শেফালী ও কয়েকজন পুরুষ – ২


মেয়েরা রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ডাক্তারের কাছে আসে আর শেফালি এসেছিলো সেদিন বেড়ে গেছে বলে। শেফালির সবকিছুই উল্টাপাল্টা। যেমন তার এক হাতে ছয় আঙুল। ছয় আঙুলে যে তার কোনো কাজে সমস্যা হয় তা না, তবে সেই ছোটবেলা থেকেই এই আঙুলের জন্য মানুষকে যত কথা বলা লেগেছে তা লিপিবদ্ধ করলে একটা ডিকশনারির সমান জায়গা লাগত। ডাক্তারের এখানে রোগীর সংখ্যা মন্দ নয়। বোঝা যাচ্ছে রাত ১২টা বাজবে। বসে বসে পত্রিকা মুখস্থ করতে আর ভালো লাগছিলো না। এক কাপ চা খাওয়া দরকার। শেফালি বাইরে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানের ঝুলে থাকা ম্যাচ লাইট দিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিলো। চায়ের দোকানের অসংখ্য কৌতূহলী চোখ তখন তার দিকে। এসব দেখতে ভালোই লাগে। শেফালি চোখ গোনা শুরু করল। দোকানদারসহ ২৮টি।
‘এক কাপ লাল চা, আদা ছাড়া। কাপ ধুয়ে দেবেন’ – দোকানদারকে বলেই বেঞ্চে বসে পড়ে শেফালী। শাহেদ সরে জায়গা দেই।
সিগারেটসহ একটা মেয়ে রাত ১১টার সময় চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে দৃশ্যটা উপভোগ করতে শাহেদেরও ভালোই লাগছিল। আড়চোখে সে-ও কয়েকবার তাকিয়েছে। কিন্তু চোখাচোখি হতেই যে মেয়েটা পরিচিত মানুষের মতো,
‘কেমন আছেন?’ বলবে তা আশা করেনি। নিজেকে সামলে শাহেদও বলল,
‘আমি কি আপনাকে চিনি?’
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি শেফালি’
শাহেদ বুঝতে পারছে না পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। পরবর্তীতে কোন দৃশ্য আসে। তারপরেও শাহেদ বাড়ানো হাতটা ধরল কিছুটা জড়তা নিয়েই।
‘শাহেদ’।
শেফালি হাত ছাড়ছে না। চারদিকে মানুষের চাপা উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্পর্শের অনুভূতি মারাত্মক। শাহেদ কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। শাহেদের ঘাম ছোটার আগেই শেফালি হাত ছাড়ল।
‘আমি ডাক্তার রোকনুজ্জামানের কাছে এসেছি। নিজেই রোগী। আপনি?’
‘আমি রিপোর্ট দেখাতে এসেছি।’
‘কার?’
‘আমার।’
‘কি সমস্যা আপনার?’
‘আমার পায়ে একটা পুরোনো সমস্যা আছে। হঠাৎ ব্যথাটা বেড়েছে। রাতে খুব সমস্যা করে।’
‘কী হয়েছে বলে মনে করছে ডাক্তার?’
‘এখনো জানি না’।
‘কই দেখি রিপোর্টগুলো’।
‘আপনি কি নিজেও ডাক্তার’?
‘হা! হা! না। তবে রোগ-শোকের সঙ্গে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা আছে’।
মেয়েরা কথার পিঠে কথা বললে ছেলেরা ঠিক তাল ধরে রাখতে পারে না, শাহেদেও পারল না। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
‘মানে?’
‘অভিজ্ঞতা। বাসা ভর্তি রুগী সামলেছি, নিজেও রোগ শোক নিয়ে আছি।’
‘রোগ শোক নিয়ে থাকলেই বুঝি ডাক্তার হওয়া যায়। ‘
‘সে আপনি বুঝবেন না।’ – বলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত রিপোর্টগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে শেফালী। শাহেদ কি বলবে ঠিক বুঝতে উঠতে পারছে না। অপলক চোখে শেফালীকে দেখছে।
‘হুমম, পায়ে কি ঢুকেছিলো?’
‘ স্প্লিন্টার ঢুকেছে’
‘ কি প্রিন্টার?’
‘প্রিন্টার না, স্প্লিন্টার। বোমার স্প্লিন্টার’
‘সে কি? আপনি তো মারাত্মক লোক দেখা যায়? চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই।’
‘ আমি মারাত্মক লোক?’
‘ এক দিনের পরিচয়ে কিভাবে বলবো? এই যা অনেক সময় হয়ে গেল। আমার সিরিয়াল বোধ হয় এসে পড়েছে। উঠি। কেমন? আবার দেখা হবে’।
বলেই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না শেফালি। বুঝতে পারে পেছনে বোকা বোকা এক জোড়া চোখ অদ্ভুতভাবে তার চলে যাওয়া দেখছে।
শাহেদ সত্যিই বোকা হয়ে গেছে। এতক্ষণ কথার পিঠে কথা বলে যাচ্ছিল অচেনা-অজানা একজনের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গভাবে ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছে। সম্বিত ফিরে পেল দোকানদারের কথায়।
‘ওই মাইয়া আপনার কী লাগে?’
‘তাতে আপনার কী?’
এক ধমক লাগিয়ে উঠে পড়ে শাহেদ। তারও সিরিয়াল এসে গেছে হয়তো এতক্ষণে।
সেই শেফালির সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হবে এ শাহেদের কল্পনায় ছিল না। প্রায় ছয় মাস আগের কথা। চেহারাও এত দিনে ভুলে গেছে। কিন্তু শেফালি ভোলেনি। ঠিক সে রাতের মতোই সহজাত ভঙ্গিতে ‘আরে, শাহেদ ভাই!’ বলে যে চিৎকার দিল তাতে শাহেদের পিলে চমকে উঠেছে।
পাবলিক লাইব্রেরির ক্যানটিনে বসে চা খাচ্ছিল তখন শাহেদ। তার একটা চাকরির কথা চলছে। যে সে চাকরি না, একেবারে আন্তর্জাতিক ফার্মে। বেতন মাসে ১১২০ ডলার। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ হারিয়ে গেছে। এই দ্বীপের দখল নিয়ে দীর্ঘদিন মন কষাকষি চলছিল বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে। এত বড় একটা দেশ ভারত তারপরও বাংলাদেশের কোলে থাকা এই ছোট্ট দ্বীপের ভাগ ছাড়তে নারাজ। বাংলাদেশও হাল ছাড়বার পাত্র নয়। শাহেদের হবু প্রতিষ্ঠানটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কাজ করছে। তারা এই দ্বীপ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে গবেষণা করবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে বাংলাদেশের মত দেশ গুলো কি কি সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে তাই তাদের কাজের উপজীব্য। সভ্যতার নামে সারা বিশ্ব জুড়ে চলেছে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ। বায়ুমণ্ডল যেমন বিষিয়ে উঠছে তেমনি ধ্বংস হচ্ছে অরণ্য, পাহাড়, নদী। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণীজগৎ, পশুপাখি। এমন কি মানুষের প্রাণ! হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের আবাস ভূমি, চাষের জমি। বিশ্ব পুঁজিপতিদের এতকাল মাথা ব্যথা ছিলো না। কিন্তু বেশ কিছু গবেষক দেখলো পুঁজিপতিদের এই লোভকে দমন করতে না পারলে, যুদ্ধ না শিল্পায়নের পাপেই আগামী পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরপর বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন প্রতিষ্টান এই নিয়ে কাজ করছে। শাহেদের এই প্রতিষ্টানের’র ফান্ডের উৎস জানা নেই। জানার প্রয়োজনও বোধ করে নি। বেতনটাই তার জন্য মুখ্য ছিল।
যদিও জালাল যখন সব কথার শেষে বেতনের কথা বলল, তখন শাহেদ কিছুটা চিপসে গেছে। বর্তমানে যেখানে আছে সেখানে ১১ হাজার টাকা বেতন, তাও ঠিকমতো দেয় না। মাসের ২৫ তারিখ পার হয়ে যায় বেতনের গন্ধ শুঁকতে। সেখানে এক লাফে ডলারে বেতন। পাগল না মাথা খারাপ লোকগুলোর যে এত টাকা শাহেদকে দেবে! কিন্তু জালালের বিশ্বাস দেবে। ১ বছরের প্রজেক্ট ওদের। চাকরিটাও এক বছরের। তবে এক্সটেনশন করলেও করতে পারে। জালালের পরিচিত লোক আছে ওখানে। আর এমপ্লয়িদেরই পরিচিত লোক খুঁজছে ওরা। মাসে ১৪ দিন ডিউটি। অর্থাৎ ১৬ দিন সময় পাওয়া যাবে অন্য কিছু করার। শুধু ঢাকায় থাকা যাবে না। এই যা সমস্যা।
শাহেদ খুব অবাক বিস্ময়ে বলেছিল, ‘এত লোভনীয় চাকরি তুমি না নিয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছ কোন আক্কেলে’?
আক্কেল অবশ্য জালালের মারাত্মক! চাকরিটার জন্য জিওগ্রাফী অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিগ্রি দরকার। জালালের সেটি নেই। তবে শাহেদের আছে। এই সাবজেক্টে পড়ার সার্থকতা প্রথম খুঁজে পেল শাহেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে কোনো মানুষকে সহজে বোঝাতে পারত না তার সাবজেক্ট এর ধরণ। সবাই বিস্তারিত শুনে বলত সবি বুঝলাম, কিন্তু এই পড়ালেখা করে চাকরি হবে কোথায়? শাহেদ নিজেও জানত না তার ভাগ্যে কি আছে?
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হবার চার বছর পর আজ জালাল অদ্ভুত এই চাকরির অফার নিয়ে এসেছে। চাকরি অবশ্য অদ্ভুত না, চাকরির বেতনের শর্ত অদ্ভুত। শর্ত একটাই জালালের। ১১২০ ডলার দুই ভাগে ভাগ হবে। এক ভাগ জালালের। ৫৬০ ডলার শাহেদ পাবে। ৫৬০ ডলার মানে কম না। প্রায় ৪৬ হাজার টাকা। আজ তাদের কথা পাকা হবে। সে জন্যই এখানে আসা। শাহেদ জালাল এর জন্য অপেক্ষা করছিল। মাঝখানে শেফালি এসে উপস্থিত।
‘আমি কি আপনাকে চিনি?’
‘আমি জানতাম আপনি চিনবেন না। আমি শেফালি। ওই যে পপুলারে দেখা হয়েছিল’।
‘পপুলারে’!
‘হ্যাঁ, আপনি আপনার রিপোর্ট দেখাতে এসেছিলেন। আমি চা-সিগারেট খাচ্ছিলাম। আপনার সঙ্গে গল্প করলাম’।
শাহদের এবার সব মনে পড়ল। এই পাগলি দেখি ভালোই পাগল। সব মনে রেখেছে। তবে মেয়েটাকে আজকে সেই রাতের মতো এত সহজে ছাড় দেওয়া যাবে না। আজ অবশ্য শেফালিকে অন্য রকম লাগছে। খুব শান্ত সরল মুখ! বয়স ২৩/২৪ হবে। পরনে বেগুনী রঙের একটা শাড়ি। কপালে বেগুনী টিপ। ঠোঁটে হালকা কালারের একটা রঙের ছোঁয়া। দীর্ঘ কালো চুল পেছনে ছড়ানো। সেই রাতের পর শাহেদ তিন-চার দিন শুধু শেফালিকে নিয়েই ভেবেছে। বন্ধু-বান্ধবদের কেউ হুট করে একটা মেয়ে তার সঙ্গে কথা বলে বসবে, ঘটনাটা বিশ্বাস করেনি।
‘তুমি। আমি তো চিনতেই পারিনি। এখানে কী মনে করে?’
‘বাবা বাঁচা গেল। চিনতে পেরেছেন তাহলে। আমি এসেছিলাম একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে। সেখান থেকে গেলাম বারডেম এ। একজন রোগী দেখতে। ভাবলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা ঢুঁ মেরে যাই। বহুদিন আসা হয় না’।
‘একা?’
‘আমি তো একাই চলাফেরা করি’।
‘চা খাবা বা অন্য কিছু!’
‘হুমম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। পেটিস আর চা খাব’।
শাহেদ অর্ডার দেয়।
‘তারপর। আপনি এখানে কেন?’
‘আমি এক বন্ধুর অপেক্ষা করছি’।
‘বন্ধু না বান্ধবী! আমাকে আপনার সঙ্গে দেখে ঘটনা বিগড়াবে না তো’।
‘কেন তোমাকে দেখে ঘটনা বিগড়াবে কেন’?
‘আমি যথেষ্ট সুন্দরী একটা মেয়ে। আপনি বোধ হয় ভালো করে খেয়াল করেননি। আমার সঙ্গে আপনাকে দেখলে আপনার গার্লফ্রেন্ড…’
শাহেদ হেসে ফেলে। এই মেয়েটা অদ্ভুত। সত্যি অদ্ভুত। তার ২৯ বছরের জীবনে এমন মেয়ে সে দেখেনি। শাহেদ হাসতে হাসতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত। শেফালীর মধ্যে যেন কী একটা ছিল– চাহুনি আর গলার স্বরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
পেটিস আর চা এসে গেছে। শেফালি পেটিস খাচ্ছে বাচ্চাদের মতো। কোনো দ্বিধা, শঙ্কা, লজ্জা কিছু নেই। যেন কত পরিচিত জায়গায় কত পরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে আছে সে। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার শাহেদকেও সে সহজ করে ফেলেছে। শাহেদের মধ্যেও কোনো ঘোর নেই। নির্বিকারভাবে শেফালির খাওয়া দেখছে। এর মধ্যে জালাল ফোন করা শুরু করেছে। এখন জালালের সঙ্গে বসলে শেফালির সঙ্গে আর সময় কাটানো হবে না। শাহেদ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। মেয়েটার মোবাইল নম্বর, ঠিকানা কিছুই জানে না। এগুলো নেওয়া দরকার।
‘শেফালি’।
‘হুমম, বলেন’।
‘আমার বন্ধুটি বোধ হয় চলে এসেছে। পাবলিক লাইব্রেরির গেটে আছে’।
‘আপনি চলে যাবেন? যান। কিন্তু বিল দিয়ে যান। আমার কাছে ভাংতি একটা টাকাও নেই। এক হাজার টাকার নোট’।
‘বাসায় যাবা কীভাবে?’
‘সমস্যা হবে না। আপনি শুধু চা আর পেটিসের বিল দিয়ে যান’।
‘তা না হয় দিচ্ছি। কিন্তু তোমার মোবাইল নম্বরটা অন্তত দাও। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হবে কীভাবে?’
‘যোগাযোগ রাখার কী কোনো প্রয়োজন আছে, শাহেদ সাহেব!’
আলতো করে শাহেদের হাতের ওপর হাত রাখে শেফালি। স্পর্শের অনুভূতিতে শাহেদ কথা হারিয়ে ফেলে। কিছুটা বিব্রত। চট করে কোনো উত্তর মাথায় আসছে না। আসলেই কি মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রয়োজন আছে? হুট করে আবার একদিন দেখা হয়ে যাবে, আবার এমন পরিচিত ঢঙে কিছুক্ষণ কথা হবে। মেয়েটা একপর্যায়ে একটু ছুঁয়ে দেবে তাকে। একটা মিষ্টি স্বপ্নের মতো। কিংবা কোনো দিনই হয়তো আর দেখা হবে না। স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে মেয়েটি আজীবন। স্পর্শটা ফ্রেমে বন্দী ছবির মতো ঝুলে থাকবে হৃদয়ে। শাহেদ তাই বিল মিটিয়ে পেছনে না তাকিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো জালালের কাছে। পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে বসে ছিলো এক পানশালায়। জালাল নিয়ে এসেছে। শাহেদের এই প্রথম পানশালায় বসা। এর আগে দু-চারবার মদ খেয়েছে, কিন্তু কোনো দিন মদের বারে ঢোকা হয়নি। এই বার বা সেলুন বা সরাই বা পাব কত নামেই না বইয়ের পাতায় পড়েছে এত দিন। মদের বার বলতে সিনেমায় যেমন দেখেছে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। সাধারণ চায়নিজ রেস্টুরেন্টের মতো, একটা অন্ধকার পরিবেশ। তবে কেমন যেন একটা গা ঘিন ঘিন ব্যাপার আছে। চারদিকে টক টক গন্ধ। দুর্গন্ধে হঠাৎ হঠাৎ শাহেদের বমির উদ্রেক করলেও সে ঢোক গিলে গিলে অস্বস্তি চাপবার চেষ্টা করছে। তার ওপর এখানে এসি নেই, মাথার ওপর বিশ্রী শব্দে ফ্যান ভোঁ ভোঁ করছে। সিনেমায় যেমন মহিলা বারটেন্ডার দেখা যায় তার কোনো লক্ষণ নেই, চার পাঁচটা ছেলে ছোটাছুটি করছে পানীয়,বাদাম আর বরফ নিয়ে।
বোঝা যাচ্ছে জালাল এ বারের রেগুলার কাস্টমার। শাহেদ এক পেগ খেয়ে দ্বিতীয় পেগ নাড়াচাড়া করছে, এদিকে জালালের তিন পেগ খাওয়া শেষ। শাহেদ দু পেগ এর বেশী খেলেই টলমল করে। অসুস্থ হয়ে পড়ে,বমিও করে ফেলে। বহুবার চেষ্টা করেছে কন্ট্রোল করার, কিছুতেই দুইটার বেশি খেতে পারে না, পাকস্থলীতে নিশ্চয় কোন ত্রুটি আছে ওর। এদিকে জালালের চার নম্বর পেগ গলায় ঢালতে কথাবার্তা জড়াতে শুরু করেছে। মদের মন্দ ক্রিয়া কাজ করতে শুরু করেছে। একটা ভারি মদাসিক্ত শ্বাস ফেলে বলল,
‘মাই ডিয়ার, শাহেদ ভাই।’
‘হুম বল।’
‘আপনি কি জানেন আপনাকে আমি কতটা পছন্দ করি, আজ আপনার সঙ্গে শেয়ারে চাকরি ঠিক করলাম, কাল শেয়ারে বিয়ে করব’।
‘শেয়ারে বিয়ে করবে মানে?’
‘এক বাড়িতে বিয়ে করব। দুই বোন, ছোট্টটারে আমি বিয়া করমু, আপনি বড়টা’।
‘বুঝলাম না’।
‘বিশাল বড়োলোক শাহেদ ভাই, ঢাকা শহরে দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি’।
‘দুই বিঘা’!
‘জানি বিশ্বাস করতেছেন না। ঢাকা শহরে যে দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি হতে পারে আমার নিজেরই ধারণা ছিল না। সব তো মুরগির খোপ, স্কয়ার ফিটের হিসাব। আমরা স্কয়ার ফিট হিসাব করব না, বিঘা হিসাব করব। শাহেদ ভাই বিঘা ইংরেজি কি’?
‘জানি না তো’।
‘দুই বোন বুঝলেন। মাশাল্লাহ সুন্দরী আছে, আজ রাতে দেখতে যাব, আপনিও যাবেন’।
‘তোমার যে হাল, তাতে তুমি এখান থেকে বের হতে পারব কি না আমার সন্দেহ হইতেছে’।
‘শাহেদ ভাই, আমি জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক আছি। একবার বিয়েটা করতে পারলে, দুই বিঘার ওপর বাড়ি। চিন্তা করতে পারেন’।
একথা বলে সে আরো একটা ভদ্‌কা নিলো। তারপর আবার ডবল হুইস্কি। শাহেদের দুই পেগ শেষ। বিয়ার একটা নিয়েছে। জালালের চোখ টকটকে লাল। পাড় মাতালের সব লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও সব কিছু ছাপিয়ে তার মোহময় হাসি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল শাহেদকে। কথা চালিয়ে যেতে জিজ্ঞাসা করে,
‘কোথায় বাড়ি’?
‘খিলক্ষেত
খিলক্ষেত না নীলক্ষেত?
না খিলক্ষেত। এয়ারপোর্টের কাছে, চেনেন না?
হুমম, এক দুবার গিয়েছিলাম মনে হয়?
‘দাঁড়ান আপনারে ঠিকানা লিখে দিই’।
ঘচ ঘচ করে ঠিকানা লেখে জালাল। এরকম টাল মাটাল একটা লোক স্পষ্ট অক্ষরে ঠিকানা লিখতে পারে বিশ্বাস হয় না।
‘ধরেন। ঠিক রাত নয়টায় উপস্থিত থাকবেন। আজ সুমির চাচাতো বোনের বিয়ে। আমাদের নিমন্ত্রণ আছে, গিফট আমি নিয়ে যাব’।
‘সুমি কে’?
‘ছোট্টটা। সুমি আর রুমি। সুমিরে আমি পটায়া ফেলমু। ছয় মাস ধইরা ঘুরঘুর করতেছি। অহন বড়বোনের বিয়া না হইলে ছোটটারে কেমনে বিয়া দেয়’?
জালাল এমনিতে পরিশ্রমী, সাহসী এক টগবগে যুবক, কিন্তু তাকে কোনোমতেই সুদর্শন বলা যাবে না। মুখের ভাষাও জঘন্য রকমের খারাপ। প্রকৃতপক্ষে কোন মেয়ে যে তার প্রেমে পড়তে পারে এ শাহেদের বিশ্বাস হয় না। যদিও জালালের মুখে চোখে খুশির আভা। ভ্রু নাচায় শাহেদের দিকে চেয়ে।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে শাহেদ জিজ্ঞাসা করে,
‘বড়টার পিছনে ঘুর ঘুর করো নি কেন?’
‘বড়টা আপনার জন্য রাখছি।
‘তুমি কি সিরিয়াস’?
‘জোর জবরদস্তি নাই। আপনি মাইয়া দেখেন। পছন্দ হইলে বিয়া হইব, না হইলে না। তবে আপনার পছন্দ হইব। ডানা কাটা পরী না হইলেও খারাপ না, তার ওপর দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি’।
শাহেদ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। এমন আজব প্রস্তাব সে জীবনে শোনেনি। তার বাড়ির সবাই অবশ্য মেয়ে দেখেছে। বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
‘কী ভাবেন’?
‘না কিছু না’।
‘ভাবাভাবি কইরেন আজ নয়টার পরে, জাস্ট নয়টা। অহন বাজে সাতটা। দুই ঘণ্টার ভেতর ফ্রেশ হইয়া উপস্থিত থাকবেন, একটা সেলুনে গিয়া দাড়িটা কমায় নেন, আমি একটু নিউমার্কেট যামু। চলেন উঠি’।
‘হুমম, চল…’
দুজনেই উঠে পড়ে। জালালের পা টলমল করছে। শাহেদ অবাক হলো, যখন দেখল জালাল বিশ টাকা টিপস দিতেছে। তার ধারণা ছিল এসব জায়গায় হাজার টাকা টিপস দিতে হয়! এতক্ষণে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো শেফালীকে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। শেফালী শাহেদের পিছু ছাড়লো না। ওই রাতেই ফের দেখা হয়ে গেল।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত