একটি বিষণ্ণ মন

এক

আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু বরবাগের একটা চিপা গলিতে বইসা রেগুলার আড্ডা দেই। বড়ভাই বন্ধুও আছে বেশ কয়েকজন। বিচিত্র রকমের মানুষ বিচিত্র ভাবে এই আড্ডায় যুক্ত হয় আবার নাই হইয়া যায়।

গলিটা চিপা বলে আমরা ঠিক গলির উপরে দাঁড়াইনা বা এদিক সেদিক থিকা টোল টান দিয়া বইসা পড়িনা। বইলে বা দাঁড়াইলে একটা মোটরসাইকেল ঢোকারও স্পেইস থাকেনা। গলি দিয়ে বের হলেই বা পাশে একটা গীর্জা আছে, গীর্জার পাশে একটা ছোটমতন জায়গা আছে, সেখানে আছে পরিপাটি একটি চায়ের দোকান! কফি পাওয়া গেলেও কফিশপ বলার মতোন পরিপাটি নন দোকানটি। তো সেখানে আমরা বসি। মানে আমাদের একত্র হইয়া অন্যত্র যেতে হলেও এই দোকানটিতে এসেই আমাদের একত্র হতে হয়।

দোকানটি যিনি পরিচালনা করেন তিনি এলাকার স্থানীয় লোক। নিজের জায়গায় দোকান দিছেন। এছাড়া আমরা যখন নতুন নতুন আইসা বসি দোকানে তখন তিনি গল্প করার ফাঁকে আমাদের জানায়া দিছিলেন যে তিনি একজন অনার্স পাশ করা লোক। প্রথম প্রথম দোকানে আমাদের পায়ের উপর পা তুইলা বসতে দিতেন না। তার এসব কার্যকলাপ আমাদের ভারী আনন্দ দিলে পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিছিলাম এই দোকানেই আমরা আড্ডা মারবো প্রতিদিন! 

অনার্স পাশ দোকানদারের দোকানে ফাইনালি আমরা সেটেল হওয়ার পরে দেখা গেলো দোকানদার আমাদের মামা বইলা ডাকতে দিবেননা তাকে। তিনি সাফসাফ জানিয়ে দিলেন, ভাই বা দাদা বলে ডাকতে হবে। আমরা রাজি হলাম, বললুম, ওকে, দাদা, সে-ই হবে। সবকিছু মেনে নিয়ে দাদার সাথে যখন আমরা সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তুললাম তখন আর পায়ের উপর পা তুলে বসাটা দাদার জন্য সমস্যা থাকলো না। তবে মামা তিনি বলতে দেবেনই না। আমরাও দাদাতেই পার্মানেন্ট হলাম।

কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা দিলো নতুন সমস্যা। দোকানে দীর্ঘক্ষণ টানা বসে থাকলে দাদা টুস করে ফ্যান অফ করে দেন! প্রথম প্রথম আমরা ভাবতাম বিদ্যুৎ চলিয়া গেছে। কিন্তু পরে দেখলাম, নহে, ইহা দাদার সিগনাল। এভাবেই দাদা আমাদের নির্দিষ্ট সময় পর দোকান প্রস্থান করিতে বলতেন। দিন যত গড়াইলো আর সম্পর্কও যতো গভীর হইলো দাদা আমাদের সাথে আরো গভীর রাজনীতি করা শুরু করে দিলেন। এসে বসলেই একটা কোক বের করে দিয়ে বলেন, দাদা, নেন, কোকটা খেয়ে নেন, যা গরম পড়েছে! সিগারেট একটা চাইলে দুইটা দেয়া শুরু করলো — আমরা দেখলাম যে দোকানে বসিয়া আড্ডা মারিবার জন্য আমাদের বাজেট না বাড়াইয়া উপায় নাই।

আমাদের বন্ধু সৃজন তার সৃজনশীল বুদ্ধি কাজে লাগাইয়া বাজেট বাড়ানোর একটা প্ল্যান উপস্থাপন করে। সে একটা গেইম নিয়া আসে, গেইমের নাম ফ্ল্যাপি বার্ড। একটা পাখি সেটারে পড়তে দেয়া যাবেনা, কোন খাম্বাতে বাড়ি খাইতে দেয়া যাবেনা। খাম্বায় বাড়ি খাইলেই পাখিটি নিচে পইড়া যায়। যে যতোগুলো খাম্বা পার হইতে পারে তার ততো পয়েন্ট কাউন্ট হয়। খেলাটা নিয়া সবাই বেশ উত্তেজনায় মেতে গেলো। নিয়ম সেট করা হলো: প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যারা হবে তারা বাদে সবার মধ্যে মোট বিল সমানভাগে ভাগ করে নেয়া হবে। এক ঘণ্টায় মোট বিল কোনভাবেই ৩০০ টাকার নিচে হতে পারবেনা। ৮ জন না হলে খেলা শুরু করা যাবেনা।

এভাবে বেশ কিছুদিন ভালোই গেলো কিন্তু দেখা গেলো ঘুরেফিরে ইরফান, আদনান আর সুমন এই তিনজনই বিজয়ী হচ্ছে। আর আমরা বাকিরা প্রতিদিনই কন্ট্রিবিউট করে যাচ্ছি। একদিনও জয়ের মুখ না দেখতে পেরে আর প্রতিদিনই পকেট থেকে টাকা বেরিয়ে যাবার শোকে কেও কেও আড্ডাতেই আসা বন্ধ করে দিলো। একেবারে বন্ধ করলো না, তবে আসাটা কমিয়ে দিলো। আমরা পরাজিতরা বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। 

তো একদিন খেলার ফাঁকে কে যেন বলে বসলো, ওয়েট, আমার একটা আইডিয়া আছে। আমরা সবাই ব্যক্তিটির দিকে তাকালাম। ৩০/৩১ বয়স হবে লোকটার। আমার চেয়ে ৩/৪ বছরের সিনিয়র হবে বলে মনে হলো। মাথা ভর্তি ঘন চুল। এতো সুন্দর দাড়ি আমি খুব কমই দেখছি। সুন্দর, সিম্পল একটা শার্ট পরা। দেখতে নিপাট ভদ্রলোক। ছোট করে হাসে, হাসলে তাকে শিশুটির মতো সরল মনে হয়। সৃজন জিজ্ঞাসা করলো, কে ভাই আপনি? আগে তো দেখিনি। উনি বললেন, আমার নাম আরবিন নিহার। নিহার বললেই চলবে। আমি এখানে বেশ কয়েকদিন ধরেই আসি, বসি, আপনাদের খেলা দেখি, আলাপসালাপও কানে আসে। ইরফান কিছুটা বিরক্ত হয়। আদনান বলে, তো নিহার ভাইয়া শুনি আপনার আইডিয়া। আদনান এমন ভঙ্গিতে কথাটা বলে যে শুনে সবাই হেসে ফেলে।

মুখে সরল হাসি নিয়ে নিহার বলতে শুরু করে, মার্কেটের সবার সম্মতিক্রমে একটা খরচের সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন, আজকের জন্য সবাই সম্মতিতে আসতে পারেন আজকে মার্কেটে ৫০০ টাকা খরচ করা হবে। এখন আপনারা ক’জন আছেন? ৭ জন তো, গড়ে যার যতো পড়বে সেটা সে পরিষোধ করবে। এসে একে ওকে আর বলতে হলোনা এই তুই সিগারেট নে, কোক নে, চা নে। যিনি পরিষোধ করতে পারবেনা তাকে লোন দেবেন, অথবা একটা ‘আল্লার নামে দান’ ফান্ড রাখতে পারেন। মার্কেটে পরে এসে কেও জয়েন করলে সে অনুপাতে খরচের লিমিট বাড়াবেন।

সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে একজন আরেকজনের উপর পড়তে লাগলো। রাফি বললো, আপনি বেশ ফানি আছেন তো! তবে আইডিয়াটা কিন্তু নাইস হইছে। আমার পছন্দ হইছে। অন্যরাও একে একে বলতে শুরু করলো, হ্যাঁ, আইডিয়া পছন্দ হইছে। মুহূর্তের মধ্যে বহুদিনের পুড়নো হয়ে উঠলো আরবিন নিহার। আমরা তাকে ডাকতে শুরু করলাম, নিহারদা। 

নিহারদা’র আইডিয়া আর নিহারদাকে আমাদের সবার পছন্দ হইলেও সৃজনকে কিছুটা অখুশি দেখালো। সে বুঝতে পারে এই সিস্টেম চালু হলে খেলার আমেজটা নষ্ট হয়ে যাবে। এরমধ্যে হঠাত দমকা হাওয়ায় গীর্জার পাশের চায়ের দোকনটিতে ঝুলতে থাকা কেক-রুটিগুলি আরো বেশি ঝুলতে শুরু করে। যেন ছিড়ে পড়ে যাবে। লোকজন যে যার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকে। আমরা বন্ধুরাও বিল পরিশোধ না করে পরে দিবো বলে কেটে পড়লাম।

সবাই যখন এদিকসেদিক ছুটোছুটি শুরু করলো ঝাপসা ধুলাবালির আড়ালে দেখা যায় সৃজন আর নিহার কি নিয়ে যেন কথা বলছে। দুজনের চোখে মুখেই আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। এশা ওয়াক্তের আজান পড়ে। মুহূর্তেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। নিহার আর সৃজন মসজিদে গিয়ে ঢোকে।

কী করেন আপনি? নিহারকে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে জিজ্ঞাসা করে সৃজন।

চুল মুছার জন্য পকেট থেকে টিস্যু বের করে দিতে দিতে নিহার বলে, আমি ফ্রিল্যান্সিং করে চলি।

এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ, এই মুকুলফৌজ মাঠের দুই গলি পরেই আমার বাসা। আমার বাসা মানে ২ রুমের একটা বাসা নিয়ে আমি একাই থাকি।

বাবা-মা?

দেশের বাইরে থাকে।

বৌ? জিজ্ঞাসা করে আবার একটু হাসে সৃজন।

আপনি আর আমি মিলে পাত্রী দেখা শুরু করবো আগামীকাল থেকে। ঠিকাছে?

দুজনেই হাসতে হাসতে ওজু করতে বসে। ফরজ নামাজ শেষে অনেকক্ষণ লাগিয়ে নফল নামাজ আদায় করে নিহার। সৃজনের নফল নামাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। সৃজন খেয়াল করে নিহার সেজদায় গেলে উঠতে অনেক সময় নেয়। সাঁইসাঁই করে মসজিদে বাতাস ঢুকতে থাকে। নিহারের ঢুলুঢুলু শার্ট আর বানানো প্যান্ট ঢেউয়ের মতো দুলতে থাকে। নিহার যেন একটা নদী, চোখ বুজে বয়ে চলেছে, আর সে নদী আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ বলে জিগির করছে।

ফোঁটাফোঁটা বৃষ্টির মাঝেই নিহারের নামাজ শেষ হলে দুজন বের হয়ে পড়ে। সুনসান নীরব চারপাশ, ভেজা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে, অনেক দূরে অনির্দিষ্ট কোথাও আনসেটেলড্‌ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিহার বলে, আহ! কি সুন্দর মুহূর্ত, যদি এখন মৃত্যু হতো!

সৃজন কিছু বলেনা। তার চোখ টলমল করে উঠে অযথাই! তবু বলে, ভাই কি বলেন এসব! বেশ তো মজা করছিলেন!

নিহার বলে, আপনার মরতে ইচ্ছা করেনা, সৃজন?

সৃজনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে নিহার তাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কই থাকেন?

আমি এইতো গীর্জার পেছনে একটা মেসে থাকি।

আপনার পরিবারে কে কে আছে?

মা, দুই বোন আর এক ভাই।

আপনি কী করেন?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছি। বিসিএস এর জন্য চেষ্টা করছি। একটা টিউশন ছিল গত মাস পর্যন্ত।

নিহারের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। আবার বলে, সৃজন সাব বলেন, এই সুন্দর রাতে যদি মরে যেতে পারতাম!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত