কেউ জানতে চায়নি ( ষষ্ঠ , সপ্তম , অষ্টম অংশ )।।


রাত প্রায় সাড়ে দশটা উবার পূর্ব রাজাবাজার বাসার কাছাকাছি। একবার ইচ্ছে হলো শান্তার সাথে দেখা করে আসে। কিন্তু কেমন একটা গ্লানি কাজ করছে।অভিমান। শান্তা কি এসবের অর্থ বোঝে? অনুভব করতে পারে? রাকিব ঘরে ঢুকেই নিজের ঘরে চলে যায়। মেসেঞ্জারে শান্তাকে একটা মেসেজ দেয়। এখন কথা বলা যাবে?
ফোন করবো?
শান্তা অনলাইনেই ছিল। হ্যাঁ বলে।
রিং বাজতেই ফোন ধরে।
হ্যালো।
হুম, কী করো?
একটা বিয়ে থেকে আসলাম। এই জন্যই বসুন্ধরা মার্কেটে গিয়েছিলাম গিফট কিনতে।
ও আচ্ছা। তোমাদের প্রোগ্রাম কেমন হলো?
ভাল। খুব মজা হয়েছে। অনেকদিন পর সব কাজিনদের সাথে দেখা।
বাহ্, তা হলে তো ভাল মুডে আছো।
শান্তা চুপ করে থাকে।
রাকিব বলে শান্তা আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলা দরকার।
কোনো জরুরি কথা?
তুমি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছো।
শান্তা চুপ করে থাকে।
রাকিব বলে আমি কাল দেখা করে সব বলতে চাই। এভাবে দুজনেই বিভ্রান্ত হচ্ছি।
শান্তা বলে আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, আপনি অনেক কঠিন কঠিন করে কথা বলেন রাকিব ভাই।
না, কাল সব সহজ করেই বলবো। কাল কখন ফ্রি আছো?
কাল তো অফ-ডে। ক্লাস নাই।
হুম কিন্তু আমার তো অফিস আছে। বিকাল পাঁচটায় দেখা করি।
রাকিব ভাই আমি জানি আপনি কি বলবেন।আমারও কিছু বলার আছে।
তাহলেতো খুব ভাল। দুজনের কথাই দুজনে শুনলাম।
এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। রাখছি। কাল ছয়টায় দেখা হবে। শুভ রাত্রি।
ফোন রেখে রাকিব খুব বিপর্যস্ত বোধ করে। শান্তার গলাটা আজ খুব অচেনা লাগলো।এই তিন বছরের চেনা শান্তা যেন মুহূর্তে বদলে গেছে। রাকিব ওর ঘরে রাখা দোলন চেয়ারটাতে দোলনার মতো দুলতে থাকে। চোখ বন্ধ করে কপালে আঙুল চেপে আছে। হাসিনা বেগম এ অবস্থায় ছেলেকে দেখে বলে, কিরে সাত-সকালে প্রেজেনটেশন না কিসের জন্য যেন বের হলি। সারাদিন কোনো খবর নাই। দুপুরে ফোন করলাম, কেটে দিলি। এখন রাত এগারোটা খাবি-টাবি না?
মা আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা হচ্ছে।
ওষুধ খেয়ে নে।
হুম দাওতো টেবিলের ড্রয়ারে আছে। হাসিনা বেগম ছেলেকে ওষুধের পাতাটা দিয়ে বললেন, নে হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়,আমার শরীরটাও ভাল না।প্রেসার বেড়েছে।
এতো চিন্তা করো না। আমার চিন্তা করে প্রেসার বাড়িও না। আমি একটু গোসল করবো, চুলায় একটু গরম পানি দাও।
এতো রাতে, মাথা ব্যথা বেড়ে যাবে।
না, গরম পানিতে ভাল লাগবে। সকালে অফিস আছে। রাতের মধ্যেই সুস্থ হতে হবে। রাকিব ইষদুষ্ণ পানিতে গোসল করে রাতের খাবার খেল। খুব একটা খিদে নেই। সোহানীর ওখানে সমুচা আর নাড়ু খেয়ে পেট ভরে আছে।
সোহিনীর সাথে কথা বলতে কোনো চাপ বোধ করে না রাকিব। মেয়েটার অনেক বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা আছে,জীবনকে অনেক গভীরভাবে অনুভব করে। ভিন্ন ধর্মের একটা ছেলের সাথে বসবাস করছে। এজন্য সামাজিক-পারিবারিক নানা চাপ নিতে হয়। শান্তার বিষয়টা অন্যরকম। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের আদুরে মেয়ে, কখনো না শুনতে হয়নি জীবনে। রাকিবকে হয়তো প্রশ্রয় দিয়েছে নিজের খেয়াল-খুশি মতো। এখন হয়তো মন বদলে গেছে। রাকিবের প্রচণ্ড মন খারাপ লাগতে থাকে। রাতে ঘুম আসছে না, শেষে রাত তিনটার সময় উঠে ব্রোমাজেপাম থ্রি মিলিগ্রাম খেয়ে নেয়। সকাল আটটায় মার ডাকে ঘুম ভাঙে।
কিরে অফিসে যাবি না? উঠছিস না যে।
হুম বলে রাকিব দ্রুত তৈরি হয়ে নেয়। এক টুকরো রুটি আর চা মুখে দিয়ে দৌড় দেয়। আজ দেরি হয়ে যাবে। মহাখালীর যানজটে পড়লে একদম দশটা বেজে যাবে। অফিসে নিজের ডেস্কে পৌঁছে দ্রুত গত দিনের কাজ নিয়ে বসে। যতোটা সম্ভব সম্পাদনা করা যায় করে।
মিডিয়া সেকশনের হেড কাকলি আপা রুমে ডাকে।
রাকিব কী অবস্থা?
ভালো। আপনি ভালো।
হুম।
তোমার কাজটা শেষ?
প্রায়। আপনি একটু সাজেশন দিতে পারেন।
না না তুমি করলে আমার দেখার দরকার নাই। স্ক্রিপ্টটা তুমি সুফিয়ানকে দিয়ে দাও। আমি ডেকে পাঠাচ্ছি।
হ্যালো সুফিয়ান একবার আসো।
কোকড়া চুলের সুফিয়ান কাচের দরজা ঢেলে রুমে ঢোকে। চেহারা উস্কো-খুস্কে। রাতে মনে হয় ঘুম হয়নি, দেখতে অনেকটা অঞ্জন দত্তের মতো। সুফিয়ান স্ক্রিপ্ট ইজ ফাইনাল। তোমরা প্রোডাকশনের কাজে চলে যেতে পারো। কোনো কিছু জানার থাকলে রাকিবের সাহায্য নিও। আমি আবার কিছুদিনের জন্য ভূটান যাচ্ছি।
ওহ্ তাই। দারুণ জায়গা কাকলি আপা, সুফিয়ান বলে। ওদের ঝাল ঝাল খাবার আর শান্ত-সমাহিত পাহাড়ের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
তুমি গিয়েছো নাকি!
হ্যাঁ তিনবার গেলাম। থিম্পুতে ছিলাম। ওখানে আমার দুজন বন্ধু থাকে। আপনি চাইলে ওদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেব।
আচ্ছা দিও। এখন যাও, রাকিবের সাথে পরের প্রজেক্ট নিয়ে আলাপ আছে।
কাকলি আপা খুব কাজের মানুষ। প্রতিষ্ঠানটা ওনার দক্ষতার জন্যই দিন দিন বেড়ে উঠছে। রাকিবের কাজ, স্ক্রিপ্ট রাইটিং ওনার খুব পছন্দের। এমন কী পরিচালনাতেও উনি রাকিবকে রাখতে চান। তবে রাকিবকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে কবে কাজ ছেড়ে চলে যায়।
রাকিব তোমাকে নিয়ে ভয় হয় কবে আমাদের ছেড়ে চলে যাও।
হা … হা… না না এতো জলদি যাচ্ছি না, আর যেখানেই যাই, আপনাদের কাজের সাথে আছি সব সময়।
সেটাতো খুবই ভালো। আমি জানি তুমি কাজটা ভালোবাসো।
কাকলি আপা নতুন একটা প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে রাকিবের সাথে কথা শুরু করে। প্রায় চারটা বেজে যায়। মাঝে খাবার এনে খাওয়ান। ওনার যে ভাবভঙ্গি তাতে মনে হচ্ছে সন্ধ্যার আগে উঠবেন না।
রাকিব একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে কাকলি আপা আমার খুব জরুরি একটা এপয়নমেন্ট আছে। ছয়টায় পৌঁছাতে হবে।
ওহ্ কিন্তু আমি ভাবলাম আজকেই পুরো স্টোরি লাইনটা নিয়ে আরেকবার আলোচনা করি।
সরি কাকলি আপা আজ যেতে হবে, কাল সকালে এসে শুরু করি।
ওকে নো প্রব্লেম। আমি আরেকটু আগিয়ে নেই। তুমি যাও। কী ব্যাপার এমন অস্থির হয়ে আছো, প্রেম-ট্রেম নয়তো?
রাকিব মৃদু হেসে দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়। শান্তাকে ধানমণ্ডি তিনের একটা রেস্তোরাঁয় আসার জন্য টেকস্ট করে রাকিব। শান্তা আসবে জানায় মেসেজে। একটা সিএনজি নিয়ে ধানমণ্ডি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সোয়া ছয়টা বেজে যায়।
রেস্তোরাঁর দোতলায় ওঠার পথটায় একটা কাঠের সিঁড়ি। একদিকে সিমেন্টের চেয়ারে বসার ব্যবস্থা। অধূমপায়ীদের জন্য। অন্যপাশে চেয়ার-টেবিল সাজানো ধূমপায়ীদের জন্য। ওখানেই লোক বেশি। রেস্তোরাঁর পেছন দিকে বেশ গাছপালা। রাকিব ওখানে পৌঁছে দেখে শান্তা তখনও এসে পৌঁছায়নি। একবার ভাবে ফোন করবে পকেট থেকে ফোনটা বের করে আবার রেখে দেয়। নিজের অস্থিরতা শান্তাকে আর দেখাতে ইচ্ছে করছে না। ধূমপায়ীদের জায়গায় বসে সিগারেট খেতে থাকে একটার পর একটা। পাশের টেবিলে একটা জুটি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। মেয়েটি খালি পা দিয়ে ছেলেটির পায়ে স্পর্শ করছে, হাত ধরে আছে। মাঝে মাঝে মেয়েটি ছেলেটির ঘাড়ে ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করছে। ছেলেটির একটি হাত মেয়েটির দুই উরুর মাঝে। রাকিব চোখ সরিয়ে নেয়, ওয়েটারকে ডাকে।
আমাকে এক কাপ ক্যাপাচিনো কফি।
স্যার আর কিছু অর্ডার করবেন।
নো, থ্যাঙ্কস।
প্রায় এক ঘণ্টা পর শান্তা এলো। আজ চোখে-মুখে তেমন কোনো উচ্ছ্বলতা নেই। কেমন একটা মলিনতা সারা মুখে লেপ্টে আছে।
সরি রাকিব ভাই বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে, ঝামেলা ছিল।
সমস্যা নাই, আমারও দেরি হয়েছে অফিস থেকে বেরোতে।
আপনার অফিস কেমন চলছে?
ভাল। ছোট পরিসর কিন্তু কাজটা করে আনন্দ পাচ্ছি।
বাহ্ তাহলেতো ভালোই।
হুম, তবে এটা পুরোপুরি আমার কাজের জায়গা নয়। পড়ানোর ইচ্ছাটাই আমার প্রবল।
হুম। সেটাতো আপনি পারবেন।
তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
হুম ভালো না, মনোযোগ নাই।
ওহো, কেন?
কেন জানিনা কিন্তু নাই।
ওহো, আমিতো তোমার সাবজেক্ট কিছুই জানিনা, না হলে দেখিয়ে দিতে পারতাম।
থ্যাঙ্কস। আপনি পড়াতে শুরু করলে দৌড়ে পালাবো।
রাকিব ওয়েটারকে ডাকে।
শান্তা মেনু দেখে আজ তুমি অর্ডার করো।
আপনি করেন।
না তোমার পছন্দে আজ খাই। তবে আমি খাওয়াচ্ছি।
আচ্ছা বলে শান্তা দুটো ভেজিটেবল কাটলেট আর মাঞ্চুরিয়ান ফিস উইথ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার করে।
রাকিব সরাসরি শান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর হাত দুটো ধরে। শান্তা একটু কেঁপে ওঠে।
ওর হাত দুটো শীতল, রাকিব কোনো উত্তাপ বোধ করে না কিন্তু কেমন যেন একটা আকর্ষণ। ওকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না।
শান্তা এতোদিনে তুমি জেনে গেছো নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ভীষণ…
শান্তা হাত দিয়ে রাকিবকে থামতে বলে।
আমি জানি রাকিব ভাই। প্রথম থেকেই আপনি আমার প্রতি ভীষণ দুর্বল, আমাকে অনেক কেয়ার করেন, পছন্দ করেন।
আমি শুধু তোমাকে পছন্দ করি না তোমাকে আমার সঙ্গী হিসেবেও প্রত্যাশা করি।
শান্তা রাকিবের হাত দুটো সরিয়ে বলে, আমিও আপনাকে পছন্দ করি। ইনফ্যাক্ট আপনার মতো কারো সাথে আমার পরিচয় হয়নি কখনো। আপনি মেধাবী, খুব রোমান্টিক, আবেগপ্রবণ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।
রাকিব চুপ করে শান্তার কথা শোনে।
শান্তা বলে প্রথমদিকে আমিও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, যদিও তা প্রকাশ করিনি, স্বাভাবিকভাবে মিশেছি আপনার সাথে। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি আমাদের সম্পর্কটা আগাচ্ছে না। আমার ধরণটা অন্যরকম, আপনার সিরিয়াস ধাঁচটা আমার না। আপনাকে বন্ধু হিসেবে, ফিলোসফার হিসেবে ভাল লাগে কিন্তু জীবনের পার্টনার হিসাবে ঠিক আমরা পরস্পরের উপযোগী নই।
এসব ভেবেই কি মানুষ প্রেমে পড়ে?
শান্তা বলে না, তা পড়ে না কিন্তু আমি আপনার প্রেমে পড়ি নাই। সরি রাকিব ভাই, কথাগুলো বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে, জানি আপনার মনের কী অবস্থা কিন্তু না বলে পারছি না।
রাকিব চুপচাপ বাইরের গাছপালার দিকে তকিয়ে থাকে।
ওয়েটার খাবার দিয়ে যায়। রাকিব শক্তমুখে ছুরি দিয়ে ফিশ ফ্রাই কেটে খেতে থাকে। ওর শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওকে পানির মধ্যে চেপে ধরেছে, কিছুতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওর শরীরে যেন ফুলকা গজিয়ে গেছে তা দিয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে। হাত থেকে কাঁটা চামচ নীচে পড়ে যায়, শান্তা তুলে দিতে গেলে রাকিব না করে, খাবারের প্লেটটা সরিয়ে রাখে। ফ্যানের নীচেও রাকিব দরদর করে ঘামছে। বারবার চশমা খুলে টিস্যু দিয়ে মুছছে। যখন চশমাটা খুলছে শান্তাকে খুব ঝাপসা দেখাচ্ছে, অচেনা কোনো মেয়ের মতো আবার চশমা পড়লে পরিচিত লাগছে।
শান্তা মাছ ভাজাটা কেটে খাচ্ছে। রাকিবের মনে হচ্ছে একটা কাঁচা মাছ ছুরি দিয়ে কেটে খাচ্ছে। ওর বমি আসছে, দৌড়ে ওয়াশ রুমে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে থেকে চোখে মুখে ঘাড়ে পানি দিয়ে ফিরে আসে।
ততক্ষণে শান্তার খাওয়া শেষ। শান্তা বলে রাকিব ভাই আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে, কিন্তু আমরা যদি সম্পর্কিত হই সেটা দুজনের জন্যই ভালো হবে না। আপনার অনুভূতি আমি বুঝি কিন্তু তার সাথে একাকার হতে পারি না। আপনি নিশ্চয়ই চমৎকার কোনো সঙ্গী খুঁজে পাবেন।
রাকিব কোনো কথা বলে না, ওর শরীর খারাপ লাগছে। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে, পকেট থেকে ওষুধ বের করে খায়।
আপনার শরীর খারাপ লাগছে? শান্তা বলে।
রাকিব বলে আমি এখন যাই শান্তা।
আমিও তো যাব।
রাকিব ওয়েটারকে ডেকে বিল দিয়ে দেয়, শান্তা বিল দিতে চাইলে কোনো কথা বলে না।


দুজনে কাঠের চিপা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। রাকিব রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েই জোরে হাঁটতে শুরু করে।
শান্তা হাত নাড়ে, রাকিব তা লক্ষ্য করে না। ঘোরগ্রস্তের মতো হাঁটতে থাকে। চারপাশের মানুষজন, গাড়ি কোনো কিছুই গ্রাহ্য করে না। মনে মনে ভাবে, শান্তা ওকে একটুও ভালোবাসে না? কোথাও যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বুকে চাপ চাপ অনুভূতি, মাথাটা ভারশূন্য। হাঁটতে হাঁটতে রাকিব রায়েরবাজারের মিতালী রোডে চলে আসে। ওখানে ওর স্কুলের বন্ধু মনসুর থাকে। বাসায় আছে নাকি জানা নেই, তবু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনতলায় বেল দেয়।
মনসুর বারান্দায় আসে।
আরে রাকিব তুই? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
রাকিব তিনতলায় উঠে বলে আমার মন ও শরীর দুটোই খারাপ একটু কিছুক্ষণ একা থাকি, পরে কথা বলছি।
তুই এতো ঘামছিস কেন?
মনসুর রাকিবকে এক বোতল পানি দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মনসুর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। স্কুলে রাকিব ছিল প্রথম, মনসুর দ্বিতীয়। মনসুর রাকিবকে খুব ভালো করে চেনে, বুঝতে পারে। শান্তার কথা ও শুনছে। একদিন বলেছিল, মেয়েটাকে সরাসরি বলে ফেল তোর ভালো লাগার কথা। এভাবে সময় অপচয় করে পরে পস্তাতে হতে পারে। রাকিব যখন মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে তখন মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়ে যায়। ফোনটা সাইলেন্টে দিয়ে মনসুরের কাছ থেকে একটা ঘুমের ওষুধ নিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

রাকিবের মা বহুবার ফোন করে রাকিবকে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। রাত সাড়ে বারোটায় মনসুরের ডাকে রাকিবের ঘুম ভাঙে। ফোনে মায়ের অসংখ্য কল দেখে জানায় রাতে মনসুরের ওখানে থাকবে। হাসিনা বেগম বেশ অবাক হয়। ছেলে সাধারণত বন্ধুদের বাসায় রাতে থাকে না, সারাদিন আড্ডা দিলেও রাতে বাসায় ফিরে আসে। আজ ব্যতিক্রম দেখে হাসিনা বেগম একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কিছুদিন ধরেই দেখছে ছেলে খুব বিষণ্ণ থাকছে। কাজের ছাড়া কোনো কথা বলছে না, কী এক চিন্তায় মগ্ন। ইদানিং মাইগ্রেনের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। রাকিব কোনো কিছু নিয়ে খুব অস্থির হলে এমন হয়। হাসিনা বেগম ভেবেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি নিয়ে ছেলে হয়তো চিন্তিত তাছাড়া নতুন চাকরি। মাকেতো কিছুই বলে না। হাসিনা বেগম কিছু বলতে গেলেই ছেলে দার্শনিকের মতো কথা বলে।
মনসুর রাতে রাকিবকে খাওয়ার জন্য অনেক বলে কিন্তু রাকিব কিছুই খায় না, একটু বমি করে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে উঠে দুবন্ধু বাইরে একটা নাস্তার হোটেলে ঢোকে।
কিরে রাকিব কী হয়েছে তোর? কিছুইতো বুঝতে পারছিনা, এনিথিং রং?
হুম।
বল আমাকে। নাকি বলতে চাচ্ছিস না?
না বলার কিছুই নাই। শান্তার কথাতো তুই জানিস।
হুম, ও তোকে কিছু বলেছে?
হ্যাঁ। সে আমার প্রেমে পড়ে নাই। প্রথম দিকে একটু ঘোর ছিল পরে বন্ধুর মতো মিশেছে।
আমি তো তোরে আগেই বলেছিলাম। তোর অনুভূতিটা ওকে জানা। এটা তো দেবদাসের যুগ না যে মাসের পর মাস শুধু ভাবতে ভাবতেই কেটে যাবে, কষ্ট পেতে থাকবি। এখন ছেলে-মেয়েরা অনেক ফাস্ট, সবার হাতে সময় অনেক কম। আজ একটা সম্পর্ক হচ্ছে কাল আরেকটা। কেউ তোর জন্য হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করবে না।
কিন্তু শান্তা তো আমার সব আচরণে সাড়া দিত। কথা বলতো, ঘুরতো, বাসায় নিয়ে গেছে।
মনসুর বলে হয়তো তোকে পছন্দ করে, তোর ইমোশনটা এনজয় করে, এর বেশ কিছু না।
রাকিব বলে কিন্তু আমার তো তা মনে হয়নি।
তোর কী মনে হয়েছে?
মনে হয়েছে ও কিছুটা ইমম্যাচিউরড, সরল প্রকৃতির। আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে আড়ষ্টতা কাজ করেছে। সেজন্যই ওকে সময় দিয়েছি। যাতে নিজের অনুভূতিটাকে বুঝতে পারে, আমাকে জানাতে পারে।
শান্তাতো তাই করেছে। ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে তোকে জানিয়েছে। সে যে তোর প্রেমে পড়ে নাই এটা জানিয়েছে। আবার এমন হতে পারে প্রথমে প্রেমে পড়েছিল। এখন কেটে গেছে।
হুম।
রাকিব আমি জানি তুই খুব ইমোশনাল। তিনটা বছর ধরে শান্তার সাথে মিশছিস। এখন এভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে খারাপ লাগছে। তোর সুপার ইগো মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এজন্য তুই নিজেই দায়ী। এখন ওই মেয়ের চিন্তা বাদ দে। কম্পিউটার নতুন করে রিস্টার্ট কর, চারপাশে তাকা। জীবন বৈচিত্র্যময়। কষ্টটাকে খুব দ্রুত মন থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
হা… হা… তুই তো পুরো যন্ত্রের ভাষায় কথা বলতেছিস।
হ্যাঁ বলতেছি। কারণ জীবন একটা যন্ত্র। এর কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে মেরামত করতে হয়।
হা… হা… রাকিব জোরে জোরে হাসতে থাকে।
মনসুর বলে কেন তুই কি এখন দেবদাস সেজে মদের বোতল হাতে নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে গান শুরু করবি?
হা… হা… ইউ আর রিয়্যেলি ফানি মনসুর। এ জন্যই তোর কাছে এসেছি। তুই একটা চিজ।
মনসুর হাসতে থাকে। এসেছিস ভাল করেছিস। শোন এখন অফিসে যেতে হবে। রাতে যে খেল দেখালি। কথা বলিস না। গুম মেরে ছিলি। খাবার খেলি না। এক থাপ্পর লাগাতে ইচ্ছে করছিল।
হা… হা… লাগাতি। থাপ্পর লাগালে অবশ্য ভালোই হতো, মাইগ্রেনের ব্যথাটা ছুটে পালাতো। তোর হেলেনের খবর কি?
ওরে হেলেন অফ ট্রয়। ওকি আর আছে এই সেঞ্চুরিতে।
ওমা, তাই নাকি? নাই।
নো। তোকে কী বললাম এখন সম্পর্ক খুব দ্রুত বদল হয়। প্রেম করে বিয়ে করে, দুদিন পরেই অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এটা এমন কিছুই না।
রাকিব বলে তোর তো প্রেমের হাজারটা কেস।
হ্যাঁ কী করবো বল। বুয়েটের তমা থেকে শুরু করে এই হেলেন পর্যন্ত সবাই এতো বেশি নাক উঁচু ভাব করেছে। ওদেরকে সহ্য করতে পারি না। এখন সব বিদায়। স্টেটসে একটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করছি। এডমিশন হলে চলে যাব। তারপর আমি চিনিগো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনি। মানে একজন ফরেন উমেনকে শাদী মোবারক করে দেশে আসবো।
হা… হা… ব্রিলিয়ান্ট।
তুই ওসব শান্তা-ফান্তা বাদ দে। মেইক ইউর ক্যারিয়ার এন্ড দেন ফাক দিস লাইফ।
শাট আপ। চল উঠি, অফিসে দেরি হয়ে যাবে। দুজনে একটা উবার নিয়ে নেয়। মনসুর রাকিবকে মহাখালিতে নামিয়ে দিয়ে গুলশানে নিজের অফিসে চলে যায়।
রাকিবের মাথাটা এখনও দপদপ করছে। মনে হচ্ছে কেউ কানে থাপ্পর মেরেছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা। চাপা অবস্থায় আছে। শান্তার সাদা সরু আঙুলগুলোর ছোঁয়া এখনও টের পাচ্ছে হাতে। মনটা এমন অবস্থায় আছে যেন কেউ মারা গেছে। খুব কাছের কারো মৃত্যুর পরে যেমন অনুভূতি হয়।জিভ স্বাদহীন। চোখে একটা ভোঁতা অনুভূতি। আজ কাকলি আপার সাথে কাজ করতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যই মনোযোগ দিয়ে নতুন প্রজেক্টের পেপারগুলো পড়তে শুরু করে। কোনোভাবেই অবসাদগ্রস্ত হওয়া যাবে না। তাহলে সেখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন হবে। রিশেপশনের রিমি রাকিবকে দেখে মুচকি হাসে, রাকিবও হাসি বিনিময় করে। নিজের ডেস্কে কিছুক্ষণ বসে সোজা কাকলি আপার রুমে ঢোকে। কাকলি আপা তখনও এসে পৌঁছায়নি।
রাকিব আবার ডেস্কে এসে এক কাপ চা বানিয়ে খায়। পাশের ডেস্কের সবুজ বলে রাকিব আপনাদের নতুন স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ।
আরে না। কাল মাত্র কাকলি আপার সাথে মিটিং হলো। আজও কিছু আলাপ আছে।
স্ক্রিপ্ট আপনিই করছেন?
হুম।
আপনার ভাগ্যটা ভালো নতুন এসে খুব দ্রুত সব কাজ শিখে নিয়েছেন। আমরা এতোদিনে তেমন কিছু শিখতে পারলাম না।
তা কেন হবে? আপনার ‘নদী ভাঙন’ নিয়ে করা ডকুমেন্টারিটা দারুণ হয়েছে।
ওই একটাই। এবারের স্টোরি লাইনটা কি?
মূলত একজন আদিবাসী নারীর পাহাড় থেকে সমতলে মানে রাজধানীতে আসার গল্প। তার সংগ্রাম, জাতিগত-ভাষাগত স্ট্রাগল, কিভাবে মূল ধারার সাথে টিকে থাকতে লড়ে যাচ্ছে, এসব। একটা লিনিয়ার স্টোরি। রাঙামটিতে যেতে হবে।
বাহ্। কবে যাচ্ছেন?
এখনও ঠিক হয়নি।
রাকিব চা শেষ করে নিজের ডেস্কে এসে বসে। ল্যাপটপে ফেসবুক খুলতেই শান্তার বার্তা।
আমি খুব দুঃখিত রাকিব ভাই। আমাকে কি ক্ষমা করবেন কখনো?
রাকিব কোনো উত্তর না দিয়ে শান্তার বার্তাটা সংরক্ষণ করে রাখে। নতুন অনেক বন্ধু হওয়ার অনুরোধ ।উর্মিলা নামের একজন লিখেছে, গত সপ্তাহে বিডি নিউজ-টুয়েনটিফোরে ঔপনিবেশিক সাহিত্য নিয়ে আপনার লেখাটা পড়লাম। ভালো লিখেছেন। রাকিব একটা ধন্যবাদ দিয়ে সোহিনীর ফেসবুকে একবার ঢু মেরে বেরিয়ে যায়।
স্ক্রিপ্ট শুরু করার আগে ছোট একটা কনসেপ্ট পেপার লিখতে থাকে।
কাকলি আপার ফোন। রাকিব এক ঘণ্টা পরে রুমে আসো। আমি একটু ব্রেইন স্টর্মিং করছি।
ওকে আমিও কনসেপ্ট পেপার লিখছি।
ওকে। ভেরি গুড। ওটা নিয়ে চলে এসো। লিখতে লিখতে প্রায় একটা বেজে যায়। সারা দুপুর দুজনে নানা তথ্য, লিঙ্ক ঘাটাঘাটি করে গল্পটা প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলে।
পরদিন থেকে পাণ্ডুলিপি লেখা শুরু হবে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়েই রাকিবের আবার গতকালের অনুভূতি ফিরে আসে। মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। কোথায় যাবে ভেবে পায় না। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। একবার সোহিনীর কথা মনে হয় আবার ইচ্ছে করে না। আসলে এই সময়ে কেউ কারো ক্ষত পূরণ করতে পারবে না, কিন্তু ভাল বন্ধুর সঙ্গ মনটাকে সচল রাখবে। মনসুরকে ফোন দেয়।
তুই অফিসে আছিস?
আছি মানে, আজ রাত কয়টা বাজবে ঠিক নেই।পুরো গিট্টু লেগে গেছে।
ওহো।
তুই কোথায়?
অফিস থেকে বের হলাম।
মন-টন ঠিকঠাক?
রাকিব হাসে।
মনসুর বলে আচ্ছা এক কাজ কর অফিসে চলে আয় । দুজনে একটু খাওয়া দাওয়া করি তারপর তুই চলে যাস, আমি কাজ করবো।
রাকিব গুলশান দুইয়ে মনসুরের অফিসে যায়। খুব সাজানো-গোছানো অফিস, শৈল্পিক। কিছুক্ষণ মনসুরের রুমে বসে গল্প করে তারপর বেরিয়ে মনসুরের পরিচিত এক ছোট হোটেলে যায়। ওখানে ভেতরে বার আছে। গোপনীয়। কিছু খদ্দের শুধু জানে এর খবর।
দুজনে একটা ব্র্যান্ডি নিয়ে বসে। সাথে বাদামভাজা আর আইস দেয়া হয়।
বেশ অনেকটা শেষ করে দুজনে বেরিয়ে আসে।
বোতলটা মনসুর রাকিবকে দিয়ে দেয়। তুই নিয়ে যা, আমার বাসায় স্টক আছে।
না, না আমি তো তেমন খাই না।
আরে খেলে কিছু হবে না। যখন ইচ্ছে হবে রাতে বারান্দায় বসে খাবি। বোতলটাকে একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা উবার নিয়ে রাকিব বাসার দিকে রওনা দেয়।
সোহিনীর ফোন।
হ্যালো।
হ্যালো কী খবর রাকিব? কেমন আছেন?
এই আছি, চলতেছে।
কেন না চলার মতো কিছু হয়েছে কি?
হা… হা… প্রায় খাদের মুখে চলে এসেছিলাম।
তো পড়ে যাননি তো?
এখনও যাইনি। যেতে কতক্ষণ?
তাই? গুড।
সোহিনী আপনি ড্রিঙ্ক করেন? জিজ্ঞেস করলাম কিছু মনে করবেন না।
না না মনে করবো কেন? হ্যাঁ করি।
তবে খুব কম। মোস্তফার সাথে খাই। এছাড়া আমাদের নাটকের দলের বন্ধুরা দাওয়াত দিলে কখনো-সখনো।
আচ্ছা তাহলে আমার খিচুড়ি খাওয়ার দাওয়াতটা দেন? ওই দিন পার্টি হবে।
ওকে, কবে আসতে পারবেন?
ছুটির দিন তো অবশ্যই। শুক্রবারে হলে ভালো হয়।
আচ্ছা আমি মোস্তফার সাথে কথা বলে জানাবো।
আচ্ছা।
আজ কি টাল নাকি?
কেন?
একটু গলাটা ধরা ধরা লাগছে।
রাকিব হাসতে হাসতে বলে, কিসের টাল? তিন-চার পেগে টাল হওয়া যায় না।
ও আচ্ছা, খুব ভাল। রাতে ভাল ঘুম হবে।
রাকিব বলে হ্যাঁ আমার খুব ঘুম দরকার। খুব ক্লান্ত লাগছে, মনে হচ্ছে অনেক দিন ঘুমাইনি, জেগে আছি।
সে কি? রাতে ঘুম হয় না?
এখন রাখছি সোহিনী।
আচ্ছা, ঠিক আছে।


রাকিব বাসায় ফিরে সোজা গোসলখানায় চলে যায়। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে মার ঘরে আসে। হাসিনা বেগম একটা বই পড়ছিলেন খাটের সাথে হেলান দিয়ে।
কী বই মা?
নিমাইয়ের মেম সাহেব।
হা… হা… তুমি তো এই বই মুখস্ত বলতে পারবে। ছোটবেলায় থেকে দেখছি প্রায়ই পড়ো।
কী করবো খুব ভালো লাগে যে। তোর তো তত ভালো লাগে নাই।
হুম। ভাল কিন্তু এতো আবেগ আমাকে টানে না। সাহিত্যে আমি আরেকটু ভিন্নতা খুঁজি। নিমাই বাবু সবাইকে টানেন। তার মেম সাহেবের গল্প শুনিয়ে সবার চোখে জল নিয়ে আসেন। এটা এক ধরণের সাহিত্য। আরও কত ধরণের যে আছে।
হাসিনা বেগম বলেন, আমি অত-শত বুঝি না। তোর ওই হাসান আজিজুল হকের গল্প আমার ভালো লাগে নাই। জীবনকে এতো নির্মমভাবে দেখা আমার পছন্দ না।
কিন্তু জীবনতো তাই।
কেন, এখানে আবেগ-অনুভূতি, মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা কিছু নাই? সব মিথ্যা?
আছে মা,থাকবে না কেন? কিন্তু রুঢ় বাস্তবতাকে এড়িয়ে সাহিত্য রচনা করা হয় অনেক সময়। কোলকাতায় এটা প্রচুর হয়েছে। তোমরা তার পাঠক।
আচ্ছা আচ্ছা তোর সাথে কে পারবে? আজ তোর মনটা একটু ভাল মনে হয়, মাথা ব্যথা আছে?
মা সবই আছে, তবু চালিয়ে নিতে হবে তো।
শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে
একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে।।কার কবিতা বলো তো মা?
সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তোর ছোট মামা খুব জোরে জোরে পড়তো। ও কমিউনিস্ট হয়েছিল, সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কশাস্ত্রে পড়তো। সব বাদ দিয়ে কি সব আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেল। বহুদিন ফেরারী ছিল। এখনতো দিব্যি ব্যবসা করছে। কুমিল্লায় একটা পাঠাগারও দিয়েছে।
হুম জানি মা। তোমরা কেউ ছোট মামার মতো হও নি। ছোট মামার কারণেই তো এই জমিটা পেলে।
থাক এসব কথা এখন।
মা চলো কুমিল্লায় একবার নানা বাড়ি যাই।
যাবি সত্যি?
হুম, যাবো।
আমাদের ঘরটায় সালেহা বুজি থাকে আর তার ছেলে, ছেলের বউ। কবে যাবি?
যাব, তোমাকে জানাবো।
হাসিনা বেগম আলমারিটা খুলে পুরনো একটা অ্যালবাম বের করে। অ্যালবামটায় সব সাদা-কালো ছবি। চারমাথায় চারটি স্টিকার দিয়ে ছবিগুলোকে আটকে রাখা হয়েছে। ছেলের হাতে অ্যালবামটা দিয়ে বলেন এটা দেখ, আমি ভাত বাড়ছি টেবিলে। রাকিব অ্যালবামটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে একটু গন্ধ শোঁকে। কেমন একটা পুরানো গন্ধ, মনে হয় একটা যুগ এই অ্যালবামের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। ছবিগুলো কী সুন্দর, শৈল্পিক। সব স্টুডিওতে তোলা। ভালো ফটোগ্রাফারের হাতে, সাদা-কালো।
একটা ছবিতে রাকিবের নানা পাকিস্তানে সাথে নানি,রাকিবের মা, মামারা। আরেকটা ছবিতে রাকিবের মা ছোট দুই বোনের সাথে। সবাই একসাথে পিঠ দিয়ে চক্রাকারে বসে আছে। সবার লম্বা বেনী দুলানো, চোখে মায়াময় দৃষ্টি, পুরু কাজল, ছোট জামা আর ভেলভেটের ঢোলা পায়জামা, চিকন ওড়না। পাকিস্তান আমলে শহরে ও মফস্বলে মেয়েরা বেশ আঁটোসাঁটো পোশাক পরতো।রাকিবের বাবার ছবি। চোখে রাকিবের মতো পুরু কাচের চশমা, বেশ স্টাইলিস্ট ছবি; বাম কোমড়ে একটা হাত,গলায় ফ্লাস্ক ঝোলানো। ক্যামেরার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে একটু বাঁকাভাবে তাকানো। রাকিব বাবার ছবিটার গন্ধ নেয়। কিছুক্ষণ বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে। বাবার স্মৃতি খুব ঝাপসা,কম সময়ের। রাকিব ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় ওর বাবার হৃদরোগ দেখা দেয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। ওখানেই বাবা মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর হাসিনা বেগম খুব ভেঙে পড়েন। সেসময়ে রাকিবরা মোহাম্মদপুরে রাজিয়া সুলতানা রোডে থাকতো। বিহারিদের বাড়ি। বেশ সুন্দর দোতলা বাসা, বারান্দায় কারুকাজ করা। ওই বাড়িওয়ালার তিনটি মেয়ে ছিল ডালিয়া, জিনিয়া, পাপিয়া। খুব সুন্দর ছিল মেয়েরা, শার্ট-প্যান্ট পড়তো, বব কাট চুল ছিল। রাকিব ওদের সাথে সাইকেলে সারা মোহাম্মদপুর ঘুরে বেড়াতো। মেয়েদের সাইকেলের পেছনে বসে রাজিয়া সুলতানা রোড ধরে সোজা কবরস্থানের কাছে চলে যেত। কবরস্থান নিয়ে এতো গল্প শুনেছিল রাকিব, ওর মনে একটা আতঙ্ক জন্ম নেয়। পাশের বাসার দারোয়ান গল্প করতো। কবরস্থানে রাতে একজন আসে সে কোদাল দিয়ে কবরের বাঁধ কাটতে কাটতে এগিয়ে যায়। আবার চোখের পলকে নাই হয়ে যায়। দারোয়ান নিজের চোখে দেখেছে। তাবিজ বানানোর জন্য কবরের মাটি নিতে অনেকে আসে রাতের বেলা। তারা অনেকে ওই কবর খোদককে দেখেছে। এসব গল্প শুনে শুনে রাকিবের মনেও কবরস্থান সম্পর্কে খুব ভয় ধরে যায়। একদিন জিনিয়া-পাপিয়ারা ওকে চ্যালেঞ্জ দেয় ও যদি কবরস্থানের এক গেট দিয়ে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে বের হতে পারে তাহলে বুঝবে ও সাহসী ছেলে। পাপিয়ারা সবসময় রাকিবকে ভীতু ভীতু বলতো। রাকিব একদিন সাহস করে কবরস্থানের গেট দিয়ে ঢুকে এক দৌড়ে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে ঘুরপথে বাসায় ফিরে আসে। ওর বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। প্রথমে ও বাসার ছাদে চলে যায়। ওখানে বড় বোন ডালিয়া ছিল। ওর সামনে রাকিব হাঁপাতে থাকে। ডালিয়া বলে তুমি কবরস্থানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে ফিরে আসতে পারবে আমরা ভাবি নাই। রাকিব ভয়ে কিছুটা নীল হয়ে গিয়েছিল। ছাদে একটা ছোট ঘর ছিল ডালিয়া রাকিবকে সে ঘরে নিয়ে যায়। ডালিয়া রাকিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে অনেকক্ষণ থাকার পর রাকিবের মুখে চুমু খেতে থাকে। ওর সারা শরীরে হাত বোলায়। রাকিবের কিছুটা ভালো লাগতে থাকে। সারা শরীর শিরশির করতে থাকে। ডালিয়া রাকিবের যৌনাঙ্গে হাত বোলায়। রাকিবের ভেতর শিহরন তৈরি হয়। ডালিয়া রাকিবের শিশ্ন নিজের যোনিতে প্রবেশ করায়। রাকিব এক অনাস্বাদিত অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়। প্রথম নারী দেহের অভিজ্ঞতা। এরপর থেকে ডালিয়া প্রায়ই ওকে ছাদে নিয়ে গিয়ে ওই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতো। ডালিয়ার অন্য বোনেরা দরজা ধাক্কা-ধাক্কি করতো। ডালিয়া বলতো ওরা লুকান্তিস খেলছে। ডালিয়া রাকিবের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় ছিল, স্কুলে নাইন-টেনে পড়তো। একদিন ডালিয়ার মা ছাদে এসে ডালিয়া আর রাকিবকে ওই ঘরে দেখতে পেয়ে দারুণ হৈ-চৈ শুরু করে। রাকিব ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ডালিয়ার মা ডালিয়াকে অনেক পিটায়। ওই ঘটনার পর রাকিবদের ওই বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়। রাকিবের বাবা তখন খুব অসুস্থ। রাকিব ওই ঘটনায় মনে মনে খুব ভেঙে পড়ে, ডালিয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে কষ্ট হতো কিন্তু কাউকে বলতে পারতোনা। ওই ঘটনার পর রাকিবের মা রাকিবকে কিছুই বলেন নি। উনি ধরে নিয়েছেন ডালিয়া তার ছেলেকে জোর করে সবকিছু করেছে। রাকিব ছোট ছেলে, যৌনতা বিষয়ে ওর কোনো ধারণা নেই। ডালিয়ার সাথে অভিজ্ঞতা রাকিবকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলে। পরে স্কুলে বন্ধুদের কাছে তাদের নানা যৌন অভিজ্ঞতা শুনে বুঝতে পারে নারী-পুরুষের এই বিষয়টা খুব স্বাভাবিক কিন্তু তার জন্য একটা বয়স আছে। রাকিব সেই বয়সের আগেই অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। রাজিয়া সুলতানা রোডের বাসা ছেড়ে ওরা বাবর রোডে নতুন বাসায় এসে ওঠে। ওই বাসাতে আসার দুমাসের মাথায় একদিন রাতে রাকিবের বাবার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওই রাতে রাকিব আর ওর মা অনেক কষ্টে ওর বাবাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওখানে সারারাত রাকিবের বাবাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়। কোনো জ্ঞান ছিল না। ভোরের দিকে উনি না ফেরার দেশে চলে যান। সেই থেকে মা-ছেলের সংগ্রামের শুরু।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত