কেউ জানতে চায়নি (তৃতীয় , চতুর্থ , পঞ্চম অংশ )


হাসিনা বেগম সারাদিন ধরে ঘরের কাজ করেন। কাজ যেন শেষ হতে চায় না। একটা শেষ হলেই অন্য একটা এসে সামনে দাঁড়ায়। দুপুরে চাপিলা মাছ আর বেগুন দিয়ে মাখা মাখা করে রাঁধেন, সাথে চিচিঙ্গা সরু করে কেটে ভাজি আর পাতলা ডাল। তেঁতুল আর লাউ দিয়ে একটা টক রান্না করেন। রাকিব ভাতের সাথে টক খেতে পছন্দ করে। হাসিনা বেগমের সংসার সাতাশ বছরের। এর মধ্যে মাত্র বারো বছর স্বামীর সাথে সংসার। দাম্পত্য বিষয়টি বোঝার আগেই স্বামী আব্দুল লতিফ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। বিয়ের পর দুজনে খুব ঘুরে বেড়িয়েছে। রাকিবের বাবা স্ত্রীকে নিয়ে মাসে একবার বলাকা না হলে গুলিস্তান সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতো। ববিতার বসুন্ধরা সিনেমাটার কথা খুব মনে হয় হাসিনা বেগমের। ফেরার পথে দুজনে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে রাতের খাবার খেয়েছিল। রেস্টুরেন্টের নাম রঁদেভু সুন্দরম, মতিঝিলে। হাসিনা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। এখন ছেলে রাকিবকে ঘিরেই তার জীবন। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের অল্প বয়সে স্বামী মারা গেলে কঠিন সময় পার করতে হয়। রাকিবের বাবার মৃত্যুর পর অনেকেই হাসিনা বেগমকে বিয়ে করতে উপদেশ দেয়। ভাইয়েরা মৃতদার,বিপত্নীক বেশ কিছু বিয়ের প্রস্তাব আনে। ওরা বোঝায় তোর এত অল্প বয়স একা একা এত বড় জীবন কাটাবি কীভাবে? ছেলেকেও বড় করতে হবে। হাসিনা বেগম জানতো ভাইদের এই কথাগুলোর মধ্যে শুধু তার আর রাকিবের ভবিষ্যৎ জীবনের সুরক্ষার ভাবনাই ছিল না। করাচি ফেরত বাবার কুমিল্লা শহরে কয়েকটি জমি ছিল, ঢাকায় জমি ছিল। সেসময়ে ভাইয়েরাই সব জমি ভোগ দখল করছিল। দুই ভাই কুমিল্লার জমিতে ঘর তুলে দোকান ভাড়া দিয়ে ভাল টাকা রোজগার করতো। স্বামীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসিনা বেগমের সাথে বাবার বাড়ির সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর কয়েক বছর হাসিনা বেগম স্বামীর অফিস থেকে প্রাপ্ত টাকা-পয়সা আর সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালিয়ে নেন। কিন্তু পড়ালেখার খরচ বেড়ে গেলে ভাইদের কাছে যেতে বাধ্য হন। ভাইদের কাছে বাবার সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করার প্রস্তাব রাখেন। ভাইয়েরা এতে খুব নাখোশ হয়। কিন্তু হাসিনা বেগমের মামা-চাচারা মিলে ঠিক করে হাসু যখন আর বিয়ে শাদী করলোই না তখন ওর হক দিতে হবে। ভাইরা খুব অসন্তুষ্ট হয়ে এই ভাগ-বাটোয়ারা করে। ঢাকার পূর্ব-রাজাবাজারের জমিটা দুই বোনের নামে লিখে দেয়া হয়। ছোট বোন খোশনুর ওরফে খুশির স্বামী গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতো। সে বড় বোনকে রাজাবাজারের জমি লিখে দেয়। হাসিনা বেগম শ্বশুর বাড়ির গ্রামের জমি বিক্রি করে আর ছোট বোনের কাছ থেকে ধার নিয়ে পূর্ব-রাজাবাজারে একটা একতলা বাড়ি তৈরি করেন। বাড়ির অর্ধেক অংশ ভাড়া দেয়া হয়। সামনে ছোট এক চিলতে জায়গা। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নামাজে বসেন হাসিনা বেগম। কিছু কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার এসেছে সেগুলো করতে করতে অনেক বেলা হয়ে যায়। রাকিবেরও পাত্তা নেই। নামাজ পড়ে হাসিনা বেগম রাকিবকে ফোন করেন।
হ্যালো রাকিব কখন আসবি?
আমার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তুমি এখনও খাওনি?
আসবি না সে কথাটি জানাবি তো, আমি অপেক্ষা করছিলাম।
ভুলে গেছিলাম। আজ ব্রিটিশ কাউন্সিলে একটা সিনেমা দেখতে যাব, শেষ হতে রাত সাড়ে আটটা বাজবে।
খেয়েছিস?
না।
কখন খাবি?
দেখি হাতের কাজটা শেষ করে যাচ্ছি।
তোকে এতো করে বলি খাবার নিয়ে যা, কথা শুনিস না। আলসার হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে।
রাখি মা।
ফোন রেখে রাকিব বই-পত্র সব গুছিয়ে রুম থেকে বাইরে আসে। পড়ন্ত বিকেল, হাকিম-চত্বরের বিশাল রেইনট্রিগুলো পুরো এলাকাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ছেলে-মেয়েরা যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করছে। একটা ছেলে গিটার নিয়ে লাইব্রেরির কোনায় টুংটাং বাজাচ্ছে চোখ বন্ধ করে। ওখানে আগে ভাস্কর নভেরা আহমেদের একটা ভাস্কর্য ছিল। বেশ লম্বা, মাটির সাথে গাঁথা ছিল। একটা ছোট পাটাতনের উপরে একজনের অবয়ব। এক পাশে কিছুটা ভাঙা ছিল। এখন সরিয়ে নেয়া হয়েছে। লাইব্রেরির পিছন দিকটায় ভেতরের দেয়ালে নভেরা আহমেদের একটা ম্যুরাল এখনও আছে। রাকিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমাদের দেশে গুণী মানুষদের কদর নেই। কত প্রতিভাবান সুযোগের অভাবে, স্বীকৃতির অভাবে, অর্থনৈতিক দৈন্যের জন্য তার সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারছে না। এমনকী দলাদলি আর ঘৃণ্য রাজনীতি করে তাদের নাম মুছে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে। নভেরা আহমেদের মতো শিল্পীকে শহীদ মিনারের ইতিহাস তৈরির নাম থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। শিল্পী হামিদুর রহমানের নামটিই আজ সবাই জানে। হাঁটতে হাঁটতে রাকিব কাঁটাবনে চলে আসে। ওখানে ঘরের ছোঁয়া নামে একটা রেস্তোরাঁয় ঢোকে,ভেতরটা গমগম করছে। রাকিব একটা চেয়ার টেনে বসে ।
কী খাবেন স্যার? গরু শেষ। মুরগি, পাবদা মাছ, ডিম, ভুনা, মিক্সড ভাজি, ডাল ভর্তা আছে।
আর ভর্তা আছে?
চিংড়ি, বেগুন।
আচ্ছা আমাকে চিংড়ি ভর্তা, ডাল আর সবজি দাও। সাথে একটা মিনারেল ওয়াটার। ছেলেটি চোখের পলকে খাবার এনে হাজির করে। খাবারগুলো এখনও গরম আছে। খাবারের পাতিল চুলার উপর বসিয়ে রাখে মনে হয়।
খাবার খেয়ে শান্তার কথা মনে হয়। ওর সাথে কয়েকদিন যোগাযোগ নেই। রাকিব যখন যোগাযোগ করে তখনই শুধুমাত্র শান্তা সাড়া দেয়, বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, কিন্তু নিজের থেকে খুব একটা যোগাযোগ করে না। শান্তার মনের ভেতরে ওকে নিয়ে কোনো অনুভূতি আছে কিনা রাকিব এখনও নিশ্চিত নয়। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে ও গবেষণা করতে চায় না।
সরাসরি জানতে চাইলে যদি ঋণাত্মক কোনো জবাব আসে। রাকিব শান্তার প্রতি দারুন দুর্বল। এর জন্য ভেতরে ভেতরে একটা প্রস্তুতি,পরিচয়ের পর থেকে ওকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। এসব রাকিব এড়াতে পারেনি। গত দুবছরে শান্তার সাথে বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কিন্তু দুজনের মধ্যে যেন একটা কুয়াশায় ঘেরা পর্দা রয়ে গেছে। রাকিব কখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি, আর শান্তা অনেক কথা বললেও রাকিবের প্রতি ওর ভালোলাগার কথা কখনো বলেনি। রাকিব ভাবে শান্তাও কি ওর মতোই নিজের মনে বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু প্রেম তো চাপা থাকে না। রাকিবের কথা, বারবার শান্তার বাসায় যাওয়া, দেখা করা ঘুরতে যাওয়া এসবের মধ্যে দিয়ে শান্তা কি কিছু বুঝতে পারেনি? রাকিব একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে এলিফ্যান্ট রোডের প্লেন মসজিদের গলিতে শান্তাদের বাসার সামনে চলে এসেছে নিজেও জানে না। নিজের অসংযত আচরণে একটু লজ্জা পেল রাকিব। এখন কি ফিরে যাবে নাকি শান্তাদের বাসায় যাবে? বার বার যেচে এখানে আসতে ওর খারাপ লাগে কিন্তু না এসে পারে না। গেটের সামনে গেলে দারোয়ান গেট খুলে দেয়।
দারোয়ান বলে শান্তা আপা তো ছাদে গেছে। রাকিব সোজা ছাদে চলে যায়।
শান্তা আর একটি অপরিচিতি ছেলে দাঁড়িয়ে বেশ তন্ময় হয়ে কথা বলছে। রাকিবের উপস্থিতি ওরা টের পায়নি। রাকিব একবার ভাবে চলে যাবে কিন্তু এভাবে চলে গেলে বিষয়টা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে শান্তার চোখে চোখ পড়লো। ও খুব উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে কথা বলছে হাত নেড়ে নেড়ে। শান্তা ওকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। আরে রাকিব ভাই, কখন এসেছেন? আমাকে ডাকেননি কেন?
রাকিব একটু গম্ভীর হয়ে বলে, অনেকক্ষণ। ভাবলাম তোমাকে বিরক্ত না করে চুপচাপ চলে যাই।
কেন? বিরক্ত হবো কেন? আসুন পরিচয় করিয়ে দেই। আমার মামাতো ভাই ফয়সাল। ওরা গত সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে।
রাকিব হাত বাড়িয়ে দিল। আমি রাকিব।
ওহ্ আপনিই রাকিব। শান্তার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। একজন প্রমিজিং রিসার্চার, রাইটার। রাকিব মুচকি হেসে বলে, তেমন কিছুই না, জাস্ট সুইমিং ইন দ্যা ওশান অ্যান্ড ট্রাই টু পিক সাম ফিশ।
ওহ্ রিয়েলি। দ্যাট সাউন্ডস গুড।
ফয়সাল রাকিবের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। শান্তা চুপচাপ শুনছে দুজনের কথা।
ফয়সাল তুমি চা খাবে?
তোমার ওই গ্রিন টি দিও না, আমি এক কাপ দুধ, চিনিসহ চা চাই, সাথে ফুপুর ঝাল পিঁয়াজু। আচ্ছা মাকে বলে আসছি। রাকিব ভাইতো দুধ চা।
রাকিব ঘাড় নাড়ে।
ফয়সাল কি পড়াশোনা করছেন?
হ্যাঁ আমি এভিয়েশন নিয়ে স্টাডি করছি। প্রায় এন্ডিং স্টেজে আছি।
বাহ্, গুড।
আপনার প্ল্যান কী রাকিব?
এখন তো ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করছি, দেখা যাক কী হয়।
হুম, ইউ আর এ বর্ন ট্যালেন্ট, শুনেছি শান্তার কাছে।
রাকিব হা হা করে হাসতে থাকে। ট্যালেন্ট বলে তেমন কিছু নাই। সুযোগ আর ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
শান্তা ট্রেতে করে চা, পিঁয়াজু আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে আসলো। চা খেয়ে রাকিব বলে, আমি তাহলে এখন যাই শান্তা।
কেন? আরেকটু থাকেন। এখন তো বাসাতেই যাবেন।
না একটু কাজ আছে।
আচ্ছা তাহলে আটকাবো না। ওহ্ আপনার দেয়া বইগুলো পড়ছি। শহীদুল জহিরের চন্দনবনে উপন্যাসটা খুব ভাল লাগছে।
হ্যাঁ এই উপন্যাসটা আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি। পাঠক সমাবেশ করেছে।
রাকিব ভাই, আপনি সব বিরল জিনিসপত্র নিয়ে আসেন।
আরে না। তবে শহীদুল জহীর এই উপন্যাসগুলোর বিষয়ে নীরব ছিলেন।
পড়তে গিয়ে আপনার কথা মনে হচ্ছিলো।
তাই? কী মনে হচ্ছিলো?
আপনার বইও নিশ্চয়ই একদিন পড়বো।
হা … হা … হা… রাকিব হেসে সিঁড়িঘরের দিকে যায়। শান্তা পিছন পিছন আসতে থাকে।
তোমার আসার দরকার নাই। তুমি থাকো।
কেন? সবসময় তো আসি।
আজ এসো না, ফয়সাল আছে।
শান্তা একটু অবাক চোখে রাকিবের দিকে তাকায়। রাকিব কিছুটা গম্ভীর হয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়।
শান্তা ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে রাকিবের চলে যাওয়া দেখে। রাকিব একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না।
শান্তা ফয়সালের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে কাটায়।


সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝুম বৃষ্টি। সোহিনী ঘরে বসে রিহার্সেল করছে।এবারের নাটক একজন নতুন নাট্যকারের। সোহিনীর চরিত্রটা একজন গ্রামের মেয়ের যে কিছুটা গেছো ধরণের। নিয়ম-কানুন কম মেনে চলে। একজন গায়েনকে সে ভালোবাসে কিন্তু গায়েন উদাসীন। ওর প্রেমের আকুতি গায়েনের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না। মেয়েটি একা একা গ্রামের পাশের বাঁশ-ঝোপে ঘুরে বেড়ায়, নদীতে সাঁতার কাটে। সোহিনী একটা শাড়ি আঁটোসাঁটো করে পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিহার্সেল করতে থাকে। ওর উন্নত স্তনযুগল আয়নায় নিজের চোখে পড়ে। সোহিনী কিছুটা ভারীর দিকে তবে ওর সবকিছুর মধ্যে একটা দুরন্তপনা আছে। নিজেকে আয়নায় দেখতে দেখতে এক ধরনের আত্মপ্রেমে আক্রান্ত হয়।
জাহাঙ্গীরনগরে পড়ার সময় তিনটা টিউশনি করে চলতো সোহিনী। সাভারে পাশাপাশি দুবাসায় ছাত্র পড়াতো। বাড়ি থেকেও টাকা আসতো। মোস্তফার মাস্টার্স শেষ হয়নি তখন। বেশ একটা টালমাটাল অবস্থা। হঠাৎ করেই দুজনে বিয়ে করে ফেলে। দুই ধর্মের সোহিনী-মোস্তফা কাউকেই বাড়িতে মেনে নেয়া হয় না। বাড়ি থেকে টাকা আসা বন্ধ। মাস্টার্সের পর মোস্তফা বিজ্ঞাপনী অফিসে কাজ পায়। মিরপুরে একটা বাসায় সাবলেট থাকে দুজনে। প্রথম দিকটা খুব অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়। সেই সব দিন খুব কঠিন ছিল। ভাবলে সোহিনীর এখনও অস্বস্তি হয়। হাতে টাকা নেই বাড়ি ভাড়া দিতে হবে, বাজার করতে হবে। ভাত, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে খেয়ে ওরা দিনের পর দিন কাটিয়েছে। সোহিনীর মা কখনো লুকিয়ে ওকে টাকা বিকাশ করতো। এভাবে অভাব-অভিযোগে কাটানোর পর একটা পর্যায়ে ওর মনে হতো এভাবে বিয়ে করার কোনো অর্থ হয় না। মোস্তফার নতুন চাকরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রডাকশনের কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হয় প্রায়ই। সোহিনী একটা নাটকের দলে যোগ দেয়। সন্ধ্যায় মহড়া আর দিনে মিরপুর এক নম্বরে এডভেন্টিস স্কুলে শিক্ষকতা। একটু একটু করে ঢাকা শহরে থিতু হতে শুরু করে ওরা। অভিনয়ে সোহিনী বরাবরই নিপুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ওকে একজন প্রতিভাবান ছাত্রী হিসেবে চিনতো। হুট করে বিয়ে করে ফেলাকে অনেকে ওর কর্মজীবনের জন্য বাধা হিসেবে দেখেছে। নানান জন নানা কথা বলেছে। এসব ঋণাত্মক কথা শুনতে শুনতে সোহিনীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা এসে বাসা বাঁধে। মোস্তফার প্রতি ওর প্রবল আকর্ষণ,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মোস্তফার হল ছিল সোহিনীর ঘর-বাড়ি। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে ক্যাফেটেরিয়ায় খেয়ে সোহিনী মোস্তফার সাথে ওর হলে যেত। রুমমেটের বাসা সাভার। সে খুব কম হলে থাকতো। সেসময়ে ওরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। ঝড়ের মতো উদ্দামতা ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ ঝড় যেন আর কোনোদিন থামবে না, নেশা হয়ে যায় দুজনের, শরীরের স্পর্শ দুজনকে পাগল বানিয়ে দেয়। হঠাৎ সোহিনী টের পায় ওর মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। খাবারেও স্বাদ পাচ্ছে না। তখন মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়ে যায় দুজনের। গর্ভপাতের কথা ভাবে সোহিনী। ঢাকায় এসে একজন গাইনোকোলজিস্টকে দেখায়। কিন্তু মোস্তফা সিদ্ধান্ত নেয় ওরা বিয়ে করে ফেলবে। এরপর যা হয় হবে। বিয়ের পর প্রথমে আশুলিয়ায় মোস্তফার চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে প্রায় পাঁচ মাস থাকে ওরা। ওখান থেকে গিয়ে ক্লাস করে। তিন মাসের সময় হঠাৎ সোহিনীর শরীর খারাপ হয়, একদিন প্রচণ্ড পেট ব্যথা হওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায়। দ্রুত সাভার এনাম মেডিক্যালে আনা হয় সোহিনীকে। আলট্রাসনোগ্রাফিতে দেখা যায় বাচ্চা মৃত। এই ঘটনা সোহিনীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়, মনমরা হয়ে পড়ে।
এরপর কিছুদিন ওই বাসায় থেকে ওরা ঢাকায় মিরপুরে সাবলেট নেয়। সোহিনী আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। ওদের নিয়ে নানা কানাঘুষা হয়। পরীক্ষা দেয়ার জন্য সোহিনী হলে থাকার জন্য যায়। হলের মেয়েরা ওকে ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেখে নানা কটু মন্তব্য করে। একজন বড় আপা ওকে দেখে বলে, কিরে এত দ্রুত ফিরে আসলি হলে? পেটেরটা কই?
সোহিনী চোখ তুলে ওই আপার দিকে তাকায়। এই কি কথা বলার ভব্যতা?
এক আপা বলে ভালো হইছে পেটের বাচ্চা খালাস করে আসছিস। তোকে তো হলে থাকতে দেবে না, অনুমতি নিয়ে আসছিস?
সোহিনী বলে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম প্রভোস্ট ম্যাডামের সাথে কথা বলেছেন, উনি অনুমতি দিয়েছেন।
ওরে বাবা, তোর তো দেখি লাইন-ঘাট সব ভালোই চেনা। তা স্বামীটি আছে নাকি তাকেও তালাক দিয়ে আসছিস?
ওখানে আরও অনেকে বসা ছিল। সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। সোহিনী দ্রুত রুমের দিকে পা বাড়ায়।
পুরানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে সোহিনী শাড়ির আচঁলটা কোমড়ে প্যাঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় অনুশীলন করতে থাকে। সোহিনী দমবার পাত্রী না। হঠাৎ বিয়ে করে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব অনেকের কাছেই অপদস্থ হতে হয়েছে ওকে কিন্তু মনে মনে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকে।
সেন্টার ফর ডেপেলভমেন্টের সাথে ওদের এক শিক্ষক জড়িত তিনিই ওকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন। স্কুলের চাকরিটা ওর ভালোই লাগে। কিন্তু বেতন কম। এবারের নাটকটা নিয়ে সোহিনী খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। কুসুমের কুন্তল কেশরাশি, কাজল দেয়া মায়াভরা চোখ, গায়েনের জন্য প্রবল প্রেম এসব কিছু যেন ওর মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। আয়নায় সোহিনী একজন কুসুমকে দেখতে পায় যার উদ্দাম তারুণ্য, জীবনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ,একটা দোয়েল পাখির মতো নাচতে থাকে কুসুম। এক সময় গায়েন ভিন গায়ে চলে যায় গান গাইবার জন্য। কুসুমের বিয়ে হয় গ্রামের একজন বয়স্ক ধনী কৃষকের সাথে। কৃষকের প্রথম স্ত্রী কুসুমকে দিয়ে সারাদিন কাজ করায়। ধান সিদ্ধ করা, ধান শুকানো, ধান মিলে পাঠানো, চাল ঝাড়া সব করতে হয় কুসুমকে। কুসুমের স্বামী সারাদিন বাংলা ঘরে শুয়ে বসে থাকে। কামলা-কিষানরা সব কাজ করে। কুসুমের স্বামী শুয়ে-বসে সব তদারকি করে। এদের জন্য কুসুমকে রান্না করতে হয়। ফযরের আযানের সময় কাজ শুরু হয় আর রাতের খাওয়ার পর কাজ শেষ হয়। তখন কুসুমের স্বামী ঘরে ফেরে। বেশিরভাগ দিন সে বড় বউর ঘরে থাকে। কুসুমের কাছে আসে মাঝে মাঝে। অনিচ্ছা নিয়ে কুসুম স্বামীর সাথে মিলিত হয়। এ জীবন যেন কুসুমের নয়। গ্রামের সেই দুরন্ত মেয়েটি কৃষকের ঘরে কুরে কুরে মরে। শরীর-মনের স্বপ্ন প্রেম তুষের আগুনে জ্বলতে থাকে। একদিন কুসুম রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে পালায়। গায়েনের খোঁজে ভিন গাঁয়ে যায়, সেখানে গায়েনকে না পেয়ে রাজধানীতে যায়। একজন ওকে বলে গায়েন রাজধানীতে গেছে। হাজার মানুষের ভিড়ে কুসুম হয়ে ওঠে আরেকজন কুসুম।
সোহিনীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। গালের জল মুছে ঘেমে যাওয়া শরীর নিয়ে গোসলে ঢোকে। কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদে। শাওয়ারের ঠাণ্ডা জল ওকে শান্ত করে।
দুদিন ধরে মোস্তফা বাসায় নেই। প্রডাকশনের কাজে সিলেট গেছে। গোসল শেষে সোহানী বারান্দায় এসে বসে। বারান্দায় কয়েকটা ফুলের গাছ। কাটা-মুকুট, রক্তজবা, বেলি। বারান্দার কোণে দুটো বেতের চেয়ার পাতা। চেয়ারে বসে রাকিবকে ফোন করে।
হ্যালো।
হ্যালো কেমন আছেন রাকিব?
রাকিব চিনতে পারে না।
এর মধ্যেই ভুলে গেলেন।
মনে রাখার মতো তেমন কিছু ঘটেছে কি! প্লিজ কে বলছেন।
ওহ্ আপনি আমার নম্বর সেভ করে রাখেননি?
রাকিব স্মৃতি হাতড়ে বলে ওঠে, ওহ্ সোহিনী। কী খবর? কেমন আছেন?
বাব্বা এতক্ষণে।
না একদম তন্ময় হয়ে পড়ছিলাম, হঠাৎ আপনার গলা শুনে চিনতে পারিনি, আগে তো কথাও হয়নি।
কী পড়ছিলেন?
জাক লাকার একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম।
ওহো, তাহলে পড়েন, অন্য সময় কথা হবে।
না না রেখে দেয়ার দরকার নাই, আমি পড়ে পড়বো।
এখন কি ডিপার্টমেন্টে?
হ্যাঁ। ওখানেইতো আমার বাড়ি-ঘর।
আপনার গবেষণার কাজ কতদূর?
এই প্রায় শেষের পথে। ওহ্ আপনাকে তো আসল খবরটাই দেয়া হয় নাই, আমি সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টে জয়েন করেছি। যদিও চাকরিটা আপনারই প্রাপ্য ছিল।
অভিনন্দন । কেন, চাকরিটা আমার প্রাপ্য ছিল কেন?
কারণ আমি তো কিছুদিন পর ছেড়েই দেব।
ওহ্ আচ্ছা, ডিপার্টমেন্টে জয়েন করছেন?
যদি ওখানে না হয় তাহলে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করবো হয়তো। পড়ানোটাই আমার কাজ।
তাহলে এটাতো ভারী অন্যায় হয়েছে, আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছেন।
তা নিয়েছি, এ জন্য কী দণ্ড দিতে হবে বলুন।
আজ বিকালে কফি খাওয়াতে হবে।
আচ্ছা কোথায়?
আমার বাসাতো মিরপুর। সবদিকেই দূর।
রাকিব বলে আমি চলে আসবো মিরপুর?
না এখানে তেমন ভালো বসার জায়গা নেই।
ধানমন্ডি দুইয়ে আসছি ইয়েলোতে।
আচ্ছা আসুন।
ঠিক পাঁচটায়।
ওকে।
পাঁচটা মানে কিন্তু পাঁচটাই।
হা … হা … ঠিক আছে।
হাতের কাজগুলো শেষ করতে করতে রাকিবের প্রায় সাড়ে চারটা বেজে যায়। দুপুরের খাওয়া হয় না।
রাকিব ভাবে ইয়েলোতে গিয়ে একবারে লেট লাঞ্চ করে নেবে। একবার ভাবে শান্তাকেও আসতে বলবে কিনা। তিনজনে মিলে বেশ ভালো একটা আড্ডা দেয়া যাবে কিন্তু মনে হয় শান্তা হয়তো সহজ হতে পারবে না আর সোহিনীতো ওর সাথে একা দেখা করতে চেয়েছে, একটা রিকশা নিয়ে ইয়েলোর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। যেতে যেতে সোয়া পাঁচটা বেজে যায়। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। শেষে ঢাকা কলেজের সামনে রিকশা ছেড়ে হেঁটে রওনা হয়। সোহিনী দূরে বাসা বলে বেশ আগে রওনা হয়েছে। পৌনে পাঁচটায় পৌঁছে যায় ইয়েলোতে। কিছুক্ষণ ওদের আউটলেট সেকশনগুলো ঘুরে দেখে। একটা নীল রঙের ফতুয়া খুব পছন্দ হয় কিন্তু কেনা হয় না, হিসাব করা টাকা, খাবারের বিল দেয়ার মতো টাকাই হাতে আছে।
মোস্তফা প্রডাকশনের কাজ নিয়ে অনেক খাটা-খাটনি করছে, সোহিনীও স্কুলে কাজ করছে। এই দিয়ে ওদের সংসার ঠিকই চলে যাচ্ছে কিন্তু নিজেদের একটা শখ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। থরে থরে সাজানো পোশাক, নানারকম ঘর সাজানোর জিনিস দেখতে দেখতে কুসুমের কথা ভাবছিল সোহিনী। কুসুম কি এখন ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে? খড়কুটোর মতো যা সামনে পায় আঁকড়ে ধরছে। পেছন থেকে রাকিব খুব কাছে এসে বলে, কী ব্যাপার এতো তন্ময় হয়ে কী ভাবছেন?
সোহিনী অবাক হয়ে যায়, কখন রাকিব এসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি।
আপনি কি বিড়াল প্রজাতীর?
হা… হা… কেন?
এতো নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বিড়াল প্রজাতির কিনা জানি না কিন্তু হিংস্র নই।
বিড়াল তো হিংস্র নয় ওরা বেশ আহলাদী ধরণের।
কিন্তু বাঘের মাসি তো। কখন কী করে বলা যায় না।
নিজের সম্পর্কে তাহলে আপনার এই ধারণা?
কী ধারণা?
এই কখন বাঘ হয়ে ওঠেন।
না না সে সম্ভাবনা নাই। আমি দরবেশ প্রকৃতির বিড়াল, ধ্যানেই বেশ কেটে যাচ্ছে।
তা ধ্যান ভাঙেন না কেন?
কিভাবে ভাঙবে বলেন? ঋষির ধ্যান তো কখনো ভাঙে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ এসে ব্যাঘাত ঘটায়। এজন্য অবশ্য তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।
ওরে বাবা তাহলে তো না ভাঙানোই ভালো। এজন্যই হয়তো কেউ সাহস করে ভাঙায় না।
হুম। রাকিব এবার শান্তার চেহারাটা কল্পনা করে। সেখানে কোনো ঝড়ের পূর্বাভাষ দেখতে পায় না, বৃষ্টিরও না।
কফি খাওয়াবেন না?
ওহ্ হ্যাঁ চলুন বসি, বাইরে বসবেন?
না ভেতরেই বসি, গরম আছে।
ওয়েটারকে ডেকে রাকিব টম ইয়াম স্যুপ, চিকেনের বেশ ঝাল একটা অইটেম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর দু-কাপ কফি দিতে বলে। আমি অ্যামেরিকানো, আপনি?
আমিও। তবে আজ কিন্তু আমি খাওয়াবো।
এমনতো কথা ছিল না।
কথা দ্রুত বদলে যায়।
তাই নাকি?
জি, স্যার।
হা… হা… আমি কিন্তু স্যার না আপনার বন্ধু হতে পারি।
হুম, সোহিনী রাকিবের চোখের দিকে তাকায়। পুরু ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। দুজনে বহু সময় ধরে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। সোহিনীর বেড়ে ওঠা, গ্রামের জীবন, মায়ের কথা, মোস্তফার সাথে সম্পর্ক।
সোহিনী আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, আপনিতো একটা ঘন সম্পর্কের মধ্যে আছেন, কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। তবু আপনাকে এমন উদাসীন, বিষণ্ণ লাগে কেন?
তাই উদাসীন লাগে? কেউ বলে নাইতো।
কেউ বলে নাই কারণ কেউ হয়তো তেমনভাবে লক্ষ্য করে নি।
আপনি দুদিনেই লক্ষ্য করলেন।
যেটা চোখে পড়ার তা একবার দেখলেই চোখে পড়ে। বারবার দেখার প্রয়োজন হয় না।
আপনিতো লেখক সেজন্য হয়তো এমনভাবে দেখেন। না মোস্তফার সাথে আমি ভালো আছি কিন্তু ওর সাথে কেমন যেন ইদানিং কোনো উৎসাহ পাই না। জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। মোস্তফা খুব সাধারণ প্রকৃতির ছেলে, ক্যারিয়ার আর ঘর-সংসার। এ দুটোই ওর জীবন। এর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না।
তাতো সে আগেও এরকমই ছিল, তাই না?
হ্যাঁ, তখন জাহাঙ্গীরনগরে থাকতে ওর রুক্ষ অবয়ব, ছটফটে ব্যক্তিত্ব সব আমাকে পাগলের মতো টানতো, এখন মনে হচ্ছে ওকে জানা হয়ে গেছে। একটা চেনা গল্পের মতো লাগে।
সব মানুষই তো তাই। কিছুদিন পর পুরানো হয়ে যায়।
আমরা সেই পুরানো মানুষকে রঙ করে নতুন করে তুলি অথবা নিজের দেখার চোখকেও নতুন করতে জানতে হয়। কী জানি আমি নিজেই হয়তো পুরানো হয়ে গেছি নিজের কাছে।
যা,আপনার কি এখন পুরানো হওয়ার সময়? এখন তো নতুন করে নিজেকে আবিষ্কারের সময়। সংসার, কাজ, প্রেম এসব চলতে থাকবে কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে একটা উদ্দীপনার মধ্যে, একটা আকর্ষণের মধ্যে। এই আকর্ষণ-প্রেম, জীবনের প্রতি। জীবন যদি পানসে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে পড়ে তবে তাকে সেভাবে গহণ করে,সেই কষ্টকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে আবার কোনো প্রজাপতির পেছনে ছুটতে হবে। এটাই জীবন।
বাহ্ আপনি তো চমৎকার বলেন।
শোনার মতো শ্রোতা পেলে কেইবা বলতে না চায়। আরেকটা বিষয় আছে অপরলিঙ্গ মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ঠিকই কিন্তু তাছাড়াও প্রত্যেকের নিজস্ব একটা জীবন আছে। তাকে ভালোবাসতে হয়, যত্ন নিতে হয়। বাড়তে দিতে হয়। যদি শুধু অন্যের জন্য নিজের অস্তিত্বকে উৎসর্গ করতে হয় তাহলে নিজের ব্যক্তিত্বটাই আর থাকে না।
হুম সেটাই। আমার মনে হয় ভেতরে ভেতরে এইরকম একটা দ্বন্দ্ব চলছে। নিজের চাওয়া, কী করতে চাই, কী পারবো? এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। হয়তো কোনো পথ পেয়ে যাবো। কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে যায়। এরমধ্যে দুবার মোস্তফার ফোন এলো। সোহিনী রাকিবের সামনে বসেই কথা বলে। খুব সংক্ষিপ্ত। বাইরে আছি, বাসায় ফিরে তোমাকে ফোন করছি। দুজনে ইয়েলো থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডির ফুটপাথ ধরে কিছুক্ষণ হাঁটে।
রাকিব জানতে চায় আপনি কিভাবে যাবেন?
বাসে যাবো। এতো রাতে সিএনজিতে যাবো না।
চলেন তাহলে বাসে তুলে দেই আপনাকে।
না না লাগবে না, আমি অভ্যস্ত। জাহাঙ্গীরনগর টু ঢাকা করেছি সারাদিন।
ঠিক আছে আমিতো রাজাবাজার যাবো, আপনি বাসে উঠলে আমি একটা রিকশা নিয়ে নেবো।
দুজনে অনেকক্ষণ সিটি কলেজের মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। সব বাসই যাত্রীতে ভর্তি। অনেকক্ষণ পর একটা বাস আসে দুয়ারীপাড়ার। সোহানী দ্রুত বাসে উঠে যায়, পেছনে ফিরে তাকানোর সময় পায় না।


রাকিব রাস্তা পার হয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের কাছে এসে একটা রিকশা নেয়। হেঁটে ফিরবে ভেবেছিল কিন্তু যা গরম হাঁটার কথা বাদ দেয়, ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। হাসিনা বেগম ছেলের খাবার নিয়ে টেবিলে অপেক্ষা করছেন। রাকিবটা যে কী হচ্ছে? ছন্নছাড়া।
এমনিতে পড়াশোনায় খুব মনোযোগ, মেধাবী কিন্তু নিজের প্রতি যত্ন নাই। সকালবেলা দুটি রুটি মুখে দিয়ে অফিসে দৌড়। আগে তো ডিপার্টমেন্টে গেলে সকাল-সন্ধ্যা কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কোনো দিন দুপুরে চা-সিঙ্গারা বা একটা বার্গার খেয়ে কাটিয়ে দিত। এখন অফিসে যাচ্ছে, নতুন চাকরি। কাজের জন্য দুপুরে খাবার সময়ই পায় না। ঢাকায় বাসে চলাচল করা যায় কিন্তু রাকিব খুব একটা বাসে চড়ে না। দূরে কোথাও গেলেই শুধু চড়ে। ঢাকার মধ্যে রিকশাই তার বাহন। কখনো উবার বা সিএনজি। নতুন চাকরির আগে ফ্রি-ল্যান্সিং কাজ করে হাতে টাকা এসে জমলেই ইচ্ছেমতো খরচ করতো। উবারে চড়ে ইউনিভার্সিটি যায়, একগাদা বই-পত্র কেনা শুরু করে। বিদেশ থেকে বই আনায়। মায়ের জন্য শাড়ি, লোশন, পাউডার রাকিবের স্বভাবটা হচ্ছে একটু অগোছালো। রাকিব মায়ের অনুভূতিটা বুঝতে পারে। মা বহু বছর ধরে ওকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছে। বাবার অকাল মৃত্যুর পর নানারকম ঝড়-ঝাপটা গেছে মায়ের উপর দিয়ে সেজন্য মার জন্য কিছু করতে পারলে ওর ভালো লাগে। মাকে নিয়ে চীনা রেস্তোরাঁয় খেতে যায় মাঝে মাঝে। হাসিনা বেগম এসব বিদেশী খাবার খুব একটা পছন্দ করেন না কিন্তু ছেলের ভালো লাগায় ব্যাঘাত ঘটান না।
টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো চামচ দিয়ে একটু একটু করে গরম স্যুপ মুখে তুলে খায় রাকিব । হাসিনা বেগম ছেলের এসব পাগলামি দেখে বলে তুই কি একটু সংসারী হবি না? সামনে তোর ভবিষ্যৎ জীবন পড়ে আছে। রাকিব হেসে বলে সেজন্য তোমার চিন্তা করতে হবে না, আমি জানি কী করতে হবে, ঠিক পথেই এগাচ্ছি, তবে প্রকৃতি যদি অনুকূলে না থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
এ কেমন কথা? প্রকৃতি তোর বিরুদ্ধে যাবে কেন?
না, এমনি বললাম। ভবিষ্যতের কথা কিছু ভাবতে হবে না?
রাকিব বলে ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিকার অর্থে কিছু ভাবা যায় না শুধু তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। তুমিও তো অনেক কিছু স্বপ্ন দেখেছিলে, সবটা কি পেয়েছো?
হাসিনা বেগম ছেলের এসব কথা-বার্তা পছন্দ করেন না।
এই বয়সে এতো ভারী ভারী কথা কেন?
আমার জীবনে যা হওয়ার হয়েছে। এখন তোর জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে নে।
রাকিব জানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা ওর জন্য খুব কঠিন নয় কিন্তু সেজন্য ওকে নানা কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। সব শিক্ষাঙ্গন আজ রাজনৈতিক দলগুলোর ইশারায় চলে। এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। ইচ্ছা না থাকলেও রাকিবকে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকদের সাথে সদ্ভাব রাখতে হয়। তবে ওনারা যতটা চান, যেভাবে চান ও ঠিক সেভাবে চলে না। ওর কিছু নীতি আছে, চিন্তা-ভাবনা আছে। চাকরির জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয় সে।
সকাল বেলা খুব ভোরে উঠে গোসল করে রুটি, ডিম আর সবজি খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আজ অফিসে যাবে না আগেই জানিয়ে রেখেছিল। আজ ওর এমফিলের একটা উপস্থাপনা আছে।
ওর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া জাহাঙ্গীনগর আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক থাকার কথা।
এই সময়গুলো রাকিব খুব স্বাভাবিকভাবেই সব সামলে নেয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা, উত্তেজনা থাকে। আজ চাটাও শেষ করলি না। হাসিনা বেগম বলেন। কী ছেলে এতো তাড়াহুড়ো কেন? প্রেজেনটেশন আছে একটু ধীরে সুস্থে যা।
বাসা থেকে বেরিয়ে রাকিব কোনো রিকশা পায় না। একজন রিকশাওয়ালা গান গাইতে গাইতে আসছেন। ডাকতেই ওর সামনে দিয়ে জোরে চালিয়ে চলে যায়। মেজাজ খারাপ নিয়ে রাকিব হাঁটতে থাকে। পান্থপথে এসে একটা সিএনজি পেয়ে উঠে পড়ে। সোহিনীর ফোন। এতো সকালে? একবার ভাবে ধরবে না, পরে সময় করে কথা বলবে। কিন্তু দুবার বাজার পর ফোনটা ধরে।
হ্যালো।
হ্যালো রাকিব, কেমন আছেন?
এইতো।
ব্যস্ত?
হ্যাঁ একটা প্রেজেনটেশন আছে তাই ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি। জরুরি কিছু?
না, ভাবলাম ওইদিনের পর তো আর কথা হয়নি।
সরি, এতো সকালে করলাম।
ঠিক আছে, আমি পরে কথা বলছি, রাখি।
সোহিনী বাই বলার আগেই রাকিব ফোনটা রেখে দেয়।
হঠাৎ ওর খুব শান্তাকে দেখতে ইচ্ছে করে, বেশ কিছুদিন এই প্রেজেনটেশনের যন্ত্রণায় ওর সাথে দেখা হয়নি। ফোনেও অল্প-সল্প কথা।
শান্তাকে ফোন করতেই ওপাশে শান্তার উচ্ছ্বসিত গলা।
হ্যালো রাকিব ভাই।
কী খবর তোমার?
ভালো। আপনি আসেন না কেন?
আমি প্রতিদিন আসবো এটা চাও তুমি?
হা… হা… হা… শান্তা হাসতে থাকে।
আজ খুব ঝামেলার মধ্যে আছি, শোন তোমার ক্লাস কখন শেষ?
দুপুর তিনটা। যদি ল্যাব হয় তাহলে পাঁচটা।
ওকে আমি তিনটায় তোমাকে ফোন করবো, আজ দেখা করবো।
কিন্তু আজতো আমরা একটা বিয়েতে যাবো সন্ধ্যায়। গিফট কিনতে হবে। তাড়াতাড়ি চলে যাবো।
যেও, আমার সাথে পাঁচ মিনিট দেখা করে যেও।
আচ্ছা দেখি।
শান্তার নিরুত্তাপ গলায় রাকিব কিছুটা দমে যায়। বাই বলে ফোন রেখে দেয়।
ধুর কেন যে শান্তাকে ফোন করতে গেল। এখন মেজাজ খারাপ লাগছে। আজ দেখা না হলে খুব অস্থির লাগবে।
সিএনজি কলা ভবনে ঢুকতেই রাকিব হুড়মুড় করে বিভাগে যায়, নিজের বরাদ্দকৃত কক্ষে যায়।
ইংরেজি বিভাগের সভাপতি ওয়াকিল আহমেদ রাকিবকে খুব পছন্দ করেন, তিনিই রাকিবকে বিভাগে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বিভাগের সভাপতির পছন্দের ছাত্র বলে শিক্ষকরা অনেকেই ওকে একটু বাঁকা চোখে দেখে। কাগজপত্র সব গুছিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নেয় রাকিব। পড়তে পড়তে শান্তার কথা ভুলে যায়।
প্রেজেনটেশন খুব ভাল হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাজহার হোসেন রাকিবের পেপারের খুব প্রশংসা করেন। উপস্থিত অন্য শিক্ষক ও ছাত্র-দর্শকরা গ্যালারি থেকে নানা প্রশ্ন করে। রাকিব বুদ্ধিদীপ্ত সব উত্তর দেয়। প্রেজেনটেশনের পর রাকিব বেরিয়ে একটা পরিতৃপ্ত মন নিয়ে শিক্ষকদের সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করতে যায়। ওখানেই ঝামেলাটা বাঁধে। ওর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনির হোসেন শিক্ষকদের ক্যাফেতে রাকিবকে দেখে বলে, কী খবর প্রফেসর রাকিব? কেমন আছেন স্যার?
রাকিব কিছুটা বিব্রত হয়ে কথার কোনো উত্তর দেয় না, মৃদু হাসে। মনির হোসেন আবার বলেন, কী এখন আর আমাদের চিনতেই পারছোনা?
রাকিব বলে সরি স্যার, চিনতে পারবোনা কেন, কিন্তু সব প্রশ্নেরতো উত্তর হয় না।
তাই নাকি? তুমিতো ক্লাসে বেশ শান্ত ছিলে, এখনতো বেয়াদব হয়ে উঠেছো। তোমাদের মতো ছেলেরা অন্যের পেছনে ঘুরে ঘুরে ঠিকই নিজের আখের গুছিয়ে নেয়। রাকিব মনির হোসেনের কথা শুনে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আর ওর বিভাগের সভাপতি রাকিবকে ওনাদের টেবিলে বসতে বলেন।
রাকিব চেয়ার টেনে বসে।
বিভাগের সভাপতি বলেন, মনিরটা বরাবরই এমন, ওর কথায় কিছু মনে করো না। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি ফর দিস সিচুয়েশন। আমরাই তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম। কী বিব্রতকর ব্যাপার বলো তো।
না না ইটস ওকে স্যার। আপনার দুঃখিত হওয়ার কোনো দরকার নাই। ইটস ওভার। আমি তাহলে এখন আসি স্যার।
না না কেন যাবে? আমাদের সাথে লাঞ্চ করবে। রাকিব বলে সরি স্যার আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, যদি অনুমতি দেন আরেকদিন একসাথে লাঞ্চ করবো। আজ আমাকে যেতে হবে।
দেখো, তোমার যদি জরুরি কাজ থাকে আমি আটকাবো না। তবে তোমার প্রেজেনটেশন এবং থিসিস হাইলি এপ্রেসিয়েবল। পাবলিকেশন করে ফেলো। আমরা দ্রুতই সার্কুলেশন দেবো। উইশ ইউ গুড লাক মাই বয় বলে ওয়াকিল আহমেদ রাকিবের পিঠে আলতো করে চাপড় দেন।
রাকিব সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে দুটো চল্লিশ। শান্তার ক্লাস শেষ হওয়ার সময় হয়েছে। একটা রিকশা নিয়ে কার্জন হলে যায়। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে গিয়ে ওকে খোঁজে, পায় না। ফোন করে ব্যস্ত। কার্জন হলের সামনের চত্বরে ছেলে-মেয়েরা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিছু জুটি কার্জন হলের বারান্দায় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। একটা মেয়ে একা বসে আছে, পরনে লাল টকটকে জামদানি, কপালে টিপ। কারো জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। বারবার ঘড়ি দেখছে, মোবাইল দেখছে। রাকিবের সাথে চোখাচোখি হতেই উঠে হাঁটতে শুরু করে। কার্জন হলের সামনের এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটতে থাকে। মেয়েটির অস্থিরতা রাকিবের মধ্যে এসে প্রবেশ করে। প্রায় সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কার্জন হলের মাঠে বসে থাকে। শান্তা সাড়ে তিনটায় ফোন করে।
হ্যালো, সরি রাকিব ভাই, কল শুনতে পাইনি।
হুম।তুমি কোথায়?
আমিতো বসুন্ধরা মার্কেটে।
ওহ্। তুমি চলে গেছো।
হ্যাঁ, আজ শেষ ক্লাসটা হয়নি, ল্যাবও হবে না, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেলাম। ছোটখালা বসুন্ধরা মার্কেটে অপেক্ষা করছিল।
আমার আসার কথা ছিল তোমার মনে ছিল না বোধহয়।
মনে ছিল। ভাবছিলাম ফোন করে জানাবো আপনাকে কিন্তু তাড়াহুড়ায় ভুলে গেছি।
ঠিক আছে আমি রাখছি।
শান্তার ব্যবহারে রাকিব খুব অবাক হয়। ও কী আসলেই ভুলে গিয়েছিল নাকি রাকিবকে এড়াতে চাইছে? শান্তার ব্যবহার ও কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারে না।
রাকিবের কি এখন বলে দেয়া দরকার শান্তার প্রতি ওর অনুভূতির কথা। শান্তাকে নিয়ে ও যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, সেই স্বপ্নের নানা ডালপালা গজাচ্ছে। দিন দিন বিশাল বৃক্ষে পরিণত হচ্ছে ওর অনুভূতি। শান্তা একটু অপরিণত। ওর আর রাকিবের মাঝখানের কুয়াশাটা ভেদ করে ও কি বুঝতে পারছে রাকিবের অনুভূতি। আর শান্তাই বা ওকে নিয়ে কী ভাবছে? দুজনের পরিচয় তিন বছর হতে চলল। শান্তা আবৃত্তি করে, পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা আবৃত্তি সন্ধ্যায় ওর সাথে পরিচয়। রাকিবের সহপাঠী তুলির মামাতো বোন। সেই থেকে কথাবার্তা। ওর সাথে পরিচয়ের সময়ে রাকিব মাস্টার্সের থিসিস করছিল, মাথা খারাপ অবস্থা। সারাদিন লাইব্রেরিতে, সেমিনার লাইব্রেরিতে,ব্রিটিশ কাউন্সিলে। একটা অবসাদগ্রস্ততা চলছিল ওর মধ্যে। কেনো কাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে করার সময় এমন হয় ওর। সেই সময় শান্তার সাথে ফোনে কথা বলতে ভালো লাগতো। শান্তা সবসময় উচ্ছ্বসিত। হৈ চৈ পছন্দ করে, দল বেঁধে থাকে, রাকিবের ঠিক উল্টো। কিন্তু কেন যেন ওর প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়। সেটা ভেতরে পুষে রাখে রাকিব। শান্তা ওদের বাসায় বেড়াতে যেতে বলে, রাকিব যায়, ওর পরিবারের সাথে পরিচয় হয়। প্রথমে তুলির বন্ধু হিসাবে সবাই ওকে দেখে, ধীরে ধীরে শান্তার বন্ধু হয়ে যায়। শান্তাদের পরিবার আধুনিক, ওরা ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না। শান্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা ওর বাসায় আসে। প্রাণ-চঞ্চল শান্তা সবাইকে আকৃষ্ট করে। শান্তার মা রাকিবকে একটু বেশি প্রশ্রয় দেন, ওরা ছাদে বসে গল্প করে। মাঝে মাঝে রাকিব গান গায় শান্তাদের বসার ঘরে। একটা নির্মল বন্ধুত্ব। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে শান্তার প্রতি একটা ব্যক্তিগত অনুভূতিও কাজ করতে থাকে। সেটা রাকিব সরাসরি কখনো প্রকাশ করেনি। ও কেন যেন তা করতে পারছে না। মনে একটা সংশয় শান্তা কি ওকে ভালোবাসে? যদি শান্তা অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। রাকিবকে নিছক বন্ধু হিসাবে দেখে, এসব চিন্তা ওকে আগাতে দেয় না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এভাবে আর নয়। এর একটা শেষ হওয়া দরকার। শান্তাকে নিজের অনুভূতি জানিয়ে ভারমুক্ত হতে চায়। রাকিবের মনে একটা চাপা আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর আচরণে শান্তা নিজেই ওর কাছে আসবে। নিজেকে প্রকাশ করবে। রাকিব যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে শান্তাকে। কিন্তু কেমন যেন খুব কাছাকাছি এসেও আবার দুজন আলাদা হয়ে গেছে। সারা সন্ধ্যা রাকিব প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্যে কাটায়। পাঠক সমাবেশে গিয়ে উত্তর আধুনিক সাহিত্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কিন্তু কিছুতেই মন শান্ত হয় না। হঠাৎ সোহিনীর কথা মনে হয়। সকালে ফোন করেছিল। ফোন করে রাকিব।
হ্যালো।
হুম, কী খবর সোহিনী?
ভাল। আপনার প্রেজেনটেশন কেমন হলো?
ভালোই।
কেন আমার তো ধারণা খুব ভাল হয়েছে।
খুব ভাল কী আর হয় আর হলেও সবাই তার কদর বোঝে না।
আপনাকে কেমন মনমরা লাগছে।
হ্যাঁ, আজ বেশ ডিপ্রেশনে আছি।
কেন হঠাৎ কী হলো?
না এমনি হয়তো এতদিনের কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
আসবেন মিরপুর?
মিরপুর? রাকিব বেশ অনীহা নিয়ে বলে।
ওমা সেদিনই তো আসতে চাইলেন।
তাই নাকি কবে?
ওই যে যেদিন দেখা হলো ইয়েলোতে।
ওহ্ আচ্ছা।
কেন ওটা কি কথার কথা ছিল?
না তা নয়, ভাবছিলাম আপনার মিরপুর থেকে এদিকে আসতে কষ্ট হবে তাই আমিই কেন যাই না।
তো আজ আসেন। আসতে কষ্ট হবে?
আজ ?
হুম।
এখনতো প্রায় পাঁচটা বাজে।
হ্যাঁ এখন রওনা দিলে সন্ধ্যায় চলে আসতে পারবেন। আচ্ছা আপনি ঠিকানা পাঠান,আমি আসছি। ওহ্ আচ্ছা আপনার স্বামী, সে আছে কি?
নাহ্ ওতো প্রোডাকশনের কাজে ব্যস্ত। ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা একটা।
আমি বাসায় গেলে উনি কিছু মনে করবেন না তো।
না না, ওকে আপনার কথা বলেছি। মোস্তফা উদার মনের ছেলে। আমার বাসায় বন্ধুরা আসে।
আচ্ছা আমি তাহলে আপনার বন্ধু?
হা… হা… কেন কী মনে হয়?
রাকিব একটা উবার নিয়ে মিরপুর ছয় নম্বরে পপুলার ডায়গনস্টিকসের কাছে পৌঁছে ফোন করে।
এসে পড়েছি।
বাহ্ খুব দ্রুত।
ষাট ফিট দিয়ে নিয়ে এলো ড্রাইভার।
ও আচ্ছা।
সোহিনীর বাসাটা একটা চারতলা বাড়ির তিনতলায়। ফোন করলে চাবি হাতে একটা পনেরো-ষোলো বছর বয়সী মেয়ে নেমে আসে। তিনতলায় উঠে ঘরে ঢুকতেই সোহিনী। বেশ ঘরোয়া পোশাক। একটা ফতুয়া আর ঢোলা পায়জামা, চুলগুলো খোলা, পিঠে ছড়ানো। রাকিব মিরপুর আসতে আসতে ভাবছিল শান্তা আজ যা করছে তা হয়তো খুব স্বাভাবিক। ব্যস্ত ছিল কিন্তু রাকিবের মনে পাকাপাকি সন্দেহ ঢুকেছে শান্তা হয়তো ওর সঙ্গ আর চায় না। মনটা খুব ভারী হয়ে আছে।বাসাটা ছোট, ছিমছাম। বসার ঘরে বেতের একসেট সোফা, দেয়ালে কিছু মাটির ভাস্কর্য ঝোলানো। মাঝখানে একটা তেপায়ার উপর একজন নারীর ভাস্কর্য,নগ্ন। ভাস্কর্যটির সূক্ষ্ম কাজের উপর চোখ আটকে গেল রাকিবের। বাহ্ বেশ সুন্দর, আর্টিস্টিক, কার কাজ এটা?
সোহিনী বলে আমার।
বলেন কী দুর্দান্ত !
তাই?
আপনিতো অনেক ভালো কাজ করেন।
সোহিনীর চোখেমুখে একটা দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে।
আরে ধুর, কী এমন কাজ এটা।
আমি সহজে কোনো কাজের প্রশংসা করি না। এটা সত্যি দারুন। মনটা ভাল হয়ে গেল।
বাহ্ তাহলে ভাল। আপনার কি ডিপ্রেশন চলছিল বলছিলেন। শান্তার মায়াময় চোখদুটো আবার ভেসে ওঠে রাকিবের মনে।
এসব কাজ আপনারইতো দেয়ালে ঝুলছে?
হুম।
আপনিতো নাটকের ছাত্রী, ভাস্কর্য শিখলেন কবে?
না শিখিনি ঠিক। আমরা পাল বংশ। আমার মা শীলারানী খুব ভাল মাটির কাজ জানে। সবাই কমবেশী মাটির কাজ জানি। মা একটু ভিন্ন ধরনের কাজ করেন অবসর সময়ে। ছোটবেলায় মার সাথে মাটি ঘাটতে ঘাটতে কিছু শিখেছি।
বাহ্, খুব গুণী মা আপনার।
সব মায়েরাই গুণী। তারা তো আপনার মতো একজন জুয়েল তৈরি করেছেন। নিশ্চয়ই অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
আরে না, কিসের জুয়েল!
আপনি ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন, রিসার্চ করছেন। কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন।
না, সবকিছু অতো সহজ নয়। রাজনীতির চক্করে এমন বহু রাকিব হারিয়ে যায়।
আপনি হারাবেন না।
রাকিব ঘুরে ঘুরে সোহিনীর কাজগুলো দেখতে থাকে।
একজন বয়স্ক পুরুষ হাতে হুক্কা, চেহারায় পরিশ্রমের ছাপ,চামড়া কোঁচকানো।
সোহিনী রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত দু-কাপ চা, ঘরে বানানো সমুচা আর কিছু ফল নিয়ে আসে।
নিন।
রাকিব চায়ের কাপটা টেনে নেয়।
আগে সমুচা খান, আমি বানিয়েছি।
ওহ্ তাই?
রাকিব সমুচায় কামড় দিয়ে বেশ একটা উল্লাসের ভঙ্গি করে। খুব মজা হয়েছে। আমি কিন্তু দুপুরে খাইনি, সব শেষ করে ফেলবো। পেটে রাক্ষসের মতো ক্ষিধে।
ওহ্ তাহলে আরও কিছু নিয়ে আসি।
না না, এই সন্ধ্যায় এর চেয়ে বেশি খেতে পারবো না। সোহিনী ভেতরে গিয়ে একটা পিরিচে অনেকগুলো নারকেলের নাড়ু নিয়ে আসে।
সোহিনী বলে মা পাঠিয়েছে, বিয়ের পরেতো কেউ মেনে নেয়নি আমাদের বিয়ে। সমাজ যতই আগাক, দু-ধর্মের বিয়ে এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। মা একা সবার সাথে যুদ্ধ করেছে আমাকে নিয়ে।
রাকিব বলে আসলে এই ধর্ম ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে। মানুষকে বিভাজন করেছে সবচেয়ে বেশি। ধর্মযুদ্ধে ক্রসেডে, জেহাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এখনও প্যালেস্টাইনে, ইসরায়েলে, আফ্রিকার নানা দেশে যুদ্ধ চলছে।
এক সময় সারা পৃথিবীতে এক ধরনের আধুনিকতার জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল। রেনেসার পর প্রথাগত ধর্মের বাইরে বহু মানুষ চিন্তা করা শুরু করে। দেশে দেশে বিপ্লব, শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতার চরম প্রকাশ। অনেকদিন এটা চলে এখনও চলছে।কিন্তু বর্তমানে সেই তথাকথিত আধুনিকতাবাদ ভেঙে পড়েছে। পশ্চিমাদের তৈরি করা আধুনিকতার মতবাদ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। পশ্চিমা বিভাজনমূলক তত্ত্ব তৈরি করে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় উন্নয়নের নামে নয়া সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করেছে। শোষণ করেছে। এখন ধর্মও আর আগের জায়গায় নাই। ধর্মকে লেবাস করে নানা জাতি নিজেদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে।
সোহিনী বলে, হ্যাঁ কিন্তু এই সংগ্রাম কি তাদের মুক্তি এনে দিতে পারবে? এতে তো শুধু হিংসা আর বিদ্বেষই বাড়ছে।
রাকিব বলে, হুম ধর্মকে আশ্রয় করে কোনো বিপ্লব আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পালনীয়। যুদ্ধটা হওয়া দরকার নয়া সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।
আমাদের দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাটা ভয়াবহ। একটা দেশের মানুষকে ধর্মের নামে নিজের মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে, মরতে হয়েছে। এক ট্রেন লাশ এসে পৌঁছেছে পাঞ্জাবে, এসব মেনে নেয়া যায় না। দুধর্মের মানুষের পরস্পরের প্রতি যে সহমর্মিতা ছিল, একত্রে বাস করার মানসিকতা ছিল তা ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়েছে। আমাদের এখানে আটাশ পার্সেন্ট থেকে চার পার্সেন্টে এসে দাঁড়িয়েছে।
হুম আমাদের জ্ঞাতিরা সবাই ভারতে চলে গেছে। পালরা প্রায় নিশ্চিহ্ন। তাদের পেশাও আজ ক্ষয়িষ্ণু। অল্প কজন পাল নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে তাতে রুটি-রুজি চলে না।
রাকিব বলে হুম। শুধু হিন্দুরা কেন চাকমা, মারমাসহ এদেশের অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জাতিদেরকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে অনুন্নত, অনগ্রসর বলে মূলধারা হতে আলাদা করে রাখা হয়েছে। সোহিনী হঠাৎ দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে নয়টা বেজে গেছে? শুধু বকবক করলাম, আপনাকে খেতে দেই।
না না, আমি এখন খাবো না। এখন ফিরতে হবে। না আজ খেয়ে যান। দুপুরে যা আছে তাই দিয়ে খান।
প্লিজ আজ না। কিছু মনে করেন না। মা অপেক্ষা করবে। আমার ফিরতেও বেশ রাত হয়ে যাবে। আরেকদিন আমি খিচুড়ি খাবো। সেদিন মোস্তফাকেও থাকতে হবে।
আপনিতো একগুঁয়ে একবার যখন বলেছেন খাবেন না। তখন জোরাজুরি করে লাভ নেই।
রাকিব একটু হেসে উঠে দাঁড়ায়। তাই একগুঁয়ে? আপনার মায়ের নাড়ু খুব ভাল লেগেছে। ওনাকে আমার প্রণাম জানাবেন।
সোহিনী বলে এক মিনিট আসছি।
ভেতর থেকে একটা ছোট শপিং ব্যাগ রাকিবের হাতে দিয়ে বলে, আপনার ভালো প্রেজেনটেশনের উপহার।
আশ্চর্য পাগল নাকি? রাকিব প্যাকেটটা খোলার চেষ্টা করে।
সোহানী বলে, না এখন খোলা যাবে না। বাড়ি গিয়ে দেখবেন।
রাকিব বেশ অবাক হয়ে ব্যাগটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফেরার পথেও উবারে ফেরে। গাড়িতে উঠেই প্যাকেটটি খুলে দেখে একটা রূপালী মোড়ক দিয়ে প্যাঁচানো ছোট একটি নারীমূর্তি, মাটির। গালে হাত দিয়ে বসে কিছু ভাবছে। বেশ নিখুঁত কাজ। রঙটা পোড়া পোড়া তামাটে। সোহিনীর প্রতিভা এবং প্রকাশভঙ্গি ভালো লাগে রাকিবের।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত