বনলতা — (৩)

৭.

পৃথিবীর জন্য মানুষ?নাকি মানুষের জন্য পৃথিবী ঘুরছে কে বলতে পারে? তবুও প্রতি রাত ভোরে এসে মেশে। সূর্য নির্লিপ্ত চোখে দেখে সুখী দুঃখী সকল মানুষকে। কারো প্রতি এতোটুকুও হেলে যায়না। জন্ম মৃত্যু সবই সমান তার কাছে।

দরজায় মৃদু টুক টুক শব্দে ঘুম ভাঙে বনলতার। একটা আস্ত রাত সম্পূর্ণ ঘুমে কাটালে শরীর জানান দেয় কতটা ভালো লাগার আমেজ মিশে থাকে দেহের পরতে পরতে!

চোখ ঘুরিয়ে সারা ঘরে দৃষ্টি বোলায় বনলতা। সারাঘর সকালের তীব্র আলোয় ভরে আছে। আজ কি সূর্য বেশি আলো ছড়াচ্ছে! ঝটপট উঠে কাপড় ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দেখে শাশুড়ী মা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। বললেন
– শুভ জন্মদিন আমার লক্ষীমা।
জন্মদিনের পায়েস তৈরী করেছেন নিজের হাতে। কোনোবার এর অন্যথা হয়নি।

বনলতা মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় একবার নিজের দিকে দেখে। অনেক বেশি ফ্রেশ লাগছে আজ নিজেকে। রোজ ঘুম ভাঙার পর যে ম্যাজমেজে ভাবটা কাজ করে, মাথা ঝিমঝিম করে আজ তার কিছু অনুভব হচ্ছে না। নিজেই নিজেকে দেখে একটু হেসে বলে – শুভ জন্মদিন বনলতা।

শাশুড়ীমা নিজের হাতে পায়েস মুখে তুলে খাইয়ে দেন। নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করে নিলো চট করে। একাজ অবশ্য করা হয়না সচরাচর দুই ঈদ ছাড়া। আজ ভেতরের আনন্দটা একটু বেশিই যেন। এরপর হয়তো কোনোদিন আর এই সুযোগ আসবে না ভাবে বনলতা। তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন মা।

ঠিক ওই সময় ফোন আসে। রফিকের ফোন। মায়ের মুখের হাসির ব্যাস একটু দীর্ঘ হয়ে ওঠে, বনলতা খেয়াল করে। মা খেয়াল করেন বনলতার মুখে আনন্দের ঝিলিক। সেই ঝিলিক কয়েক মুহূর্তে ফ্যাকাসে রূপ নেয় তাও মায়ের চোখ এড়ায় না। উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন কোনো আশাংকার। তার আশংকা সত্য করে দিয়ে বনলতা ফোন রেখে জানায় আজ রফিক আসছেনা। আরো দুদিন পরে আসবে। কারণ ওখানে স্নিগ্ধা ভাবি আর বাদল ভাই, রফিকের বড় খালার ছেলে, গেছেন। অস্ফুটে শাশুড়ী বলে ফেলেন – স্নিগ্ধা ওখানেও… কথাটা শেষ না অন্ধকার থমথমে মুখ নিয়ে বের হয়ে যান তিনি।

বনলতার খারাপ লাগে নিজের জন্য না মায়ের জন্য। অনাবিল খুশি কি করে একটু একটু উবে যায় তা সে মর্মে মর্মে বোঝে। গতকাল রাতেও সে অভ্যাস বশত খেয়াল করেছিলো অনলাইনে রফিকের যখন সবুজ বাতি জ্বলে স্নিগ্ধা ভাবির’ও। নিজেকে স্বান্তনার সুরে বলে আজ মন খারাপ নয় বনলতা। আজ নতুন দিন।

চুপ করে ফোন হাতে নিয়ে বসে পড়ে সে। আনমনে বলে ওঠে – এর শেষ কোথায়! মেসেজ এলো একটা
– ‘শুভ জন্মদিন। নোটিফিকেশনে এলো তাই আবারও শুভেচ্ছা। খুব আনন্দ করুন। আজ আপনার দিন।’
পাঠিয়েছেন লেখক। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকে বনলতা। গতকাল তার ফ্রেন্ড হয়েছেন ভদ্রলোক। এক মুহূর্তে মনে পড়ে যায় গত রাতের কথা। লজ্জায় ভেতরটা কুঁকড়ে ওঠে। হঠাৎ এমন ছেলেমানুষী ঠিক হয়নি। বনলতা লেখে

