কেউ জানতে চায় নি

জানালার পর্দা সরাতেই একরাশ অলজ্জ আলো এসে ভরিয়ে দেয় ছোট ঘরটিকে। প্রাত্যহিকতা সেরে রাকিব মার ঘরে উঁকি দেয়। মা একমনে সেলাই করছেন। দরজায় খুট করে শব্দ হতে চোখ তুলে তাকান।
কিরে এতক্ষণে তোর ওঠার সময় হলো? নাস্তা খাবি না?
আমি খেয়ে নিচ্ছি, তুমি ব্যস্ত হয়ো না।
বাইরে যাবি কোথাও?
হুম আজ আরেকটা ইন্টারভিউ আছে। তোমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা হবে?
এত টাকা কী দরকার?
আছে একটা দরকার, তোমার এসব টাকা তো আমি শোধ করে দেব ।
মা মুচকি হেসে বলে তোদের কাছে যে আমার কত টাকা পাওনা আছে তা শোধ করতে পারবি সব?
চেষ্টা তো করি।
মা সেলাইয়ের মেশিন ছেড়ে উঠে তোষকের নিচ থেকে আলমারির চাবি বের করে। চাবিটা দিয়ে আলমারির গোপন ড্রয়ার খুলতেই জোরে খুট করে একটা শব্দ হয়।রাকিব ছোটবেলা থেকেই এই শব্দ শুনে অভ্যস্ত। নিজের ঘর থেকেও সবসময় এই গোপন ড্রয়ার খোলার শব্দ শোনা যায়। গোপনীয়তা আর রক্ষা হয় না। মানুষ যা কিছু গোপন করতে চায় তা আরো বেশি প্রকাশিত হয়ে পড়তে চায় যেন। রাকিবের মা যখন আলমারি খোলেন তখন তাঁর মেজাজ খুব ভালো থাকে কারণ আলমারিটা তাঁর প্রিয় একটা বস্তু। বাবার বাড়ি থেকে আনা।রাকিবের নানা মোতালেব সরকার পাকিস্তানের করাচি থেকে সত্তর সালে আলমারিসহ আরো বহু মালপত্র নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। সঙ্গে স্ত্রী, দুই মেয়ে,দুই ছেলেসহ বহু স্মৃতি। রাকিবের নানা করাচিতে খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। খুব বড় কোনো চাকরি নয়, ছোটোখাটো কেরানির পদ।কিন্তু ওই সময়ে পাকিস্তানে একটা ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করাও সহজ ছিল না। এজন্য রাকিবের নানাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। দুঃসম্পর্কের খালু এমদাদুল হক তখন খাদ্য অধিদপ্তরের বড় পদে কর্মরত। রাকিবের নানা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে খালুর কাছে চাকরির জন্য অনেক তদবির করেন,আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে অনুরোধ করেন। এমদাদ সাহেব রাকিবের নানাকে করাচিতে আসতে বলেন। ওখানে তিনি নিজ গরজে রাকিবের নানাকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। এটা ১৯৫৮ সালের কথা,তখন বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা টালমাটাল। ভাষা আন্দোলনের জোয়ার রয়ে গেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে, দেশে থমথমে অবস্থা। লেখাপড়া শিখলেও চাকরি-বাকরির তেমন কোনো সুযোগ নাই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বড় বড় পদ দখল করেছিল,ছোট ছোট পদগুলো বাঙালিদের জন্য বরাদ্দকৃত।রাকিবের নানা করাচিতে চাকরিতে ঢুকে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পান। এমদাদ সাহেবের বাসার কেয়ার টেকারের ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হয়। এমদাদ সাহেবের দুই মেয়ে রাখী আর ছবির দেখাশোনার ভার কিছুটা নিতে হয়। কোয়াটারের পাশেই অফিস। দুপুরে বাসায় দুপুরে ভাত খেতে আসতেন রাকিবের নানা। খাবার ওনার ঘরে পৌঁছে দেয়া হতো। এমদাদ সাহেবদের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার নিয়ম ছিল না। খালুর বাড়িতে কিছুটা গুটিয়ে থাকতে হতো। সন্ধ্যায় রাখী, ছবিকে নিয়ে পড়তে বসাতেন, ওদেরকে নিয়ে রাতে বাগানে হাঁটতে যেতেন। এমদাদ সাহেবের স্ত্রী বেশ অসুস্থ ছিলেন। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতেন, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতে পারতেন না, রক্তচাপের জন্য জল চিকিৎসা করতেন। এক বালতিতে গরম পানি, অন্য বালতিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে পা বদল করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। রাকিবের নানা মোতালেব সরকার কয়েক বছর পর দেশে এক সচ্ছল পরিবারের আইএ পাস মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর করাচিতে ছোট এক বাসা ভাড়া করে স্ত্রীকে নিয়ে যান। ওখানে দুই মেয়ে তিন ছেলের জন্ম হয়। ছোট ছেলে জন্মের সময় মারা যায়। পাকিস্তানের নানা প্রদেশের লোকেরা ছিল ওদের প্রতিবেশী। তারা মোতালেব সরকার ও জোবেদা বেগম এর সাথে অত্যন্ত সদ্ভাব রাখতো। জোবেদা বেগম এক পাঞ্জাবি মহিলার ঘরে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। ওই পাঞ্জাবি মহিলা একটা বড় গামলায় আটা ময়ান করে রেখে দিতেন। পরদিন সকালে রুটি বানিয়ে দোকানে পাঠানো হতো সেঁকার জন্য। বড় বড় মুখওয়ালা চুলায় রুটিগুলো সেঁকা হতো। রুটিগুলো এত বড় হতো একটা রুটি দিয়েই দুজন খেতে পারতো। পাঞ্জাবি মহিলা বিকালে খাসি বা দুম্বার মাংস রান্না করতো। রান্নার গন্ধে সারা ঘর ভরে যেত। জোবেদা বেগম বিকালে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন,পাঞ্জাবি মহিলা সবাইকে গাজরের বা ময়দা আর বাদাম মিশ্রিত বরফি খেতে দিতেন। রাকিবের মায়ের এখনও সব কথা স্পষ্ট মনে আছে। একবার সবাই মিলে ক্লিফটনে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ক্লিফটনের সমুদ্রের পাড়ে তখন বেশি ভিড় হতো না। ওই সময়ে করাচিতে বসবাসরত বাঙালিরা একসাথে মিলে পিকনিকে যেতেন। রাকিবের নানা পরিবার নিয়ে করাচির অনেক জায়গায় ঘুরছেন। তখনকার করাচির সমাজের সাধারণ মানুষেরা বাঙালিদের সাথে তাদের কোনো পার্থক্য করতো না,কিন্তু রাজনীতি তা করেছিল। পাকিস্তান সরকারের দু-চক্ষু নীতি বাঙালিদের কোনঠাসা করে রেখেছিলো, তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
সত্তর সালে রাকিবের নানাকে ঢাকায় বদলি করে দেয়া হয়। ওনার খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু একাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন একরকম শাপেবর হয়েছে ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলেন।এমদাদ সাহেব পরিবার নিয়ে করাচিতে আটকা পড়েন। ওই সময় এমদাদ সাহেব এবং তাঁর পরিবারকে নানা কষ্ট ভোগ করতে হয়। যুদ্ধের মাঝামাঝি বহু বাঙালিকে আটক করে ক্যাম্পে রাখা হয়। লম্বা টানা বিল্ডিংয়ের এক ঘরে কয়েকটি পরিবারকে থাকতে হতো। বাঙালি পরিবারগুলো টাকা-পয়সা গয়নাগাটি ছাড়া আর কিছুই সাথে নিতে পারে নাই। মোটা মোটা রুটি আর পাতলা ডাল দেয়া হতো খেতে। সে রুটি খাওয়া যেতো না। এত শক্ত ছিল দাঁত বসানো যেতো না, পানিতে ভিজিয়ে রেখে খেতে হতো। দু-একদিন ভাত দেয়া হতো,চালে পোকা ভর্তি,দুর্গন্ধ যুক্ত। সে ভাত কেউ খেতে পারতো না। বারান্দা দিয়ে সামনের খোলা জায়গায় সবাই ভাত ছুঁড়ে ফেলে দিতো। কাক এসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাত খেত। এক রাতে এমদাদ সাহেবরা খবর পায় দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে কিন্তু ক্যাম্পের একজন বাঙালিকেও জীবিত রাখা হবে না। ক্যাম্পের সামনে বড় বড় গর্ত করা হয়। সবাই নিজের কবরের সামনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে,এ যেন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। এভাবে দু-তিনদিন কাটার পর সব শান্ত হয়ে আসে। ক্যাম্পের বাঙালিরা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে। বাহাত্তর সালে বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এমদাদ সাহেব এবং তার পরিবার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এয়ারপোর্টে সবাইকে মোটা মোটা বনরুটি খেতে দেয়া হয় আর সাথে কিছু যাতায়াত খরচ দেয়া হয়। করাচি থেকে ফেরত আসা বাঙালিরা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি দেশে ফিরতে পারবেন। দেশে ফিরে এমদাদ সাহেব কিছুদিন রাকিবের নানা মোতালেব সরকারের পুরানা পল্টনের ছোট ভাড়া বাসায় এসে ওঠেন। করাচির ঠাট-ঠমক, জৌলুশ সব হারিয়ে কিছুদিন আশ্রিতের মতো জীবন কাটাতে হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে এমদাদ সাহেব চাকরি ফিরে পেলেও বেশিদিন সে চাকরি করতে পারেন নাই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মোতালেব সরকারও যুদ্ধের পর পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকেন। অল্প বেতন আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাঁকে দ্রুত বয়স্ক করে তোলে। ক্ষমতাসীন দলের এক পাণ্ডাকে ধরে রেশন কার্ড বানিয়ে নেন। রাকিবের মা হাসিনা বেগম পঁচাত্তর সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন অফিসারের সাথে। বিয়ের বারো বছর পর রাকিবের বাবা মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। তারপর থেকে হাসিনা বেগম ছেলেকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। রাকিবের নানার ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে একটা জমি ছিল। ওখানে রাকিবের মামারা তিন রুমের একটা বাসা বানিয়ে দেয়। রাকিবের বাবার অফিস থেকে পাওয়া কিছু টাকা আর রাকিবের দাদাবাড়ির জমি থেকে কিছু আয় আসতো,তা দিয়ে কষ্টে কেটেছে দুজনের সংসার। হাসিনা বেগম সেলাইয়ের মেশিনে এলাকার মেয়েদের কাপড় সেলাই করে আর শীতকালে উলের মেশিনে সোয়েটার বুনে কিছু রোজগার করতেন। ক্লাস এইট থেকেই রাকিব টিউশনি শুরু করে। স্কুলে ভালো ছাত্র হওয়াতে ছোট ক্লাসের ছেলেদের পড়ানোর সুযোগ পায়। এসএসসি পাশ করার পর একটা কোচিংয়ে যোগ দেয়। বিকালে ক্লাস নিতে শুরু করে।

২.
আজ শান্তার জন্মদিন। রাস্তায় বেরিয়ে রাকিব ভাবতে থাকে, ওর জন্য কী কেনা যায়? বেশ অনেকদিন ধরেই শান্তার জন্য মনের ভেতর একটি অনুভূতি তৈরি হয়েছে। প্রায় সন্ধ্যায় শান্তাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় যায় রাকিব। আজ বিকালে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে মহাখালীতে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট নামের একটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পৌঁছে যায়। বাসে প্রচণ্ড ভিড় গরমে ঘেমে-নেয়ে একদম চ্যাপ্টা হয়ে অফিসে এসে ঢোকে। খাজা টাওয়ারে লিফটে সাত তলায় অফিস। রিসেপশনে বেশ ফ্যাশান দুরস্ত এক মেয়ে বসে আছে। হাতাকাটা ব্লাউজের সাথে আড়ংয়ের ব্লকের শাড়ি পরা, চুল বব ছাট, কড়া মেকআপ। ওখানে আরো ছয়জন চাকরিপ্রার্থী বসেছিল। রিসেপশনিস্ট এসে বলে আরো দেড় ঘন্টা পর ইন্টারভিউ শুরু হবে, ডিরেক্টর স্যার একটা জরুরি কাজে আটকে যাওয়াতে আসতে দেরি হচ্ছে। রাকিব ফাইল হাতে বসে থাকে, ওর পাশেই সালোয়ার-কামিজ পরা এক দীর্ঘাঙ্গী তরুণী।
এক্সকিউস মি,কথা বলতে পারি? মেয়েটি বলে।
অবশ্যই, রাকিব বলে।
এখানে কি রেস্টুরেন্ট আছে আশেপাশে?
রাকিব চশমাটা ঠিক করে পরে বলে, আছে রাস্তার ঐপারে ।
মেয়েটি বলে, আমি আসলে নাস্তা করে আসি নি।
চলে যান ভালো রেস্টুরেন্ট।
আপনি খেয়েছেন? কিছু মনে না করলে চলুন এক কাপ চা খাবেন। ওদের তো শুরু করতে দেরি আছে ।
রাকিব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে আচ্ছা চলুন, আপনার যদি কোনো অসুবিধা না হয়।
আরে না কেন, আমিই তো আপনাকে অফার করলাম। মেয়েটার চেহারায় একটা পোড়া পোড়া ছাপ, মনে হয় এককালে রোদে ঘোরাঘুরি করেছে অনেক।
লিফটে নামতে নামতে মেয়েটি বলে আপনার কি মনে হয় এখানে চাকরি হবে?
রাকিব হেসে বলে ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে, তাও চেষ্টা করতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
ও আচ্ছা।
এছাড়া আর কিছু করারও নেই, চাকরির চেষ্টা তো করে যেতেই হবে।
মহাখালীর রাস্তায় শতশত লোক চলাচল করছে। ডাচ বাংলা ব্যাংকের পাশেই ডিঙ্গি রেস্তোরাঁ, লোক গিজগিজ করছে। ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে বলে আসেন স্যার ভিতরে আসেন।
রাকিব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ওয়েটার বলে স্যার,ম্যাডাম,ভেতরে জায়গা আছে।
একটা টেবিলে নাস্তা খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। উঁচু করে পনিটেল করা একটা মেয়ে জিন্স টপস পরা, পায়ে কেডস, সাথে বেশ সুদর্শন এক যুবক। ওদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে, দুজনে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে যায়। দুজনের পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। মহাখালীর আশেপাশে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ওখানকার ছাত্র হয়তো।
রাকিব আর মেয়েটি মুখোমুখি বসে।
রাকিব বলে কি খাবেন বলুন।
মেয়েটি হেসে বলে এখনো কিন্তু আপনার নামটা জানা হলো না।
রাকিব। আপনার?
সোহিনী।
বাহ খুব সুন্দর নাম । আপনার নামের অর্থটাও সুন্দর শোভাবতী বা সোহাগিনী।
বাহ্ আপনি আমার নামের অর্থ জানেন?
এই জানি আর কী!
সোহিনী হাসি হাসি মুখ করে ওয়েটারকে ইশারায় ডাকে, কী নাস্তা আছে?
ম্যাডাম, পরাটা, গরু ভুনা, সবজি, ডিম, সুজি।
পরোটা, দুটো ডিম মামলেট আর সবজি নিয়ে আসো। সাথে দুটো মিনারেল ওয়াটার।
ম্যাডাম চা?
চা পরে দিয়ো। আমার চিনি ছাড়া আপনার?
রাকিব বলে আমি চিনি দিয়ে। কিন্তু এখন এতো নাস্তা খেতে পারবো না।
আরে পারবেন, একটা পরোটা খাওয়া কোনো ব্যাপার না।
সোহিনী হাসলে গালে টোলপড়ে। রাকিব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চায়, আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে।
ওহ তাই? বাহ্। আমি কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছি ওখানে, দারুন জায়গা। ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকটা অসাধারণ।
কবে গিয়েছিলেন?
এই কয়েক বছর আগে মাস্টার্স পড়ার সময় শেষ গিয়েছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সাথে জাহাঙ্গীরনগরের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের একটা যৌথ সেমিনার ছিল ।
ও আপনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন?
রাকিব একটা হাসি দিয়ে বলে পড়েছি কতটুকু জানি না, তবে পড়ি নাই যে কিছুই এখন তা বুঝতে পারি।
হা হা হা আপনি তো মজা করে কথা বলেন।
দোকানের ছেলেটি নাস্তা এনে টেবিলে সাজিয়ে দেয়, সাথে এক প্লেট শশা চাক চাক করে কাটা। রাকিব শসার মধ্যে মিনারেল ওয়াটার ঢালে কিছুটা।
সোহিনী জানতে চায় বাইরের খাবার কম খান?
আরে না প্রচুর খাই, আর সেজন্যই দুবার জন্ডিস হয়েছে, হেপাটাইটিস ই ভাইরাস।
তাই নাকি?
হ্যাঁ এজন্য বাইরের কাঁচা সালাদ একটু ধুয়ে নেই, সেদ্ধ হলে তো জীবাণু থাকে না তেমন।
আমার কখনো হয়নি, তবে হলে মেয়েদের প্রায়ই হতো শুনেছি।
আপনি হলে থাকতেন?
হ্যাঁ, প্রীতিলতা হলে।
ওটা তো খুব সুন্দর, একদম লেকের কোল ঘেঁষে।
জাহাঙ্গীরনগর আপনার খুব ভালো লাগে?
হ্যাঁ প্রাকৃতিক পরিবেশ, গাছপালা, পাখি এখন ঢাকা শহরে নেই বললেই চলে। আমার ইউনিভার্সিটির আশেপাশে গাছপালা কিছু আছে, কিন্তু এত গাড়ি-ঘোড়া, নির্জনতা বলে কিছু নাই।
ডিম দিয়ে পরোটা খেতে খেতে রাকিব একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
সোহিনী ছেলেটাকে ডেকে চা দিতে বলে। নাস্তা শেষ করে দুজনে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য খাজা টাওয়ারে ফিরে এসে অফিসের রিসেপশনে বসে। দুজন কোট-টাই পরা ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। মনে হচ্ছে এরা ইন্টারভিউ নেবে।
প্রথমেই রাকিবের ডাক পড়েছে।
স্লামালাইকুম।
ধন্যবাদ বসুন।
ধন্যবাদ।
রাকিব আহমেদ আপনি পাশ করেছেন দু’বছর, এখনও কোথাও চাকরি করেন নি?
রাকিব বলে আমি ইউনিভার্সিটিতে এমফিল করছি সেজন্য পার্মানেন্ট চাকরিতে ঢুকি নাই এখনো। পার্ট-টাইম কিছু কাজ করেছি।
কিন্তু এম ফিলের কথা তো সিভিতে উল্লেখ করেননি।
করিনি কারণ এটা সমস্যা তৈরি করে, এমফিল দেখলে অনেকে ভাবে শিক্ষকতা করবো, তাই চাকরি দিতে চায় না।
আপনার রেজাল্ট তো অনেক ভালো। আমাদের এখানে চাকরি করবেন?
করবো বলেই তো এসেছি, আসলে স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ে আমার ঝোঁক আছে। কিছু কাজ করেছি, সে আগ্রহ থেকেই এসেছি।
খুব ভাল। আমরা কিন্তু খুব বেশি বেতন দিতে পারবো না, কোট পরা ভদ্রলোক বলেন।
একজন বেশ সুদর্শন,বব করে চুল ছাঁটা ভদ্রমহিলা জানতে চান আপনার ইনডিজেনাস পিপল বিষয়ে ইন্টারেস্ট আছে? পড়াশোনা আছে?
রাকিব বলে হুম আছে। আমাদের অ্যানথ্রোপলজির একটা কোর্স ছিল, অনেক কিছুই পড়েছি।
আর রিসার্চ, মেথডোলজি?
হ্যাঁ পড়াশোনা আছে কিছু।
রাকিব টেবিলের এক পাশে বসে ভাবছিল চাকরিটা কি শেষ পর্যন্ত পেয়ে যাচ্ছে?
লাল টাই পরা ভদ্রলোক রাকিবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উইশ ইউ গুড লাক। আমরা ফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। রাকিব হাত মিলিয়ে বাইরে আসে।
সোহিনী এক কোনায় বসে ছিল। রাকিবকে বের হতে দেখে এগিয়ে আসে, কেমন হলো ইন্টারভিউ? ভালো, মনে তো হচ্ছে চাকরিটা হয়ে যাবে।
তাই? তাহলে আমাদের ইন্টারভিউ দিয়ে লাভ নেই।
আরে না, এমনি বললাম সবার সাথেই ওরা এমন ব্যবহার করে।নাটকের ছেলেমেয়েদের ওদের দরকার আছে ।
সোহিনী একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে।
আমি তাহলে আসি বলে রাকিব চলে যেতে উদ্যত হলে সোহিনী বলে আপনার মোবাইল নম্বরটা রাখা যাবে?
অবশ্যই,আমি ভুলে গিয়েছিলাম। নিজের নম্বরটা দিয়ে সোহিনীর নম্বরটা মোবাইলে সেভ করে নেয় ।
ভালো থাকবেন সোহিনী, পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।
আপনিও ভালো থাকবেন।
রাস্তায় বের হয়ে রাকিব একটা সিগারেট ধরায়। দিনে চার পাঁচটার বেশি সিগারেট এখন খায় না। এতে খরচ বাঁচে আর অভ্যাসটাকে একটু বদলাতে চাচ্ছে। ছাত্র অবস্থায় দিনে দশ পনেরোটা সিগারেট খেতো।
রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট, এ সময় বাসে ওঠা যাবে না। একটা সিএনজি নিয়ে শাহবাগে আজিজ মার্কেটে আসে। শান্তা বই খুব পছন্দ করে, সারাদিন গল্প উপন্যাস পড়ে। ওদের বাসায় গেলেই দেখেছে ওর হাতে একটা না একটা বই, কবিতাও পড়ে। শান্তার প্রিয় লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। আজিজ মার্কেটে ঘুরে বেশ কিছু বই কিনে ফেলে রাকিব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দুই তীর, শহীদুল জহিরের উপন্যাস সমগ্র, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতাসংগ্রহ। নানা পত্রিকায় সুব্রত অগাস্টিনের বেশ কিছু কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে। পুলিপোলাও অসাধারণ। উইলিয়াম ব্লেক, শেক্সপিয়ার, এমিলি ডিকিনসনের অনুবাদও দারুন। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাকিব কবিতা লেখে, কিছু গল্প আছে। একটা উপন্যাস লিখেছে দেশভাগের বিষয় নিয়ে, উৎপাটন নামে। একটা সাহিত্য পত্রিকায় উপন্যাসটা ছাপা হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় ইংরেজি কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে কিছু প্রবন্ধ, রচনা লিখেছে। সেসব দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছে। সেই সূত্রে সাহিত্য জগতের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে নতুনদের লেখা কেউ ছাপতে চায় না। বেশ ভারী প্রবন্ধ হলে ছাপা হয়। রাকিবের খুব খিদে পেয়ে গেছে, আজিজ মার্কেট থেকে বেরিয়ে শাহবাগে আসে। মৌলি রেস্তোরাঁয় ঢুকে নান রুটি, গরু ভুনা আর বুটের ডালের তরকারি নেয়। বাইরের খাবার খেতে একটু অস্বস্তি হয়, কিন্তু এখন আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। প্রায় চারটা বাজতে চলেছে, মৌলি থেকে বের হতেই সৈকতের সাথে দেখা।
আরে কি খবর রাকিব, কেমন আছিস?
ভালো, তোর কী অবস্থা?
আমার অবস্থা তো ফাটাফাটি মামু।
হা হা হা তাই নাকি?
হ্যাঁ সোনারগাঁ হোটেলে কাজ করতে গিয়ে কত লোকের সাথে যে পরিচয় হলো, নানা অভিজ্ঞতা। তুই ওখানে চাকরি করলে শঙ্করের মতো দুচারটে উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতি।
ধুর লেখা এতো সহজ না ।
তুই তো একদিনও আসলি না আমার অফিসে।
সময় পাই না।
সময় পাবি না কেন এখনও তো ডিপার্টমেন্টে জয়েন করিস নাই।
আরে কিসের ডিপার্টমেন্ট!
কেন কবিরের কাছে শুনলাম তোর এমফিলের রেজাল্ট হলেই ওরা সার্কুলেশন দেবে।
খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমার রেজাল্টের জন্য বসে আছে।
তোকে ওরা অবশ্যই নেবে, এমন জুয়েলকে হাতছাড়া করবে না।
আচ্ছা যখন নেবে তখন দেখা যাবে, আজ একটা এন-জি-ওতে ইন্টারভিউ দিলাম, ওরা ডাকলে ফুলটাইম কাজ শুরু করে দেবো।
কিন্তু তোর এমফিল?
ওটা অলমোস্ট কমপ্লিট। আর যা কাজ আছে চাকরির সাথে করতে পারব, এভাবে আর ভালো লাগছে না।
দেখ যেটা ভালো হয়, শোন আমার এখনই যেতে হবে কিছু কাজ বাকি আছে।
ওকে দেখা হবে ফোন করিস, বাসায় আসিস।
রাকিব পাঠক সমাবেশে বসে উত্তর আধুনিক কবিতার সংকলনটা দেখলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বাজে। এতো তাড়াতাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। আরো কিছুক্ষণ বই দেখে পৌনে ছয়টার দিকে শান্তাদের এরোপ্লেন মসজিদের গলিতে যায়। গলির মুখে রিকশা ছেড়ে কিছুটা পায়ে হেঁটে শান্তাদের তিনতলা বাড়ির সামনে পৌঁছায়। একটা মাধবীলতা প্রায় ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে, গাছ ফুলে ভর্তি। বাসার সামনে দুটো গাড়ি। শান্তার জন্মদিনে কোনো পার্টি হচ্ছে নাকি? রাকিব একটু ইতস্তত করে তিনতলায় উঠে বেল বাজায়। নিচের গেট খোলা ছিল, শান্তা এসে দরজা খুলে দেয়। রাকিব ভাই, শান্তার চোখে বেশ একটা খুশি ঝলকে ওঠে। যাক রাকিব কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে।
শুভ জন্মদিন শান্তা কেমন আছো?
আমি ভালো আছি, আপনি আসবেন ফোনে জানালেন না তো। যদি বাসায় না থাকতাম।
অনেকটা রিস্ক নিয়েই এসেছি, মনে হচ্ছিল তুমি থাকবে।
রাকিব বইয়ের প্যাকেটটা শান্তার হাতে দেয়।
বই? শান্তা খুব দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলে চিৎকার করে ওঠে। আমার প্রিয় লেখকদের বই, অনেক ধন্যবাদ।
রাকিব সোফার দিকে তাকিয়ে দেখে শান্তার বন্ধু মেরিনা আর আইরিন বসে আছে। সবাই রাকিবকে ঘিরে ধরে বলে খুব ভালো হয়েছে, আজ আমরা রাকিব ভাইয়ের গান শুনবো। শান্তা ভেতরের ঘরে চলে যায়, শান্তার মা এসে ড্রয়িং রুমে বসে রাকিবের কুশল জানতে চায়। ভেতর থেকে শান্তা একটা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে এসেছে, কপালে নীল টিপ। বেশ স্নিগ্ধ একটা লাবণ্য চোখে-মুখে। রাকিব কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ওর ভেতর একটা অস্থিরতা কাজ করছে। ইচ্ছে করছে শান্তার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে। কিন্তু সেটা আজ সম্ভব না। সাতটার দিকে কেক কাটা হয়। রাকিবকে চার-পাঁচটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হয়। রাতে মোরগ- পোলাও খেয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়।
রাকিব চলে আসার সময় শান্তা নিচে নেমে আসে। রাকিব ভাই, আমি খুব খুশি হয়েছি আপনি আসাতে।
তোমার জন্মদিনে আমি আসবো না?
শান্তা রাকিবের কণ্ঠের উত্তাপ টের পায়।
শান্তা কাল তোমার সময় হবে?
কখন?
যেকোনো সময়, আমি সকাল থেকেই ডিপার্টমেন্টে থাকবো।
আমি ফোন করবো আসলে।
রাকিব রাতে অনেকবার ভাবে ফোন করবে, কিন্তু বেশি রাত হয়ে গেছে তাই আর করা হয় না। শেষে মেসেজ পাঠায়। নীল শাড়িতে তোমাকে আজ দারুন লাগছিলো।
সাথে সাথে উত্তর, আপনাকেও কেমন অন্যরকম লাগছিল।
তাই?
হুম।
কী রকম?
কেমন যেন অন্যমনষ্ক, কোনো স্বপ্নের ঘোরে ছিলেন।
তুমি বুঝতে পেরেছো?
আমি কেন? সবাই বুঝতে পারবে। আপনি তো খুব এক্সপ্রেসিভ।
ও আচ্ছা তাহলে তো মুশকিল।
মুশকিল কেন?
সবাই সবকিছু বুঝে ফেলবে।
ভালই তো।
হুম, তবে তোমাকে একদমই বোঝা যায় না, কেমন যেন আলাদা আবরণ চোখে মুখে। সেজন্য আমি যা বলতে চাই তা বলতে পারি না।
কিছু বলবেন?
বলবো, তবে এখন না, দেখা হলে। শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত