৩
‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
‘ – কবিতাখানা শাহেদের ভীষণ ভাল লাগে। প্রায় সময় আবৃতি করতো। শুনেছে রবি ঠাকুর ট্রেনে প্রায়ই যাতায়ত করতো। ট্রেন ছাড়া তখন উপায়ই বা কি? তবে তিনি যার জন্যই এই কবিতা লেখেন না কেন হঠ্যাত দেখায় শাহেদের মত এমন বিপদে পড়েন নি। আজ ট্রেনের কামরায় শেফালীর সাথে দেখা হবার কি কোন দরকার ছিল? যদিও শেফালীর সাথে তেমন কোন সম্পর্ক নেই। ক্ষনিকের দেখা এই বিশাল জীবনের এক ফাঁকে। তবে ওইটুকুই শাহেদের হৃদয়ে একটা জায়গা করে নিয়েছিল। অনেক বার ভেবেছে, মেয়েটির ওই রাতে কি হল? কারা তাকে মাইক্রবাসে তুলে নিল। শেফালীর সাথে কি কোন দিন আর দেখা হবে? – এরকম অনেক কিছুই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে দেখা না হলেই ভাল হত। ট্রেন অনেকক্ষণ ধরে এই ষ্টেশনে দাড়িয়ে আছে। যেন যাওয়ার তাড়া নেই। শাহেদের মনে হচ্ছে অনন্তকাল এইখানে আটকে আছে। শেফালী আর হাসান সাহেব মোবাইলে কিছু একটা দেখা নিয়ে ব্যস্ত। ৩ বছর আগের শেফালী আর এই শেফালীর ভিতর বিস্তর ফারাক।
শেফালি যখন উনিশ তখন বাবা-মায়ের ওপর একপ্রকার অভিমান করেই হাজির হয়েছিল রাজধানীতে। পীযুষ ওকে প্রথমে নিয়ে তুলেছিল টঙ্গীতে এক মাসির বাড়িতে। মাসি থিয়েটারের অভিনেত্রী। প্রথম দর্শনেই পীযুষের ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল। মুসলমানদের হিন্দুরা যে ব্যঙ্গ করে ‘নেড়ে’ বলে সেই প্রথম শেফালির শোনা। নেড়ে’র মেয়ে থাকলে জাত যাবে এই ছিল মাসি আর পীযুষের ঝগড়ার উপজীব্য। মাসি বলল, একজন ব্রাহ্মণ এর ছেলে হয়ে মুসলমান মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিস শুনলে মুখে থু থু দিতে ইচ্ছে করে।
শেফালী পাশের ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল তখনই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু এই এত বড় শহরে তাকে আশ্রয় দেবার মতো মানুষ কি হবে? এগিয়ে এসেছিল মেসো মশাই। ‘মানুষকে ছুঁলে মানুষের কোনদিন জাত চলে যায় না’ – মেসো মশাইএর যুক্তির ভীড়ে মাসী রণে ভঙ্গ দিল। কিছূক্ষনের ভিতর মাসীর ফণা তোলা মাথা একটু ঝুঁকে গেল। মেসো তার জীবনের স্কুল বন্ধু জব্বারের গল্প শোনালো। দুজনই ছিল হরিহর আত্মা। এহেন কোন দুস্টমি বাঁদরামি নেই যা দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় ঘটত না। তারপরও জব্বারকে মেসো কোন্দিন ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। জব্বার গেলে ওদের ঘরের পবিত্রতা নষ্ট হবে। ছোঁয়াছুঁয়িতে খোয়া যাবে ওদের এতদিনের আগলেরাখা ধর্ম । তাই একদিন শেষ হয়ে যায় এই দূরত্ব বজায় রাখা বন্ধুত্ব। শুধু এই ছোঁয়াছুঁয়ির কালচারে জব্বার বুঝলো যতই বুন্ধু বলুক আদতে হিন্দুরা তাদের ঘৃণা করে। ৭১ এ যুদ্ধের ডামাডোলে মেসো অবেক বিস্ময়ে দেখলো তাদের বাড়ীতে আগুন দিতে সবার আগে ছূটছে জব্বার।
পীযুষের ঐকান্তিক চেষ্টায় শেফালীর জন্য ছোট্ট একটা ঘরও বরাদ্দ হলো। মাসী আপাত ক্ষান্ত দিলেও মন থেকে মানতে পারেনি। তাই সেই ঘর আর ড্রয়িং রুম বাদে কোথাও যাওয়া মানা। রান্না ঘরে তো ১৪৪ ধারা। খাবার-দাবার একটা প্লেটে করে মাসি তিতলীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। শেফালির ঘরটা ৮ ফিট বাই ৮ ফিট। দেয়ালে বাবা লোকনাথের ছবির একটা পোস্টারে লেখা-
‘রনে বনে জলে জঙ্গলে যখন বিপদে পরিবে,
আমাকে স্মরণ করিও আমিই রক্ষা করিব- লোকনাথ ব্রহ্মচারী’।
প্রতিদিন পড়তে পড়তে শেফালির মুখস্থ হয়ে গেছে। সেও মাঝে-সাঝে আওড়ায়। ছোট্ট একটা জানালা আছে না থাকার মতো। জানালা খুললে পাশের বাড়ির দেয়াল বাদে আর কিছু চোখে পড়ে না। মাসির সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ না হলেও মেসো মশাইয়ের সঙ্গে সহজেই ভাব হয়ে যায়, তাদের একটা মেয়ে তিতলি। ক্লাস নাইনে পড়ে। অসম্ভব কথা বলা স্বভাব। এক মুহূর্ত চুপ থাকতে পারে না।
মেসোমশাই অরূপবাবু পুরো পরিবারটা সারাক্ষণ জমিয়ে রাখেন। এলাকার সবার সাথেই তার হৃদ্যতা শেফালী লক্ষ্য করেছে। দোষের ভিতর একটু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে ভালোবাসেন। হারমোনিয়ামটা টেনে হেড়ে গলায় গান ধরে ফেলেন। অবসর সময় পেলে তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসে যান কাব্যসাধনা করতে। আর সাধনা শেষ হলে তার এই নতুন কাব্য সবাইকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শেফালীর অবশ্য কবিতাগুলো একেবারে খারাপ লাগেনি। দেহের গড়ন ঠিক আছে শুধু আত্মাটা দিতে পারলে ভাল কবিতা হয়ে যেত। এই মানুষটির উপর শেফালীর শ্রদ্ধা অসীম, তার বুঝতে বাকী নেই, অরূপবাবুর মতো মানুষ আর দুটি নেই। অবশ্য পুরো পরিবারটা সংস্কৃতমনা। মাসি থিয়েটারে অভিনয় করে। মেসোমশাই গান, কবিতা নিয়ে আছেন। তিতলিও ভালো নাচে। মোটামুটি কিছুদিনের ভেতর ভালো লাগতে শুরু করল শেফালির। শুধু মাসির সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়নি। কোনো কারণ ছাড়াই মাসি তাকে অপছন্দ করে। কথায় কথায় খোঁচা দেওয়া তার রুটিন। তবু এই বাড়িতেই বছর দুয়েক কাটিয়ে দিল শেফালী। কিন্তু মাসির সঙ্গে বনিবনাটা একেবারেই হচ্ছিল না। হয়তো মাসি ভেবে বসে আছে কোনো এক দিন পীযুষ প্রস্তাব দেবে এই নেড়ে’র মেয়েকে বিয়ে করবে। তখন এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। শেফালীও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এভাবে পরের ঘরে আর কত দিন? চিন্তা করল এখন সে একা ঘর ভাড়া নিয়ে ঢাকা থাকবে।
ভাবা যায়! দু বছর আগে সে ভাবতে পারত। বলা নেই কউয়া নেই রাজধানীতে শুরু হলো শেফালির একাকী সংসার কর্মজীবী হোস্টেলে। যৌবনের স্বপ্ন সাধ প্রায় বিলীন হয়ে গেল। জীবিকা চালাবার জন্য শুরু হলো কঠোর পরিশ্রম। দু বেলা খাবার জোটাতে হাড় মাংস এক হয়ে যায় তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে – বাপের হোটেলে কোন দিন যা বুঝতে পারেনি। ছোট খাট একটা চাকরি পেয়েছে, এক অফিসে রিসিপশনিস্ট। তারপর কিভাবে কিভাবে যেন একটা কল অপারেটরের চাকরির সুযোগ এসে গেলো। নতুন এই অফারে সামান্য রোজগার বাড়ল কিন্তু অবস্থার তেমন হেরফের হলো না। প্রতিদিন শত মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। কত কত আজব মানুষ যে এই পৃথিবীতে আছে। কত সংগ্রামই না করতে হয়েছে টিকে থাকতে গিয়ে। জীবন ধারার স্রোত আপনমনে বয়ে চলে। জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। দিন, মাস, বছর ঘুরতে লাগলো শেফালীর এই যান্ত্রিক নগরে। আমরা সবাই যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তায় বাস করছি তা কাউকে বুঝতে দিই না, শেফালীও তার কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না, সবার সামনে সে প্রেজেন্ট করে সে ভীষণ হাসি খুশি আর সুখী একটা মেয়ে। অহরহ মিথ্যা বলে সারভাইভাল এর জন্য। দেখতে দেখতে ৫টা বছর ওর কেটে গেছে এই ইট কাঠের জঞ্জালের রাজধানীর বুকে।
পীযুষের কাছে শেফালির ঋণের শেষ নেই। এই ভয়ংকর পড়থিবীতে বেচে থাকার সংগ্রামে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো সবচেয়ে ভয়ংকর প্রানীটার নাম মানুষ আবার এই মানুষের ছায়া ছাড়া কোন মানুষের উন্নতি সম্ভব না। যদিও আসলে মানুষ মানুষের জন্য কিছু করে না, নিজের জন্যই করে। নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য সে মানুষের সেবায় লিপ্ত হয়। উপকার করার মধ্যেও এক ধরনের স্বার্থ আছে। এ ক্ষেত্রে স্বার্থটি হচ্ছে নিজ আত্মার প্রশান্তি। পীযুষের ভেতর কি শুধুই এই আত্মার শান্তি খোঁজার প্রচেষ্টা? কি না করেনি পীযুষ শেফালীর জন্য। সেই ঢাকায় নিয়ে আসার পর একটা টুকরো বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। ডিগ্রি ভর্তি করিয়ে দেওয়া । টুকটাক ইনকামের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। আজ যে ঢাকা শহরে টিকে আছে, কিম্বা বেঁচে আছে তার পিছনে এই পীযুষ। ছোটখাট গোলগাল চেহারার এই ছেলেটির সাথে শেফালীর পরিচয় গাঢ় হয়েছিলো গহনা বিক্রি করে মোবাইল কেনার সময়। পীযুষের দাদা নিমাই ভট্টাচার্যকে এলাকার সবাই ভালোবাসে। এলাকায় তরুণদের জন্য এক রকম মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন। কোন এক সময় আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টি করতেন। ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের টিচার। সে সব অবশ্য অতীত। তবে এলাকার উন্নয়ের আন্দলোন সংগ্রামে কিম্বা কিশোর- তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখতে বিছিন্ন খেলাধুলা, শরীরচর্চার আয়োজনে সদা ব্যস্ত এই নিমাই ভট্টাচার্য। শেফালীদের পরিবারের সাথে অনেক দিনের পরিচয় এদের। শেফালীর বাবাকে অনেক সমীহ করেন। করার কারণও আছে। ১৯৪৭ এর পর শেফালীর দাদা জয়নুদ্দিন না থাকলে হয়ত নিমাইদের এই দেশে থাকা হত না। ভারতে পাড়ি দেওয়া লাগতো। মামুন স্যার এর সেই ঘটনার পর প্রাইভেট পড়াই ছেড়ে দিয়েছিল শেফালী। কিন্তু পরিক্ষার আগে বাবা একরকম জোর করেই নিমাই দাদা কে নিযুক্ত করেছিল। পীযুষ আর শেফালী এই দুই জনই একসাথে পড়তে বসতো। নিমাই দা প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার হলে কি হবে – প্রতিটি বিষয়ে তিনি এমন ভাবে পড়াতেন শেফালীর এস এস সি পাশ করতে কোন অসুবিধা হয় নি। তার উপর ছিল ভালবাসার মানুষ বগা’র চাপ।
এই এত বছরের ভিতরে যে শেফালী বাবা মা’র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি তা না। শেফালীর বাবা মাইনুদ্দিন মিয়া জেলে আছে। জে এম বি’র ঘটনায় তিনি এমন ভাবে ফেসেছেন যা বলার মত না। তিনি জানেন না অথচ তার একাউন্ট থেকে জঙ্গিদের ব্যাংক একাউন্টে টাকা গেছে। তাছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক কারনও আছে তার জেল খাটার পিছনে। মাইনুদ্দিন মিয়ার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ানোরও একটা কানা ঘসা ছিল। বর্তমান চেয়ারম্যান এর সাথে তেমন ভাল বনিবনাও হচ্ছিলো না। সব মিলিয়ে তিনি গর্তে পড়েছেন আর সবাই ল্যাং মারা শুরু করেছে। আর এ সব কিছুর জন্য তার ধারনা তার বড় মেয়ে শেফালী দায়ী। তার পাপেই নাকি আজ এই বেহাল অবস্থা। রাবেয়াকে কিরা কসম দিয়ে রেখেছেন শেফালী এ বাড়ীতে ঢুকলে তার মরা মুখ দেখতে হবে। শেফালী অবশ্য ঢোকার চেস্টাও করে নি। সে এই রাজধানী ছেড়ে এ’ ক’ বছরে বাড়ির মুখ ধরেনি। যদিও বাড়ির সব খবর ই পাই। পদ্ম এবার এস এস সি পরীক্ষা দেবে। ক্লাশ ফাইভ, এইট দু জাগাতেই বৃত্তি পেয়েছে। তাকে ঘিরে স্কুলের সবার অনেক উচ্চাশা। বাবা জেলে, বোন পেট বাঁধিয়ে পলাতক, মা বিছানাগত এর ভিতর দিয়েই কিভাবে কিভাবে এত ভাল রেজাল্ট করে এই মেয়ে প্রতিবেশীরা সবাই বিস্মিত।
সব চরাই উতরাই পেরিয়ে শেফালির জীবনে এক নতুন ভোর হতে চলেছিল আজ। No winter lasts forever – শেফালী এই আশায় পথ চলে বেড়ায় আজ ৫ বছর। সকাল থেকেই ভাবছে, এই নতুন কী বয়ে আনবে? কত খারাপই তো এই জীবনে ঘটল। এর চেয়েও খারাপ কি কিছু আর হতে পারে?মানুষ এর জীবনে যদি কেবলই সুখ বা কেবলই দুঃখ থাকে তবে তা হয় রোবটের জীবন। বৈচিত্র্যহীন জীবন বড় একঘেয়ে। আজ শেফালি নতুন একটা প্রাইভেট ফার্মে ইন্টারভিউ দেবে। চাকরি একরকম ঠিক করাই আছে। জাস্ট একটা ফর্মালিটি মেইনটইন করার জন্য ডেকেছে। এডমিনের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। শেফালী পারবে কি পারবে না জানে না। এ পর্যন্ত বেশকটা চাকরি করেছে। আলিবাবা গ্রুপ খুব নামকরা কোম্পানি। এরকম এক কোম্পানি থেকে অফার পেয়েও চাকরি করতে না যাওয়া মানে পাগলামি করা। শেফালী বেশ সেজেগুজেই বেড়িয়েছিল।
গুলশানের অভিজাত এলাকায় এক বিশাল ভবনের ১৩ তলায় বহুজাতিক সংস্থার অফিস ‘আলীবাবা গ্রুপ’। দেশের প্রথম সারির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ত্রিজগুলর মধ্যে আলীবাবার নাম গত কয়েক দশক ধরে ওপরের সারিতে। চট্রগ্রামের এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী আকবর আলী প্রায় ত্রিশ বছর আগে খুলেছিলেন এই সংস্থা। তখন একেবারেই ছোটো ছিল। একটা গার্মেন্টস কারখানা দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। কিন্তু এক যুগ না ঘুরতেই যেন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেলেন আকবর আলী। একের পর এক কারখানা হতে লাগলো। সেই ছোটো ব্যবসা এখন ডানা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বহু শাখাপ্রশাখায়। আলীবাবার সাথে ব্যাবসা আছে নামিদামি বহু বিদেশী কোম্পানির।যেমন অজস্র অর্ডার এদের, তেমনই ভালো এদের সমস্ত ব্যবস্থাপনা। এদের প্রতিটা অফিসে রয়েছে ম্যানেজমেন্টের সুরুচির ছাপ। শেফালী এসেছে এদের হেড অফিসে। চকচকে সোফা, দেওয়ালে চোখ জুড়িয়ে দেওয়া দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়া আকবর আলী আর তার মেয়ের ছবি, আর তার সঙ্গে রয়েছে মনোরম চিত্রকলা। আকবর সাহেবের মেয়েকে খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হল কোথায় যেন দেখেছে?
শেফালী দামি কাচের ভারী সুইং ডোর ঠেলে এই অফিসের ভেতরে ঢুকতেই ঠান্ডা হাওয়া শরীরকে যেন মুহূর্তে স্নিগ্ধ করে দিল। ভেতরটা শুধু যে ঠান্ডা তা-ই নয়, অস্বাভাবিক রকমের একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারদিকে। অথচ এখানে জনসংখ্যা যথেষ্ট, লম্বা করিডোরে পরপর পাতা রয়েছে টেবিল-চেয়ার, আর প্রতিটা টেবিলের উল্টোদিকে বসে রয়েছেন একজন করে কর্মকর্তা। তাঁরা প্রত্যেকেই সামনের লোকের সঙ্গে কথা বলছেন বা কম্পুটারে একনিস্ট কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মোবাইলে অদ্ভুত নিচুস্বরে হাসিমুখে কথা বলছেন। কোন কোন জায়গায় গোল করে বসে অনেকে মিল কাজ করছেন। প্রত্যেকের পরনে রুচিশীল পোষাক। এরকম ওয়েল অরগানাইজড একটা কোম্পানিতে কাজ করবে ভাবতেই গর্ব বোধ হচ্ছিল শেফালীর।
মানুষ অনেক কিছুই ভাবে কিন্তু তা সব সময় সত্যই হয় না, বিধাতা অন্য কিছু লিখে রাখে। এত সাজগোজ করে ইন্টারভিউ দেওয়া হল না। শেফালী খেয়াল করেনি কখন হট্যাত দূর থেকে কাচ ঘেরা ঘর থেকে তাকে দেখে মামুন হাসি হাসি মুখ করে এসে দাড়িয়েছে। ্মূলত মামুনই শেফালীর জন্য এই চাকরীর ব্যবস্থা করেছে। শেফালীর জানা ছিল না , পীযুষ এই বদ্মাশটার সাহায্য নিয়েছে। একরকম অপ্রস্তুত হল। দেখেই মাথাটা একটু চক্কর দিল। শেফালী বেশ কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে মামুনের দিকে তাকাল। তারপর ঠোঁটটা কামড়ে ধরে চোখের জলটাকে প্রাণপণে আটকাতে আটকাতে বলল,’একটা ইন্টারভিউ এর জন্য এসেছিলাম।বলেই আর এক মূহিত দেরী করে না। পিছন থেকে মামুন দুবার ডাকলও। কিন্তু না শোনার ভান করে দরজা খুলে বেড়িয়ে আসল। বাইরের খোলা হাওয়ায় আসতেই একটা রিলিফ। শেফালী ভাবল একবার বারডেমের দিকে যাওয়া যাক। মা বারডেমে আছে খবর পেয়েছে। দূর থেকে এক নজর দেখে আসবে। মা’র উপর বাবার চেয়েও বেশী রাগ শেফালী। মা হবার কোন যোগ্যতায় তার নেই। কতবার শেফালী কথা বলার চেষ্টা করেছে মোবাইলে। কত চিঠি দিয়েছে। কিন্তু কোনদিন এই মহিলা একবারও কথা বলে নি। কি ধাতু দিয়ে গড়া কে জানে? শেফালীর মাঝে সাঝে সন্দেহ হয় ইনি তার আসল মা কিনা? স্বামীর ভয়ে একটা মানুষ এত ভীত হতে পারে? ভয় না ভালবাসা! – হিসাব মেলে না। বারডেমের অলিগলি সবই শেফালীর চেনা। বারডেমে শেফালী নিজেও একবার এসেছিল। বাচ্চা এবরশন করাতে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিখান থেকে ফিরে এসেছে।
বগা ভাই যে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরা একজন ফ্রড প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর বুঝে গিয়েছিল শেফালী। রাজধানীতে বগা ভাই কী করেছিল সেই অতীত আর মনে করতে চাই না সে, বিয়ে মানে যৌন চুক্তি না, সেক্স করলেই বিয়ে করতে হবে – এমন সনাতন ধারণায় সে বিশ্বাসী না – এই ছিল বগার সার কথা। তারপর বলা নেই কওয়া নেই একদিন উড়াল দিলো বগা ভাই। দেশ ছেড়ে বহু দূরে।
বগার দেশ ছাড়ার কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। বগা তখন ওয়ারীর মেসেই থাকে। পড়ালেখা শেষ করে এই জায়গায় সেই জায়গায় ইন্টার্ভিউ দিয়ে যাচ্ছে। এই সময় একটা প্রাইভেট ফার্মের পক্ষ থেকে দোভাষীর কাজটা পেয়েছিল। বিদেশ থেকে এক দম্পতি এসেছে। তাদের সাথে সাথে থাকতে হবে। পুরুষটির নাম জেরাল্ড। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। বাড়ী কানাডা। অফিসিয়াল কাজে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন স্ত্রী সহ। স্ত্রী জেনি’র বয়সও ৫০ পেরিয়েছে। দুজনেই একই প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। বগার সাথে প্রথম যেদিন ওদের দেখা হলো, দেখে জেনি’র কোলে একটা নেড়ী কুকুরে বাচ্চা। নেড়ী কুকুরে বাচ্চা সে গাজীপুর রোডের কোন সি এন জি স্টেশনে পেয়েছে। ততক্ষনাত ওটাকে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে কোলে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
পরিচয় পর্ব শেষ হতেই জানতে চাইলো, বগা তার কুকুরের বাচ্চার জন্য একটা বক্স জোগাড় করে দিতে পারবো কিনা? সে এটাকে ডেনমার্ক নিয়ে যেতে চায়। বগা বোকার মত তাকে বলল, “তুমি কুকুরের বাচ্চা না নিয়ে একটা মানুষের বাচ্চা নিয়ে যাও।” উত্তরে বললো “মানুষ খারাপ। বড় হলে সব ভুলে যায়। বেঈমানী করে। কিন্তু পশু কখনো বেঈমানী করে না।”
৩ ‘দিন ওদের সাথে কাটাল। নানা প্রসংগেই কথা হচ্ছিলো। ওরা স্বামী স্ত্রী সারা পৃথিবীই ঘুরে বেড়ায় অফিসিয়াল কাজে। বাংলাদেশে ধর্ষিত মেয়েদের নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে দুজন। কিভাবে ডাক্তারি পরিক্ষা হয়, কিভাবে টেস্ট হয়, ফরেনসিক বিভাগে কি কি সুবুধা আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তারা কিভাবে তদন্ত করে, শাস্তি কি হয়, ধর্ষিত মেয়েদের পরবর্তী জীবনে কি ঘটে, পুনর্বাসনের কি ব্যবস্থা সবই তাদের গবেষণার উপজীব্য।
বগা সবখানেই তাদের সংগ দেয়। দুজনেই গল্প করতে ভীষণ ভালবাসে। আজ ফিলিপাইন, কাল ভারত তো পরশু ডেনমার্ক, জার্মানী, মেক্সিকো, কানাডা। ডেনমার্কের খাবার জঘন্য তাই তারা শুধু খাবার খেতে জামার্নি যায় সে গল্প যেমন হলো তেমন হলো পোলান্ড আর রাশিয়ার মাঝামাঝি এক শহরে কি ভয়ংকর মাফিয়াদের খপ্পরে পড়েছিল সেই গল্পও। নায়গ্রা ফলসের বোর্ট জার্নি যেমন দেখালো তেমনি দেখালো তার নিজের হাতের বানানো রেসিং কার। সাত সেকেন্ডে ৩৭০ কি:মি: প্রর্যন্ত স্পীড তোলা যায় থামাতে দুটো প্যারাশ্যুট লাগে। শুধু রেসিং কার না তার নিজের বানানো ট্রাক্টরও আছে। শুধু গল্প না বিশ্ব রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমা অনেক কিছু নিয়েই আলাপ হলো ওদের দুজনের সাথে।
একটা পযার্য়ে বিদায়ের পালা। বগা জিজ্ঞাসা করল, “পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ততো ঘুরে বেড়িয়েছো বাংলাদেশের কি ভালো লাগলো?” দুজনেই এক সাথে উত্তর করলো ” মানুষ”। বাংলাদেশের মত এত আন্তরিক মানুষ নাকি তারা পৃথিবীর কোথাও খুজেঁ পাই নি। তারপর এক অদ্ভুত গল্প শোনালো।
বছর সাতেক আগে তারা একবার বাংলাদেশ এসেছিলো। প্রায় দিন সাতেক থাকা পড়েছিলো। ওদের কোম্পানি থেকে যে গাড়ী দেওয়া হয়েছিল তার ড্রাইভারের নাম ছিলো হাবিবুর। হাবিবুরকে তারা গল্প করেছিলো, এক জায়গায় লাঞ্চের পর মিষ্টি জর্দা দিয়ে ওরা পান খেয়েছে। আরেকবার খেতে চাই। ফ্লাইটের লেট হয়ে যাচ্ছে বলে হাবিবুর সেদিন ওদের আর পান খাওয়াতে পারেনি। কিন্তু কথা দিয়েছিলো নেক্সট টাইম আসলে খাওয়াবে। হাবিবুর মারা গেছে বছর দুই হয়েছে। জেরাল্ড আর জেনি বাংলাদেশে এসেছে শুনে হাবিবুরের ছেলে ঘন্টা দুয়েক আগে পন্চগড় থেকে ঢাকায় এসে ওদের মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান খাইয়ে গেছে। ওরা এত বিস্মিত কোনকালেই হয় নি। গল্প করার সময় জেরাল্ডের চোখ ভেজা কিনা নিজেরটা ভেজা থাকায় খেয়াল করতে পারি নি বগা। সেদিন এয়ারপোর্টে জেনির হাতে কুকুর নেবার কোন বাক্স ছিল না। কিন্তু বিস্ম্যকর ব্যাপার হল এই দম্পত্তি তার জন্য জার্মানিতে একটা চাকরির ববস্থা করে দিল মাস দুয়েকের ভিতরে। সেই বগার শেফালীকে ফেলে জার্মানি যাওয়া।
শেফালী প্রথমে দুঃখ পেলেও, কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গেলেও – এ ক’বছরে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাচ্চাটাকে এবরশন করিয়েছে। সব দুঃসহ অতীত পেছনে ফেলে বেশ এগোচ্ছিল শেফালী। নতুন করে বাঁচতে শেখা ভালোই রপ্ত করেছিল। কিন্তু আজ তার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। থরে থরে সাজানো স্বপ্নের বাগানটা নিমেষেই ধূলিসাৎ। কাউলার এই বেঞ্চে পাথরের মতো বসে আছে। ইশ যদি সে সেই ডাক্তার ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠে বসত। বিপদের আগ মুহূর্তে মানুষ বিপদ থেকে বাঁচার অনেকবার সুযোগ পায়, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত কাজে না লাগানোয় বিপদে পড়ে। আর শেফালির কার্বন কপিই তো বারবার বিপদের মুহূর্তে হাজির হয়। কত ভাবে নাই না শেফালিকে সিগন্যাল দিয়েছে বিপদের। যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে শরীর। বার বার মনে পড়ছে কিভাবে খুবলে খুবলে ছিঁড়ছিল ওই পশুরা তার নারীত্ব। সেই ডাক্তার ভদ্রলোক হাসান সাহেব কি আবার আসবে তাকে বাঁচাতে। নাকি রক্তক্ষরণ হতে হতে এখানেই জীবনের সমাপ্তি ঘটবে? রক্তে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে। এত রক্ত মানুষের শরীরে থাকে?বমি উলটে আসতে চাইছে পাকস্থলী থেকে। অবশ হয়ে যাচ্ছ শরীরের প্রতিটি স্নায়ু। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলো –‘আমি কি ক্ষতি করেছি তোমার?এ তুমি কি করলে আমার? আমাকে এভাবে মেরে ফেলো না। আমি বাঁচতে চাই। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।’
হাসান সাহেব সত্যই এসেছিলেন। তার কারনে এখন বেচে আছে সে। তবে জীবনহানির আশঙ্কা কাটেনি। হাসান সাহেবের বন্ধুর ক্লিনিকে আছে। সাথে রাসেলও আছে। মানুষ এত খারাপ, পাষণ্ড হতে পারে! রাসেল তার জীবনে যত বই পড়েছে সব বই-ই মানুষকে ভালো হতে বলেছে। যত সিনেমা দেখেছে, সব সিনেমাতেই ভালো মানুষের জয়জয়কার। শেষ দৃশ্যে খারাপ মানুষের পরাজয়। কী সংগীত, কী কবিতা- সবই ভালোর প্রচারণা। খারাপের কোনো মূল্য নেই। মোটাদাগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, চিন্তা- সবকিছুতেই মানুষকে ভালো হবার নসিহত দেওয়া হয়েছে। জীবনে একটি লেখাও পড়েনি যেখানে লেখা আছে – মানুষ তুমি খারাপ হও, চোর হও, বাটপার হও, মিথ্যাবাদী হও, দুর্নীতিপরায়ণ হও, ধর্ষক হও- তা সে ধর্মগ্রন্থ হোক আর এমনি গ্রন্থই হোক।
মানুষ কতটা খারাপ হলে তাকে যুগের পর যুগ এই একই নসিহত করা লাগে, ভালো হ, ভালো হ, ভালো হ,,,। মেয়েটা বাঁচবে কিনা সন্দেহ? রাসেল কিছুতেই মানতে পারছে না। কিন্তু তার কি বা করার আছে? এখন ভরসা হাসান সাহেব। হাসান সাহেব নিজেও একজন এমবিবিএস ডাক্তার। যদিও গত বিশ বছর প্র্যাকটিস করা হয়নি । পৃথিবী দেখার নেশা চেপে বসেছিল হাসান সাহেবের। সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন। ডাক্তার হবার সুবাদে তার জানা আছে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন নারীর অধিকাংশই মানসিক সংকটে ভুগতে থাকে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে ভেঙে পড়েন, যা থেকে উত্তরণ সহজে ঘটে না। এ মেয়েটাকে একটা সুস্থ জীবন এ ফেরাতে হলে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে। এ দেশ থেকে বিদেশ নিতে হবে। অনেক অনেক শারীরিক সমস্যা হয়ে গেছে এই মেয়েটির। অনেক টাকাও লাগবে। টাকা অবশ্যও একেবারে নেই তা না। উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা মারা যাবার পর বেশ কিছু টাকার মালিক হয়েছিল হাসান সাহেব। ত্রিকুলে এমন কেউ ছিল না যাদের দেখাশোনা করতে হবে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখা মেলতে তাই বাধা ছিল না। যদিও সেই প্রাচুর্যে ভাটা পড়েছে। রাসেল, হালিমা আর হাসান সাহেব সেই ভোর থেকে এই মেয়েটাকে বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। ঘটনার শুরু গত সন্ধ্যায়।
তখন একটা বই পড়ছিলেন হাসান সাহেব।
‘মানুষ বা যুক্তিবাদী জীব- কিছুটা অহমিকার সঙ্গে নিজেকে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন, সে যেমন মর্ত্যলোকের প্রাণীসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আবার বিরক্তিকরও বটে’। এ লাইনটা পড়েই বইটা বন্ধ করেন হাসান সাহেব। সময় নিয়ে পড়তে হবে। তার চেয়ে কিছু ভাবা যাক।
‘পুরো মহাবিশ্বটা আসলে একটা বয়োম এর মধ্যে ডুবানো আছে। বয়ামে পানি নাই তবে কোনো না কোনো পানি সদৃশ পদার্থ আছে। এই পানির ভেতরই পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে, ব্ল্যাক হোল সব চুবানো আছে। সে স্টিং থিওরি হোক আর যে থিওরি হোক যেভাবে ইচ্ছা আছে। সেই বয়াম কাচের তৈরি না, তবে কোনো না কোনো ধরনের পদার্থের তৈরি। এই বয়ামের জায়গা বাড়তে পারে। যত বয়ামের ভেতর জিনিসপত্র ঢুকবে তত সে বড় হবে। আবার জিনিস বের করে ফেলা হলে ছোট হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুই-একটা গ্রহ, নক্ষত্রের শক্তি নিঃশেষ হয়ে শেষ হইলে বয়োমও ছোট হয়ে যায়।‘
পুরো ব্যাপারটার একটা ছবি আঁকতে পারলে ভালো হতো। সমস্যা হলো হাসান সাহেব ছবি আঁকতে পারেন না। তারপরও পেনসিল-কাগজ নিয়ে একটা স্কেচ দাঁড় করাতে বসলেন।
কিন্তু এতেও ব্যাঘাত ঘটে। অনেকক্ষণ ধরে কে যেন কলিং বেল টিপছে। বাসায় কেউ নেই। সবাই বিয়ে খেতে গেছে। এসব অনুষ্ঠান হাসানের কাছে কেমন যেন লাগে। নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়। অনর্থক আলোচনায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। অল্পতে মাথা গরম হয়। তাই পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন। আজ হাসানের চাচাতো ভাইয়ের ছেলের বিয়ে। অনেক দূরের নিকট আত্মীয়। না গেলেও চলে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ একটা ফোন কলের অপেক্ষায় আছে সে। হালিমা এক্লায় বিয়েতে গেছে। সেই ফিরে এল কি না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবতে ভাবতে খেয়াল ছিল না কিছু। অনেকক্ষণ কলিং বেল বাজারা পরও তা খুলতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। হাসান সাহেব আবার আঁকা শুরু করলেন। আগেরটা শেষ করার আগেই নতুন একটা থিম মাথায় এসেছে।
তবে আগত ব্যক্তিও নাছোড়বান্দা। দরজা খুলিয়ে ছাড়বে না। অগত্যা উঠতেই হলো। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলেই দেখেন আনোয়ারের মা। কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে ঘটনার কিছু বোঝা গেল না তবে সারমর্ম যা বোঝা গেল- ৬০০ টাকা না হলে আনোয়ারের মা কে বিদায় করা যাবে না। পা জড়িয়ে ধরতে শুধু বাকি রেখেছে। বেশি কথা না বাড়িয়ে ৬০০ টাকা দিয়ে দরজা বন্ধ করলেন হাসান সাহেব। মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ খারাপের সময় এক কাপ চা খেতে হয়। কিন্তু এখন চা বানানো যাবে না। হালিমা রান্না ঘরে তালা মেরে গেছে। হালিমার এই এক আজব অভ্যাস। বাইরে বের হলে রান্না ঘরে তালা মারবে। তার ধারণা হাসান কিছু একটা করে গ্যাসের চুলো নেভাতে ভুলে যাবে। আর বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট ঘটবে। যদিও এ রকম কখনো ঘটেনি। হাসান সাহেবের ভুলো মন বলতে শুধু সে তার চশমাটা খুলে রেখে আসে যেখানে-সেখানে। প্রায়ই হারাতে হয়। ভাবনায় একবার ছেদ পড়লে নতুন করে চিন্তাটা ঠিক জমে না।
হাসান সাহেবের দ্বারা এখন বোধ হয় হবে না আর ব্রহ্মাণ্ডের স্কেচ আঁকা। এখানেই ইস্তফা দিলেন। দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। বনানীর দিকটায় ভালো কফি শপ আছে। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। মিরপুর থেকে এক টানে বনানী। এক কাপ কফি খেয়ে বাড়ির পথ ধরছিলেন। একটা ফোন পেয়ে , পথে দেখেছিলেন একাকী শেফালী দাঁড়িয়ে আছে। সেই মেয়েটাই এখন রেপ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মেয়েটাকে যদি তখন জোর করে গাড়িতে তুলে নিতেন। তা কি আর সম্ভব? মেয়েটা রাসেলের পরিচিত। যদিও জানা হয়নি পরিচয়ের সূত্র। রাসেলই রেপ হবার পর মেয়েটাকে প্রথম দেখতে পায়। হাসান সাহেবকে তারপর ফোন দিয়েছিল। হাসান সাহেব এসে দেখে এই মেয়ে সেই মেয়ে, যাকে রাত এগারোটার দিকে লিফট দিতে চেয়েছিলেন। কেন চেয়েছিলেন – তার পিছনে রয়েছে নিজের অতীতের আরেক গল্প। তাছাড়া কেন জানি মেয়েটাকে দেখে তখনই একটা কু-ডাক দিয়েছিল। হাসান সাহেবের অবশ্য এসব কু-ডাক এ বিশ্বাস নেই। তার স্ত্রী হালিমার আছে। হালিমাও বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছে হাসপাতালে। বিয়ে বাড়িতে বাবার খুনি কুখ্যাত রাজাকার শামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যাকে হালিমা ৪০ বছর ধরে খুঁজছে।
ঘন কালো চুলের ফাঁকে সাদা সাদা রেখা ঝিলিক দিয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙে সারা দেহে যন্ত্রণা আর অবসাদ নিয়ে। তবু একটা স্বপন সে দেখে যায়, এই বাংলার মাটিতে একদিন ৭১ সালে ঘটে যাওয়া সব অমানবিক কাজের বিচার হবে। আজও রাজাকার শামসুদ্দিন, তাদের বাড়িটা, বাবা, মদন মামা – হালিমার চোখের সামনে ভাসে।
দেশভাগের পর ভারত থেকে এসে হালিমার দাদা বাড়িটা কিনে ছিলেন। হালিমার তখন জন্ম হয়নি। ভারতে থাকার স্মৃতিও নেই। দেশভাগ হলো ভালো কথা কিন্তু কোন বিচারে বাংলা ভাগ হলো তার সদুত্তর হালিমা কখন খুঁজে পায়নি। হালিমার ছোট-বেলা এ বাড়ি ঘিরেই। মোটামুটি দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি। বেশ পুরোনো। আদি বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। ওরা যেখানে আছে এটা নাকি কাছারি ঘর ছিল। আগে যারা এখানে ছিল তারা বোধ হয় সংস্কার করেছে। বাড়ির পাশে পুকুর। বাঁধানো ঘাট এখনো অক্ষত। আর এমন কোনো গাছ নেই যে নেই। সকাল বেলায় উঠে আমড়া গাছে কাছে গিয়ে প্রথম ঢিলটা মারতেই তবারক মিঞা ছুটে আসল –
: আম্মাজান ওরা আসতেছে। পালান।
এ কথা বলে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতচকিত হালিমা। ঘরে ঢুকে দেখে সবার আতঙ্কগ্রস্ত চোখ। মা দরজা বন্ধ করল।
আজকের দিনটাই হালিমার খারাপ। সকালে মদন মামা এসেছে। মদন মামার মতো মানুষ এ দুনিয়ায় দুটো নেই। মামা নাকি একবার স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, ‘আমি মদন, আমার নাম পরিবর্তন করে শুভ রাখলাম। এখন থেকে আমাকে সবাই শুভ বলে ডাকবেন’। তাল গাছের মতো লম্বা, পাটকাঠির মতো সরু সেই মদন মামা বাড়িতে এলেই ছোটদের মধ্যে হইচই বেঁধে যেত। অসম্ভব মজার মানুষ ছিলেন বলেই ছোটদের মধ্যে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। যদিও বাড়ির বড়রা কোনো দিন তাকে নিয়ে একটা ভালো কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না। ও একটা ‘গুড ফর নাথিং’ কিংবা ‘ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’ – এ ছিল সবার মুখস্থ ডায়ালগ। বাবা তো তাকে সম্বোধনই করতেন ‘গর্দভ নম্বর দুই’। গর্দভ নম্বর এক না বলে দুই কেন বলা হতো সেই রহস্য অবশ্য কখনো আবিষ্কার করতে পারেনি সে। অবশ্য ছোটদের সে ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। মামা আসলেই তাকে ঘিরে বসত গল্প শোনার জন্য। একবার নাকি মামা ব্যাঙের স্যুপ রান্না করে বাড়ির সবাইকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। স্কুলে নাকি একবার সাপ ধরে নিয়ে গিয়ে হেড স্যারের চেয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। গুইসাপের কঙ্কাল নাকি পড়ার টেবিলে রাখতেন। এ রকম আরও কত কি। যে মজার মজার গল্প করতেন মামা!
সবাই অপেক্ষা করত রাতের জন্য। রাতের বেলায় মামা করতেন ভয়ংকর ভয়ংকর ভূতের গল্প। মামার গল্প শুনে দিনরাত ভয়ে ঘুম আসত না। রাতে বাথরুমে যেতে ভয় করায় বিছানা ভিজিয়ে সকালে মায়ের হাতের উত্তম-মধ্যম খাওয়া ছিল নিত্য ঘটনা। মামার ভূতের গল্পগুলোর অধিকাংশই ছিলে ওনার নানা বাড়িকেন্দ্রীক। মামা বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প গুলো করতেন। উনি বলতেন-
‘শোন, আমার নানার দুটো পালা জিন ছিল। নাম ছিলে, ঘবা আর ঘবি। বাড়িতে কাজের লোক সেজে কাজকর্ম করত। কেউ জানত না। একদিন নানি রান্নাঘরে রান্না করছিল, এমন সময় শুরু হেলা তুমুল বৃষ্টি। নানি বলল ঘবি, শোয়ার ঘর থেকে মনিকে মানে আমার মা আর তোদের নানিকে নিয়ে আসতে। তোদের নানি তখন দুধের বাচ্চা। কাজের লোক রান্নাঘর থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে কোলে করে নিয়ে আসলো। এমন ঘটনা দেখে তো নানির দাঁতকপাটি লেগে গেল। জিন দুটোকেও বাড়ি থেকে তাড়ানো হলো। তাদের স্থান হলো বাড়ির সামনের আম বাগানে। ভয়ে আম বাগানে কেউ যেতো না। আম বাগানের সেই জিন আমার বাবাও দেখেছে। একবার বাবা মানে তোদের নানা বলল, কোথায় ঘবা ঘবি? যত সব ফাজলামি কথাবার্তা। আজ আমি আম বাগানের জিন ছাড়াব। বলেই বাবা এক বিশাল লাঠি নিয়ে ছুটলেন আম বাগানে। কিছু দূর যেতেই দেখেন দুইটা প্যাঁচা গাছের ডালে বসে আসে। আর ওদের চোখগুলো অবিকল মানুষের মতো। বাবাকে দেখেই প্যাঁচা দুটো বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। এমন হাসি নাকি পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষেও হাসা সম্ভব না। তাই দেখে আর শুনে তোর নানা চিতপটাং। বারো দিন সরকারি হাসপাতালের বেডে। বিশ্বাস না হলে তোদের মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখ’।
পরের গল্পটা এ রকম-
‘একবার তোদের নানা গেছে শ্বশুর বাড়ি মানে আমার নানা বাড়ি। তখন তো আর এখনকার মতো বাথরুম ছিল না, রাত্রি বেলাতেও বাঁশ বাগানে যেতে হতো। কিন্তু বাবা কিছুতেই বাঁশ বাগানে যাবে না। সৈয়দ বংশের ছেলে, বাঁশ বাগানে হাগলে মান যাবে। তোরা তোদের নানাকে দেখিসনি। ভীষণ জেদি আর এক রোখা ছিল। অগত্যা উপায় না পেয়ে নানা ঘোষদের বাড়ি পাঠালেন। পুরো গ্রামে তখন ঘোষদেরই পাকা পায়খানা আছে। এক মাইল দূরে রাত তিন পারে বাবা চললেন ঘোষদের বাড়ি। সঙ্গে আমার গেদু চাচা। গেদু চাচা এক হাতে হারিকেন আর এক হাতে লম্বা লাঠি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন পেছনে আমার বাবা। ঘোষদের বাড়ির আগে একটা বিশাল পুকুর আছে। লোকে চান্দুর দিঘি বলে। হঠাৎ শোনেন পুকুর পার থেকে কাদের যেন আওয়াজ আসছে। একটু এগোতেই হারিকেনের দেখেন দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পুকুরের ধারে খেলা করছে। এত রাতে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলা করছে দেখতে পেয়ে গেদু চাচা চিৎকার দিলেন, এত রাতে কারা পুকুর পাড়ে? কোন বাড়ির? মুহূর্তেই বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো উধাও। পরে ঘোষদের বাড়ি যেয়ে শোনেন গত পরশু দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ওই পুকুরে ডুবে মরেছে। ব্যাস শুনেই তোদের নানা আবার হাসপাতালে। এবার সতেরো দিনের ধাক্কা’।
হালিমা তার মায়ের কাছে মামার গল্পের বিশ্বস্ততা খুজঁত। মা হেসেই উড়িয়ে দিতেন। এসব গল্প বানানো। কেউ না কেউ বানিয়েছে এই জিনের হাত লম্বা করা, পুকুর পাড়ে পুকুরে দুই বাচ্চার খেলা করা- তারপর সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব মদনের বানানো। আমার নানা বাড়িতে আদিকাল থেকে পাকা বাথরুম। ঘোষদের বাড়ি কেন তোদের নানা যেতে যাবে? নানার দুটো জিন থাকার কথা আমিও শুনেছি কিন্তু ওই হাত লম্বা করা, তোর নানাকে প্যাঁচা হয়ে ভয় দেখানো সবই তোদের মামার বানানো গল্প। এমন হলে আমি ঠিকই শুনতাম। তোদের নানা তো আমারও বাবা নাকি। বাবার ওপর তোর মামার অনেক রাগ। তোরা বড় হলে জানতে পারবি। বলেই মা গম্ভীর হয়ে যেতেন। সবার অবশ্য সেই সবে কোনো উৎসাহ ছিল না। মামার কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করত। শুধু হালিমায় এবার গ্যাঞ্জাম বাধাল। মামার মুখের ওপর বলে দিল, ‘তুমি সব মিথ্যা গল্প বলো। আর সব গল্পই তোমার বাবা না হলে অন্য কেউ ভূত, জিন দেখেছে। তুমি কি জীবনে একটাও ভূত দেখনি’।
‘কী! আমি মিথ্যা বলি, যদি মিথ্যায় বলি তাহলে তোরা আমরা গল্প শুনতে আসিস কেন? যা তোদের আর একটাও গল্প বলব না। কোনো দিনও বলব না’।
সবাই দেখে মহা ফ্যাসাদ। অনেক অনুনয় করে মামাকে আবার রাজি করায়। শর্ত একটাই হালিমা গল্প শুনতে পারবে না। ওকে গল্পের আসর থেকে বহিষ্কার করা হলো। শুধু মুখে না মামা একেবারে কাগজে লিখে দিলেন, ‘হালিমা গল্প অবিশ্বাস করায় বহিষ্কার করা হলো। গল্পের আসরের আশপাশে হালিমার জন্য ১৪৪ ধারা’। সেই কাগজ আবার রুমের বাইরে টাঙানো হলো। হালিমা তো কেঁদেকেটে অস্থির। বাবা সব শুনে বললেন ‘গর্দভ নম্বর দুইয়ের গালগল্প যারা শোনে তারা গর্দভ স্কয়ার’। হালিমাই এই বাড়িতে একমাত্র বুদ্ধিমতী। এই জন্য হালিমাকে তিনি আট আনা পুরস্কারও দিয়ে ফেললেন। টাকার অঙ্কটা এত বড় হবে আগে থেকে জানলে অনেকেই হয়তো গল্প বয়কট করত। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। হালিমা টাকা পেয়েও মন খুশি করতে পারেনি। রাতে গল্প শুনতে পারবে না এই দুঃখবোধ কিছুতেই তাড়াতে পারছিল না। বাগানে একা একাই আমড়া পাড়ছিল। তারপর এই তবারক মিঞার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা।
বাবা তবারক মিঞা জিজ্ঞাসা করছে
: কে নিয়ে আসছে।
: শামসুদ্দিন। তারে সঙ্গে দেখছি। আপনি পালান।
মদন মামা ভয় পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
: কোথায় পালাবে?
: জংলার দিকে যান।
: রেনু তুমি মেয়ে আর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে জংলার দিকে যাও।
: জংলার দিকে সাপ আছে।
: গাধার মতো কথা বলছ কেন?
: দুলাভাই, আমরা কোনদিকে যাব।
: তুমিও যাও ওদের সঙ্গে। সবাই যাও।
: আপনি যাবেন না?
: না।
: আপনাকে যাইতে হবে।
: আমার জন্য ওরা আসছে। আমাকে পেলে ওরা আর জংলার দিকে যাবে না। আমার জন্য সবাই বেঘোরে প্রাণ হারানোর দরকার নেই।
এ সময় কান্নার রোল উঠল। মা আর কাশেমের মা-এক সঙ্গে কাঁদছে। হালিমার চোখ বেয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। বাবার হাত চলে যায় মার মাথায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তান আর্মি বাড়িটা ঘিরে ফেলল। দূর থেকে সবই দেখা যাচ্ছে। বাবাকে একজন লাথি মারতে মারতে পুকুর ঘাটে নিয়ে আসছে। ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। তাই নিয়ে বেশ উত্তেজনা। চোখের সামনে পুড়ছে বাড়ি। ঠিক এ সময় দুটো গুলির শব্দ।
পুকুর ঘাটের পশ্চিম পাশে তবারক মিঞা দোনলা বন্দুক হাতে গুলি করেছে। একটা লোক সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। সবাই মুহূর্তে পজিশন নিয়ে ফেলল। মিনিট দুই যুদ্ধ চলল। এক সময় বাবা আর তবারক মিঞা পাশাপাশি। কিন্তু ধারণার বাইরে কাজটা ঘটল তখন। বাবা আর তবারক মিঞাকে জবাই করা হচ্ছে। জ্যান্ত জবাই। মা মূর্ছা গেছে অনেক আগেই। কাশেমের মা প্রাণপণে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু দৃশ্যটা মনে সেই থেকে আজ অবধি গেঁথে গেছে। বাবাকে পুকুর ঘাটে তিনজন ফেলে জোরে চেপে ধরেছে। শামসুদ্দিন গলায় ছুরি চালাচ্ছে। রক্ত আর রক্ত। চরম ভিতু মদন মামা দৌড় দিয়ে শামসুদ্দিনকে এক লাথি মারল। কে যেন পেছন দিয়ে মামার কাঁধে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। মামা গড়িয়ে পড়ল। তারপর সেই একই কায়দায় মামাকেও বলি দেওয়া হলো। বমি করে ফেলেছে হালিমা কখন ঠিক মনে নেই। তবে পুরো দৃশ্যটাই দেখছে। মার মতো মূর্ছা যায়নি। ঘণ্টা দু’য়েক পর ওরা চলে গেল। আকাশে গুড়গুড় শব্দে বিদ্যুতের কয়েকটি চমক হেনে ঝমঝম শব্দে নেমে এল বৃষ্টি। হালিমারা সকলেই সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। এক সময় সূর্য হারাল। অন্ধকারে হালিমারা বসে আছি জংলার ধারে। কুয়াশা আর রাতের ভয়ংকর নিস্তব্ধতা ছেঁকে ধরেছে। এক সময় ভোর হলো, শুরু হলো পথ চলা, এটাই পথ কি না কেউ জানে না , কাদা আর পানিতে ভয়ানক পিচ্ছিল। এখানকার মাটি বৃষ্টিবাদলে ভিজলে এমনিতেই হাঁটা মুশকিল।
মাঝে একটা বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া গেল। আশ্চর্য এ বাড়ির কাউকে হালিমা বা তার মা কেউই চেনে না। কাশেমের মা নিয়ে এসেছে। এত অচেনা তবু কী আদর করে যে থাকতে দিলেন। কাশেমের মামা হন তিনি। স্থানিয় মসজিদের মুয়াজ্জিন। কাশেমের মার কাছ থেকে সব শুনে বললেন-
: গরিবের ঘরে কোথায় থাকতে দিই। হাসেম সাহেবরে এমনে মাইরা ফেলছে। হারামজাদার দোজখেও তো জায়গা পাইব না। আল্লাহ গো আর কী দেখাইবা তুমি।
এ সব শোনার ধৈর্য তখন হালিমা আর তার মায়ের নেই। মা এ নিয়ে তিনবার অজ্ঞান হয়েছে। হালিমা শুধু তখনো চোখের পানি ফেলেনি। এত দ্রুত এত কিছু ঘটে গেল ঠিক তাল মেলাতে পারছে না। তবে শত চেষ্টা করেও গায়ের কাঁপুনি থামাতে পারছে না। ভাবছে। আর অবাক হচ্ছে। এত শক্ত করে বিধাতা কীভাবে গড়েছেন ।
এক ঘরেই গাদাগাদি করে ওরা নয়জন। কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছে না। ঝিঁঝি পোকার শব্দ ছাপিয়ে মায়ের ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ কেমন জানি বেমানান লাগছে। আশপাশে বোধ হয় কোথাও শিউলি গাছ আছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাবার লাশ তখনো বোধ হয় পড়ে আছে পুকুর ঘাটে। যতবারই মনে হচ্ছে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠছে। কেন বাবাকে বাঁচাতে ছুটে গেল না। ছেলে হলে কি ছুটে যেত? ঘুমে দু-চোখ জড়িয়ে আসছে হালিমার। কিন্তু বাবার সেই মৃত্যুদৃশ্য আজ অবধি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়। উলঙ্গ পড়ে আছে বাবা আর মদন মামার লাশ! ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে ঢিবিটা, তার ওপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ।
কাশেমদের মামার ওখানে একটা খোলা চালার নিচে তারা দেড়টা মাস কাটিয়েছে। পাক আর্মির কারনে মহল্লার হতবিহ্বল লোকেরা যে যেভাবে পেরেছে পালিয়েছে। গত দেড় মাসে মহল্লায় কত লাশ পড়েছে তার হিসাব দেওয়া কস্ট। সবাই বর্ডার পার হবার জন্য সীমান্তের দিকে ছুটছে। একদিন হালিমারাও ছুটল। দেশ স্বাধীনের পর যখন বাড়ির দখল নিতে এল দেখে বাড়ি আরেকজন দখল করে বসে আছে, সরকারি দলের হোমরা-চোমরা গুন্ডা। কয়েক বছর চেষ্টা করেও বাড়ি উদ্ধার করা গেল না। যদিও তাদের পুরাতন ম্যানেজার আখলাকুদ্দিনের সাথে দফারফায় কিছু টাকা পাওয়া গেল।
এত দিন পর সেই বাড়ির মেয়ের আজ বিয়ে হচ্ছে আর ঘটনাচক্রে হালিমা উপস্থিত। সেই শামসুদ্দিনের সঙ্গেই দেখা হলো তার। দুজনেই একসঙ্গে একে অপরের দিকে তাকায়। শামসুদ্দিন চিনতে পারানি কিন্তু হালিমা কি ভুলতে পারে? হঠাৎ মুখ ঢাকে দু হাতে। এক দৌড়ে বাথরুমে যেয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিশ্চল হয়ে যায়। যেন আয়নায় বাবার লাশের ছবিটা ধরা দেয়। আবার ফিরে তাকায় আয়নার দিকে । বাবার মুখে লাথি মারার মুহূর্ত থেকে যে ক্ৰোধ তার খাড়া হয়ে ছিল, তা ঝলসে ওঠে। ক্ষনেকের জন্য ভুলে যায় বিয়ে বাড়ীর কথা। বাবার লাশ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না তার।
রাসেলও ছিল বিয়ে বাড়িতে। লিমা ভাবিকে এখানে দেখে প্রচণ্ড অবাক রাসেল। লিমা ভাবীকে দেখলেই জাহানারা ইমামের মুখটা মনে পড়ে যায় রাসেলের। এ পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁদের দেখলেই শরধায় নত হয়ে যায় মুখ । লিমাভাবী সেই মানুষ যাঁর মনে কালো বলে কিছু নেই, কেবলই সাদা।
পুষ্পের সঙ্গে যার বিয়ে হচ্ছে সে হাসান ভাইদের পরিচিত। এই তথ্যটা জানা ছিল না। জানা থাকলে কী ঘটনাটা অন্যরকম ঘটতে পারত?