২
বড়কর্তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে-কয়ে— নানা পন্থায় তৈলমর্দন করে বৃহস্পতি-শুক্র-শনি—এই তিনদিনের ছুটি মঞ্জুর করানোর পর মঞ্জুরকৃত দরখাস্তের দিকে তাকিয়ে কেরামত আলী খেয়াল করল শুক্র-শনি এমনিতেই ছুটির দিন। অথচ ব্যাপারটা আগে একবারও খেয়াল হয় নি। হলে ছুটির দরখাস্তই করা লাগত না। বৃহস্পতিবার রাতে অথবা শুক্রবার ভোরে রওয়ানা দিলেই হত। বৃহস্পতিবার রাতে রওয়ানা দিলে শুক্রবার সকালে পোড়াদহ পৌঁছত আর শুক্রবার সকালে রওয়ানা দিলে দুপুর নাগাদ পৌঁছতে পারত। অনায়াসে উপস্থিত থাকতে পারত বাদ জুম্মার বরযাত্রীর দলে।
কেরামত আলী নিজের ভুলে নিজেকেই দোষারোপ করল আর নিজের মাথার দুচারটে চুল ছিঁড়ল। অবশ্য চুল ছিঁড়তে গিয়েও থামতে হল—কারণ, বয়স হয়েছে, বেশি ছেঁড়া যাবে না, শেষে আবার নিজের মাথাটি ভাঙা-হাটের মতো ফাঁকাটে হয়ে যায়, এই ভয়ে।
যাহোক।
লাগেজ টেনে শোবার ঘর থেকে বের হওয়ার আগে কেরামত আলী সোহাগ মেশানো আদুরে কণ্ঠে মিষ্টি একটি হাঁক ছাড়ল, ‘কই গো! কই গেলে তুমি?’
আঁচলে দুহাত মুছতে মুছতে ব্যস্তভঙ্গিতে মালেকা বিবি এসে বলল, ‘কী হয়েছে? ডাকছ কেনে?’
কেরামত আলী যেন বিস্ময়ের পাহাড় থেকে পড়ল। বলল, ‘বা রে! এত দূর যাচ্ছি। তুমি আমাকে বিদায় দেবে না?’
‘বিদায় দেব কেনে? তুমি কি সংসার ছেড়ে একবারেই চলে যাচ্ছ নাকি?’
‘তা যাব কেনে? আমি বলছি যে, এত দূরে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে স্ত্রী হিসেবে তোমার কি উচিত নয় আমাকে বিদায় দেওয়া?’
‘ও আচ্ছা—তাই বল। তোমার বিদায় নিতে খায়েস হয়েছে? বেশ দিচ্ছি। যাও— বিদায়।’
‘আহা, এ তো একবারে শুকনো বিদায়—কাঠখোট্টা। মরুসাহারার মতো।’
‘তা ভেজা বিদায় কেমনে দেব—বলে দাও দেকিনি?’
‘আমাকে জড়িয়ে ধর, মানে ইংরাজি ভাষায় যাকে বলে হাগ করা। তুমি আমাকে হাগ করে সিনেমার নায়িকাদের মতো অস্ফূট কণ্ঠে বল—ওগো! তুমি চলে যাচ্ছ—আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে—আমি সইতে পারছিনে।’
‘না বাপু! এ ধরনের গাঁজাখুরী কথাবার্তা আমায় দিয়ে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। মাফ কর আমায়।’
‘আহা সম্ভব নয় কেনে? স্বামীর মঙ্গল-যাত্রার জন্যে স্ত্রী হিসেবে এইটুকু করবে না? যদি আমার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে? দুঘর্টনায় পড়ে যদি আমার কোনো অঙ্গহানি ঘটে তবে কি ফিরে পাবে তা?’
মালেকা বিবি কেরামত আলীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জরিপ করে নিল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে বলছি—সাবধানে যেয়ো। সবসময় সাবধানে থেকো।’
‘উফ! হল না। আমায় হাগ করে বল। এস—আমি তোমাকে সাহায্য করছি।’
—কেরামত আলী মালেকা বিবিকে জড়িয়ে ধরার জন্য দুহাত প্রসারিত করতেই মালেকা বিবি পেছনে সরে গেল। গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার মতলবটা কী, বল তো শুনি?’
‘বিশ্বাস কর। আমার কোনো বাজে মতলব নেই। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।’
‘আবার ছুঁচ্ছ কেনে আমায়? বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে তোমায় ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যারামে ধরল কেনে, বল দেকিনি?’
কেরামত আলী বুঝল, মরুসাহারায় শত জলসিঞ্চন করেও লাভ হবে না। সে আশা জলাঞ্জলি দিয়ে, দীর্ঘতম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা যাই তবে!’
‘দাঁড়াও!’—হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় মালেকা বিবি হন্তদন্ত হয়ে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে কেরামত আলীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘নাও। এক চুমুকে পানিটুকু খেয়ে ফেলো দেকিনি।’
কেরামত আলী বাধ্য বালকের মতো পানি খেয়ে— গ্লাস ফেরত দিয়ে স্ত্রীর দিকে ঢলঢল চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর আবদারের সুরে বলল, ‘তোমার আঁচল দিয়ে আমার মুখটা অন্তত মুছে দাও না!’
‘তোমার ঢং দেখে বাঁচিনে!’— মালেকা বিবি শাসনের সুরে এই কথা বলতে বলতে আঁচল বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘নাও। নিজে মুছে নাও।’
কেরামত আলী অগত্যা তাই করল। তারপর স্ত্রীর দিকে গভীর আবেশ ভরা চোখে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন এক কপোত আর এক কপোতির দিকে ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের মতো কণ্ঠেও ঘোরাবেশ জড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে ছাড়া দুটো দিন থাকব—এই ভেবে বড় কষ্ট হচ্ছে গো। তুমি তো জানো, তুমি ছাড়া আমি কতটা অসহায়!’
—কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কেরামত আলী এই কথাগুলো বলার সময় মালেকা বিবি এক পা দুপা করে পিছিয়ে যেতে লাগল যাতে কেরামত আলী তার উপর আছড়ে পড়তে না পারে।
কিন্তু কেরামত আলীর কণ্ঠে কাঁদো কাঁদো ভাবটা এলেও শরীর সম্পূর্ণ ভারসাম্যের মধ্যেই ছিল দেখে মালেকা বিবি আশ্বস্ত হল।
‘এখনই না বেরুলে ট্রেন ফেল করবে’—বলে তাড়া দিল মালেকা বিবি।
কেরামত আলী হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই। ভালো থেকো। যাই।’
কেরামত আলী যথা সময়ে স্টেশনে পৌঁছল এবং ট্রেনও ছাড়ল সঠিক সময়ে।
পাশে বসা হোঁৎকা মোটা এক লোক পপকর্ন চিবিয়ে রস খেয়ে ছোবড়া ফেলে দিচ্ছিল মেঝেতে। কেরামত আলী তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, বেচারা পপকর্নের ভেতর রস কোথায় পাচ্ছে? চুষেইবা কী খাচ্ছে?
কেরামত আলীর এই অতি বিস্ময়ের শাস্তিস্বরূপ কি-না কে জানে, হোঁৎকা মোটা লোকটা হঠাৎ তার হাতে পপকর্নের প্যাকেটটি ধরিয়ে দিয়ে আরামসে জাবর কাটতে শুরু করল।
কেরামত আলী আঁৎকে উঠল এবং ভাবল, চেনা-নেই, জানা নেই—এভাবে হুট করে কারো হাতে পপকর্নের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া কোন ধরনের ভব্যতা? বেচারা আচ্ছা দুষ্টু লোক তো!
কিন্তু কে শোনে কার মনের কথা? জাবর কাটতে কাটতে লোকটা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়—সমুদ্রের ঢেউ যেমন তীরে এসে আছড়ে পড়ে তেমনি কিছুক্ষণ পর পর লোকটার মাথা কেরামত আলীর কাঁধের উপর ঢলে পড়তে লাগল।
কেরামত আলীর ভীষণ রাগ হল বটে কিন্তু লোকটার ঘুম ভাঙানোর সাহস করল না। ফলে সে নীরবে অপিরিচিত লোকটার অত্যাচার সহ্য করে চলল।
ট্রেন মাইলের পর মাইল অতিক্রম করতে লাগল কিন্তু লোকটার ঘুম ভাঙল না।
কেরামত আলী লোকটার উপর যতই বিরক্ত হোক তার পপকর্নের প্যাকেটটি ধরেই রইল। প্যাকেটটির দিকে তাকিয়ে ভাবল, সে কেন অন্যের খাওয়া প্যাকেট ধরে রাখবে? লোকটা তার আত্মীয়ও না বন্ধুও না। এমনকি সে কোনো অবুঝ শিশুও না।
কেরামত আলী যখন এইসব ভাবনা ভাবছে, ঠিক তখন লোকটার ঘুম ভাঙল এবং তার হাত থেকে পপকর্নের প্যাকেটটি ছোঁ মেরে নিয়ে আবার আগের মতো খেতে শুরু করল। কিন্তু পপকর্ন চিবোতে গিয়ে সে হয়তো আরাম পেল না, বরং বুঝতে পারল এতক্ষণের খোলা বাতাসে পপকর্ন পোতায়ে গিয়েছে, কামড় দিলে দাঁতের সঙ্গে আটকে যাচ্ছে—এ জিনিস আর খাওয়া সম্ভব নয়। তাই হতাশ হয়ে একবার পপকর্নের দিকে আর একবার কেরামত আলীর দিকে তাকাল।
কেরামত আলী চোখ ঘুরিয়ে নিল—মানে, দেখেও না দেখার ভান করল।
লোকটা পপকর্নের প্যাকেট কেরামত আলীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘খান।’
কেরামত আলী বলল, ‘না। ধন্যবাদ।’
‘আরে খান না। ভালোলাগবে।’
‘না না। আমি খাব না।’
‘আহা এত করে সাধছি—আপনি না খেলে আমার কষ্ট লাগবে না বুঝি?’
অগত্যা প্যাকেটটি নিল কেরামত আলী। আর হোঁৎকা লোকটা আবার চোখ বন্ধ করল।
সৌজন্য রক্ষার্থে কেরামত আলী দুটো পপকর্ন মুখে দিল বটে কিন্তু চিবোল না। মুখেই রেখে দিল। ভাবল, মুখের রসে তা আপনা-আপনি ভিজে-গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
পোড়াদহ স্টেশনে ট্রেন থামল।
লোকটা তখনো ঘুমিয়ে। বলতে কী—তার নাক-ডাকার শব্দ ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের সাথে টক্কর লাগতে লাগল।
তবে কেরামত আলী যেহেতু তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে সুতরাং সে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। অদ্ভুত লোকটাকে মনে মনে বিদায় জানিয়ে—সে উঠে পড়ল।
ট্রেন থেকে নামতেই অবর্ণনীয় ভিড়ের ঠেলা-ধাক্কায় তার হাত থেকে পপকর্নের প্যাকেটটি কখন পড়ে গেল—সে ঘূনাক্ষরেও টের পেল না। যদিও অনাকাক্সিক্ষত, তারপরও পপকর্নের প্যাকেট পড়ে যাওয়ার জন্য মনে মনে সে স্টেশনের ভিড়কে ধন্যবাদ দিল। আর তখন, বহুল প্রচলিত কথাটি মনে পড়ল তার—যা ঘটে ভালোর জন্যই ঘটে। সত্যিই তাই।
স্টেশনের ভিড় সাঁতরে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে একটু দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে এক কিশোর চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে— ‘চায়ে গরম চায়ে গরম’—বলে হাঁক ছাড়ছিল।
কেরামত আলী তার থেকে এক কাপ চা নিয়ে চুমুক দিতে না দিতেই জীর্ণ জামা পরিহিত হাড্ডিসার এক মধ্যবয়স্ক ভিক্ষুক এসে তার দিকে হাত পেতে বলল, ‘জনাব কিছু দেন?’
ভিক্ষুকটি এতটাই অধিকার নিয়ে কিছু চাইল, যেন তাদের মধ্যে কতকালের ব্যবসায়িক লেনদেন।
কেরামত আলীর খটকা লাগল, লোকটা এত অবলীলায় ভিক্ষা চাইছে বলে। কিন্তু সে এ ব্যাপারে কিছু বলল না। পকেট হাতরে পাঁচ টাকার একটি কয়েন পেল এবং সেটি তাকে দিল।
ভিক্ষুকটি বিড়বিড় করে বলল, ‘যা ভাবছিলাম তা নহে।’
‘এ্যাই দাঁড়াও!’
—ভিক্ষুকটি চলে যাচ্ছিল। কেরামত আলীর মনে হল—তাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না, অন্তত এটা জানা দরকার যে, সে কী ভেবেছিল!
ভিক্ষুকটি ফিরে এল এবং কেরামত আলী বলল, ‘যা ভেবেছিলাম তা নহে মানে কী? তুমি কী ভেবেছিলে?’
ভিক্ষুকটি এক গাল হেসে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না জনাব। আপনার চিহারা-সুরাৎ দেখে আমি ভাবছিলাম আপনি অন্তত দশ-বিশ টাকা দিবেন।’
কেরামত আলীর ইচ্ছে হল বেয়াদব ভিক্ষুকটার হাত থেকে পাঁচ টাকার কয়েনটি ফেরত নিয়ে নিতে—ঢাকা শহর হলে সে তাই করত—কিন্তু এটা পোড়াদহ—কী থেকে কী হয়ে যায় ভেবে নিজেকে সংবরণ করে নিল। নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত কথাটি বলল, ‘দেখ রে বাপু, টাকা-পয়সা খুবই খারাপ জিনিস। যখনই তোমার হাতে বেশি টাকা চলে আসবে তখন তোমার নিজেকে উজির-নাজির মনে হবে—নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না—বিপথে-কুপথে পতিত হবে—তাই কখনো বেশি টাকার লোভ করবে না। সবসময় মনে করবে, টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। আর ময়লা যত কম থাকে গায়ের জামাটি তত উজ্জ্বল থাকে, বুঝলে তো?’
ভিক্ষুকটি কেরামত আলীর হাতে পাঁচ টাকার কয়েনটি ফেরত দিয়ে বলল, ‘খুব বুঝলাম। আপনার লেকচার শুনতে বড়ই মধুর লাগল জনাব। যদি বেয়াদবি না নেন আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে চাই।’
কেরামত আলী বুঝতে পারল তার সামনে দাঁড়ানো ত্যাদর প্রকৃতির ভিক্ষুকের কাছ থেকে মানহানিকর কিছু শুনতে হবে—এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে সে তার দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ভিক্ষুকও তার দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিজ্ঞ মানুষের মতো বলতে লাগল, ‘আপনার যে মধুর ভাষা-জ্ঞান আপনি চাইলে ক্যানভাসার হতে পারবেন। বাসে বাসে খোস-পাঁচড়ার ওষুধ বিক্রি করে টাকা কামিয়ে লালে লাল হয়ে যেতে পারবেন।’
কেরামত আলী থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
ভিক্ষুকটি হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
‘টাকা যদি হাতের ময়লাই হবে তাইলে এই ময়লার জন্য দুনিয়ার সব মানুষ পাগল কেন স্যার?’—চাঅলা কিশোর ছেলেটির কথা শুনে যেন সম্বিত ফিরে পেল কেরামত আলী। সে চাঅলার দিকে তাকাল।
‘আপনার পকেটে যত ময়লা আছে—সব আমাকে দিয়ে দেন স্যার।’
কেরামত আলী বলল, ‘তোমার নাম কী?’
‘আমার নাম জেনে বুঝি টাকা দিবেন স্যার?’
‘আগে তোমার নামটা শুনি।’
‘আমার নাম শহর আলী।’
‘আমাকে দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?’
‘সত্যি কথা বলব নাকি মিথ্যা কথা বলব স্যার?’
‘সত্যি কথা বল।’
‘মাইন্ড করবেন না তো স্যার?’
‘না। তুমি নিঃসঙ্কোচে বল।’
‘আপনি একটা ভোদাই।’
চাঅলার বেফাঁস কথা শুনে কেরামত আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। দ্রুত পকেটে হাত দিয়ে বিশ টাকার একটি নোট বের করে চাঅলার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার চায়ের দাম কত?’
‘দশ টাকা স্যার।’
ডানে-বামে তাকিয়ে কেরামত আলী বলল, ‘যদি চায়ের দাম বিশ টাকা পেতে চাও তাহলে তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নাও।’
‘কথা ফিরিয়ে নিব মানে? আর একটু বুঝিয়ে বলেন স্যার।’
‘তুমি যদি আমাকে ভদ্রলোক বল তবে তুমি এক কাপ চায়ের দাম কুড়ি টাকা পাবে।’
‘মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে আপনাকে ভোদাই থেকে ভদ্রলোক বানিয়ে দিব? তা হয় না স্যার। কমপক্ষে পঞ্চাশ টাকা দেন, আপনি যা চাচ্ছেন তা বলে দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’—কেরামত আলী তাকে পঞ্চাশ টাকা দিল।
চাঅলা বলল, ‘বেকুব ভদ্রলোক।’
‘কী! ভদ্রলোকের আগে আবার বেকুব বসালে কেন? কাটো। বেকুব কাটো।’
‘জি স্যার কেটে দিলাম। আপনি শুধুই ভদ্রলোক।’
বিকেল নাগাদ আলমডাঙ্গার কদমতলা পৌঁছল কেরামত আলী।
খালাবাড়ি সংক্রান্ত ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি তার মনে দোলা দিতে লাগল। বিশেষ করে সারিয়াকান্দা বিলে মাছ ধরার স্মৃতি!
সকাল সকাল বশিরুল্লাহ আর সে দৌজাল নিয়ে মাছ ধরতে যেত। তারা যখন কচুরিপানা বা কোনো ঝোপ ঘিরে খ্যাও দিত লাফিয়ে উঠত ঝাঁকেঝাঁক রুই-কাতলা। সেখান থেকে দুচারটে মাছ জালে আটকা পড়তই।
একবার একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছিল—তাকে অবশ্য দুর্ঘটনা বলাই ভালো—বড় একটা রুই মাছ লাফ দিয়ে এসে পড়েছিল তার মুখের উপর। তার ঠোঁট কেটে গিয়েছিল। রক্ত ঝরছিল ফিনকি দিয়ে।
দূর্বাঘাস চিবিয়ে ক্ষতস্থানে চেপে ধরে বশিরুল্লাহ হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘তুমি সৌভাগ্যবান কেরামতদা। তাই তো পেলে মাছের চুম্মা!’
স্মৃতিসাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে কেরামত আলী খালাবাড়ির সামনে পৌঁছল। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে দিতে একবার উঠোনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে পড়ল।
অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে সেখানে। কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছে তেঁতুলগাছ তলে। আম গাছ তলে। কাঁঠাল গাছ তলে। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে মহিলাদের মিহিকান্নার সুর! ভয়ে কেরামত আলীর পেটের ভাত চাল হয়ে যাওয়ার দশা হল।
আগামিকাল যে বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান সে বাড়িতে থাকবে আনন্দের সুর, তা না, ভেসে আসছে কান্নার সুর। নিশ্চয় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে!
কেরামত আলীকে দেখে বশিরুল্লাহর পাড়াত ভাই মজিদ উঠোন থেকে ২০০ মিটার দৌড় মারল। অতি অল্প সময়ে পালান পেরিয়ে রাস্তায় নাম— যেখানে কেরামত আলী দাঁড়িয়ে। ২০০ মিটার দৌড়ের গতিশক্তি সামাল দিতে হল কেরামত আলীকে—মজিদকে জড়িয়ে ধরে।
মজিদ আহাজারি করে বলতে লাগল, ‘বশিরুল্লাহ নাই! নাই গো কেরামতদা!’
কেরামত আলী বলল, ‘নাই মানে? কই গেছে?’
‘ওই পাড়ে চলে গেছে গো কেরামতদা।’
‘এ কি বলছ! কীভাবে এমনটা হল?’
‘খুন হয়েছে গো দাদা—বশিরুল্লাহ খুন হয়েছে!’
(চলবে)