– ধন্যবাদ।

আর কথা হয়না। তবুও কিসের চঞ্চলতা অনুভব করে বনলতা। শাওয়ার নিতে নিতে গুনগুনিয়ে ওঠে। বাইরে বেরোবে সে। ঘরের ভেতর দম বন্ধ লাগছে। বাইরের আলো হাওয়া যেন প্রবলভাবে ডাকছে তাকে।

বনলতার বাবা ফোন করেন, মা শুভ জন্মদিন জানায়। তাকে যেতে বলেন। বনলতা নিষেধ করে দেয়। মা আসতে চান, তাও নিষেধ করে দেয়। তাদের পরিবারে অবশ্য জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই। ওটা খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠান। মোম জ্বালানো, কেক কাটা খুব গুনাহের কাজ – শুনে শুনে বড় হয়েছে। তবে কি জন্ম নেওয়াটাও গুনাহের কাজ? এই প্রশ্ন তার কচি মাথায় খুব জ্বালাতন করতো। আবার এও শুনেছে তার জন্মের সময় ফুপু কাকা দাদী কতো উদগ্রীব ছিলেন। গোল মুখখানি তে বড় বড় ডাগর কালো চোখ নিয়ে বনলতা প্রথম দেখেছিলো পৃথিবীকে। ডাক্তার তার চোখে লালচে কোনো ওষুধ দিয়েছিলেন তাতে চোখ দুটো আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো – ফুপুর মুখে এই গল্প শুনে সে ভাবতো লাল ওষুধ দিলে চোখ কি করে সুন্দর লাগে!

আজ আবার সেই গল্প গুলো মনে ভেসে বেড়াতে থাকে। কতো আদর, কতো শাসন, কতো স্নেহ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে সব দিকে। সব কিছুর মাঝে সে একা। চোখে কাজল দিতে দিতে সে নিজেই নিজেকে বলে – একাই ভালো, সবাই তো এক রকম হয়না, হবেও না। আজ সারাদিন সে আনন্দেই থাকবে।

শাশুড়ী মাকে অবাক করে সে বলে
– মা আমি একটু বাইরে যাবো।
মা বলেন
– বেশ যাও। কোথায় যাচ্ছ?
– কয়েটা বই কেনার ছিলো
– রফিককে জানিয়েছ?

অন্য সময় হলে তার মন খারাপ হতো, এক পা বাইরে যেতে হলে রফিকের অনুমতি নিতে হবে। অথচ রফিক কবে কোন কাজের জন্য তার অনুমতি নিয়েছিলো!

আজ বনলতার মন খারাপ হয়না। চোখ নিচু করে ঘরে ফেরত আসেনা। সে বলে
– বই কিনতেই তো যাচ্ছি। এসে জানাবো।
আরো কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, রফিক এখন স্নিগ্ধা ভাবির সাথে আনন্দেই আছে, বলে না। সে বুঝে গেছে অপ্রিয় কথা যতটা কম উচ্চারণ করা যায় ততই ভালো। তাছাড়া বলে কখনও কিছু ঠিক করা যায় না, যদি মন না থাকে।

অনেকদিন পর বনলতা একা বাইরে এলো। সাথে কেউ নেই। গাড়ি নিলো না। এই পুরান, নোংরা, ভাঙা রাস্তার শহরটাকেই সে ভালোবাসে। যানজট, ধুলো ময়লা, মানুষের উপচে পড়া ভিড় সব ভালো লাগে তার। উৎসুক চোখে সে দেখে মানুষকে। মানুষ দেখে তাকে। হঠাৎ করেই মনে হয় কোনো পিছুটান নেই তার।

বাইরে প্রচণ্ড রোদ। এতো তাপ, ঘরে বসে কিছুই অনুভব হয়নি। রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে পানি খেতে যায়। বনলতার মায়া হয়। মানুষ কতো কষ্ট করতে পারে জীবনের জন্য। জীবন কেন বোঝেনা!

পাইকারী ফুলের দোকানের সামনে আসতেই জ্যামে আটকে থাকে রিকশা । গরমে জ্যামে আটকে থাকা লোক গুলোর বিরক্ত মুখ দেখে সে। এলাকাটা ফুলের ঘ্রাণে আর নর্দমার কাদার গন্ধের মিশেলে অন্যরকম মনে হয়। হঠাৎ করেই সে রিকশা থেকে নেমে ফুলের দোকান গুলোর দিকে আগায়। রঙিন চমৎকার সব ফুল, তবুও রজনীগন্ধার সামনে এলে কেমন পবিত্র লাগে সব। এক গোছা ফুল কিনে নেয়। ইচ্ছে করছিলো অনেক নিতে। সম্ভব না। জ্যাম টুকু হেঁটে পার হয়। এই রোদে একজন মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো এ-শহরে লোকের কাছে তা’ই দর্শনীয়। বনলতার মনে হয় সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যপারটা মন্দ না। কিছুটা হেঁটে বইয়ের দোকানে পৌঁছে যায়। ততোক্ষণে অনভ্যস্ত বনলতা গরমে ঘেমে ক্লান্ত । বিশাল মার্কেট। কতো কতো বইয়ের দোকান। থরে থরে সাজানো সব বই। মন ভালো না হয়ে উপায় নেই। ক্লান্তি ভুলে যায় সে।

সকালে লেখকের শুভেচ্ছা মেসেজ পাবার পর থেকে তার মনে হচ্ছিলো – যে মানুষটা তাকে চমকে দিয়েছে, তাকেও সে চমকে দেবে। এর উপায় নিয়ে সে তখনও ভাবেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে পারবে।

বনলতা কয়েক দোকান ঘুরে বইটি পেলোনা। দোকানিরা জানিয়েছে শীগ্রই আসবে আবার বইটা। এ সময় সে ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করে। এমন দিন কী শীগ্রই আর আসবে? সে তো আর চায়না এই দিন আসুক জীবনে। আনন্দের সাথে জীবনের শেষ জন্মদিন সে পার করবে। আজ যা যা ইচ্ছে পূর্ণ করে নেবে। এই জীবন নিয়ে আর কোনো প্রকার পরিকল্পনা নেই তার। আজ থেকেই শেষ দিনের কাউন্ট ডাউন শুরু। কোনো কাজ তার হাতে বাকি নেই। কোনো পিছুটানও নেই। অল্প একটা দুটো বই নেবে। শেষ দিনের আগে তা পড়েও শেষ করে ফেলতে হবে। বনলতা জানে সে না থাকলে তার কোনো কিছু থাকবেনা। রাখবেও না কেউ স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে।

নতুন গড়ার সময় উত্তেজনা থাকে, কোনো শেষ করার উত্তেজনাও তার থেকি কিছু কম না। কিন্তু বই না পাবার হতাশা তার সমস্ত উদ্দীপনাকে মাটি করে দেয় যখন, তখনই এক দোকানে মিলে যায় বই। দোকানী ভদ্রলোক মহা ব্যস্ত হিসাব নিয়ে বনলতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো বেশকিছু ক্ষণ।

ফেরার পথে উত্তেজনায় সমস্ত পথ সে বইয়ের প্যাকেটটা বুকে চেপে ধরে থাকে। এই জঞ্জাল জীবন থেকে মুক্তির শেষ সাক্ষী থাকবে বইটি। সব শেষ করার নতুন পথ পেয়ে যেতে পারে সে। কিংবা কোনো সহজ উপায়।

অবশ্য না পড়া অব্দি সে কিছু ভাবতে পারেনা। জীবনান্দ দাশের জীবনে বুঝি সব উদ্দীপনাই হারিয়ে গিয়েছিল! মানুষটিকে জানতে চায় সে। উপলব্ধি করতে চায় তাঁর ব্যাথার গভীরতা। কতটা গভীর হলে জীবন থেকে অব্যবহতি মেলে।

বাড়ি পৌঁছে ভাবে বনলতা বইটির লেখক তাকে গতকাল ফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহণ করে চমক দিয়েছেন, আজ সকালে পুনরায় শুভেচ্ছা জানিয়ে চমক দিয়েছেন। এর বিপরীতে ধন্যবাদ দিয়েছে সে। কিন্তু মন ভরছেনা। এমন কেন লাগছে তার সে বুঝতে চেষ্টা করে নিজের সাথে। আবার নিজেকেই বলে কি হবে এতো বুঝতে চেয়ে। তার চেয়ে বই নিয়ে ছবি তুলে লেখককে পাঠালে কেমন হয়।

বইটি নিয়ে কয়েকটি সেল্ফি তোলে। তার মধ্যে একটি লেখককে সেন্ড করে। ছবির ক্যাপশনে লেখে – ‘অবশেষে আমি পাইলাম উহাকে পাইলাম।’ নির্ঘাত ভদ্রলোক চমকিত হবেন।

বনলতা ভাবে আসলেই এবার হয়তো সে- উপায় পেলো। সহজ শেষের উপায়।

৮.

হুট করে ঝোঁকের মাথায় কাজ করতে নেই বড়রা বলেন। চিন্তাভাবনা করে ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারপর সুস্থির ভাবে কোনো কাজ করা উচিত। মজার ব্যাপার হলো বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না কোন মানুষের ভেতর কতটা স্থির বা কতটা চঞ্চল। দেখতে শুনতে শান্ত মানুষ গুলো ভেতর ভেতর খুব অস্থির হতে পারে। কোন কাজ করার আগে তাদের মনে হয় – এ-ই ঠিক। করার পর মনে হয় – ঠিক ঠিকঠাক হলো নাকি না ? তাদের মন এমন করে দুলে যেতে থাকে।

ছবি পাঠিয়ে দিয়ে বনলতার মনে হলো কাজটা কি ঠিক না ভুল করলো? কী মনে করবেন লেখক। আবার নিজেকে শান্তনা দেয় এমন তো কত জনেই ছবি দেয় বা দেবে তাতে কী-ই বা এমন হবে। রফিক জানলে অবশ্যই রাগ করবে নিশ্চিত। তাকে জানানোর কিছু নেই। জীবনে কে ক’টা কাজ কাকে জানিয়ে করে! জানাতে গেলে নানা জনের নানা মতের জন্য নিবিষ্ট ভাবনা স্থানচ্যুত হয় ফলে কাজটি আর কাজের জায়গায় থাকতে পারেনা। এই যে স্নিগ্ধা ভাবি রফিকের ওখানে যাবে রফিক নিশ্চিত জানতো, সে আরো দুদিন ওখানে থাকবে এই সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া নিশ্চিত। বনলতাকে একবারও জানায়নি। জানালে বনলতা নাও মানতে পারে, তাই জানায়নি।

নিজের প্রতি বনলতা স্বগোতক্তি করে – সবাই নিজের মতো চলছে, সে জীবনের শেষ কাজ গুলো নিজের ইচ্ছায় করলে এই পৃথিবীর কিছুই উলটে যাবে না।

‘অপার জীবনানন্দ’ বইটি, হাতে নিয়ে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। জীবনান্দকে কেন এতো খোঁজা, কি আছে তাঁর কাছে? কোন সম্পদ তিনি গোপনে দান করে চলে গেছেন নিজের ইচ্ছেয়। ক্লাস ইলেভেনে বাংলা ম্যাম একদিন বলেছিলেন – জীবনানন্দ দাশের তিনটি কবিতার নাম বলো। বনলতা বলতে পারেনি। বাড়িতে কবিতার বই নিষিদ্ধ ছিলো। তার বাবা বলতেন কবিতা খুব অকাজের বিষয়। কবিরা খুব খেয়ালি ধরনের মানুষ হয়। ওঁরা বাস্তব জীবনের সব কাজে অপটু আর বিফল হয়।

বনলতা বাবার বাধ্য মেয়ে। কবিতা, কবিতার বই কিংবা কবি সব থেকেই সে সচেতন ভাবে দূরে থাকতো। বাবারা সন্তানের যাতে ভালো হয় সে চিন্তাই করেন। অথচ ইলেভেনের ওই সময়ের কাছাকাছি সময়ে বাবার বুকশেলফ থেকে লুকানো ডাইরি খুঁজে পায়। আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করে তার বাবা কতো কবিতা লিখতেন ছাত্রজীবনে! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, প্রেম নিয়ে, দেশ নিয়ে, জীবন নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে বনলতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি কেন? সে সংসারে একজন অপটু, বিফল মানুষ হবে, তাই? একই মানুষের মনের ভেতর এক কথা আর প্রকাশ করে ভিন্ন কথা, এমন কেন? লুকিয়ে দুদিন পড়েছিলো সে, বাবার লেখা কবিতা। তৃতীয় দিন ডায়েরি আর পাওয়া গেলো না। অর্থাৎ বাবা টের পেয়েছিলেন মেয়ে ডায়েরি ধরেছে, কিছু জিজ্ঞেস করেননি। বনলতাও কিছু বলেনি। তবে আতিপাতি করে সারা ঘরে আর ডায়েরির দেখা পেলো না।

জীবনানন্দ ডায়েরি লিখতেন জানে বনলতা। এবং ওর বাবার মতো সযতনে লুকিয়ে রাখতেন। এই সময়ে থাকলে হয়তো তিনি ডায়েরি গোপন করা নিয়ে না ভেবে পাসওয়ার্ড নিয়ে ভাবতেন।

সদ্যকেনা বইটিতে হাত বুলায় বনলতা। বাইরে বিকেল শেষ হয়ে আসছে। নিত্যদিনের মতো সেই দোয়েল শিস দিয়ে যাচ্ছে। আজ সারাদিন রফিক আর ফোন করেনি। সকালে একবার মাত্র। আগামীকাল একবারও নাও করতে পারে। এ ঘটনা বনলতার কাছে নতুন না।

নতুন বউ কাল থেকে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। মানুষের ভেতরের প্রকৃতি যে এতো রহস্যময় তা কি সে জানতো কখনো? সুতরাং বোঝার প্রশ্ন আসেনা। কিন্তু স্নিগ্ধা ভাবির বর বাদল ভাই তিনিও কি কিছু বোঝেননা? নাকি বুঝে বুঝে কাজ অকাজের খেলাকে তারা উপভোগ করেন? বাদল ভাই বুঝে বুঝে বনলতার কাছাকাছি হতে চাইতেন। হয়তো মেয়ে মানুষের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহায়। তার দৃষ্টিতে যে আহবান থাকতো বনলতার প্রথম নিজের চোখের ভুল মনে হতো। গুটিয়ে যেতো না তখনও।

এক বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দেবার ছল করে ঘরভরা লোকের সামনে গিফট বক্সের নিচে বিশ্রী করে আঙুল ছুঁয়ে দেয়। বনলতার সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই গা গুলানো ইঙ্গিত পূর্ণ হাসি।

বইয়ের উপর নিজের আঙুল গুলোর দিকে সে তাকায়। কেমন একটা বুক দুরুদুরু অনুভূতি। ভালো লাগার শিরশির অনুভব। যেনো এই স্পর্শের মতো পবিত্র কিছু হয়না। এখানে অনেক শব্দ আর অজানা যে জগৎ আছে তার ভেতর ডুব দেবার জন্য সে আর অপেক্ষা করতে পারেনা। নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়, এই সময়ে মেসেজ আসে লেখকের
– আপনার জন্মদিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন!

বনলতার খুশিতে আরেকটি মাত্রা যোগ হয় সে জানায়
– আসলে আমি এতো আনন্দিত বইটি পেয়ে, তাই ছবি দিলাম।

– পড়েছেন?

– না, এখন বসবো পড়তে।

এই বসবো পড়তে বলার ভেতর বনলতার সারল্য প্রকাশিত। কতোভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে বলা যেতো কথাটা। লেখককে সেই সারল্য ছুঁয়েছিলো কিনা তা লেখক জানেন। মানুষের মন ছুঁয়ে নিঙড়ে আবার তাকে সরস করার শক্তি লেখকদেরই থাকে। তবে তিনি সংক্ষিপ্ত ভাবে লেখেন
– পড়া শেষ হলে জানাবেন, কেমন লাগলো।
– নিশ্চয়ই।

কথা শেষ। তবুও স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে বনলতার। এই ভালো লাগার কোন নাম নেই।

——- ——- ——-

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত