ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—১৩

১৩
আজ কেরামত আলীর চিন্তার জগত খুবই উত্তপ্ত।
একেকজন খুনী তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর সে তাদেরকে নিয়ে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। খুনীরা হল যথাক্রমে —গাঞ্জুইট্টা ছেলেটা— চেংকু, চায়ের দোকানদার —চান্দু, পুতুল, পুতুলের প্রেমিক —মজনু, কদমতলার মেম্বর আজগর আলী, বশিরুল্লাহর ছোট চাচা—আব্দুর রহমান, এবং কাঁধ বাঁকা লোকটা। এদের মধ্যে একমাত্র গাঞ্জুইট্টা ছেলেটাকে পূর্ণ খুনী মনে করা যায়। কেননা খুন করার সমস্ত বৈশিষ্টই তার মধ্যে আছে। কিন্তু তার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই এমনকি তথ্য জোগাড় করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
বাকীদের কথা ভাবতে গিয়ে মাথায় প্যাচ লেগে যাচ্ছে। কেননা এদের কাউকেই পূর্ণ খুনী ভেবে নিয়ে এগোনো সম্ভব হচ্ছে না। তাই তার ঘুমাতে ডিস্টার্ব হচ্ছে। এপাশ-ওপাশ করতে হচ্ছে একটু পরপর।
স্বামী এপাশ-ওপাশ করলে স্ত্রীর পক্ষে ঘুমানো কঠিন। আর কোনো স্ত্রীর যদি বাতের ব্যথা থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
মালেকা বিবি কেরামত আলীর নড়নচড়ন অনেক সহ্য করেছে। আর নয়। সে ধমকের স্বরে বলে উঠল, ‘নড়াচড়া বন্ধ করো!’
কেরামত আলী কাঁচুমাঁচু স্বরে বলল, ‘ইয়ে মানে…তুমি এখনো জেগে আছ? আমি আরো ভাবলাম ঘুমাচ্ছ।’
‘কীভাবে ঘুমাব? তুমি যদি বাচ্চাদের মতো এত নড়াচড়া করো আমি ঘুমাই কীভাবে?’
‘খুবই দুঃখিত। কথা দিচ্ছি আর নড়ব না।’
‘নড়লে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ঘাট থেকে ফেলে দেব।’
‘আর নড়ব না।’
কেরামত আলীর ভয়ে ভয়ে বলল, ‘বাতের ব্যথা উঠেছে কি?’
মালেকা বিবি বলল, উঠলেই কী আর না উঠলেই কী। কার কী যায় আসে!’
‘ছি ছি এটা তুমি কেমন কথা বললে গো! তুমি আমার প্রাণপ্রিয় সহধর্মীনি। আমি তোমার পাশে রয়েছি। তোমার যেমনই লাগুক সেটা আমাকে বলবে।’
‘তা কী করে বুঝব যে তুমি পাশে রয়েছ? এই যে আমি ব্যথায় কাৎরাচ্ছি, একবারও তো তোমার মনে হল না—কেন কাৎরাচ্ছি?’
‘ভুল হয়ে গেছে। মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন পা টিপে দেব কি?’
‘আবার বলে দেব কি? বললে দেবে, না বললে দিতে পার না?’
‘আচ্ছা দিচ্ছি।’
কেরামত আলী খুব মোলায়েমভাবে মালেকা বিবির পা টিপে দিতে লাগল। কিন্তু এত মোলায়েম টেপা পছন্দ হল না মালেকার। তাই সে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘নাহ থাক। আর লাগবে না।’
কেরামত আলী অপরাধীর মতো বলল, ‘কেনে? আরাম পাচ্ছ না বুঝি?’
‘কিসের আরাম! আরাম তো দূরে থাক —মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। আজ তোমার হাতে একদমই জোর পাচ্ছিনে। টেপা লাগবে না। একটু কিলাও দেকিনি।’
হুকুম পেতে যতক্ষণ, তামিল করতে এক মুহূর্তও দেরি হল না। কেরামত আলী দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মালেকার পায়ে এমন সুচারুভাবে কিল মারতে শুরু করল যেন ঠুমরির তালে তবলা শুরু হল।
মালেকা বিবি বলল, ‘এইবার বেশ লাগছে গো। আরাম পাচ্ছি—খুব আরাম লাগছে। এইভাবে কিলাতে থাকো। আমি না-ঘুমানো পর্যন্ত কিলাতে থাকো, কেমন?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

আরামে মালেকা বিবির ঘুম প্রায় চলে এসেছিল। ঘুম যে এসেছিল তার প্রমাণ হল —তার ঘড়ঘড় করে নাক ডাকার শব্দ। ঘুম এসে গেলে বিড়ালিনীর মতো এভাবেই সে শব্দ করে। শুনতে বেশ লাগে!
স্ত্রীর ঘুম এসে যাওয়ায় স্বামীপ্রবরটি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে এমন সময় অসাবধনতাবশত রগের উপর একটা বৈতালিক কিল পড়ে গেলে মালেকা বিবি চিৎকার করে উঠল, ‘ও মাগো! তোমরা কে কোথায় আছ —আমায় বাঁচাও! শিগগির এস। আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি করা হচ্ছে গো!’
‘আশপাশের বাসার কেউ এমন চিৎকার শুনে ফেললে প্রথমত তাদের ঘুম ভেঙে যাবে দ্বিতীয়ত কেরামত আলীর ইজ্জত পাংচার হয়ে যাবে —এই ভেবে সে মালেকা বিবির মুখ চেপে ধরল।’
মালেকা বিবি এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসল এবং দ্বিগুন চিল্লাপাল্লা করে বলতে লাগল, ‘আমায় মেরে ফেলল গো! তোমরা কে কোথায় আছ —আমায় বাঁচাও!—বাঁচাও!— বাঁচাও!’
কেরামত আলী আর সহ্য করতে পারল না। প্রচণ্ড শুব্দে চিৎকার করে উঠল। এত বড় চিৎকার সে আগে কখনো করেছে কি-না সন্দেহ। বলল, ‘হোই! তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’
কেরামত আলীর এক চিৎকারে মালেকা বিবি চুপ হয়ে গেল। যেন মণি দেখে সাপ তার ফণা নামাল। অসুস্থ মানুষের মতো শুয়ে পড়ল মিঁউমিঁউ করতে করতে। বলল, ‘আহ! কী ব্যথা। ইচ্ছে করছে আমার পা-খানা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলি।’ —তারপর বাঙলার চিরায়ত রুগ্ন মহিলাদের মতো মিহি-সুরে বলতে লাগল, ‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না গো আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না…’
‘আবার কুলক্ষণে কথা বলছ।’
‘এসব কথা বললে তোমার খারাপ লাগে বুঝি?’
‘শুধু খারাপাই লাগে না আত্মা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।’

—বলতে বলতে কেরামত আলী মালেকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। চুলের গোড়ায় চুলকে দিতে লাগল আর ভাবল, বকা দেওয়া হয়েছে. সুতরাং আদর বোলাতে হবে; না-হলে খেসারত দিতে হবে। মালেকা বড় অনুভূতিপ্রবণ মহিলা। সহজে কোনোকিছু ভোলে না। দেখা গেল —সকালের চা বানাবে চিনির পরিবর্তে লবণ দিয়ে।
মাথা চুলকে দেওয়ার ব্যাপারটা মালেকা বিবির কাছে খুবই বিরক্তির লাগল। সে ভেবেছিল কিছুক্ষণ চুলকে দিয়ে কেরামত হয়তো পায়ে নামবে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখতে পেল না। শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আহ! চুলকাচুলকি রেখে যদি পারো —পা টেপো।’
‘আচ্ছা টিপছি।’
কেরামত আলী মালেকার মাথা রেখে পায়ে নামল। স্ত্রী যাতে বেশি আরাম পায় —সে জন্য দুহাতের দশটি আঙ্গুল পরিচালনা করে টিপতে লাগল।
মালেকা গদগদ কণ্ঠে বলল, ‘এই তো বেশ দিচ্ছ। আহ! কী সুন্দর তোমার হাত পরিচালনা। তুমি এত সুন্দর পারো অথচ মাঝে-মাঝে ফাঁকি দাও কেনে? তুমি ফাঁকি দাও বলেই তো আমি রাগ করি।’
‘আর ফাঁকি দেব না গো। তুমি ঘুমাও এবার।’

মালেকা বিবি ঠিক ঠিক ঘুমিয়ে পড়ল।
খুনীরা এসে আবার কেরামত আলীর চোখের সামনে ভিড় জমাতে লাগল। তাদের কারো হাতে ড্যাগার, কারো হাতে কিরিচ, কারো হাতে রামদা, কারো হাতে রান্নাঘরের বটি। পরনে জবরজং পোশাক। বড় বড় চোখে রঙিন চশমা। একেকজনের ভয়ঙ্কর চেহারা।
হঠাৎ সে প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠল এবং গুটিসুটি মেরে গেল। এইসব খুনীদের সামনে সে নিতান্তই নস্যি। অথচ সে তাদের নিয়ে চিন্তা করছে। এই কথা তারা জানলে তাকে খতম করে দেবে।
ব্যাপারটা তাকে ভাবিয়ে তুলল। তার বুদ্ধি ও শক্তি দুটোই কম। সে কোনোভাবেই খুনীদের প্রতিরোধ করতে পারবে না। তাহলে কি তার পিছিয়ে যাওয়া উচিত? সেটাইবা কেমন করে সম্ভব? সে একটি কাজ শুরু করেছে, যদি মাঝপথে থেমে পড়ে বশিরুল্লাহর আত্মা কি তাকে ক্ষমা করবে? —না। প্রতিটা কাজেরই শুরু এবং শেষ থাকে। শেষটা না দেখে সে ছেড়ে দেবে?
—না তা হয় না। সে লেগে থাকবে যতক্ষণ না এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে।

সে রাতে আর ঘুম হল না।
পরদিন অফিস টাইম পুরোটাই কাটল ছটফটানির ভেতর। অবশ্য এসব ছটফটানির মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ফোন করেছে সে।
প্রথম ফোন করেছে খালা কইতরি বেগমকে। কইতরি বেগম পুত্রশোকে আগের মতোই স্তব্ধ হয়ে আছে। তার সাথে কথা বলে কিছু জানতে পারে নি।
দ্বিতীয় ফোনটা ছিল দারোগা বাবুর সাথে। তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিয়েছেন তিনি। বশিরুল্লাহর আগে সিরিয়ালে আরো একত্রিশটি পোস্টমর্টেম রয়েছে তাই রিপোর্ট পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তৃতীয় ফোন গোয়েন্দা প্রধানের প্রতি। তিনি লাইন কেটে দিয়েছেন। ফোন কেটে দেওয়ার সাথে সাথে কেরামত আলীর ফোনে একটি এসএমএস এসেছে, ‘ক্যান আই কল ইউ লেটার?’ কেরামত আলী লিখে দিয়েছে, ‘ওকে স্যার।’

অতি চিন্তার ঘোরের মধ্যে হঠাৎ কী মনে করে কাগজে আঁকিবুঁকি শুরু করেছিল কেরামত আলী। একে একে দুটো ছবি এঁকে ফেলেছে। তার একটা ছবি গাঞ্জুইট্টা চেংকুর অন্যটা পুতুলের।
কেরামত আলী ভালো ছবি আঁকিয়ে না। যে ছবি দুটো এঁকেছে, বাচ্চাদের ভাষায় তা —কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং। তবে বোঝা যায়— কোন ছবিটি পুরুষ ও কোনটি নারী।
ছবি দুটো দেখে কেউ হয়তো তেমন কিছু বুঝতে পারবে না কিন্তু কেরামত আলীর উপকার হবে। কল্পনায় দেখা এই দুজন মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তো চিনতে সে পারবে।
কেরামত আলী নিজের আঁকা ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল।
এমন সময় অফিস পিয়ন ফজলু মিঞা চা নিয়ে এল। টেবিলে চা রাখতে রাখতে ছবি দুটো এক ঝলক দেখে ফেলল। বলল, ‘আমার খুব চয়েজ হয়েছে স্যার!’
কেরামত আলী বলল, ‘কী? কী চয়েজ হয়েছে তোমার?’
‘মেয়েমানুষের ছবিটা। যা এঁকেছেন না স্যার! দারুণ।’
‘চুপ। পঁচা কথা বন্ধ কর।’
‘ওকে স্যার। পঁচা কথা বন্ধ। তাহলে ভালো একটা ভালো কথা বলি। আপনার প্রিয় নায়িকা কি প্রিয়াঙ্কা চোপড়া?’
কেরামত আলী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমার প্রিয় নায়িকা সোনালি বেন্দ্রে।’
‘ওমা! সে তো মারা গেছে।’
‘তাতে কী? কেউ মরে গেলে কি প্রিয় থাকতে পারে না?’
‘তা পারে স্যার।’
‘আর কিছু বলবে?’
‘না, মানে —বলছিলাম, আপনার মনে হয় কাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি, ঠিক না স্যার?’
‘উত্তর পেলে তুমি কী বলবে?’
‘আপনি আগে উত্তর দেন পরে বলি।’
‘ধরো ঘুম হয় নি।’
‘পুরুষ মানুষের ঘুম না হলে তারা আপনার মতো এভাবেই নায়িকাদের ছবি আঁকে। খারাপ না স্যার। চলে।’
‘এই কথা তুমি কার কাছে শিখেছ?’
‘স্যার আমার বয়স এখন তেত্রিশ। এতদিন আমি মানুষের নানান বিষয়ে কাছে শিখেছি। কিন্তু এখন আর শিখি না। আমি নিজেই কাউকে কাউকে শিখাই।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, এটা তোমার কথা?’
‘জি স্যার। ডোন্ট মাইন্ড। এতদিন ভাবতাম, আপনি একজন সুখী মানুষ। কিন্তু আজকে আমার ভুল ভাঙল। আপনিও অসুখী। বড় দুঃখের ব্যাপার স্যার।’
‘তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?’
‘আপাতত শেষ স্যার। তবে পরে এ ব্যাপারে আরো কথা বলব।’
‘তুমি এখন যাও। আমি চা খাব।’

ফজলু মিঞা এ-রকম টুকটাক বিরক্ত করে বটে তবে সে মানুষ হিসেবে ভালো। এ কারণে শত বিরক্ত করলেও কেরামত আলী কখনো তাকে গালমন্দ করে না।

যাহোক।
চা খেতে খেতে পুতুলের ছবিটির দিকে গভীরভাবে তাকাল কেরামত আলী।
পুতুলের নাকে নাকফুল। কানে ঝুমকো দুল। যদিও বলপয়েন্টে আঁকা তবুও কেরামত আলী ঠিকই তার চিকনি চামেলি টাইপ সৌন্দর্য দেখতে পেল।
পুতুলের ছবি রেখে তাকাল গাঞ্জইট্টা চেংকুর দিকে।
ঠোঁট দুটো নিগ্রোদের মতো মোটা। গরুর মতো দুটি চোখ। চক্রাবক্রা ঘন চুল। ছবি দুটো দেখতে দেখতে নিজের অঙ্কনশক্তিতে নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ল।

অফিস থেকে বের হওয়ার পথে ফজলু মিঞা যখন মিটিমিটি হেসে কেরামত আলীর দিকে এগিয়ে এল, তখন সে ছোট্ট করে বলল, ‘আমার প্রিয় নায়িকা সোনালি বেন্দ্রে নয়, —আলিয়া ভাট।’
এই কথা শুনে ফজলু মিঞা অবাক হয়ে কিছু একটা কথা বলতে চাইল কিন্তু কেরামত আলী তাকে সে সুযোগ না-দিয়ে হড়হড় করে বেরিয়ে পড়ল।

অফিসের গেইট থেকে একটা রিকশা ডাকল কেরামত আলী।
রিকশাঅলা জানতে চাইল, ‘কই যাবেন?’
কেরামত আলী বলল, ‘শুক্রাবাদ।’

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত