শেফালী ও কয়েকজন পুরুষ – ২

‘ওনার সঙ্গে হাত মেলান। উনি হাসান সাহেব। আমি আপার বার্থে ঘুমিয়ে ছিলাম, অসম্ভব রোগা বলে আপনি খেয়াল করেননি। আমরা দুজনে মিলে আপনার সাথে একটু মজা করেছি’

হাসান সাহেবও হো হো করে হাসছেন? শাহেদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল –

‘জানালা খোলার পরের ব্যাপারটা কী ছিল?’

এবার শেফালী আর হাসান সাহেব চোখাচোখি হলো।

‘সরি শাহেদ সাহেব, আমরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করেছি।

আপনিও তো আমার শান্তির ঘুমে বাগড়া দিয়েছেন।‘ হাসান সাহেব যোগ করেন।

‘কী করেছেন আপনারা?’ আবারো বিস্মিত শাহেদ।

‘এক ধরনের ড্রাগ আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আপনি যখনই জানলাটা খুললেন তখনই একটা ঠান্ডা ভাব পেয়েছিলেন ঘাড়ে মনে আছে। ওটা ড্রাগ ছিল। এক ধরনের তেল। শেফালী চোখের নিমেষে আপনার ঘাড়ে লাগিয়ে দিয়েছে। এটা সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে। ত্বক ভেদ করে ঢুকে যায়। তিন মিনিটের জন্য আপনি পুরো ভিন্ন জগতে ছিলেন। কিন্তু এর কোনো সাইড ইফেক্ট নেই। শুধু ঘণ্টা চারেকের জন্য একটু দুর্বল লাগবে। কসম বলছি।

শাহেদ বোকার মতো চেয়েছিল দু’জনের দিকে। শেফালি জিজ্ঞেস করল-

‘একেবারেই চিনতে পেরেছেন?’

‘হুম, তোমার সঙ্গে দুই বার দেখা হয়েছিল।‘ – শাহেদ কিছুটা রাগ দেখিয়ে জবাব দিল।

‘দুই বার না শাহেদ সাহেব, তিনবার ।‘

শেফালীর এ কথাতে অস্বাভাবিক রকমের একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো শাহেদের চেহারায়। শাহেদ ঠিক বুঝতে পারে না কী বলবে? সেদিন বিয়ে শেষে  যখন বাড়ির পথ ধরেছিল ঠিক তখন বনানীর কাছাকাছি আবার দেখা হয়েছিল। তিনজন মেয়েটিকে একটা মাইক্রোতে ওঠাচ্ছে। শাহেদ মটর সাইকেলে ছিল। দেখে চমকে ছিল, নিজের অজান্তে থেমেও গিয়েছিল মটরসাইকেল। তবে পলকের জন্য, কেন জানি শেফালীকে চিনতে পেরেও নির্লিপ্ত ছিল। ব্যাপারটা ঠিক মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নয়, ঝামেলা এড়াবার জন্য নিষ্ক্রিয়তা। সাহায্য করতে গিয়ে পরবর্তীতে কোন ভোগান্তিতে পড়ে সেই চিন্তায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গিয়েছিল।

‘মনে পড়েছে?’ – শেফালী চোখে জিজ্ঞাসা।

অনেক আস্তে শাহেদ বলল,

: হুমম।

: আমি বারবার আপনার নাম ধরে চেঁচিয়েছি। আপনি দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন। কী যে কষ্ট শাহেদ সাহেব? ওরা যখন আমাকে খাবলাচ্ছিল। কুকুর যেমন মাংসপিণ্ড কে খাবলায়।

বলতে বলতে হঠাৎ শেফালী কোথায় যেন হারিয়ে গেল। দরজায় নক করে কে যেন দরজা খুলে ঢুকলো এ সময়।  শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রেলের একজন এটেনডেন্ট। রুক্ষ ধরনের চেহারা। লম্বাটে মুখ, গালে একটা বড় কাটা দাগ। চোখেও  একটু সমস্যা। দেখলেই মনে হয় জটিল প্রকৃতির লোক। তার সাথে সাথেই বার্থে টিটি ঢুকেছে টিকিট চেক করতে। সাদাসিদে চেহারার টিটি। মুখ দেখে মনে হচ্ছে হাসি লেগে আছে। শাহেদ নিজের টিকিট দেখিয়ে শেফালীর দিকে চেয়ে আছে। শেফালির মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন শাহেদকে চিনতেই পারছে না। এই শেফালী আর একটু আগের শেফালী যেন এক নয়। চোখের কোণা থেকে গাল পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানির সাদা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ধর্ষিতাদের  জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো আঘাত হানে ধর্ষণের দুর্বিষহ স্মৃতি। শাহেদকে দেখে সেই স্মৃতি ফিরে এসেছে অনেক বছর পর। গনগনে আগুন জ্বলছে শেফালীর চোখে।

শেফালি! কত বয়স হবে ওর? ১৯৮৬ সালের কোনো এক বসন্তের অমাবস্যার রাতে জন্মেছিল ছোট্ট একটা মফস্বল শহরে।  সবাই বলছিল এত ফরসা হয়েছে যেন অমাবস্যার ঘর অন্ধকার দূর করতেই আল্লাহ্‌ তাকে পাঠিয়েছে। হয়েছিলোও তাই। শেফালীর এই আগমন যেন তাদের পুরো পরিবারের চেহারা বদলে দিল। ঘুচে যেত লাগলো শেফালীর বাবার সব আর্থিক অনটন। এক সময় বেশ নামডাক ছিল শেফালীদের বাড়ীর এ পাড়াতে। কানি কানি জমি ছিল। মনে হত সাত পুরুষ বসে খেলেও শেষ হবে না। কিন্তু এক পুরুষ পরই পড়ন্ত গোধূলী। শেফালীর আগমনে বৈভব যেন আবার প্রান ফিরে ফেল মিয়া বাড়ীতে। আর দশটা শিশুর মতো আদরে-সোহাগে বেড়ে উঠছিল, একদিন বালিকার খাতার নাম কেটে কিশোরী হল, তারপর কত ঘটন-অঘটন যে ঘটে গেল তার এই ছোট্ট জীবনে। যে অঘটনের শুরু হয়েছিল আজ থেকে তেরো বছর আগে। দিনক্ষন ঠিক খেয়াল নেই।  খেয়াল রাখার কোন কারণও নেই। শেফালী প্রতিটি পুরুষের ছোঁয়া ভুলতে পারলেই বাঁচে। তবু এক নাছোড় আগুন অন্তরালে ঠিকই পুড়িয়ে যায়।

সেই সময়, আসছে ২০০০ সাল। নতুন শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে পুরো পৃথিবী। কত হাজার বছর পেরোল মানুষ! কত অজানা নিয়েই না নতুন শতাব্দী অপেক্ষা করছে! কত স্বপ্নই না কত মানুষ দেখছিল নতুন শতাব্দী ঘিরে! কী আনন্দের বন্যা চারদিকে! থার্টি ফাস্ট নাইটে শেফালিও সারা রাত জাগার প্লান কষে রেখেছে বান্ধবীদের সঙ্গে। শেফালির বাবা মাইনুদ্দিন মিয়ার যদিও এসব পছন্দ না। বাবাকে ভীষণ ভয় পেত বাড়ির সবাই। মাইনুদ্দিন মিয়াতো ভয় পাবার মতোই লোক।

ছোট সেই মফস্বল শহরে যে কয়জন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আছেন তাদের মধ্যে মাইনুদ্দিন মিয়া অন্যতম। কারণ তার ব্যবসার বৈচিত্র্য। হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে শুরু করে বাস-ট্রাক সব নিয়েই তার ব্যবসা। স্ত্রী রাবেয়া গৃহবধূ। একটু বেশিই স্বামীভক্ত। বিয়ের পনেরো বছর পার করেও আজ পর্যন্ত আপনি থেকে তুমিতে নামাতে পারেননি স্বামীকে। মনে মনেও কোনো অভিযোগ নেই স্বামীর বিরুদ্ধে। স্বামী অন্ত প্রাণ রাবেয়া অভিযোগ করার মতো কিছু কখনো মাইনুদ্দিন মিয়ার মধ্যে খুঁজে পাননি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো ছোট এ মফস্বল শহরেও রাবেয়াদের রেখেছেন অনেক আভিজাত্যের মধ্যে। আশপাশের লোকেরা মর্যাদা দেয়, সম্মান দেয়, সমঝে চলে রাবেয়াদের।

তাদের দুই মেয়ে শেফালি আর পদ্ম। শেফালি ক্লাস নাইনে পড়ছে তখন। সেদিন ছোট বোন পদ্মর স্কুলে ভর্তির দিন। রাবেয়া স্কুলে ভর্তি করাতে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। সচরাচর বের হওয়া হয় না রাবেয়ার। ডাক্তারের কঠিন নিষেধ। কিন্তু কতক্ষণ আর ঘরে থাকা যায়? একটু শরীরটা ভালো লাগলেই রাবেয়া বেড়িয়ে পড়েন। অন্যদিনের মতো মাইনুদ্দিন মিয়া আজও সকালেই বেরিয়েছেন। তার ট্রাক পুলিশ আটকে দিয়েছে, সেটা ছাড়াতে হবে। ট্রাকে করে নাকি ফেনসিডিল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। হারামজাদা ড্রাইভাররা এসব কাণ্ড করেই বেড়ায়। এখন ছাড়াতে কমপক্ষে হাজার পাঁচেকের ধাক্কা। তাও থানায় থাকতে থাকতেই ছাড়াতে হবে। একবার আদালতে চলে গেলে রক্ষা নেই। কাজের লোক হাফিজটাকে বাজারে পাঠানো হয়েছে। কাজের মহিলাটা আজ দু’দিন হলো আসছে না। তার স্বামীর টাইফয়েড না কী হয়েছে তা নিয়ে সে ব্যস্ত। ঘরে যে কারণে শেফালি একা। একা থাকতে শেফালীর ভালই লাগে। একটা বাড়তি স্বাধীনতা উপভোগ করে। যদিও ভয় লাগে। ভয় পেত শেফালী, খুব ভয় পেত। অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ শিশু যেমন ভয় পায়। একাকী নির্জনতায় শব্দভীতি। তারপরও একাকী থাকার আনন্দ এই ক্লাশ নাইনেই বুঝে গেছে। যদিও এই একাকী শুয়ে থাকা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কে যেন কলিংবেল টিপছে।

শেফালীকে বাসায় পড়াতে আসে মামুন স্যার।  মামুনকে কেউ কখনো সন্দেহের চোখে দেখে না। দেখার কথাও না, পাড়ার সবচেয়ে ভদ্র ছেলে হিসাবে নামডাক আছে মামুনের। পড়ালেখাতেও অসম্ভব ভালো, শেফালিকে একা বাসায় রেখে যেতে রাবেয়ার তাই বাড়তি কোনো ভাবনা মনে আসে না। আজ অবশ্য মামুন পড়াতে আসেনি। স্কুল এখনো খোলেনি, পড়াবে কি? শেফালী দরজা খুলে দেখে মামুন স্যার।

: স্যার, আপনি?

: আসলাম, একটু তোমাদের দেখতে?

: আসেন ভেতরে আসেন?

মামুন ভেতরে ঢোকে, চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন ছোড়ে,

: বাসায় কেউ নেই?

: না, সব বাইরে। আপনাকে কিন্তু আজ চা খাওয়াতে পারব না; টানা ৪৮ ঘণ্টা ধরে ঘুমাচ্ছি। কেবল ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম। এ সময় আপনি বেল বাজালেন। এখনো ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে আসছে।

: বল কী! ৪৮ ঘণ্টা?

: থার্টি ফাস্ট নাইটে সারা রাত জাগবো তাই। দাঁড়ান পুরোটা বলতেছি। আপনি একটু বসেন, আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসি।

সবাই বাইরে থাকার সুযোগে মামুন স্যার যে এমন কাণ্ড করে বসবে ভাবেনি শেফালি। সবে চৌদ্দতে পড়া কৌতুহলী কিশোরী মন কেবল বুঝতে শিখেছে এসব সম্পর্ক। তাও বড় চাচাতো-মামাতো বোনদের গল্পের ভেতর দিয়ে যতটুকু শোনা। কিন্তু এর ভয়ংকর দিকটা কখনো ভাবেনি সে।  হালকা স্পর্শের বাইরে কিছুই হয়নি এত দিন তার সঙ্গে স্যারের। অঙ্ক শেখানোর ছলে হাত ধরা কিংবা হালকা পায়ে পা লেগে যাওয়া। শাস্তির নাম গাল টিপে দেওয়া এসব এই সীমাবদ্ধ ছিল। শেখানোর ছলে নিতান্তই স্পর্শের অনুভূতি নতুন নয় তার জন্য। অথচ আজ শেফালির ইচ্ছা করছে কাঁদতে। অনেকক্ষণ ঝর ঝর করে কাঁদলও। অনেক দিন কাঁদে না এমন করে। বুকের মধ্যে অনেক কান্না জমেছিল – ব্যাপারটা এমন নয়, বয়সে কিশোরী হলেও শিশুর সারল্য ছিল শেফালির মধ্যে। জীবনের কোনো জটিল হিসাব-নিকাশের বালাই ছিল না ওর মধ্যে।

এই সদ্য ফোটা কিশোরী মেয়েটার দিকে মামুনের নজর পড়েছিল অনেক দিন ধরেই। শেফালির গাল হাল্কা গোলাপি, ঠোঁট  দুটোও গোলাপী, চোখের চাহনি দেখলে মনে হয় সব সময় অভিমান করে আছে। ছেলেমানুষি ভাব অবশ্য শেফালীর সব কিছুতে। এ সব কিছুই সব সময় মামুন কে নেশাগ্রস্ত করত। নেশা আরও বাড়িয়ে দিত শেফালীর পোশাক আশাক। ওড়না বিহীন বুকের দিকে তাকাতেই নিমাইদা’দের বাড়ির ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারাগুলোর কথা মনে পরে যায়, দেখলেই মনে হয় ঢিল মেরে পেড়ে দু কামড় বসিয়ে দিই। ঘাড়ের ওপর ছড়ানো চুলগুলোও শিহরণ তোলে মামুনের। মামুন ইচ্ছা করেই শাস্তির নামে কখনো গাল টিপে দেয়, মাথা ধরে ঝাঁকানি দিয়ে দেয়, পিঠে চড় মারার ছলে হাত বুলিয়ে এক ধরনের যৌন তৃপ্তি লাভ করে।

শেফালীও অবশ্য কখন বাধাও দেয়নি, কিন্তু আজ কী হলো মামুনের রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শেফালির ওপর। শেফালী শখ করে একটা শাড়ি পরেছিল।  মামুন বার কয়েক তাকাতে তাকাতে আর গল্প করতে করতে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে হেসে উঠেছিল শেফালী।

‘ তুমি কি জানো, তোমার গাল দুটো খুব নরম, সব সময় চুমু খেতে ইচ্ছা করে’, বলেই পিছন থেকেই ঠোঁট দুটো ওর গালে চেপে ধরেছিল। শেফালী এবার একটু বাধা দিতে শুরু করল। বাধা দিলে কী হবে, বুভুক্ষু, বিকৃত পুরুষ কি কখনো ওসব মানে! পিছন থেকে শেভ না করা গাল গলা, কাধে ঘষতে ঘষতে হঠাত সামনে ঘুরিয়ে ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে দিল। শেফালী ধাক্কা দিতে শুরু করল। বারবার বলতে লাগল,

‘আমি কিন্তু চিৎকার দেব, ছেড়ে দেন, ছেড়ে দেন’। কিন্তু সে কি মামুনের সঙ্গে পারে? বিছানায় নিয়ে মিনিট দু-একের ধস্তাধস্তি। শেফালী প্রান পন চেষ্টা করছে মুক্ত হতে। নখগুলো বসিয়ে দিচ্ছে মামুনের যেখানে পারছে সেখানে, কিন্তু কিছুতেই মুক্তি মিলছে না মামুনের ভারি শরিরের নিচ থেকে। যদিও ব্লাউজের বোতাম খুলতেই  শেফালী বিকট এক চিৎকার দেয়। থতমত খেয়ে মামুন ছেড়ে দিয়েছিল। হয়তোবা হুঁশ ফিরে এসেছে। শেফালী ছাড়া পেয়ে আলুথালু বেশেই আরেক রুমে গিয়ে খিল দিয়েছে।

ঘটনার পর বাসায় কেউ নেই, স্যারও চলে গেছেন। শেফালি নিজের মধ্যেই ঘটনার জন্য দোষ খুঁজছে। কেন যে স্যারকে প্রথম দিনই থামিয়ে দেয়নি সে। গালে চড় বসিয়ে দেয়নি! বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। নিজের শরীর থেকে পাপ তাড়াতে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বরফের মতো পানিতে গোসল করতে থাকে সে। তার মনে হচ্ছে আজ সারা দিনই সে বাথরুমে কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। মায়ের মুখোমুখি সে কীভাবে হবে? মা দেখলেই বুঝে যাবে সব। মাকে কি সব বলে দেবে? এ রকম হাজারো প্রশ্ন মাথার ভেতর কিলবিল করছে। যার কোনোটির উত্তরই শেফালির জানা নেই। অনেকক্ষণ ধরে কে যেন কলিং বেল চাপছে। কলিং বেল এর জ্বালাতন আর ভাল লাগে না। নিতান্ত অনিচ্ছায় গোসল শেষ করল শেফালি। শেফালী জানে মা এসেছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,

‘প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও মা। একদম একা’

এক ধরনের ভীতি কাজ করছে ভেতর ভেতর। বাথরুমের দরজা খুলে বাইরে আসতেই মনে হলো কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছায়া মূর্তি পেছন ফিরতেই দেখে অবিকল শেফালির মতো দেখতে।

: ভয় পাচ্ছিস?

: কে?

: আমি শেফালি। তুইও শেফালি, আমিও শেফালি।

ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না। সে যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। হঠাৎ মার কথায় সংবিৎ ফিরে পেল। মাকে দরজা খুলে দিল কে? কিছুই মনে পড়ছে না। স্যারের কথা আবার মনে হতেই অজানা আতঙ্কে মাথা নিচু করে ফেলল। একটু আগে যে এক ভয়ংকরতম ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে তাও ভুলে গেছে।

: কিরে এতক্ষণ কি করছিলি? কতক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছি।

: গোসল

: হাফিজ আসেনি?

: না

: দারোয়ানের কাছে শুনলাম তোর স্যার এসেছিলো, চলে গেছে?

এবার শেফালীর বুক কাঁপতে শুরু করেছে। এখনই বোধহয় মা বুঝে যাবেন। অনেক কষ্টে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল –

: হু।

: এ রকম কাঠঠোকরার মতো কাটাকাটা কথা বলছিস কেন?

: কই!

: কই? আচ্ছা যা দেখত, এই কাগজগুলো কিছু বুঝতে পারিস কি না। বারো হাজার টাকা নিয়ে ফেলল। কী পড়াবে কে জানে?

পদ্মের স্কুলের ভর্তির কাগজগুলো নিল শেফালি।

: হু, ঠিকই আছে। এক মাসের বেতন আর ভর্তি ফি নিয়েছে। বেতন আটশো টাকা।

: আটশো টাকা! আমার বাবা একসময় আটশো টাকা বেতন পেত। তা দিয়ে পুরো সংসার চলত। আর এতটুকু পুঁচকে মেয়েকে পড়াবে তাই আটশ টাকা!

শেফালি হাসল। অনেকক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে তার। মা কিছুই বুঝতে পারেনি এই আনন্দটাই তার সব দুঃখ ভুলিয়ে দিচ্ছে। মা’র সাথে হাতে হাতে অনেক কাজ করলো শেফালী। পদ্মাকে আজ নিজ হাতে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিল। নিজে খেল অনেকটা সময় নিয়ে। বাসন কোসন সব পরিস্কার করে মামুন স্যার, একটু আগে দেখা নিজের কার্বন কপি সব বেমালুম ভুলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে জানলার পাশে বিছানায় শুয়ে পড়লো।  সূর্যের প্রখরতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। জানালাটা আরেকটু খুলে দিল। মিষ্টি একটা বাতাস পুরো রুম জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখের কোনে লেপ্টে থাকা কান্না ওরনা দিয়ে মুছে উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে ঘুমকাতর শেফালী, খেয়াল নেই!

স্যারের সঙ্গে সেই ঘটনার পর জীবনে অনেক কিছু বদলে গেছে শেফালির। শান্ত-শিষ্ট শেফালি হঠাৎ অসম্ভব সাহসী আর দুরন্ত হয়ে উঠেছে। পরদিন যখন স্যার এসেছিল, কষে গালে একটা চড় বসিয়েছিল। স্যারের চেহারাটা তখন হয়েছিল দেখার মতো। হন হন করে সেই যে বেরিয়ে গেল তারপর আর এ মুখো হয়নি। বাবা-মা শত চেষ্টা করেও কারণ উদ্ধার করতে পারেনি এর। পাড়ার যে ছিঁচকে বাঁদরটা স্কুল যাওয়া-আসার সময় পথ আগলে রাখত তাকেও উচিত শিক্ষা দিয়েছে একদল মেয়ের সামনে। স্যান্ডেল আর গাল এক করে ফেলেছে। তারপর থেকে স্কুলে সবাই কিছুটা সমীহ করে চলে শেফালিকে। অনেক বন্ধুও জুটেছে নতুন নতুন। সবই ঠিক আছে, শুধু পড়ালেখা করতে ইচ্ছা করে না তার। ক্লাস টেনে ফাস্ট টার্ম পরীক্ষায় ছয় বিষয়ে ফেল করে বসে আছে। পদ্মটা অবশ্য পুরো বিপরীত। প্রত্যেক পরীক্ষায়  ফার্স্ট। ছোট বোনের প্রতি শেফালিরও মমতার কমতি নেই।

এদিকে শেফালীর শিক্ষক মামুন আছে ঢাকাতে। ভারতের গুজরাটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশেও ভূমিকম্প হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত তেমন ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। কিন্তু অনেকেই ভয় দেখায় যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্পের প্রকোপে পড়তে পারে এই দেশ। ঢাকা শহরে যদি একবার সেই মাত্রার ভূমিকম্প হয় মুহূর্তেই এই শহরের বোধহয় অর্ধেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হবে তা সরিয়ে আবার নতুন করে শহর গড়তে এক শ বছর লাগবে। ভূমিকম্প যেমন কোনো সংকেত দিয়ে আসে না, মুহূর্তেই সাজানো বাগান ধ্বংস হয়ে যায় মামুনের জীবনটাতেও তেমনটি ঘটেছে। সেই কিশোর বেলা থেকেই এমন যৌন হয়রানি সে অহরহ করে এসেছে অনেক মেয়ের সঙ্গে। শিশুরা ছিল তার প্রথম পছন্দ। কেউ কোনো দিন বাধা দেয়নি, হয়তো উপভোগ করেছে। অবশ্য মামুন ছিল সব সময় সাবধানী। কোনো দিন কাউকে জোর করেনি, খুব ধীরে ধীরে সে দুর্বল করত, এর মধ্যে পূর্ণ সম্ভোগ বলতে যা বোঝায় তা এক নিমাই দা’র বোন রাজশ্রী বাদে আর কারো সাথেই কোনো দিনই করার চেষ্টা করেনি। তাও রাজশ্রীর সম্মতিতেই। সেই আহবান করেছিল। নচেৎ কোনদিনই মামুন এগত না।

কিন্তু শেফালির ক্ষেত্রে তার ওই দিন কি হলো নিজেকে সামলাতে পারল না, পরদিন কিছুটা ভয় নিয়েই হাজির হয়েছিল শেফালীদের বাড়ি, পরিস্থিতি বুঝতে। শেফালী  কি কাউকে বলে দেবে কি না এই ভয় তো ছিলই। পাড়াতে তার যে ইমেজ ধুলোয় মিটিয়ে যাবে। শেফালী কাউকে বলেনি কিন্তু অপ্রত্যাশিত যে চড়টা মেরেছিল তাই মামুনের জীবনটা ওলটপালট করে দিল। এই মেয়ে কোথা থেকে কী করে সেই টেনশনে মফস্বল সে রাতেই ছেড়ে দিল। সোজা ঢাকা শহরে। এলাকার বড় ভাই কামাল ভাইয়ের এখানে।

কামাল ভাই পত্রিকার সাংবাদিক। থাকেন ওয়ারির এক মেসে। মেস বলতে নয় তলার ওপর বিশাল এক বাড়িতে দুটি রুম । বাড়ি এত বিশাল যে নয়তলা ওঠার জন্য তিন রকমের সিঁড়ি আছে। সামনের সিঁড়ি, পেছনের সিঁড়ি আর মাঝের সিঁড়ি। অবশ্য শুধু মাত্র মাঝের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে মামুনের রুমে পৌঁছানো যাবে। ভুল করে অন্য কোনো সিঁড়ি দিয়ে উঠলে ওঠাটাই বৃথা। বাড়ি বিশাল হলেও মামুনের রুমটা বিশাল না। মুরগির খাঁচা বলা যেতে পারে। ৮ ফিট বাই ১২ ফিটের একটা রুমে গাদাগাদি করে ৪ জন থাকে। রুমে কোনো জানালা নেই। দুটো ভেন্টিলেটর আছে, এর ভেতরে তিনজনই পড়ালেখা করে। আরেকজন একটা এনজিওতে চাকরি করে।

মামুনের লাগোয়া একটা রুম আছে। তাদের রুমের ভেতর দিয়ে মামুনদের রুমে ঢুকতে হয়। সেখানে তিনজন থাকে। মোটামুটি এই সাতজন নিয়েই মেসের সংসার। সাতজন বলা ভুল হবে কেননা কারও না কারও গেস্ট থাকত। তাই রেগুলার আটজনই থাকা পড়ত। বুয়া এসে তিনবেলা রান্না  করে দেয়। একজন মেস ম্যানেজার হয় সবার মাঝ থেকেই। মেল হিসাব করে পয়সা দেয় সবাই। বুয়া দেখতে অসুন্দর হলেও রান্না ভালো। মানুষ হিসাবেও ভালো। শুধু প্রায়ই কামাই করে। কামাই করলে মামুনদের মধ্যে থেকে কাউকে না কাউকে রাঁধতে হই। এমনিতে সারা মাস খারাপ খেলেও মাসে একদিন পোলাও রান্না হতো। এই দিনটা একটা উৎসবের মতো। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সমস্যা হলো বাথরুম।  কমন বাথরুম। কমন বাথরুম মানে মামুনরা সাতজন মিলে একটা বাথরুম ব্যবহার করে তা না। পাশের রুমের আরও আটজন মানে প্রায় ১৫ জনের জন্য একটা বাথরুম।

বেশিরভাগ রাতই কাটে ছাদের ওপর। খোলা আকাশের নিচে পাটি পেতে তারা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ত মামুন। রুমের ভেতরের বদ্ধতা একেবারেই সহ্য হতো না। সমস্যা হতো শীত আর বর্ষায়। ছাদে রাত কাটানো যেত না। বদ্ধ ঘরেই কাটাতে হতো।  রুমমেটের মাত্র একজন মামুনের সমবয়সী। দু’জন ছোট আর বাকিরা সবাই বড় বড়। রাতে খাবার সময়ই সাধারণত দেখা হতো সবার সঙ্গে। সুখ দুঃখের আলাপ হতো।

প্রেসে চাকরি করা শ্রমিক ভাই বিবাহিত আর  বাকিরা সবাই অবিবাহিত। ভাইয়ের স্ত্রী গ্রামে থাকে। সামান্য আয়ে স্ত্রীকে ঢাকায় আনা সম্ভব না। মাসে একবার সুযোগ পেলেই গ্রামের বাড়ি ছুটতো রহিম ভাই। হুমায়ূন জয় কালী মন্দিরে হোমিওপ্যাথির দোকানে কাজ করত। মামুনের সমবয়সী। ওষুধের নাড়িনক্ষত্র ওর জানা। ছোট খাট একজন ডাক্তার বলা যেতে  পারে। সব সমস্যার সমাধানই ওর কাছে আছে। খসরু ভাই একটা এনজিওতে চাকরি করে। ৯টা-৫টা অফিস। তার টাকায় বাড়িতে মা, ছোট ভাই আর বোন চলে। বোনের বিয়ে দিতে হবে। তার অধিকাংশ সময় কাটে একটা ভালো চাকরির খোঁজে। প্রায়ই শোনা যায় আজ এখানে তো কাল ওইখানে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছে। শফিকুল ইসলাম বগা ইংরেজ। ইংরেজ মানে সবাই ইংরেজ বলেই ডাকি। সব সময় ডিকশনারি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আর বলাবাহুল্য পুরা ডিকশনারি ঠোঁটস্থ করে বসে আছে। মামুনদের এলাকার ছেলে। দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার অদম্য নেশা। বিদেশে যাওয়ার ব্যাকুলতা দেখলে না হেসে পারা যায় না। আজকাল কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। শিং মাছ কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া যায় সেই প্রথম দেখা মামুনের।

বগা’র বিপরীত চরিত্র রাসেল পুরো দস্তুর রাজনীতিবিদ। পল্টন আর আজিজ সুপার মার্কেট তার আড্ডা স্থল। শাসক-শোষক শ্রেণির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বুনে চলা এক মানুষ। মার্কস আর লেনিনের উদ্ধৃতি ঠোঁটস্থ। এই ছেলে বেশীর ভাগ সময় সবাই কে এড়িয়ে চলে। কিছু কিছু দিন ঘরেই ফেরে না। কোথায় যায় , কি করে বোঝা দুস্কর। মামুন আর কামাল ভাই দু’জনায় হরিহর আত্মা। ছাদে এক সঙ্গে ঘুমায়। সবখানেই এক সঙ্গেই থাকে। কামাল ভাইয়ের  স্বভাব হলো প্রচণ্ড গমেও সে লেপ গায়ে দিয়ে শোবে। লেপ ছাড়া সে শুতে পারে না। জানালাহীন একটা রুমে গ্রীষ্মের গরমে একজন লেপ গায়ে দিয়ে ভরদুপুরে শুয়ে আছে দৃশ্যটা কল্পনার বাইরে।

মেস জীবনের পুরোটা সময়ই ঘটনা বহুল। প্রথম দু-চার মাস কষ্ট হলেও মেস জীবনের সঙ্গে খুব দ্রুতই অ্যাডজাস্ট করে নিল মামুন। টিউশনি পাওয়া গেছে। বরাবরের মতি ছাত্রী। প্রথম দিন বাড়ি ঢুকেই মনে হল, বিরাট বড়লোকের মেয়ে। বাবা বিদেশ থাকে। ছাত্রীর মা-মেয়ে নিয়ে একাই থাকেন। ভদ্রমহিলা স্বাস্থ্যবতী কিন্তু যথেষ্ট সুন্দরী। অন্য সময় হলে কি হতো জানে না এখন  শেফালীর এক চড় মামুনকে এত পরিবর্তন করেছে, ঘুণাক্ষরেও খারাপ চিন্তা মাথায় আসে না। পুরোপুরি বদলে গেছে সে। পড়ানোর সময় তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থাকে দুটো গোল্ডফিশ। মাছদুটোর ভিতর একটা সম্মহোনী শক্তি আছে।  মামুনের দিকে মাঝে মাঝে  অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মামুনও চোখ ফেরাতে পারে না। মামুনের নতুন ছাত্রী ক্লাস নাইনে পড়ে। মা বাপ কারো চেহারায় পাইনি। দুষ্টুমির শেষ নেই। পারলে মাথায় চড়ে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে মামুন । মাস গেলে অনেকগুলো টাকা পকেটে ঢুকবে। টাকার অঙ্কটা বেশ ভালো। তাছাড়া মামুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা সে আর ছাড়বে না। এই রাজধানীতেই ক্যারিয়ার গড়ে তুলবে। পড়ানোর ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই অ্যাকোরিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে মামুন। দুটো গোল্ডফিশ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এক দিকে এক জেলে ঝুড়ি ওপর নিচ করতে থাকে। কেবলই মনে হয় বোধহয় এবার ধরা পড়ল। কিন্তু ধরা পড়ে না। মামুনের সাথে সাথে মামুনের ছাত্রীও ভীষণ উপভোগ করে এই খেলা। সেও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাকিয়ে থাকে।

এভাবেই একদিন দেখতে দেখতে মাস শেষ হয়ে আসে। মামুন  টাকার দিন গুনে। আর মাত্র তিন দিন, দুই দিন, এক দিন। না আজ হলো না। কাল মনে হয় দেবে। কাল যায়, পরশু যায়, তরশু পার হয়। টাকাটা আর পকেটে আসে না। এদিকে কামাল ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আর কত পারা যায়। মেস খরচও দেওয়া হয় না। মেসে খেতে মামুনের সংকোচ লাগে। যদিও এখন পর্যন্ত কেউ কিছু বলেনি। ছাত্রীর বাবা বিদেশ থাকে। ছাত্রীর মাকে বলতে সংকোচে লাগে। নিজের প্রয়োজনের কথাটা কাউকে বলাটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। বলতে গিয়ে খুব অস্বস্তি বোধ হয়। তারপরও একদিন বলে ফেলে মামুন। সেদিন বরাবরের মতই গোল্ডফিশগুলোর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে ছিল। হঠ্যাত মনে হল আজ মাছ দুটো তাকে ইগ্নোর করছে। একবারের জন্য ফিরেও তাকায়নি। মনে হল মামুনকে উপহাস করছে। ভীষণ অপমানে লাগলো। মিসেস হাসানের সামনে জমে যাওয়া মূর্তির মতো স্থির নিষ্কম্প বসে থাকতে থাকতে লজ্জার মাথা খেয়ে বেতনের কথাটা বলেছিল। মিসেস হাসান শুনে, কালকের ভেতর কিছু হবে আশ্বাস দেন।

পরদিন এসে দেখে অ্যাকোরিয়ামটা জায়গায় নেই। আজ অবশ্য মামুনের গোল্ডফিশের কথা ভাবার সময় নেই। ঘণ্টাখানেক পড়েই পকেটে রাজধানীর প্রথম উপার্জন। টাকাটা পেলে কী করব, কী করব হাজার বার হিসাব করা হয়ে গেছে। আবারও ভাবতে থাকে টাকার কথাই। একটা ঘণ্টা যেন শেষ হয় না। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসে। ছাত্রীর ছুটি হলে ওর মা ঘরে ঢোকে। মামুন আড়চোখে তাকায় হাতে কোনো খাম আছে কিনা। না নেই!

‘‘তোমাকে যে কী করে বলি? ওর বাবা এ মাসে টাকা পাঠায়নি। অন্যভাবে চেষ্টা করেছিলাম সেটিও সম্ভব হলো না। আমি খেয়াল করেছি আমাদের অ্যাকোরিয়ামটা তোমার খুব পছন্দ। আমি নিচে গ্যারেজে রেখে দিয়েছি। দারোয়ানকেও বলা আছে। তুমি বরং ওটা যাওয়ার সময় নিয়ে যেও। আর ওর বাবার একটা সমস্যা চলছে। সহসা কাটবে বলেও মনে হয় না। তুমি বরং কালকের থেকে আর এসো না। আমি পরে তোমায় খবর দিলে এসো’’। – কথাগুলো এ রকমই কিছু ছিল। মামুনের রাগের সঙ্গে কান্নাও পাচ্ছিল আবার অ্যাকোরিয়াম পাবার আনন্দও আছে। এ এক মিশ্র অনুভূতি।

রাত আটটার দিকে অ্যাকোরিয়াম নিয়ে মেসে ঢুকল। রাজধানীর বুকে মামুনের জীবনের প্রথম উপার্জন। ক্লাশ নাইনে পড়ুয়া রুবিকে গোল্ডফিশের খেলা দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে রাজধানীতে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো।

কাছিকাছি সময়ে শেফালির জীবনেও নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। এই অধ্যায়ের প্রধান কুশিলব মামুনেরই মেস পার্টনার ইংরেজ শফিকুল ইসলাম বগা। সে দারুণ ম্যাজিক দেখায়। একটা কৌটার মধ্যে পয়সা রেখে ফুঁ দিয়ে তা আবার ভ্যানিশ করে দিতে পারে। ছোট্ট একটা লুডুর ছক্কা কীভাবে যেন চোখের পলকে বড় করে ফেলতে পারে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল, কতগুলো সাদা কাগজ শেফালি নিজেও হাতে নিয়ে দেখেছে হঠাৎ টাকা হয়ে গেল। সব ৫০ টাকার নোট। আর তাসের খেলাগুলোতে আছেই। সেবার খালাতো বোনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা বগা ভাইয়ের ম্যাজিক অন্য মাত্রা পেল।

খালাতো বোন নিশির বিয়ে উপলক্ষে এসেছেন বগা ভাই। সম্পর্কে শেফালির দু সম্পর্কের মামাতো ভাই। ঢাকায় থাকেন। কোনো একটা বিষয় নিয়ে অনার্স পড়ছেন। অনেক দিন পর দেখা শেফালি আর বগার। প্রথমে চিনতেই পারেনি শেফালি। কত বড় হয়ে গেছেন বগা ভাই। আর আকর্ষণীয় তো বটেই। শেফালির সঙ্গে ভাব জমাতেও বেশি দেরি হলো না। হয়তো দু’জনেই চাচ্ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু তিন দিনের মাথায় যে ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে তা চিন্তাতে আসেনি কারও। রিকশায় ঘোরাঘুরি আর নতুন একটা গানের ক্যাসেট উপহার পেয়ে নাকি তাদের প্রেম হয়ে গেছে! তাই বিয়ে শেষে বগা ভাই চলে যাওয়ার আগের দিন রাতে শেফালিদের বাসায় থাকবেন শুনেই একটা আলাদা উত্তেজনা ভর করে তার ভেতর।

যদিও  নিরুত্তাপ বগা ভাইয়ের সঙ্গে কিছুই ঘটল না রাতে। সারা রাতের অবুঝ উত্তেজনার কারণে সকালে উঠতে একটু দেরি হওয়ায় বগার ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা হয়নি। খুব ভোরেই বগা ভাই বেড়িয়ে গেছে। তারপর যা যা কথা হয়েছিল তার কোনোটাই রাখেনি বগা ভাই। কোনো যোগাযোগও করেননি। শত চেষ্টা করেও শেফালি পারেনি যোগাযোগ করতে। তার একার পক্ষে তো আর ঢাকা যাওয়া সম্ভব না। উপায়ন্তর না দেখে একটা মোবাইল কেনার জন্য উঠেপড়ে লাগল শেফালি।

বগা ভাইয়ের নম্বরটা নিয়ে রেখেছিল সে। দোকান থেকে কথাও হয়েছে দু’দিন। কিন্তু সেভাবে কথা বলা যায় না দোকানে। বগার কথা শুনে শেফালির মনে হয়েছে সে-ও অসম্ভব ভালোবাসে তাকে। শুধু সময় করে উঠতে পারছে না বলে যোগাযোগ করতে পারছে না। শেফালির নিজের কোনো নম্বর নেই বলে ফোনও করতে পারেনি। এদিকে বাবা কোনো দিন মোবাইল কিনে দেবেন না শেফালিকে। ছোটদের মোবাইল ব্যবহার বাবা পছন্দ করে না। তাই বাধ্য হয়ে খুব গোপনে তার কিছু গয়না বিক্রি করে স্কুল বন্ধু পীযুষ এর সাহায্য  নিয়ে মোবাইল কিনে ফেলল শেফালি।

আমেরিকার টুইন টাওয়ারে আল কায়েদা আক্রমণ করেছে। সকাল থেকেই টিভিতে সবাই ওই নিয়ে ব্যস্ত। শেফালী ব্যস্ত বগা ভাইকে ফোন করা নিয়ে।

‘হ্যালো!’

‘কে?’

‘তুমি বল?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘বৌয়ের গলা চেন না’

‘ও তুমি। শোন আমেরিকায় আক্রমণ হয়েছে। ভয়াবহ অবস্থা। বুশ মাটির তলে লুকিয়ে আছে, বিশ্বযুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে যেতে পারে।’

‘তাতে তোমার কি?’

‘আমার বোধয় আর আমেরিকা যাওয়া হবে না।’

‘না হলে না হবে। তুমি আমার সাথে থাকবা।’

‘ তোমার সাথে?’

‘হ্যাঁ জনাব, আমার সাথে।’

‘পাগল না মাথা খারাপ আমার, তোমার মত অশিক্ষিতের সাথে থাকবো। ছয় বিষয়ে ফেল করে বসে আছো।’

ভীষণ কষ্টে অপমানটা হজম করে শেফালী। এরকম কথা শুনলে কান্না বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, সেটা কি বগা বোঝে না?  কথোপকথনের মাঝে এরকম কিছু হলে আর বলার মতো আর কিছু থাকে না। যেন সব কথা হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেছে।

‘রাখি’ – বলে কান্না চাপতে চাপতে শেফালী  বাথরুমে ঢোকে। কিছুক্ষণ কান্না করে বিছানায় শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখতে লাগলো। হঠাৎ করেই মুগ্ধ হয়ে ভাবল–কী সুন্দর দিন!  আকাশের মেঘ সূর্যকে কিছু একটা করেছে। আলো আধারির খেলায় অপরূপ সুন্দর লাগছে আকাশটাকে।  মন খারাপ হলো এই ভেবে যে তার সঙ্গে বগা নেই। বগা থাকলে বলতে পারত,

‘দেখ দেখ, কী সুন্দর! এত সুন্দর ছেড়ে তুমি কেন আমেরিকা যেতে চাও।’

শেফালী আবারও ফোন দেই। কিন্তু বগা রিসিভ করে না। অপমানে কান্না চলে আসে। এভাবে দিনের পর দিন অবহেলা সহ্য করেও শেফালী বগা ভাই কে নিয়েই স্বপ্ন বুনে চলে। মন কে প্রবোধ দেই – ব্যস্ত বগা ঠিকই একদিন তার হবে।

বগা ভাইয়ের সঙ্গে বছরে মাত্র হাতে গোনা দু-চারবার দেখা হয় । তা-ও না দেখার মতো করে। নিতান্তই শুকনো আলাপ মিনিট দশেকের। মোবাইলে কথোপকথন চলছিল অবশ্য। তবে ভীষণ ব্যস্ত বগা ভাই কিছুতেই সময় দিতে পারত না। একটা ষোড়শী কন্যার আবেগ নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ সে। তার আলাপের অনেকখানি জুড়ে থাকত পড়ালেখা। শেফালিকে পড়ালেখা করতে হবে। আর নিজের বিষয়ে বলতেন, তার অনার্স-মাস্টার্স শেষ হবে। তাকে অনেক কোর্স করতে হবে। সে বিদেশ যাবে। এদেশ বসবাসের উপযোগী না। তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশে জন্ম নেওয়াটায় একটা পাপ। বিদেশ বিদেশ আর বিদেশ  – এই আলাপেই সারাক্ষণ ব্যস্ত। ডিজুস এর ফ্রি মিনিটের যুগে বান্ধবীরা যখন সারা রাত কথা বলায় ব্যস্ত বগা ভাই তখন সময় নেই পড়াশোনার অজুহাতে। শুধু জ্ঞানের কথা শুনতে আর কত ভালো লাগে!

তবে বগা ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে যেটা হয়েছিল তা হচ্ছে, এক চান্সেই এসএসসি, এইচএসসি দু’টাই পাশ করতে পেরেছে শেফালি। বগা ভাইর জন্য দিন-রাত সে-ও পড়ালেখায় কাটায়। কিন্তু কোথায় যেন মন মানে না। আরো অনেক কিছু চায় তার অশান্ত মন। তার বান্ধবীরা যেভাবে কথা বলে তা কেন যেন বগা ভাইকে সে বলতে পারে না।

এসএসসি পাশের পর তার চলাচলের পরিধি বাড়ে। জেলা শহরে যেতে হয় কলেজ করতে। বাসা থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। অপরিচিত শহর, অপরিচিত লোকজন। মফস্বল শহরের মতো অলিতে-গলিতে আত্মীয়-স্বজন নেই। একটা বাড়তি স্বাধীনতা পেয়ে বসল তাকে। নতুন শহরের দু একজন প্রেম নিবেদনও করে ফেলে। শেফালী সবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় বগা ভাইয়ের জন্য। তার বিশ্বাস একদিন বগা ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হবে, তারা হানিমুনে যাবে কোনো দ্বীপ রাষ্ট্রে। সামনে সমুদ্রের সীমাহীন জলরাশি। মাথার ওপর উজ্জ্বল চাঁদ। বগা ভাই এর হাত ধরে সারা রাত কাটিয়ে দেওয়া। এভাবেই মেকি স্বপ্নের ভেলায় চেপে কাটিয়ে দিয়েছে কয়েক বছর। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি  সম্প্রতি ঘটে যাওয়া  সুনামির মতো ১০০ ফুট ঢেউ এসে তার জীবন এই মফস্বল শহর থেকে রাজধানীতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

সালটা ২০০৫। সারা দেশে বোমা হামলা হয়েছে। জঙ্গিদের উত্থানের আশঙ্কায় চলছে জল্পনা কল্পনা। চলছে দেশব্যাপী পুলিশি তল্লাশি।

মাইনুদ্দিন মিয়ার দিনটা আজ খারাপ। ঢাকার কারওয়ান বাজারে তার তরকারী আসে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাপারীদের সঙ্গে ঝামেলা চলছিল। মধ্যস্থতা করতে নিজেই ছুটে এসেছেন। এর মধ্যে ঢাকায় তার ব্যবসাপাতি দেখত যে ছেলেটা তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে জঙ্গিদের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। নামাজ কালাম পড়ত, সৎ কিন্তু সে যে তলে তলে এসব কাহিনিতে জড়িত তা কে জানে? কোন বিপদেই না পড়তে যাচ্ছেন মাইনুদ্দিন মিয়া। কান টানলে মাথা আসে মনে করে পুলিশ এবার তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে। ব্যবসাপাতি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না আজকাল। তার দুটো বাসই অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়ে আছে। ট্রাক একটা চুরি হয়েছে। ড্রাইভার নিয়ে পালিয়েছে। সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে উদ্ধারের। তার ওপর আছে শেফালির মা, আজ প্রায় তিন বছর হলো পুরোপুরি বিছনাগত। অথচ এক সময় রাবেয়া এমন ছিল না। পুরো সংসার এক হাতে সামলেছে। কিন্তু ২য় মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়ে কি যে হল -ডাক্তার-কবিরাজ কেউ বলতে পারে না ঠিক করে কী হয়েছে। রোগ শোক লেগেই থাকত। আর এখনত পুরোই বিছানায়। খুলনা-ঢাকা শেষ করে মাদ্রাজ, সিঙ্গাপুর ঘুরে আসা হয়েছে। টেস্ট করতে কোনোটাই বাকি নেই। শেষতক কলকাতার এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তার চেষ্টায় কিছুটা এখন কিছুটা ভালো।

মাইনুদ্দিন মিয়া সারা জীবনই ব্যবসা-ব্যবসা করে কাটিয়েছেন। সংসারে তার খেয়াল কোথায়? তারপরও বউয়ের চিকিৎসা, মেয়েদের লেখাপড়া, কেনাকাটার দিকে তার খেয়াল কি ছিল না?এত বড় একটা ফাঁক যে তার সংসারে তৈরি হয়ে গেছে সেটা ঘুণাক্ষরেও তার মনে হয় নাই। এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হবে সেটা কল্পনায়ও আসেনি।

আজ রাবেয়াদের কুড়িতম বিবাহ বার্ষিকী। রাবেয়া কুড়ি বছর আগেকার সেই রাতে ফিরে গিয়েছিলেন। প্রায়ই যান। জড়সড়ো হয়ে বসে আছেন গাঁদার পাপড়ি ছেটানো লাল বিছানায়। মাইনুদ্দিন মিয়া আসলেন। সেই প্রথম দেখা। সবাই বলেছিল ভীষন রাশভারী লোক। কিন্তু রাবেয়ার কেন জানি মনে হল না। স্বাস্থ্যবান এক পুরুষ। দেহের সরবত্রই পুরুষালীভাব। পুরুষমানুষ মেয়ে মানুষেরমত হলে পুরুষ বলে মনে হয় না। আর রাশভারী কোথায়? কি সুন্দর হাসি হাসি মুখে গল্প করে গেল। দেহ সঁপার আগে পুরো সংসার রাবেয়াকে সামলে রাখতে হবে এই ছিল মাইনুদ্দিনের দাবী রাবেয়ার কাছে। তাতে এতটুকু ত্রুটি করেনি রাবেয়া। ব্যবসার কাজে প্রায়শই বাইরে থাকতে হয় মাইনুদ্দিন মিয়াকে। মাঝে মাঝে এক দেড় মাস বাড়ীর বাইরে থাকেন। এক হাতে সামলেছেন রাবেয়া সব কিছু। কখনো মুখ কালো করেননি। সেই মুখ বার বার আজ যন্ত্রণায় কুঁচকে যায়, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না সামলে নেন। আজও যন্ত্রণা হচ্ছিল, ভয়ানক যন্ত্রণা। রাবেয়া বাথরুমে গিয়ে যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠেন। ভয় পেয়ে যান আজ না বাড়াবাড়ি হয়। মাইনুদ্দিন মিয়া ফোন দিয়েছেন ঢাকা থেকে ফিরে আসছেন। তার জন্যই রাবেয়া রাত জেগে আছে। যত রাতি হোক, যত অসুখই হোক নিয়মের ব্য্যতয় কোন দিন ঘটেনি। রাবেয়ার মনে হচ্ছে হঠাত বিবাহ বার্ষিকীর কথা মনে হওয়ায় রওনা হয়েছেন মাইনুদ্দিন। বারবার ভাবছেন, একটা শুভ দিনেও মাফ দিচ্ছেনা হতচ্ছাচ্ছাড়া অসুখ। অনেকক্ষণ পরে রাবেয়াকে ক্লান্ত, অবসন্ন, পরাজিত করে ব্যথা কমে। কিন্তু বাথরুম থেকে বের হয়ে শেফালীর বাবার চেহারা দেখে তাঁর সাদা কপালে লম্বা ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় রাবেয়া জানে ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটেছে।

টেলিফোনে খবরটা জানবার পরই মাইনুদ্দিন মিয়ার প্রথমেই মনে হয়েছিল কেমন করে খবরটা চেপে যাবেন। তার মেয়ে শেফালি গর্ভবতী। ঢাকা থাকতেই জোহরা জানিয়েছে। জোহরা মাইনুদ্দিনের ছোটবোন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না মাইনুদ্দিন মিয়া, তার মেয়ে এ রকম করতে পারে এ কথা তার মাথাতেই আসছে না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, সব দোষ মায়ের। এ জন্য শিক্ষিত দেখে বিয়ে করতে হয়। রাবেয়া এইট পাশ। মাইনুদ্দিন মিয়া সব কাজ ফেলে তখনই ঢাকা থেকে রওনা হয়েছেন। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তিনটা। সোজা তিনি গেলেন শেফালির ঘরে। দরজা ভেতর থেকে লক করা । রাতের নীরবতা খান খান করে সেই দরজা ধাক্কাতে শুরু করলেন শেফালির বাবা।

অন্য দিনের মতো শেফালি বিছানায় শুয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। এমন সময় মনে হলো কেউ যেন তার রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতরে কারও পক্ষে আসা অসম্ভব। দরজা লক করে দেয় শেফালি রাতে মোবাইলে কথা বলতে অসুবিধা হয় সে জন্য। মোবাইলের আলো ফেলল শেফালি। একটা ছায়ামূর্তি।

লাফ মেরে উঠে বসে সে। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। মশারির বাইরে অবিকল ওর মতো দেখতে একজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। একে তো শেফালি আগেও দেখেছে। স্যারের সঙ্গে সেই ভয়ংকরতম দিনে। আজও কি তার জীবনের কোনো ভয়ংকরতম কোনো দিন? ভয়ে গলার স্বর আটকে আছে। অতিরিক্ত রাত জাগার ফলে কী ভুল দেখছে শেফালি? এ কি স্বপ্ন না বাস্তব? কতক্ষণ হয়েছে ঠিক খেয়াল নেই। সময় যেন স্থির হয়ে আছে।

: ভয় পাচ্ছিস?

ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া নতুন না শেফালীর জন্য। মন চাচ্ছে জোরে একটা চিৎকার করতে। কিন্তু ঈশ্বর যেন গলার স্বর কেড়ে নিয়েছে। শেফালি কি মারা যাচ্ছে, তার পুরো শরীর এমন অবশ লাগছে কেন? কেউ কি তাকে একটু পানি খাওয়াতে পারে। মা কোথায়? বাড়ির কেউ কিছু টের পাচ্ছে না কেন? না পেয়েছে। ওই তো বাবা দরজায় জোরে জোরে লাথি দিচ্ছে। এখনই দরজা ভেঙে ফেলবে। শেফালি কি চিৎকার করতে পেরেছে তাহলে। না হলে বাবা কীভাবে আসবে? দরজায় লাথি মারার শব্দ শেফালিকে কি শক্তি এনে দিল? দরজার সিটকিনি খুলে দেয় শেফালি।

: তুমি কী কর আজকাল? বাবার একটা মুদ্রা দোষ আছে। প্রায়শই দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আর খোলে। রাগের মাথায় ব্যাপারটা আরও বেশি করে। শেফালী ভয়ে ভয়ে বলল,

: কেন?

ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন মাইনুদ্দিন মিয়া। নিজের রাগকে সামলাতে পারলেন না। উপর্যুপরি কিল-ঘুষি-লাথি মারতে লাগলেন গালাগালি করতে করতে। শেফালি ঠেকানোর চেষ্টা করেও পারল না। কোনো হুঁশ ছাড়াই মেয়েকে পেটাতে  শুরু করেছেন।  শেফালির মতো অবিকল দেখতে আরেক শেফালির দেখা পেয়ে যখন মূর্ছা যাওয়ার জোগাড় তখনই দরজায় বাবার ধাক্কাধাক্কিতে হুঁশ ফিরে আসে। ঠিক কি হয়েছিল তখন বোঝার আগেই বাবার এই অগ্নিমূর্তি। বাবা, মা কাউকেই বলা হয়নি তার ঘরে সে একটু আগে কী দেখেছে। সেরকম সুযোগই ঘটেনি। অবশ্য এখন সেসব নিয়ে ভাবার অবকাশও নেই। সম্পূর্ণ নতুন এক পরিস্থিতিতে নিজেকে আরো বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে শেফালি।

রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিলেন শেফালিকে। তার জীবনে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তার ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে বারবার শিউরে উঠছিল সে, কান্নায় তার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘটনার কিছুই এখনো শেফালি জানে না। তবে বাবার কথায় অনেকখানি আঁচ করতে পেরেছে। ঘটনা ঘটেছিল মাস দেড়েক আগে। হঠাৎ বগা ভাই এসে উপস্থিত। শেফালিকে নিয়ে সারা সকাল ঘোরাঘুরি। দুপুরে নিয়ে গেল তার এক বন্ধুর বাসায়। কিন্তু ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে তা চিন্তাতে আসেনি কারও।

কথার ফাঁকে বগা’ই বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। সারা শরীরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা ঝড় তুলেছিল। সেই মুহূর্তে নড়তে ভুলেই গিয়েছিল, হয়তো চাইলেও পারত না। বগার বুক শেফালীর বুকে আশড়য় খুঁজছিল। খুব জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছিল শেফালির। শেফালিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শেফালির ঠোঁটে ওর নিজের ঠোঁট চেপে ধরে অনেকক্ষণ আদর। ভীষণ ভাল লাগছিল শেফালীর। কী লজ্জা। মনে হল বগা বুঝে ফেলবে, এই আদর ভীষণ ভালো লাগছে। বগার আদর এক মুহূর্তের মধ্যে পাগল করে  তুলল–অথচ মামুন স্যার যেদিন কাছে এল শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল। বগার মধ্যে কী আছে, জানে না শেফালী।

হঠাৎ বগার হাতের তালুর ঘঁষা লেগে গেল স্তনে আর সেদিকে ইশারা করে বগা শুধু বলল,

: শেফালী ?

শেফালির সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। লজ্জায়। মুখে কোনো ভাষা নেই,

বগা আবার বলল,

: দেবে না?

শেফালী মুখ নিচু করে বলল,

: ওই সব ঠিক না। আর আমার ইচ্ছা করে না। ভীষণ লজ্জা করে।

বগা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই বলল, তুমি আমাকে ভরসা করতে পারো।

তারপর নিমেষেই  শেফালী, শেফালী, বলতে বলতে বগা জামা উঠিয়ে সমস্ত শরীরে চুমু খেতে লাগল। শেফালী দু-পা জোড়া করে রেখেছিল। কখন কি করে বগা ভাই বিশ্বাস নেই। আর সেটা সত্য হাত সময় লাগল না, দুজন একজনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল বেখেয়ালে।

অন্যরকম এক ভালো লাগা, যেন এক স্বর্গীয় আনন্দ। স্যারের ঘটনার সঙ্গে এ কিছুতেই মেলে না। হিংস্র বাঘ যেমন হরিণ শাবকের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মামুন স্যার সেদিন, মিনিট দু-একের ধস্তাধস্তি। স্যারের সেই ঘটনাটা আজও ভুলতে পারেনি শেফালী।

তবে সেই স্মৃতির রোমন্থনের চেয়ে  বর্তমানে কী করবে সেটা ভাবা বেশি জরুরি শেফালির জন্য। মফস্বল শহরে কোনো কথা এ কান ও কান হতে বেশি সময় লাগে না। বাবার ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো তার। সন্তানের এমন বিপদে কোনো বাবা-মা কি তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়?  না আগলে রাখে?  এদিকে বগা ভাইও ফোন ধরছে না। শেফালি কি আত্মহত্যা করবে? চারিদিকে অন্ধকার এখনো কাটেনি। এই অন্ধকারই যেন শেফালীকে ফিসফিস করে বলল – হাল ছেড়ো না। শেফালি সিদ্ধান্ত নিল যায় হোক সে ঢাকায় যাবে। বগা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে। জীবনের গতিপথ কত পরিবর্তনশীল, কত কুটিল। সামান্য একটা ঘটনা মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। দাঁড়াতে গিয়ে টের পেল, মেরুদন্ড মট মট করছে। বাবার কোন বেকায়দায় লাথি হয়তো পড়েছে। সামনে পিছনে কয়েক গজ হাঁটল। কিছুতেই ব্যাথা সরছে না। উপরি হিসেবে আছে মশার দল। তার ভিতর চেপেছে প্রচন্ড প্রসাব। এদিক সেদিক দেখে একটা ঝোঁপের মধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিল। বেশ হালকা লাগছে, একটু আগে চেপে বসা আতঙ্কটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ভালো লাগছিল। ভোর হচ্ছে। শান্তি শান্তি একটা ভাব নেমে এসেছে চারপাশে। ঝি ঝি পোকার ডাক আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। হালকা বাতাসে গাছগুলো নড়ছে। পাখিগুলো নীড় থেকে বের হয়ে  ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। কতগুলো মোরগও যোগ দিয়েছে। কি মিষ্টি সকাল! মোবাইল বের করে অসময়ের প্রিয় বন্ধু পীযুষকে ফোন দিল।

ভোর ৫টার দিকে মফস্বল শহরটাকে চিরবিদায় জানিয়ে স্কুল বন্ধু পীযুষের সঙ্গে রাজধানীর দিকে পা বাড়ায় শেফালি। কোনো স্বপ্ন নেই এখন তার, শুধু বেঁচে থাকা। লুকোতে হবে নিজেকে। বগা ভাই কী পারবে তাকে একটা নতুন জীবন দিতে? রাজধানী তার মামুন স্যার কে বরণ করেছে। তাকেও কি বরণ করবে?

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত