড়িয়ে আসতে পারে।

এদিকে নজরুল বিভিন্ন বাস্তবতায় সমাজের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে বেশ হিমশিম খায়। একটা টাইমে নজরুলের সরিষা তেলের ফ্যাক্টরি ছিল। সেখানে অর্গানিক ভাবে সরিষার তেল উৎপাদন করতো। এবং সে উৎপাদিত পন্য হোল সেলিং করতো উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে। সেখান থেকে যা প্রোফিট হতো তার থেকে নিজের সহ কর্মচারি বিল পেমেন্ট দিয়ে চলতে পারতো। কিন্তু এখন সে অবস্থা নাই। দেশের অর্থনৈতিক মন্দার সাথে সাথে নিজেরও মন্দাভাব শুরু হতে লাগলো। এখনো একই অবস্থা বিদ্যামান। এইখান থেকে কিভাবে পরিত্রান পাবে তা ভাবতে ভাবতে গলদগর্ম হয়। এই ব্যবসাটা সে করেছিলো ব্যাংক লোন করে। কিন্তু তার ব্যবসায়ী পার্টনারদের অসহযোগীতা আর অসততা থাকার কারণে ব্যবসাটাকে বেশিদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এনজিও ও ব্যাংক মামলা করে নজরুলের বিরুদ্ধে। বাড়িতে একের পর এক উকিল নোটিশ আসতে থাকে। কিন্তু কি করবে সে। ব্যবসা বানিজ্যে লস খেয়ে সে এখন পথে পথে ফেঁউয়ের মতো ঘোরে। মাথা টাল খায়। চোখে ঝাপসা দেখে। নাক দিয়ে যা শুঁকে তা সবই উচ্ছিষ্ট পঁচা ভাগার থেকে যে গন্ধ উৎপাদন হয় তার মতো গন্ধ লাগে। গন্ধে বমি আসার জোগাড় হয়। এদিকে বসে থেকে থেকে শরীরে কোলেস্টোরেল মাত্রা বাড়তে থাকে। কাছের বন্ধুরা যারা ছিলো অর্থ্যাৎ যারা সুখের সময়ে বন্ধুরূপে আবির্ভূত হয়েছিলো তারা নজরুলকে দেখলেই সটকে পড়তো। ভাবতো, কখন কি না কি জানি চেয়ে বসে। অথচ, ব্যবসা চলাকালীন সময়ে তাদের কাছে ধারকৃত টাকা যা পাবে তা ফেরত পেলেও অনেক উপকার হয়। কিন্তু তারা এ দুর্যোগের সুযোগে গা ঢাকা দিয়ে থাকে।
ভাবে, চৌদ্দ শিখোত্ উঠ নাক্যা। খুব তো ভাব মারাচ্চিলু, চোখে চশমা, হাতে ব্রেসলেট মার‌্যা ঘুরিচ্চিলু। মনে হচ্চিলো কোটিপতির সোল!
একজন বলে, ব্যবসা করলে ট্যাকা দিনুহিনি। আবার মাল দে, ট্যাকা দিমু। ট্যাকা দিমু মাল নিমু। মাল দিব্যার পারিচ্চু নে, ট্যাকা দিমু ক্যাং করে। ব্যবসা না করলে কেউ কে ট্যাকা দেয়! তাদেরকে যে টাকা ধার দিয়েছে তার কোনো ডকুমেন্টও নাই। মানে, স্ট্যাম্প, স্বাক্ষী কিংবা চেক কোনো কিছুই নেয়নি। শুধুমাত্র বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছে নজরুল।

ব্যাক্তি নজরুল ও কাজের কাজি নজরুলকে সমালোচনা করার লোক অনেক আছে। তেমন ধরনেরই একজন বলে, ব্যাংকোত থেকে লোন করে উংকে ভাব মারে ঘোরাই যায়। ট্যাকা কামাই করে ঘুরলে পরে তালে বুঝনু হিনি উই বাপের ব্যাটা সাদ্দাম!
-ক্যা, একোন উংকে করিচ্চু ক্যা, মাথা আচড়াচ্চু ক্যা! হায় রে, মনে করিচ্চিলো সব সময় ইংকেই যাবি। কথা কলেই ফাল পাড়ে উঠিচ্চিলো! মানুষোক এনাও মানুষ মনে করিচ্চিলো না। হাদীসোতই আছে, বেশি অহংকার করা ভালো লয়। যার অহংকার আছে তার পতন হবিই, হবি!
নজরুল ভাবে, কোথায় তার অহংকার! মানুষের সাথে দেখা হলে তাদের সাথে কুশল বিনিময় থেকে শুরু করে আপ্যায়ন সব কিছুই সে আন্তরিকতা দিয়ে করে। সে অহংকার জিনিসটা কি তা অনুধাবন করতে পারেনা। অথচ, একজন অহংকার মানুষের যা বৈশিষ্ট্য তার সাথে তাকে তুলনা করে।
অহংকার জিনিসটা আসলে কে কিভাবে নেয় তা বুঝতে চায়। নজরুল ভাবে, আল্লাহ তাকে যেভাবে তৈরি করেছে তার বাইরে সে যেতে চাইলেও যেতে পারবেনা। আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছে, ফলে তার গুণাবলীও তার মাঝেই আছে। ফলে, সে এ বিষয় নিয়ে টেনশন ফিল করেনা। এছাড়াও, একেকজন একেকভাবে, অহংকারকে মাপে। এটা টোটালি দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্লাসের ব্যাপার। এ জগতে সবাই সবার মন জুগিয়ে চলতে পারেনা। এই মন না জুগিয়ে চলার ভেতরেই যদি কেউ কারো ভেতর অহংকার খুঁজে পায় তাহলে তার করার কি থাকে? অথচ যত অহংকার নজরুলের ভেতরই দেখতে পায় সবাই।

সে হাড়ে হাড়ে টের পায় বন্ধুত্ব বলে আসলে কিছুই নাই দুনিয়ায়। যা আছে তা গিভ এন্ড টেক। তুমি দিতে পারলে দুনিয়া তোমার। না দিতে পারলে রাস্তার কুকুরের যা মূল্য আছে তোমার তাও নাই। ফলে, তার সামনে বন্ধু বন্ধু শব্দ উচ্চারণ করলেই তাকে ঘৃণা করে নজরুল। ভাবে, এই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তার কি না কি জানি সর্বনাশ করতে এসেছে।

যাই হোক এতোগুলো টাকা নজরুল কিভাবে পরিশোধ করবে; তার চিন্তায় মাথার চুল উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে। রোদে, জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তার গায়ের চামড়া পুড়ে পোড়া বেগুনের মতো হয়। দেখা হলেই লোকজন বলে, ক্যা বারে ইংকে হয়্যা গেছো ক্যা! অথচ মাস খানিক আগেও কি নজরুল ভাবতে পেরেছিল তার এমন দুরবস্থা হবে? পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবাই তাকে দেখে ভ্রু কুচকাবে? কুসন্নি লোক বলে অপবাদ দেবে!
-না, নজরুলের মাথায় ভুলক্রমেও এসব আসেনি। সে সবসময় রিলাক্স মুডে থেকেছে- ব্যবসা বানিজ্য ও লেখালেখি করেছে। তার কনফিডেন্টের মাত্রা এত হাই ছিলো যে, তার পা কোনোক্রমেই স্লিপ করবেনা। মানে, পা স্লিপ করার কোনো চান্সই দেখতে পায় নাই নিজের ভেতরে। বরং ব্যবসার মূলধন ৪০ লাখ থেকে কোটির অংকে পৌঁছাবে, কোটি থেকে পাঁচ কোটি হবে। তাহলে এতো কনফিডেন্ট থাকাটাই কি তার কাল হলো? কিংবা এমন কনফিডেন্টই বা সে কিভাবে পেলো? কনফিডেন্ট হবে না কেনো? একটা ব্যাংকের উদ্ধর্তন কর্মকর্তারা বলেছে, নজরুলের ব্যাবসাতে যতো টাকা লাগবে ব্যাংক ইনভেস্ট করবে। ব্যাংক চায় প্রোফিট। যে উদ্যোক্তার ভেতরে সম্ভাবনা আছে ব্যাংক তাকে ইনভেস্ট করবে। এদিকে নজরুলের সোস্যাল রিপুটেশন ভালো থাকার কারণে সে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিলোও। তার কনফিডেন্টের মাত্রা বাড়ার আরো কারণ আছে। সেটাকে নজরুল আধ্যাত্মিক শক্তি মনে করে। সে গল্প ভিন্ন, আলাদারকমের।

একদিন দুপুর বেলায় নিজ কর্মস্থলে দুপুরের খাবার শেষে নজরুল ফুঁকে ফুঁকে সিগারেট টানছে। এমনি সময়ে দরবেশের মতোন দেখতে এক বয়স্ক মানুষ, এক হাতে তসবিহ্, আরেক হাতে নুহ আঃ এর মতো লাঠি, গাল ভরা সাদা দাঁড়ি, পড়নে পাঞ্জাবী পড়া লোকটা আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু জপতে জপতে নজরুলের সামনে হঠাৎ আবির্ভাব হয়। সে নজরুলকে দেখামাত্রই বলে, পকেটে যা আছে তা দিয়ে দে। তোর থেকে ট্যাকা লিয়ে হামার মায়োক এটা শাড়ি কিনে দিমু!
আশেপাশে কেউ নাই। বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খায় এবং এতে সে কি করবে না করবে এসব দোনোমোনো করতে করতেই সেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে যা আছে তা পকেট থেকে বের করে নেয়। আর থুথু ছিটায়া দেয় তার গায়ে। বলে, এটা জান্নাতের সুগন্ধি! ঘৃণা করিস ন্যা! তুই অনেক ভাগ্যবান, আল্লাহ হামাক পাঠাছে তোর উপর রহমত নাজেল করার জন্যি। এই কথা বলেই তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা আধখাওয়া আপেল বের করে নজরুলকে তাতে কামড় বসাতে বলে। আর বলে, এই আধখাওয়া আপেলটা তুই খেয়ে নে। এটা বেহেস্তি ফল। এই ফলটা খেলে তুই দুনিয়াতে যতোদিন বাঁচবি ততোদিনই বেহেস্তের মতো সুখ অনুভব করবি!
সে খাবে কি খাবে না এরকম ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে দরবেশ বাবা পিঠে একটা থাপা দিয়ে বলে, যাহ ব্যাটা- তোর কপালে সারাজীবনের সুখ লিখে দিলাম! তুই অনেক বড়লোক হবি। কোটি কোটি ট্যাকার মালিক হবি, সুন্দরী এটা বউ পাবি। যা চাবি তাই পাবি। সে কথা বলেই সে সামনের দিকে হাঁটতে বলে। একদম হতচকিয়ে যাওয়া নজরুল তিন চার কদম সামনে যেয়ে আবার পিছনে তাকায়ে দেখে, সে হাওয়া হয়ে গেছে। এদিক ও দিক তাকায়াও কোথাও খুঁজে পায় না তাকে। ফলে, নজরুল বিস্মিত হয়। নজরুল ভাবে, সে যদি সাধারণ কোনো মানুষই হতো তাহলে হঠাৎ করে সে কিভাবে গায়েব হয়ে যাবে? ফলে, নজরুলের ভেতর বিশ্বাসের বীজ বপন হতে থাকে যে, ঐ ফকির বাবাকে আল্লাহ তার তরফ থেকেই প্রেরণ করেছে আমার উদ্দেশ্যে!
এরকম ঘটনা সে শৈশবে বিভিন্ন মুরুব্বীজনদের কাছে থেকে শুনে এসেছে। তার মনে হতে থাকে, তারই পাশের গ্রামের এক হিন্দু দাদার ঘটনা এরকম। সেও একদিন সকালবেলায় ফুয়েল স্টেশনে কাজ করতে করতে এরকমের এক দরবেশ তার কাছে থেকে একটা রুটি ও একটা পাউরুটি খেতে চেয়েছিল। ঐ দাদাটি তাকে তার চাহিদামাফিক সব কিছু কিনে খেতে দিয়েছিল। এবং যাওয়ার সময় তার হাতে একটা আংটি দিয়ে বলেছিলো, এডে খুব যত্ন করে আঙুলে পরবু। নাপাক অবস্থায় খুলে রাখবু, পাক পবিত্র হয়ে আবার হাতে দিবু। ভুলেও যেনো এই আংটি অন্য কেউ আঙুলোত দিবের না পারে। তোর কাছে যতদিন এই আংটি থাকপি ততোদিন তুই সোনায় সোহাগা থাকপু। তুই দিন দিন বড়লোক হব্যার পারবু। যদি কোনোদিন দেকিস যে, তোর আঙুলোত আংটি নাই সেদিন বুঝবু, তুই আবার বেন্নে হয়ে যাচ্ছু! মানে, যিকি সেই হয়ে যাবু আবার!
সেই ঘটনার পর থেকে ঐ দাদার সংসারে সত্যি সত্যি উন্নতি দেখা যেতে থাকে। যা করে সেটাই সোনায় সোহাগা হয়। এভাবে দেখতে দেখতে বলা যায় সে গ্রামের ভেতরে টপ র‌্যাংকিংয়ের লোক হয়ে গেলো। বাজারে গেলে, বাজারের সর্বোচ্চ মাছটা তার চাই। এক কান্দি কলা কিনতে গেলে পুরা ঘাউরই সে কিনে ফেলে। তার সাক্ষাত পেতে লোকেরা ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে। রিক্সার ভাড়া যদি ১৫ টাকা হয় তাহলে সে রিক্সার ভাড়া হায়ুস করে ৫০ টাকা দেয়। বাড়ি ফেরার সময় রাত একটু বেশি হয়ে গেলে ১০০ টাকাও দেয়, বকশিস হিসাবে।
এভাবে তার দিনকাল ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিলো। বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর এভাবে চলতে চলতে একদিন দেখে, তার হাতের আংটিতে ফাটল ধরতেছে। একদিন সত্যিই হাতের আংটি ফেটে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। তাকে জোড়া দিয়েও যে, হাতের আঙুলে পড়বে এমন অবস্থা আর নেই। সে ক্রমেই হতাশ হতে থাকলো। ঐ দরবেশের কথা তার মনে পড়লো, যেদিন তোর হাতোত আর আংটি থাকপিনে, বুঝবু, তুই বেন্নে হয়ে যাচ্ছু! একদিন দেখা গেলো, সত্যি সত্যিই সে গরীব হয়ে গেছে। চেহারায় মলিনতার ছাপ, পড়নে ছেঁড়া-ফাঁটা প্যান্ট, যেখানে যায় সেখানেই তার পাওনাদার। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাসায় ফেরে। একদিন দেখা গেলো ঐ হিন্দু দাদাটি রাতের আঁধারে ইন্ডিয়ায় পার হয়ে গেছে। এরকম অনেক হিন্দু লোকই জমি জমা বিক্রি করে রাতে আঁধারে কাউকে কিছু না বলে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। কিন্তু ঐ দাদা, পাওনাদারের ভয়ে, লজ্জায়, দেশের মানুষের কাছে অপমান হয়ে ইন্ডিয়াতে চলে যায়।

নজরুলের সামনে এরকম ঘটনা জলজ্যান্ত সাক্ষি হয়ে থাকার কারণে আজ যা ঘটলো তা নজরুলের মনে একেবারেই দাগ কেটে যায়। সে বিশ্বাস করে, তার লাইফে এরকম অলৌকিক ঘটনার মানেই হচ্ছে সে সত্যি সত্যিই বড়লোক হতে চলেছে। এবং পারমান্টেভাবেই সে বড়লোক হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আর হোঁচট খাবেনা। যেহেতু তাকে ঐ দরবেশ বাবা সাবধানী বানী শোনায় নাই। যেখানে হিন্দু দাদাকে সাবধানী বানী শুনাইছিলো। এবং নজরুল বিশ্বাস করতে থাকে যে, ঐ সাবধানী বানী এমন যে, যা বলেছিল তাই ঘটেছিল তার ভাগ্যে। ফলে, নজরুল হাফ ছেড়ে বাঁচে, যাক্, এবার সংসার জীবনটা সুখে শান্তিতে ভরে উঠবে।

আজকের ঘটনাটা কাউকে বলেনা নজরুল। সে নিজে নিজে এনালাইসিস করতে থাকে। আজ যা ঘটলো তা কি আসলেই সত্যি হবে?

নজরুলের আত্মবিশ্বাস বাড়ার আরো একটা কারণ আছে তাহলো, সমাজে নজরুলের অনেক পরিচিতি আছে। যা ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেলেও তার এক জনম কেটে যাওয়ার কথা। ফলে, নজরুলের কখনোই আত্মবিশ্বাসের অভাব হয় নাই। যেখানে অন্যদের উপরে উঠার জন্য নানারকমের লড়াই সংগ্রাম করতে হয়। পলিটিক্যাল, ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট পেতে তাদের নানাধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করতে হয় সেখানে নজরুলের সবকিছুই অটোমেটিক তৈরি হয়েই থাকে। ফলে, নজরুলের কনফিডেন্টের লেভেল তো হাই-ই হয়ে থাকার কথা। তার উপরে তিন শক্তি- যথাঃ আধ্যাত্মিক শক্তি, পলিটিক্যাল শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি। সব শক্তিই তো নজরুল ক্যারি করে বসে আছে। তাহলে সে তার বিশ্বাস হারাবে কেনো? এই কনফিডেন্ট দেখে কেউ যদি কোদ্দো করে বসে থাকে তাহলে তার মান ভাঙ্গানোর জন্য নজরুল বসে থাকবে না তো! কিংবা তার এ কনফিডেন্ট থাকার জন্য নজরুলের ভেতরে যারা অহংকার নামক বায়বীয় জিনিসটাকে অনুভব করে এবং নজরুলের পরাজয় হয়েছে মূলত তার এ অহংকারের কারণেই। এই বলে যারা অপবাদ দেয় কিংবা দিতে চায় তারা কি সত্যিই সত্যটাকেই ধারণ করা মানুষ? অথচ নজরুলের মন তো সাদা। একদম সাদা দাঁতের মতো সাদা। তাহলে দুনিয়ার কূটকৌশল না বোঝাটাই কি নজরুলের পথে বসার কারণ?
হয়তো- কিংবা হয়তো না। এর উত্তর জানা নাই নজরুলের। শুধু সে বিশ্বাস করে আল্লাহ পাক মহা প্ল্যানার। সে মহাচিন্তক! সে মানুষকে ভাল রাখার জন্য কোথায় কখন কি গিফট করবে কেউ জানে না তা। পাশের গ্রামেরই এক সুহৃদ নজরুলকে দেখে বলেছিলো, ও যে মাপের মানুষ বার‌্যা সেভাবে সে চলেনা- ভাব দেখায় না। অথচ নজরুলের মতো অন্য কেউ এমন যোগ্যতা ক্যারি করলে সে তো, মানুষকে মানুষ মনে করলোনা হিনি বার‌্যা!

কিন্তু বাস্তবতা নজরুলকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। যেদিকে শূন্যতার সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা নাই। নজরুল দিন দিন বুঝতে শিখেছে, টাকা ছাড়া দুনিয়াতে সব কিছুই অচল। দুনিয়াটা দিন দিন কেমন জানি টাকার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। টাকা ছাড়া কোনোকিছুই হয়না এখানে। হবেই বা কিভাবে? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং টিকে থাকে টাকার উপর নির্ভর করে। টাকাই ক্লাস তৈরি করে দেয়। নজরুল বোঝার চেষ্টা করে, যে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তাকে খুশি রাখতে হলেও টাকার প্রয়োজন হয়। ন্যাংটা হয়ে ইবাদাতে বসলে সে ইবাদাত আল্লাহ কবুল করেনা। আল্লাহর কাছে সেই মানুষটিই সুন্দর যে সুন্দর সুন্দর পোষাক পড়ে তার সামনে হাজির হতে পারে। একারণে দেখা যাবে একজন গরীব মানুষও শুক্রবারের নামাযে কিংবা ইদ উৎসবে তার সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পড়েই মসজিদ কিংবা ইদগাহে নামাজ আদায় করতে যায়। তারমানে কি দাঁড়ায়? ইবাদাত বন্দেগী করার জন্য পোষাক কিনতে হয়, সে পোষাক কিনতে গেলে টাকার প্রয়োজন হয়। মসজিদ বানাতে গেলে টাকা লাগে। সে মনে মনে চিন্তা করে যেখানে আল্লাহকে খুশি করানোর জন্য টাকার প্রয়োজন পড়ে সেখানে মানুষকে খুশি করার জন্য টাকার প্রয়োজন পড়বেই তো। তাহলে পুঁজিই কি আল্লাহ? মানুষদের মুখে এতোদিন মানি ইজ দ্যা সেকেন্ড গড বলতে শুনেছে। কিন্তু এখন দেখছি কেউ কেউ মানি ইজ দ্যা ফার্স্ট গড বলা শুরু করে দিয়েছে। ফলে টাকাই সব। মান সম্মান, প্রভাব প্রতিপত্তি সব কিছু এখন টাকার মাধ্যমেই ক্রয় করা সম্ভব।

কিন্তু এখন নজরুলের ভবিষ্যত কানা! এই ভবিষ্যত কানা হওয়ার পেছনে নজরুলের টাকার অভাবই দায়ী। নজরুল এমন শূন্যতা এর আগে অনুভব করেনি। মাঝে মাঝে বেঁকে কঁকিয়ে উঠে। মিথ্যাকে হাসতে দেখলেও কিছু করতে পারেনা। প্রতিবাদ করতে পারেনা। প্রতিবাদ করবেই বা কিভাবে? এমন শূন্য অবস্থায় থাকে যে, কখনো কখনো পকেটে সিগারেট খাওয়ার টাকাও থাকেনা। তখন ধ্যান্দা মাছের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে অন্য দিকে। ঐ নিঃসঙ্গ আকাশ তখন তার সঙ্গী হয়ে উঠে একমাত্র।

নজরুল ছাড়াও নজরুলের পরিবার ও নিকটাত্মীয় যারা তারা সবাই দুশ্চিন্তা করে নজরুলকে নিয়ে। এতগুলো টাকা কিভাবে পরিশোধ করবে নজরুল?
এই ভাবনা থাকতে থাকতেই একদিন ওয়ারেন্ট জারি হয় নজরুলের নামে। থানা থেকে ফোন আসে এ এস আইয়ের। সে জানায় তার নামে একটা কাগজ আছে কোর্টে। এসে যেনো নিয়ে যায়। নজরুল জানতে চায় মামলার বাদী কে? সে জানায় না। নজরুল ভুয়া মনে করে। যেহেতু কোর্ট থেকে জানাইতেছে তাহলে তো, নিশ্চিত বাদীর নাম বলবে। একারণে এ সংবাদটিকে হেসেই উড়িয়ে দেয় নজরুল। মনে করে, এই দুঃসময়ে কেউ কেদারকি করিচ্চে তার সাথে! কিন্তু না- একদিন সত্যি সত্যিই বাঘ এলো!
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে থানার হাজতে ঢুকায়ে দিলো। হাজতে ঢোকানোর আগে পুলিশ কয়,- তোক এক্ষুনি ছাড়ে দিমু, কিন্তু তুই কি হামাগোরক এক লাখ ট্যাকা দিব্যার পাবু? পাশে আরেক পুলিশ বলে, স্যার, এক ছাড়ে দেওয়া যাবির লয়- বহুত জ্বলান জ্বলাছে! ফোন দিলে নানান তালবাহানা করে। আজ ভাগোত পাছি, শালা যদি ট্যাকা দিব্যার না চায়, ওক ক্রসফায়ারে ফালায়া দেন! ইংকে কতো জাউরাক খাছি হামরা! ফোন দিলেই টাল্টিবাল্টি করে। য়ুই হামাগোরক জেরা করে! মনে হয়, য়ুই পুলিশ।
কিন্তু নজরুল টাকা দিবে কোথায় থেকে? টাকা দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে নজরুলের নামে কি আর মামলা হয়? যেখানে এখন তার নিজেরই চলার সামর্থ্য নাই। তখন কিভাবে দেবে টাকা? এটা তো নজরুলের জন্য মরার উপর খাড়া ঘা এর মতো অবস্থা। নজরুল যখন পুলিশদের কথা মতো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তখন তাকে হাজতখানার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
নজরুলকে ভালবাসার লোক অনেক। তার যখন ভাল অবস্থা ছিলো তখন সবাই তাকে শুধু ভালবাসার কথাই বলেছে। মনে হয় নজরুল ছাড়া তাদের একদিনও চলবে না। যখন যেখানে যে ডাকে তখনই তাদের ডাকে সাড়া দেয়। নজরুল শুধু তাদের প্রয়োজন মিটাইছে। এখন নজরুলের প্রয়োজন কেউ তাকে দেখতে আসবে কি? তার প্রয়োজনে কোনো বন্ধুকে সে পাশে পাবে কি?

-নজরুল চেয়ে থাকে? কেউ তাকে দেখতে আসবে? কেউ তার সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসবে। সময় গড়িয়ে যায় কিন্তু কেউ আসেনা তাকে উদ্ধারের জন্য। সে কি বিভৎস অবস্থা। হাজতে ঢোকার পর নানাপ্রকার লোকের সাথে পরিচিত হয় নজরুলের। কাউকে জুয়ার বোর্ড থেকে, কাউকে চোরাই মোবাইল রাখার অপরাধে, কাউকে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের অভিযোগে, কাউকে সন্দেহবশত মার্ডার কেসের আসামী দেখিয়ে গ্রেফতার করে থানায় এনেছে পুলিশ। এতো লোকের মধ্যে গাদাগাদি করে কিভাবে থাকবে নজরুল তা ভেবে পায় না। এদিকে বন্ধুদের ভেতর থেকে নজরুলকে কেউ দেখতে না এলেও পরিবার এবং নিকটাত্মীয় কেউ কেউ খবর পেয়ে থানায় ছুটে আসে নজরুলকে দেখতে।
ঐ লকাপের পাশেই বাথরুম। খোলা বাথরুম। যা থেকে হুর হুর করে গন্ধ বের হচ্ছে। যারা জীবনে প্রথমবার থানার লকাপে থাকতেছে তাদের পক্ষে লকাপে থাকা একেবারেই সম্ভব না। বাথরুমে প্রয়োজনের তুলনায় পানি না থাকার কারণে আসামীরা পায়খানা প্রসাবের পর দুর্গন্ধের মাত্রা আরো বাড়ে।

দুনিয়াটা সত্যি অনেক আশ্চর্য্যরে। এই লকাপে না আসার জন্য কেউ কোনোদিন পাপ কিংবা অপরাধ করার সুযোগ থাকলেও তা করেনা। অথচ কেউ কেউ তা ইচ্ছা করেই করে। এটাকে তারা শ্বশুড়বাড়ি মনে করে। জামাই আদর পাওয়া যায় এখানে আসলে। কেউ বলে, কি করমু ভাই, বাড়িত থাকলেই বউয়ের ঢ্যানঢ্যানি ভালো লাগেনা! চাউল নাই, ডাল নাই- আজ ভাত রানমু কি দিয়ে। কাল কিস্তি। বউ লিত্তিদিনই কয়, ট্যাকা ম্যানেজ হলো। এল্লে শুনতে আর ভাল লাগেনা ভাই। দুনিয়াডা দোজখ দোজখ লাগে। কি করমু! কিসু করার মুরোদ থোয় নি আল্লাহ। দেকতেছেন না, বাম পাও ল্যাংড়া। ঠেঙ্গো লিয়ে হাঁটা লাগে।
-নজরুল কয়, ক্যাং করে এল্লে হলো বা! ছোটবেলাত আম গাছোত থাক্যা পড়ে যায়্যা পাও কাটে ফেল্যা দেওয়া লাগছিলো। জমি জিরোতও নাই যে করে খামু। বিয়ে করার সমি শ্বশুড় বাড়িত থাক্যা এটা জুস বানানোর মেশিন ডিবেন হিসাবে পাছনু। সেডে লিয়ে এনা করে কিনে খাচ্ছিনু। কিন্তু ঐ জাউরা পুলিশরা হামার সব স্বপ্ন পাংচার করে দিছে ভাই। প্রতিদিন চাঁন্দা দিব্যার পারতিছিনুনো দেখে, একদিন আস্যা হামার এল্লে ভাঙ্গে গুড়োগুড়ো করে থুয়ে গেছে। বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসে। নিজ হাত দিয়ে চোখ মোছে। আবার কান্দে। আবার চোখ মোছে।
এই গল্প শুনতে শুনতে পাশে থেকে আরেকজন বলে, ভাই, এল্লে দুক্ষের কথা কাক কমো আর কে শুনবি ভাই। হামার তো তোমার চাইতেও আরো কঠিন জীবন ভাই। শুনলে পরে চোখোত পানি আস্যা লাগবি!
হামার বাপ মুছি আছলো। হামরা খায়্যা না খায়্যা বড় হছি। মানসের বাড়িত কাম করে হামার মাও একথালি ভাত পাচ্ছিলো সেডে হামরা ৪ ভাইবোন মিলে ভাগ করে খাওয়া লাগিচ্চিলো। কারো ভাগোত ২ মুঠোত বেশি ভাত পড়িচ্চিলো না। যেদিন আতোত দুডে করে শেখালু খাসচুনু সেদিন ঐ এক থালি ভাত বেনা খাব্যার জন্যি পান্তা করে থুচচিলো। বেনা আবার সে পান্তা হামরা খাচ্চিনু। সাথে এটা কাঁচা পত্তেও জুটিচ্চিলো না। ইংকে করে হামাগোরে বাপ মাও হামাগোরোক মানুষমান করচে। বুঝচো! বড় হয়ে ৩ হাজার ট্যাকা দেনাত পড়ে এটা কালেনি মাগিক বিয়ে করা লাগছিলো হামার। ঐ মাগি আবার ঠসা। যদি কচ্চিনু বায়ে যা- যুই যাচ্ছিলো ডানে। নানান পেগনা লিয়ে হামি সংসার করিচ্চুনু। ইংকে হলে তাও না হয় হলোহিনি। কিন্তু একদিন হলো কি- খুব ঝড়ি হলো। আংনে প্যাঁতপ্যাতা কাদোতে ভরে গেছে। য়োরি মধ্যে ঐ মাগি করছে কি আম কুড়াব্যার গেছে। যায়ে কিসের কি আম;-আংনেত পিছলে খায়ে কোমড় ভাঙ্গে লিয়ে ওমা ওমা করে কান্দিচ্চে! মাগির পিছলে পড়া দেখেই মেজাজ হামার ১৮০ ডিগ্রি হয়ে গেছে। পড়ে যাওয়ার উপরই আরো লাত্থি দিছি লাগ্যা! মাগি তো আরো উল্লাউল্লি করে গোটা গাও ভাঙ্গে মাথাত তুলিছে। সগলি আসে কয়, কেবারে রেবেকার বাপ এডে এটা কাম করছো? কোমড় ভাঙ্গে যে মানুষটা পড়ে বেঁভাচ্ছে তারই উপর আরো পিটোন দিছো। এল্লে মানসের কাম বারে! -কোনোদিকোত উসোস না পায়্যা বাড়ির কাছেই এক কবিরাজের ডাকে লিয়ে আস্যা ঝাপ দিয়ে লিছি। তারপরও কাম হয়না। নজরুল এই লম্বা গল্প শুনতে শুনতে একটা হাই তোলে। গল্পের দিকে মনোযোগ দিতে কষ্ট হয়। তারপরও মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। যেহেতু এই লকাপে তারাই প্রতিবেশি। ভাল না লাগলেও তাদের গল্প শুনতে হচ্ছে। শুনে শুনে সময় অতিবাহিত করতে হচ্ছে। তার গল্প শোনার জন্য পাশ থেকেও কেউ কেউ এদিকে কান ফেলে রেখেছে। বলে, কও মন্টু কও, জীবন আসলে ইংকেই বারে- হামাগোরো মতো লোকের এ দুনিয়াত কিসোক যে পাঠালো সেডেই বুঝবের পানুনো! হামরা না পারিচ্চি আল্লার হুকুম মানবের না পারিচ্চি লিজের সখ আহলাদ পুরন করবের!
তারপর কি হলো বার‌্যা মন্টু? -কি হবি আবার? মাগি ঐ যে ছেংটা পালো আর কোমড় খাঁড়া করবের পালোনা। তারপর থাক্যা, মাগিরও গুঁ মুত হামার ধোঁয়া লাগে, সোলপোলেরও গুঁ মুত ধোঁয়া লাগে। সারাদিন কিষেন খাটে আসে এল্লে করতে করতেই সময় কুনদিক থাক্যা যে চলে যায় টেরই পাইন্যা। এনা যে, সন্ধ্যা লাগলে হাটখোলাত বসে খা খামু, বেড়ি খামু, দুডে মানসের সাথে গল্প করমু। সেডে করার উপায় নাই। তা মন্টু, পুলিশেরা তোমাক এটি ধরে লিয়ে আলো কিসোক? -কিসোক আবার? -য়োই যে, নজরুল ভাইয়োক যেকারণে লিয়ে আচ্চে সেকারণে হামাকও লিয়ে আচ্চে।
নজরুল ভাই, আপনেক কিসোক পুলিশেরা ধরে লিয়ে আচ্চে বারে? আপনেক দেখে তো বড়লোকের সোলের লাগানতিই লাগিচ্চে! নজরুল থতমত খেয়ে যায়। উত্তর দিতে সঙ্কোচ বোধ করে। তবু বলতে হয় হামাকও এনজিও মামলা দিছিলো। মন্টু কয়, হামার কিস্তি শোধই হয়ে গেছে বারে- আর মাত্র এক মাস বাকি আছিলো। কিন্তু জাউরোরা হামাক পরে লোন দিব্যার চায়েও আর দেয়নি আর। আগ করে হামিও আর শ্যাষ কিস্তি আর দিইনি! দিনুই হিনি এনা ঘুরে নিচ্চুনু! শালারা এক দুই মাসই আর শোলো না। দিছে মামলা করে। এটি আসে হামাক খারাপ লাগিচ্চে না। বাড়িত কতো ভেজাল। এটি খামো দামো আর ঘুম পাড়মু। তোমার বাড়িত কি খাবি? ওরা যা পারে তাই খাবিহিনি। না খালে যাই যেটি যাক যাবিনি। জিঁউয়ের উপর দিয়ে গেছে বার‌্যা, বুঝছো? বিচেরে যে কয়দিন জেল দেয়, দিবি। সেল্লে লিয়ে হামার টেনশন নাই। বরঞ্চ, এটি থাকে বার হলেই হামার উপর আবার আকাশ ভাঙ্গে পড়বি!
যেখানে অন্য আসামীরা খুশি হয়েছে লকাপে ঢুকে সেখানে নজরুল খুব টেনশনে থাকে। নজরুলের এগুলো ভাবলে চলেনা। নজরুল অন্যমনস্ক হয়ে যায়। নিয়তির কি পরিহাস, আজকে নজরুলের থাকার কথা কোথায় আর আছে কোথায়? এগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে রাত ন‘টা বেজে গেছে। লকাপের বাইরে থেকে এক সেন্ট্রি ডাকে এখানে নজরুল কে? -নজরুল? নজরুল হাত তুলে বলে, আমি। তোমাকে দেখতে এসেছে। সামনে যেয়ে তাকায়ে থাকে নজরুল। কথা বলে মাথা নিঁচু করে। পরিবারের সম্মান একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে যে। যে পরিবারে কোনোদিন পুলিশ আসবে এবং হাতকড়া পড়িয়ে থানায় নিয়ে যাবে যেটা ছিলো কল্পনার অতীত। নজরুলের পরিবার বলে, সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। কাল জামিন হয়ে যাবে। স্থানীয় অনেক নেতা নজরুলের জন্য থানায় সুপারিশ করে দিয়েছে। পুলিশও পরে বুঝতে পেয়েছে, নজরুল ভাল ঘরের সন্তান। সামান্য ভুল বুঝাবুঝি হওয়ার কারণে তার আজ এ দশা।
নজরুলের পরিবার পুলিশকে কিছু টাকা দিয়ে সাধারণ হাজতিদের থেকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করে। সামান্য ক’ঘন্টা তো। রাত পোহালেই তার জামিন হবে ফলে নজরুলকে সাধারণ হাজতিদের লকাপ রুম থেকে বের করে তাদেরই মানে পুলিশদেরই কক্ষে রাত্রিযাপনের জন্য রাখে। নজরুল সেখানেই শুনতে পায় পুলিশদের সারাদিনের কর্ম। কে কোথায় কিভাবে টাকার ভাগ পেয়েছে। কয়জন মানুষকে হয়রানি করেছে। কে কোন হোটেলে সুন্দরি মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কোন রাজনীতিবিদ, কাকে কোন চালে ফেলে টাকা ইনকামের রাস্তা বের করেছে। এসব নানান গল্প একে অপরকে বলতে থাকে।
রাত বাড়তে থাকে। রাত বাড়তে থাকলে সব পুলিশ ধীরে চলে গেলে পুরা রুমটাই খালি হয়ে যায়। একা রুমে নানান কিছু ভাবতে থাকে। সে খাঁচায় আবদ্ধ। চাইলেও বাইরে যেতে পারছে না। সে কি এক যন্ত্রনা। খাঁচাবদ্ধ পাখির যন্ত্রনা কি আমরা বুঝি?
সারারাত মেঝেয় পায়চারি করে। সময় যায়না। নজরুলের মনে হচ্ছে সময়কে কেউ শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। একবার বিস্কুট খায়, আবার বোতলে ভরা পানিতে চুমুক দিয়ে পানি খায়। আধা ঘন্টা পর পর সিগারেট ধরায়। দুই ঘন্টা পর পর পুলিশদের ডিউটিতে চেঞ্জ আসে। ওদের সবাইকে নজরুলকে পরিচয় দিতে হয়। তারা হাত পাতে তাদেরকেও একটা একটা সিগারেট দিতে হয়।
গোটা রুমের ভেতর পড়ার মতো কোনো বই নাই। নাই বিগতকালের কোনো পত্রিকাও। যেটা পড়ে সময় কাটাবে। অনেকদূরের আলমারিতে অবশ্য একটা বই নজরুলের চোখে পড়ে। বইটা আলমারি থেকে বের করে আনা হলে, নজরুল দেখে ঐ বইটা পুলিশদের নিয়েই লেখা। স্বাধীনতাকালীন পুলিশের ভূমিকা। বইটা উল্টে পাল্টে দেখে। পুলিশদের বই হিসাবে যা থাকার কথা তাই আছে। পুলিশদেরই প্রশংসা ছাড়া আর কিবা আছে। কিছু পড়েও দেখলো নজরুল, পুলিশ আইজিপির বাণী। বইয়ের প্রথম পৃষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা বাণী পরের পৃষ্ঠাতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ খানের অভিনন্দন বাণী। আরো কিছুদুর এগোতে এগোতে তার নানা চিন্তা মাথায় ভর করতে থাকে। সে এগোতে পারেনা। বইয়ের পৃষ্টার মাথা ভাঁজ করে বই উল্টায়ে টেবিলে রাখে। যদি একটু ঘুম ধরে। কিন্তু ঘুম ধরেনা। আবার সিগারেট ধরায়, সিগারেট খেতে খেতে ভোরের আজান কানে আসতে থাকে। আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাজউম নাউম।

সকাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে পুলিশে। সারাদিন কে কি করবে। কার কোন অপারেশন সেগুলো খাতায় টুকে রাখছে সকলে। গতরাতের মাদক মামলায় বন্দি একজনকে এই এস আইদের রুমে নিয়ে এসে সে কি বেধড়ক পিটুনি। বলে, তোর গোয়ার মধ্যে গরম ডিম ঢুকে দিমু জাউরা। ক, ওই মাস্টারোক ফাঁসা। -ক, যে, উই তোর সাথে ব্যবসা করে। মাদক ব্যবসায়ী, কয় না স্যার, ঐ মাস্টার হামাগোরে সাথে নাই স্যার। নাই ক্য, এ কথা বলেই ও হাঁটু সোজা লাঠি দিয়ে মারে একটা বারি। ঐ বারি খেয়েই মাদক ব্যবসায়ীর গোয়া দিয়ে গুঁ বের হয়ে যায়। শাদা প্যান্টের কালার পাছার কাছে হলুদ হয়ে যায়। প্যান্টের নিচে জাঙ্গিয়া থাকার কারণে গুঁ গুলো পাছার নিচে টোগলা হয়ে থাকে। নজরুল ভাবে, এভাবে মারার অধিকার পুলিশের নাই। তার নামে কোনো রিম্যান্ডও মঞ্জুর হয়নি। অথচ, বেধড়ক পিটুনিতে লোকটা নিভু নিভু প্রায়। কিন্তু নজরুলের এই উপলব্ধি কাজে লাগবেনা। তারই অবস্থা কাহিল। সারারাত জেগে শরীরটা তার ভেঙ্গে পড়েছে। ক্লান্তির ছাপ চোখেমুখে। টেনশনে এবং সারারাত জেগে নজরুল বুঝতে পায় সে ট্রমায় জড়িয়ে গেছে। ফলে, কোনো পুলিশ এসে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে, অল্প কথায় পথ পাড়ি দেয়।

সকাল ১০ টার দিকে নজরুলকে থানা থেকে কোর্টে নিয়ে আসা হয়। এনে যে রুমে নজরুলকে রাখা হয় সে রুম বেশ বড় সরো। কিন্তু সময় বাড়তে বাড়তে ঐ রুমে এতই আসামীতে ভরে গেলো যে, নিঃশ্বাস ফেলবার মতো অবশিষ্ট জায়গাটাও আর নেই। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। মনে মনে ভাবে, আজ জামিন না হলে, কিভাবে এর ভেতর থাকবে সে। ভাবতে ভাবতেই গা শিঁউরে উঠে। কিন্তু না। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বসার পরে নজরুলের গুরুতর অপরাধ না ভেবে জামিনে বের হয়ে আসে।
কোর্টের বাইরে পা ফেলার পরই সে কি আনন্দ। উন্মুক্ত আকাশ, ঝিরঝিরিয়ে বইছে দক্ষিনা বাতাস। মনে হয়, কতোদিন পর অথচ মাত্র একদিনই তো তাকে থাকা লেগেছে থানাতে। অথচ মনে হচ্ছে কতোদিন পর সে মুক্ত বাতাসে শার্টের বোতাম খুলে একটু বাতাস খেতে পারছে। আর মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে কানোত চিমটি কেটে বলে, ইংকে ভুল আর জীবনেও করমু না ভাই!

(চলবে..

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত