ঠুল্লো (৫)

১ম পর্ব:

২য় পর্ব:

৩য় পর্ব:

৪র্থ পর্ব:

 

এবার ৫ম পর্ব পড়ুন:

নজরুল যখন গ্রামে থাকে তখন তার শহরের কথা মনে হয়। যখন শহরে থাকে তখন তার গ্রামের জন্য টান দেখা দেয়। নজরুল এখন শহর ছেড়ে গ্রামে বসবাস করতেছে। নজরুলের মনে হয়, ইশ এখন তার কোথায় থাকার কথা। শুধুমাত্র নিজেকে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে না পেয়ে আজ সে ঠুল্লোর মতন গ্রামে গ্রামে ঘুরতেছে। নজরুলের মনে পড়ে শহরে এক সময় যাদের সঙ্গে বসে সাহিত্যের আড্ডা দিয়েছিলো তারা আজ অনেক বড় বড় পোস্টে চাকরি করে। কত বিখ্যাত হয়ে গেছে তারা। তাদের জন্য কতো মিডিয়া হা করে তাকায়া থাকে যে তাদের মুখখানা মিডিয়ায় দিবে বলে। অথচ নজরুল গ্রামে থেকে থেকে কতো লো চিন্তা আজ তাকে পেয়ে বসেছে। তার গ্রামে থাকা এবং অর্থনৈতিক ভাবে সলভেন্ট না থাকা ও প্রচুর রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকার দরুণ তাকে কেউ পাত্তাই দিতে চায়না। সেটা সাহিত্য সমাজ হোক কিংবা সাহিত্য সমাজের বাইরে হোক। সমাজ এখন চকচকে লোভনীয় বস্তুর দিকে তাকায়ে থাকে। সমাজের ধান্দাই হলো নগদ প্রাপ্তি ঘটবে যেখানে সেখানেই তার বন্দনা করবে। নজরুলের বন্দনা করার মতো কোনো নগদ প্রাপ্তির কাজ সে এখন পর্যন্ত করে দেখাতে পারেনি। ফলে, কারো কাছ থেকে নজরুল যে পাত্তা পাবে এমন ভাবাটাও অলৌকিক। নজরুল খুব ধন্ধে¦ পড়ে যায় এই ভেবে যে, যে কাজের জন্য মানে নজরুলের সুপ্ত বাসনা যা সেটা হলো লেখক হয়ে উঠবে সেটাও হচ্ছেনা আবার দুনিয়াবি যা মানে ভোগবিলাসীতা সেটাও হচ্ছেনা। এক ধরনের না ঘরকা না ঘাটকার ভেতরে সে হাঁসফাঁস করতে থাকে।
কালু বলে,নজরুইল্লা, তুই তো স্বর্গোতো যাবার পারলু নো আবার নরকেও যাত্যা পারলু নো। দুইয়ের মাঝখানে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছু!
নজরুল খুব বিব্রত অবস্থায় পড়ে যায়। কথা তো সত্য। কিন্তু এমন একটা সিচুয়েশনে নজরুল পড়েছে যেখান থেকে আসলে বের হওয়ার উপায় খুজছে কিন্তু উপায় তাকে খুঁজে পাচ্ছেনা।
নজরুল মোটেও প্রফেশনাল স্বভাবের লোক না। নজরুল যা করে তা এ্যামেচারের বৈশিষ্ট্য থাকে। কেনোকিছুতেই স্থিতু হতে পারেনা সে। শুধু অস্থিরতা আর অস্থিরতা। অথচ এ অস্থিরতাকে বিসর্জন দিতে পারলে আজ সে দেশের নামকরা প্রোডুসারের তালিকায় নাম লেখাতে পারতো। এরকম সুযোগের অপেক্ষায় কতোজন থাকে অথচ নজরুল হাতের কাছে পেয়েও সব হারিয়েছে। এট্ইা কি নজরুলের নিয়তি? নজরুল নিয়তিবাদ কিংবা অদৃষ্টবাদকে বিশ্বাস করেনা। সে মনে করে মানুষই সবকিছু কন্ট্রোল করতেছে। নজরুলের এই বেকারজীবন কাটানোর পেছনে মানুষের ভূমিকা আছে। নজরুল তার লাইফের প্রত্যেক সিচুয়েশনে তা অনুধাবন করতে পেরেছে। গোটা দুনিয়াটা যে একেকটা এজেন্সির মাধ্যমে চলে তা বুঝতে বাকি থাকেনা নজরুলের। নজরুল যে আদর্শ যে বিশ্বাস নিয়ে চলাফেরা করে সে মতাদর্শের লোকেরাই তাকে বোতলবন্দি করে রেখেছে। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, নজরুলকে দিয়ে তারা তাদের পারপাস সার্ভ করে নিবে। নজরুল যেখানেই যায় সেখানেই তার কাজে ভেটো পড়ে। মানে নজরুল যে মতাদর্শ নিয়ে থাকে তার বাইরে গেলেই তা আর হয়না। ফলে, নজরুলের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি থাকার পরও জগতের লোকেরা কর্মক্ষম বলতে যা বোঝে তা করা হয়ে উঠেনা নজরুলের পক্ষে। নজরুল তবু আগাইতে চায়; জগতের সকল কূটকৌশলকে মোকাবেলা করতে চায়। কিন্তু কিভাবে এ জগতের বিশাল শক্তির সাথে মোকাবেলা করবে সে। যখন বড় বড় এজেন্সিগুলোই তাকে গরীব করে রাখার জন্য মাসে মাসে বিরাট বাজেট বরাদ্দ করে!
কালু কয়, হ, তুই তো এমপি মন্ত্রি; যে তোক বেন্নে বানানোর জন্যি সরকার লাখ লাখ ট্যাকা খরচ করবি!
তুই তো সুপার স্টারও লোস! এল্লে আজগুবি চিন্তে বাদ দিয়ে কি করলে ভাল থাকা যাবি সেল্লে চিন্তে কর।
কিন্তু নজরুল বোঝে, কালুর জায়গা থেকে কালু ভেবে বলতেছে, কিন্তু তার ভাবনাটা আলাদা; সঙ্গে বাস্তবতাটাও। এই বয়সে কে তাকে চাকুরি দেবে? কেউ তো তার উপর বিশ্বাস কিংবা আস্থা কোনোটাই রাখতে পারবেনা। ইন্টারভিউয়ের সময় ইন্টারভিউয়ার জিজ্ঞাসা করে এই বয়সেও আপনি কিছু করেননি কেনো? তখন উত্তর খুঁজে পায়না। দুই একটা উত্তর বললেও তা ইন্টারভিউয়ারের মনমতো হয়না। মন মতো হবেই বা কিভাবে? নজরুল পূর্বে যে দুই একটা চাকরি করেছিলো সেখানে কোনো চাকরি কন্টিন্যু করতে পারে নাই? করলেও সে চাকরির মেয়াদ ছিলো সর্বোচ্চ ২ মাসের। এ কথা কোনো ইন্টারভিউয়ারকে বললে, চাকরি তো দেবেই না; আরো দু একটা কথা শুনায়ে দরজা থেকেই বিদায় করে দেবে।
নজরুল যে চাকরিগুলো পেয়েছিলো সে চাকরির প্লেস ছিলো বড় শহরকেন্দ্রিক। একারণে নজরুলের জীবন যাপনের জন্য যা খরচ হতো তা তার বেতনের তুলনায় যৎসামান্যই। এই স্বল্পবেতন নিয়ে সে বড় বড় শহরগুলোতে সারভাইব করতে পারেনি। এটা দোষ নয় তার। দোষ যদি দিতেই হয় তাহলে সিস্টেমকে দোষ দেয়া উচিত। যে বেতন দিয়ে ব্যক্তির ভরণপোষনই চলেনা সেখানে সে কিভাবে নিজেকে সারভাইব করাবে! ফলে সে দাঁতের উপর দাঁত দিয়ে চাকরি করতে চাইলেও তা কন্টিন্যু করতে পারেনা নজরুল। এর বাইরে অস্থিরতা কিংবা মায়ার মতো মুদ্রাদোষ নজরুলের তো ছিলই! তার যত মুদ্রাদোষই থাক না কেন সেগুলো সে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারতোই যদি অর্থনৈতিক সংকটটাই মূখ্য না হয়ে থাকতো। অর্থের অভাবে নজরুলকে প্রতিনিয়ত কঠিন কষ্ট সহ্য করতে হয়। সইতে হয় নানাপ্রকার গঞ্জনা আর বঞ্চনা! চাকরির জন্য বড় বড় শহরগুলোতে থাকার জন্য তার কখনোই প্রয়োজনীয় অর্থ ছিলোনা। অর্থ্যাৎ প্রথম মাস চলার মতো যে পরিমান টাকার দরকার পড়ে সে পরিমান টাকা তার কখনোই ছিলোনা। একারণে সবসময় তাকে একবার শহর আরেকবার গ্রাম করতে করতেই তার জীবনের অনেকগুলা সময় ফুরিয়ে যায়!

বড় শহরে প্রায় সবাই অচেনা- অজানা। দুই একজন যারাও পরিচিত তারাও নিজ নিজ সীমার ভেতরেই আবদ্ধ। এক্সাট্রা কেউ কিছু করতে পারেনা। দুনিয়ার সবাই তার সমাজ, মর্যাদার ভেতর চলতে গেলে সে যা আয় রোজগার করে তা দিয়ে তাদের টানাপোড়েনই চলে।
কালুকে কয়, ধর, একজন বিশাল কোটিপতি মানুষ। হাইচ, পাজারু গাড়িত ছাড়া সে চড়েই না। তার মাসে ইনকাম ধর, দুই লাখ টাকা। দেখপু, সেও মাস শেষে কোতাকুতি করতেছে!
-কতো ক্যাং করে?
ধর, হামাগেরে চা বিড়ির দোকানোত বসলে যদি ৫০/১০০ টাকা খরচ হয় তালে তারিগোরে খরচ ৫ হাজার ট্যাকা।
কিসোক এতো ট্যাকা খরচ হবি তারিগোরে? তারিগোরে কি আটাশটে পেট আছে লিকি? নাকি তারিগোরে পেট ঢোর হছে যে, একবারে পঞ্চাশটে কলা ঢুকে যাবি!
নজরুল বলে, কালুরে ব্যাপারটা আসলে তা লয়। তারিগোরে সোসাইটির মর্যাদা আছে, তারিগোরে সম্মান আছে। তারা হামাগেরে লাগানতি লজুল্লোফজুল্লো লিকি যেটিই রাত সেটিই কাত হবি! তারা হামাগেরে লাগানতি ইংকে মাচাংয়োত কিংবা টং ঘরোত বসে চা বিড়ি খাবার পাবিনে তো।
তারা একেকজন বড় বড় হুইস্কির বারোত, কফি শপোত যায়ে চা, কফি মদ খাবি। আর তাতিই তারিগোরে বিল হবি ৫ হাজার দশ হাজার ট্যাকা। বুঝছু, যেটি হামাগোরে ৫০ ট্যাকা হলিই দিন পাড়ি হয়ে যায়!
কালু কয়, বুঝচি বুঝচি, বড়লোকেগেরে মেলা ব্যাপার স্যাপার বাপু। হামাগেরে লাগানতি ওরা পুঁটি মাছ লয়!
নজরুল বলে, একারণে কারু কাছ থেকে সহযোগিতা চাবু সেডেও বাধে! আর মানসের কাছ ট্যাকা পসা চাওয়াডাও ক্যাংকা লাগে।
কালু কয় থো থো, তোর এল্লে নীতি বাক্য! এ দুনিয়াত সগলি ফকির। খালি কায়দাটা আলাদা। একেকজনের ভ্যাঁস একেকরকম। হামাগোরে দেশের মন্ত্রি এমপিরাও ফকির!
নজরুলকে কালু বলে, কতো ক্যাং করে? হামরা হাত পাতি কোটিপতিগেরে কাছে, আর ওরা হাত পাতে বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ এর কাছে। হামাগেরে চাইতেও যারা বেন্নে তারা আবার হামাগোরে কাছে থেকে ভিক্ষে লেয়। এ দুনিয়াত কেউই স্বয়ংসম্পন্ন লয় বুঝছু?
লিজের দরকারে মানষের কাছে ট্যাকা চালে সমস্যা কি? তুই তো আবার তাক ফেরত দিবু, -নাকি?
কিন্তু নজরুল অর্থসংকটে পড়লে কারো কাছে থেকে হেল্প নিতে লজ্জ্বা করে। অথচ এটাতে লজ্জ্বা পাওয়ার কিছুই নাই। মানুষই তো মানুষের কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। কিন্তু নজরুল মনে করে, নিজ সংকটে অন্যের কাছে সহযোগিতা চাওয়া মানে ব্যক্তিত্ব স্খলনের ব্যাপার। আর এতে করে সবাই কালুর মতো চোখ নিয়ে দেখবেনা ব্যাপারটা। মানবতাই যে আসল পথ এটা রক্ষণশীলরা বুঝবেনা কখনো। একারণে নজরুলের অনেক সময় মর্যাদা ও সম্মান দুটোই জলে ভেসে যায়। একারণে নজরুল প্রতিজ্ঞা করে যে টাকার কারণে অনেক সময় মানুষের কাছে নিজেকে ছোট হতে হয় সে টাকাই কামাই করে দেখাবে মানুষকে। কিন্তু সে টাকা রোজগার করতেও যে পথ নজরুলকে উতরাতে হয়ে সেখানেও ঐ টাকাই প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এক কথায় বলা যায়, নজরুলকে টাকাই হেরে দেয় বারবার। যাক সে সব কথা। আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে নজরুলকে। যাতে লোকেরা আঙুল তুলে দেখায় দেখ, দেখ, ঐ তো নজরুল যাচ্ছে স্কুটি চালিয়ে!

শহরে পরিচিত কবি সাহিত্যিক অনেক আছে। বিশেষত যে কবি, সাহিত্যিকরা সাহিত্যসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে; তাদের সাথে পরিচিয় আছে। কিন্তু এ সামান্য পরিচয় দিয়েই কি নজরুলকে ভাল কোনো চাকরি ম্যানেজ করে দিবে? যেখানে সারাজীবন গাতা ধরে যাদের সাথে থাকা হলো তারাই ফেল মারলো সেখানে ঐ সামান্য পরিচয়ে জুটবেনা কিছুই! এটা স্পষ্ট বুঝে গেছে নজরুল।
তারিগোরোক দিয়ে যদি কিছু হলোইহিনি তালে পরে তুই (নজরুল) এতোদিন গুঁছে গেলোহিনি!
নজরুল তবু এই সিস্টেমটাকে মেনে নিতে চায়। সিস্টেম মেনে না নিতে পারলে তার খুব ভাল পরিনাম হবেনা যে! নজরুল তাদের কাছে অবহেলার পাত্র হলেও নিজ উদ্যমে আবার চেষ্টা করতে থাকে। তাকে শহরে একটা চাকরি ম্যানেজ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে নজরুলকে। এটা নজরুলের প্রয়োজন না হলেও তার প্রেমিকা আফসানার জন্য তা করতে হবে। কেননা আফসানাকে প্রচন্ড ভালবাসে নজরুল। আফসানার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতেও কার্পন্য করবেনা। যেহেতু আফসানা গ্রামের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবেনা সেহেতু আফসানাকে পেতে হলে নজরুলকে শহরে শিফট করতেই হবে। নজরুলের সামনে এর বাইরে আর কোনো পথ খোলা নাই। শহরে থাকতে পেলে নজরুলের একই সঙ্গে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। আফসানাকেও পাওয়া হবে তার আবার নির্বিঘ্নে সাহিত্যচর্চাটাও করতে পারবে। নজরুল যে গ্রামে বড় হয়েছে সে গ্রামে সাহিত্যচর্চার জন্য উপযোগী নয়। সারাক্ষণ রাজনীতি, পরচর্চা ইত্যাদিতেই মশগুল না থাকলেও থাকা লাগে নজরুলকে। কেননা, নজরুল এ সমস্ত রাজনীতি কিংবা পরচর্চাতে অংশগ্রহন করতে না চাইলেও তার কানের কাছে লোকেরা এসে বলবে। এছাড়াও যে সমাজে নজরুল আছে সে সমাজের সাথে খাপ খেয়ে চলতে না পারলে নিজের অস্তিত্বেরও সংকট তৈরি হবে। একারণে নজরুলকে তাদের সুখ দুঃখের প্যাঁচালগুলো কান পেতে দিয়ে শুনতে হয়। নজরুল যদি একদিন এ সমস্ত আলাপে পার্টিসিপেট না করে তাহলে গ্রামের লোকেরা নজরুলের বাড়িতে এসে এ সমস্ত কিচ্ছা শুনায়ে যায়। যদি কেউ বাড়িতে এসে শুনায় তাহলে তো তাকে শুনতে না চাওয়াটা অভদ্রতার ভেতরে পড়ে। ফলে, নজরুলকে শুনতেই হয় তাদের কানকথা। একারণে নজরুলের পক্ষে নিরিবিলি সাহিত্য সাধনা করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে। একের পর ঘটনা লেগেই থাকে যেহেতু গ্রামগুলাতে। ফলে, শহরে থাকলে এ সমস্ত উঠকো ঘটনা থেকে নিজেকে রেহাই দিতে পারবে নজরুল।

যেই ভাবা সেই কাজ। অনেক সার্চ করতে থাকে সে। কাকে বললে এ যাত্রায় তাকে ব্যাপআপ দিতে পারবে। নজরুলের প্রথমত দরকার শহরের কোনো মেসে থাকা। তার চাকরি হোক আর না হোক। শহরে থেকেই সে চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাবে। এজন্য দরকার তার সমমনা কাউকে। যে নজরুলকে বুঝবে। তার যে এ সময়ে একটা সাপোর্ট দরকার। এরকম এলাকার এক ছোট ভাইকে সে খুঁজে নিয়ে নজরুল তার সমস্যার কথা জানায়। কিন্তু নজরুলকে সে বলে,
ভাই, এ দুনিয়েত কেউ কারো লয়। আপনের সমস্যা তাতে হামার কি? হামি মেস ভাড়া দিমু, হামি খিলেমু তাতে হামার লাভ কি?
এ স্বার্থপর দুনিয়াতে এরকম স্বার্থপরতা কথা তার খারাপ লাগেনা। এরকম শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। তবু পুনর্বার রিকোয়েস্ট করলে রাজি হয়ে যায়।
বলে, হামি আপনেক এক মাস থাকপের দিমু, খাবারও দিমু। কিন্তু এক মাসোত থাক্যা দুই মাসোত পড়লেই আপনের মেসভাড়া, খাবারের ট্যাকা আপনেক দেওয়া লাগবি। আর চাকরি পেলে হামার এক মাসের ট্যাকা আগে দেওয়া লাগবি। এল্লে শর্তে যদি রাজি হন তালে পরে আসেন।
নজরুল অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তার আগে শহরে শিফট হতে হবে। শহরে গিয়ে প্রতিদিনই তাকে এ অফিস থেকে ও অফিস ঘুরে ঘুরে তাকে একটা চাকরি ম্যানেজ করতে হবে।
শহরে যদি এত মানুষের জাগা হয় হামার হবির লয়?
নজরুলের আত্মবিশ্বাসটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মুখের উপর ঘামবিন্দুগুলো চকচক করতে থাকে। একটা হাই ফেলে শূন্যর উপর।
এবার এটা ব্যবস্থা করা লাগবিই লাগবি!

নজরুল এবার শহরে যায়। হারেসের মেসে উঠে। এই মেসে সবাই দারুণ। সবাই কো-অপারেটিভ। কেউ সাংবাদিক, কেউ বোহেমিয়ান, কেউ সরকারি চাকুরে, কেউ ছাত্র, কেউবা এনজিওজীবি। শহরে এসে নজরুলের শহরের নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগে। আজ এ অফিস তো কাল আরেক অফিসে নজরুল ঘুরঘুর করতে থাকে। কিন্তু কোথাও তাকে চাকরির জন্য উপযুক্ত মনে করেনা। আবার যেখানে তাকে উপযুক্ত মনে করে সেখানে আবার নজরুল উপযুক্ত মনে করেনা। ফলে, নজরুলের দিনগুলো পাড় হয় দীর্ঘশ্বাসে। আবার নিজেই নিজেকে সান্তনা দেয়,
আসেই তো আর জয় করা যাবিনে! একটু লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলে এটা ব্যবস্থা হবিই হবি!
এর আগে যে কয়বার শহরে থেকেছে চাকরির জন্য সে কয়বারই তো চাকরি নিয়েও তো শহরে টিকতে পারে নাই। এখন এই শহরের সাথে নজরুল অভ্যস্ত হতে শিখে গেছে। পথ ঘাট সব চেনার পথে। লোকজনের সাথেও সে ভালভাবে কম্যুনিকেট করতে পারে। অথচ এর আগে যে শহরেই সে গেছে তার ডিউরেশন ছিলো মাত্র এক থেকে দেড় সপ্তাহের। এরপরই সে তার টাং টোগলা বেঁধে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। এসব কথা ভেবে তার স্বস্তি হচ্ছে। মানুষকে সে ধীরে ধীরে জাজ করতে শিখে গেছে!
এভাবে নজরুলের সপ্তাহ যায় দেড় সপ্তাহ যায়। এদিকে মেসের অন্যান্য সদস্যরাও বলে,
-কি ভাই কুনু কিছুর ব্যবস্থা হলো?
নজরুলের নিজেরও অস্বস্তি লাগে। সবাই সকাল হলে যে যার কাজে বের হয়। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ চাকুরিতে কেউ ভাইবা পরীক্ষা দিতে যায়। আর নজরুল সেসব বসে বসে দেখে। দেখা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? অন্যের অনুকম্পা নিয়ে একটা চাকরির আশায় কার মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকে সে? তার উত্তর জানা নাই। নজরুল যে উদ্দেশ্যহীনতার পায়ে বেড়ি পরাবে সে সাহসও তার নাই!

এদিকে নিজ গ্রামের এক বন্ধুকে চাকরি দিয়ে যে টাকা ভাগে পেয়েছিলো; সে টাকা নিয়ে শহরে এসেছিলো নজরুল। এভাবে বসে খেতে খেতে সে টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছে নজরুলের। সে ভাবে নিজের চাকরি না হলেও অন্যের চাকরি সে ঠিকই নিয়ে দিতে পারতেছে। অথচ তার ভাল কোয়ালিফিকেশন না থাকার কারণে নিজেই নিজের একটা ব্যবস্থা করতে পারতেছে না। তার সাথে অনেক বড় বড় লোকের সম্পর্ক থেকে কি হবে? তারা তো সিস্টেমের বাইরে যেতে পারবেনা। আর তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিলে সে চাকরি নজরুল করতে পারছে না সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে।
নজরুল যে বড়মানসিগিরি দেখায়, সেডে কিসের ভিত্তিতে দেখায়? মেসের এক রুমমেট হারেসকে বলে।
বড় চাকরি ওক কে দিবি? যোগ্যতা থাকা লাগব্যার লয়? এডে কি বাপের ঘরের চাকরি? যে পৈত্রিক সূত্রে কোম্পানীর মালিক হয়ে যাবে?
হারেস তার রুমমেটের প্রতিউত্তরে বলে,
আসলে বিষয়টা সেটা নয়। নজরুল ভাইয়ের একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন কম হইলেও উনার এক্সাট্রা অর্ডিনারি কিছু কাজ আছে। যেইটা উনার বাড়তি যোগ্যতা। নজরুল ভাই সৃষ্টি করতে পারে। উনি আসলে এভাবেই ট্রাই করতেছে। যদি এই এক্সাট্রা কারিকুলাম দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের কিউরেটর কিংবা কনসালটেন্ট হতে পারে। এরকম তো অনেক ভুরি ভুরি আমাদের সামনে এক্সাপমল হিসেবে আছে? তাই না? উনি নিজেও জানে, উনার এ কোয়ালিফিকেশন দিয়ে ভাল কোনো চাকরি হবেনা। কিন্তু ঐ যে, এক্সাটা অর্ডিনারি দিয়ে কিছু করতে চাইছে আসলে।
রুমমেট বলে, এজন্য তো উনার প্রচুর পাওয়ার লাগবে। ব্যাপক পরিচিতি থাকতে হবে? কিন্তু এই শহরে নজরুল ভাইকে কয়জন চেনে? যারা একাডেমিক যোগ্যতা ক্যারি করে বসে আছে তারাই তো বেকার হয়ে বসে বসে দিন কাটাচ্ছে।
বুঝছো, এসমস্ত চাকরিতে ইনভলব হতে গেলে প্রচুর ইমেজধারি ব্যক্তিত্বের দরকার পড়ে। যাতে করে ঐ কোম্পানী নজরুল ভাইয়ের ইমেজ বিক্রি করে কোম্পানীকে উন্নত করতে পারে?
-নজরুল ভাইয়ের কি তা আছে? মানছি গ্রামে গঞ্জে তার প্রচুর পরিচিতি আছে, কিন্তু শহরে? শহর আর গ্রামকে কি এক কাতারে মেলালে চলবে?
হারেস বলে, সেটা তো বুঝতেছিই, এই জিনিসটা নজরুল ভাইও বোঝে। তবু ট্রাই করতে দোষ কি? অন্তত, সে আফসোস করতে চাইছেনা যে, সে চেষ্টা করেনি। চেষ্টা করেও যখন হবেনা তখন নিজেকে অন্তত সান্ত¡না দিতে পারবে যে, চেষ্টা করেছে, কিন্তু হয় নাই। পৃথিবীর সবাই কি জয়ী হতে পারে?
আমরা সারাক্ষণ তো জয়ী মানুষদের গল্পগুলোই শুনে থাকি। কিন্তু পরাজিত মানুষরা থাকে বক্সের বাইরে। তাদের গল্প কেউ বলেও না আর বললেও শুনতে চাইবে না কেউ। এ পৃথিবী জয়ী মানুষদের জন্য।

নজরুলের একেকদিন পাড় হয় আর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়তে থাকে। কেননা দিন দিন তার পকেট শূন্য হতে চলেছে যে। যখন একেবারেই শূন্য হয়ে যাবে তখন তার গ্রামের বাড়ির দিকে ফেরত যাওয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু হবে। আর তাছাড়াও এভাবে চাকরিহীন থাকাটা মেসের অন্যান্য রুমমেটরাও ভাল চোখে দেখবেনা। ইতোমধ্যে নজরুলকে ঘিরে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। নজরুল কি করে-কোথায় যায় এ নিয়ে নানান চিন্তার গোলকে ঘুরপাক খায় তারা।
নজরুল কবিতা লেখে এটা ঠিক, কিন্তু এ পরিচয়ই তো তার সব কিছু না। কবিতা লিখেই দিন পার করবে এমন অবস্থা নাই এদেশে। মানে শুধু লেখালেখি করাটাই কারো প্রফেশন হতে পারে এটা ভাবনারও অতীত। এখনো এদেশে সে কালচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানরা এদেশের প্রধান প্রধান কবি হওয়া সত্ত্বেও তারা শুধু শুধু লিখে দিন পার করার দুঃসাহস দেখায়নি। তারাও কোথাও না কোথাও চাকুরি করেছে। তাহলে নজরুলের মতো চুনোপুটি কিভাবে লিখে দিন পার করার দুঃসাহস করে? এইতো সেদিন নজরুলের রুমমেট হারেস মুখের উপরই বলে দিলো, শুধু লেখালেখির উপরই যদি নির্ভর করার টার্গেট ফিক্সড করেন তাহলে তো আপনি ট্র্যাশ হয়ে যাবেন।

গ্রামে থাকতে নজরুল শহরকে কতো কিইনা ভেবেছে। সেখানে থাকা গেলে কবি সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডা দেবে- দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমনে যাবে একসাথে। বিভিন্ন সভা-সিম্পোজিয়ামে বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে দেখা করার সুযোগ মিলবে। কিন্তু কই? এখানে যারা বসবাস করে তাদের কেউ কারো সাথে বছরেও দেখা হওয়ার চান্স থাকেনা। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকলেও কেউ কারো কিচ্ছুটি খবরও রাখেনা। এদিকে নজরুলের রুমমেট হারেসও নজরুলের অবস্থা বেগতিক দেখে সেও বাসা পাল্টানোর চিন্তা করে। যদি সে এই বাসাটাই কন্টিনিউ করে তাহলে নজরুলকেও তার পালতে হবে। সেটা সে কেনো করবে? নজরুল তার বয়সে বড় বলে তাকে মুখের উপর কিছু বলতেও পারছেনা ফলে, সে নজরুলকে রেখেই আরেক বাসাতে গিয়ে উঠে।

নজরুল হারেসকে ছাড়াই মেসে থাকে। নজরুল বোঝে তাকে কিছু করতে হলে এইখানেই তাকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। এভাবে চলেও যায় কিছুদিন। কিন্তু যতোই দিন পার হতে থাকে ততোই তার মেসের সদস্যদের আচরণ বুঝতে পারে। সবাই নজরুলকে দেখলে শিং শিং করে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর ঠিকঠাক মতো তো দেয়ই না বরং টাংসোনি মার্কা কথা বলে। নজরুল সবই বোঝে। কিন্তু কিছুই বলেনা, কেননা জগতের এরকম রঙঢঙ দেখতে দেখতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যেহেতু নজরুলের অবস্থা নাজুক সেহেতু সে মুখের উপর কিছু কথা বলতেও পারেনা। শুধু বুঝে শুনে যায় শুধু। নানান দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয়না নজরুলের। তার মনে পড়ে গ্রামে থাকতে সব বন্ধুই একসাথে ঘুরতো। একে অপরের পাশে দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতো। হিন্দু-মুসলমান বলতে কিছু ছিলোনা। জাত-পাত, শ্রেনীভেদ ছিলোনা। একে অপরের পাশে সব সময় দাঁড়াতো তারা। একারণ থেকেই নজরুলেরা সবাই মিলে গ্রামে স্থাপন করেছিলো ভিলেজ ভয়েস নামের একটা ক্লাব। এই ক্লাব সদস্যের সবারই মুল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো, সবার জন্য আমরা। এ ক্লাবের উদ্যোগে এলাকায় সব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা হতো। যেখানে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা পর্যায়ের অনেক সরকারী কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ ছিলো।

ভিলেজ ভয়েস এর ব্যানারে একবার একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিলো। হিন্দু-মুসলমান সকলের সহযোগিতায় এ অনুষ্ঠান করে সে কি উৎসাহ এবং প্রশংসা পেয়েছিলো নজরুলরা। সেবার মুক্তিযুদ্ধের উপর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেসময় অনেকে ভয়ে ছিলো যে, এ নাটকের মুল পর্বে ছিলো রাজাকারের ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা। সে সময় শহরের অনেক বড় বড় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলারও সাহস করেনি এ নাটক প্রদর্শন করার। ভয়ে ছিলো অনেকে; যদি কোনো আইনি ঝামেলা হয়। কেননা ঐ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলোনা। তখন এ প্রক্রিয়া মাত্রই জোরালো হতে শুরু হচ্ছে যে, জীবিত রাজাকারদের ধরে ধরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হবে। হুমায়ুন আহমেদ বিটিভিতে এরকম একটা নাটকের মধ্যে সবে মাত্র প্রচার হতে শুরু হয়েছে যে, রাজাকারদের ফাঁসি দিতে হবে। মোটামুটি এই বিষয়বস্তুই ছিলো নাটকের মূল উপজীব্য। মনে পড়ে নজরুলের, নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে সবার ভেতরই সে কি ছিলো উত্তেজনা- ছিলো ভয়। কিন্তু নজরুলের সাহসে সে যাত্রায় গ্রামে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। পরবর্তীতে এ নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য এলাকার মুরুব্বি এবং নেতাদের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল।
নজরুলের আরো মনে পড়ে, সন্ধ্যা হলে সবাই একত্র হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে নয়তো মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলামাঠে বসে বসে তাস পেটানোর কথা। চারপাশে জোনাকীর ঝিঁ ঝিঁ শব্দ আর মিটিমিটি আলো। মনে পড়ে শীতের রাতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোকুলের মেধের উপর বসে কিচ্ছা কাহিনী শোনার কথা। আসলে নজরুল যেভাবে বড় হয়েছে সেটাই নজরুল। নিজেকে অস্বীকার করতে পারেনা। নিজেকে অস্বীকার করা সম্ভবও না। তা অস্বীকার করার মানেই হইলো নিজেকে অস্বীকার করা। আজকে নজরুল দাঁড়ায়ে আছে সেটা তার পূর্ব জীবনাভিজ্ঞতার উপরই।
নজরুল মনে মনে ভাবে, নিজেকে ছেড়ে নজরুল কেনো সে অপরকে খুঁজছে?
জীবনের মানে বুঝতে হলে তো তাকে নিজের দিকেই তাকানো দরকার। পরলোভে কেনো সে মত্ত আছে? সে কারণেই কি নজরুল তার জীবনের অর্ধেক বয়স অতিক্রম করার পরও একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে? সফলতা যে কি জিনিস সেটা সে অনুধাবন করতে পারছে না। সে আরো কবে অনুভব করবে নিজেকে? কবে অর্থময় জীবন লাভ করবে?
নজরুল নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে। -আচ্চা, ক তো সফলতা মানে কি?
নজরুলের সত্ত্বা উত্তর দেয়, বারবার ব্যর্থ হওয়াটাই সফলতা! যারা প্রথমেই সফল হয় তাদেরকে সফলতার মতো লাগে। কিন্তু বৃহৎ অর্থে তারা ব্যর্থ! এর বাইরে সফলতার মানে খুঁজতে গেলে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। একেকজনের কাছে একেকরকমের ব্যাখ্যা দাঁড় হবে।
জগতে কেউ কেউ টাকা রোজগার করাটাকেই সফলতা মনে করে? আসলেই কি তাই?
একজন ব্যক্তির টাকা রোজগার করাই কি মূল উদ্দেশ্য? এ জগত, এই বিশ্বব্রক্ষান্ডকে তার দেওয়ার কি কিছুই নেই? সমাজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যক্তি কি ভূমিকা রাখছে সেটা দেখার কিছু নাই?
নজরুলের মনে হয়, আচ্ছা যদি একজন ব্যক্তির টাকা আয় রোজগারের প্রয়োজন না পড়তো তাহলে সে কি করতো?
যে কাজটি করতে হতো যদি নজরুল সেই কাজটিই কন্টিনিউ করে তাহলেই তো সফল হতে পারবে সে। এতো জটিল সমীকরণের তো মানেই হয়না। কিন্তু নজরুলের আরেক সত্ত্বা হাসে, এটা কল্পনা তোমার। বাস্তবতাটা ভিন্ন। বাস্তবতাটা হচ্ছে, তোমাকে এ দুনিয়ায় সারভাইব করতে হলে তোমাকে আয় রোজগার করতেই হবে। এর বাইরে কোনো ওয়ে নেই। নজরুলের এই দুই সত্ত্বা নিয়ে বেশ ধন্ধে¦ পড়ে যায়। তাহলে কোন সত্ত্বার কথা সঠিক।
নিজেকে সারভাইব করা নাকি সফল হওয়া?
এতসব প্রশ্নের সামনে পড়ে নজরুল ক্রমান্বয়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। চোখে সর্ষে ফুল দেখে। মৌমাছিগুলার সর্ষেফুল থেকে মধু সংগ্রহ করাও দেখে।

রাত দুটো। এই ৬ তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকোনিতে বসে সিগারেট ফুঁকছে আর ভাবছে সেসব। কি অপূর্ব জোসনা রাত। সারারাত দুরে দুরে কোথাও গাড়ির হর্ণ বাজছে- থেকে থেকে নাইট গার্ডের হুইসেল। কোথাও ঢস্ করে ট্রাক থেকে বালি ফেলার শব্দ শোনা যায়। জীবনটা অনেক সুন্দর লাগে। কিন্তু এ সুন্দরের পিছনে নৃশংসতা ইন্ধন দিতে থাকে। হাল্কা ড্রিম লাইটের আলোয় নজরুলের রুমমেট বেঘোরে ঘুমুচ্ছে! কিন্তু নজরুল চেয়ে আছে ভবিষ্যতের দিকে। তার দু’চোখ রাত জাগে। এ রাতজাগা অনেক দিনের। কানের ভেতর হেডফোন। হেডফোনে বাজতেছে: সানোম রে… সানোম রে.. .

 

জীবনকে সুন্দর ও স্বার্থক করার জন্য পড়াশুনা করা ছাড়া সব চেষ্টাই করেছে নজরুল। কিন্তু এটা বোঝে নাই যে পড়াটাই আসল কথা। যখন বুঝতে শিখছে তখন নদীর পানি অনেক দুর গড়িয়েছে। একাডেমিক পড়াশুনা না করে যত মেধাবীই হওনা কেনো তাতে কাজের কাজ কিছুই হবেনা। যতো সৃজনশীলই হওনা কেনো তুমি। বাস্তব জীবনের কাছে তুমি মার খেয়ে যাবে। কিন্তু নজরুলের আরেক সত্ত্বা বলে, এটা কোনো কথাই নয়। সভ্যতার শুরুতে মানুষ নিরীক্ষরই ছিলো। তখনও এই মানুষেরাই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এখন সভ্যতা এবং সভ্য হওয়ার জন্য যা কিছু করতেছে সেটা পুঁজিবাদের খেলা। পুঁজিই মানুষকে শিক্ষিত হওয়ার নামে কৃত্রিমতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেখানে সত্যিকারের জীবনের দেখা পাওয়া যাবেনা। মোহাম্মাদ (সাঃ) থেকে শুরু করে সক্রেটিসও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত, এই হালে আরজ আলী মাতুব্বর, লালন সহ অনেকেই স্বশিক্ষাতেই তারা আলোকিত। আরো অনেক উদাহরণ দিতে থাকে নজরুলের সত্ত্বাটি।
কিন্তু নজরুলের আরেক সত্ত্বা বলে, এটা উদাহরণ হতে পারেনা।
পৃথিবী যেদিকে যাচ্ছে তোমাকে তার দিকে যেতে হবে। পুরা সভ্যতার এক দুইটা উদাহরণ দিয়ে তুমি ব্যক্তি নজরুলকে এড়ায়ে যেতে পারোনা। তারা মহামানব। তুমি কি তাই?
তুমি সাত হাজার কোটি মানুষের একজন। তারা যেভাবে জীবনকে ভাবতেছে, দেখতেছে সেভাবে তোমাকে দেখা উচিত। নজরুল দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু নজরুলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি সাত হাজারের কোটি মানুষের একজন হবে নাকি তুমি হাজার কোটি মানুষের দেখানো পথেই হাটবে?
তবে, এই সাত হাজার কোটি মানুষের ভেতর থেকে একজন হয়ে উঠাটা অতো সহজ নয় মোটেও। এই একজন হয়ে উঠতে হলে তোমাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উঠতে হবে? তুমি কি তার জন্য প্রস্তুত?
নজরুল হ্যাঁও বলেনা নাও বলেনা। স্ববিরোধিতা কাজ করে। নজরুল মনে করে, এভাবে ভেবে চিন্তে কেউ কোনোদিন মহান ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেনা। মানে, ঐ মহান হয়ে উঠাটা পরিকল্পনা করে হয়না। যে হবার সে এমনিতেই হয়ে উঠে। ধর্মীয়চেতনার লোকেরা যেটাকে গড গিফটেড বলে থাকে। ফলে, নজরুল ঐ কৃতকার্য হওয়ার চেষ্টা না করে আপাতত, জীবনকে সহজ ভাবে দেখার চেষ্টা করে। মানে, তাকে আগে সারভাইব করতে হবে। যদি তার জীবনই টিকে না থাকে তাহলে ঐ পরিকল্পনা দিয়ে কি হবে তার? একারণেই তাকে টাকার কাছে যেতে হবে। টাকা ছাড়া সবই অর্থহীন। নজরুলের মনে পড়ে, সে ছোটবেলা থেকেই যার পেছনে সে ছুটছে সে টাকাই তাকে আজ তার থেকে দুরে রেখেছে। ছোটবেলা থেকেই তার শখ সে কোটিপতি হবে। একারণে নজরুল ছোটবেলাতেই তার শখ পূরণ করতে এলাকার বড় ভাইদের সাথে ছুটে বেড়ায় পথে প্রান্তে। নজরুল জানে, সে যে অবস্থায় আছে এখান থেকে সহজভাবে কেউ কোটিপতি হতে পারবেনা। একারণে সে দৃষ্টি দেয় এমন কোনো কিছুর দিকে যা পেলে সে ধর্নাঢ্য হতে পারবে। এ নিয়ে সে নিজেও সার্চ করতে থাকে কি হতে পারে সেসব। এলাকার বড় ভাইদের কাছে তার ভাবনার কথা খুলে বলে।
এলাকার বড় ভাই কাসেম বলে, একমাত্র কষ্টিপাথরের ব্যবসা ছাড়া কেউ একদিনেই কোটিপতি হব্যার পারবিনে। যার কপালোত একবার ফিট খাবি তাই কোটিপতিই হবি। এল্লেন ভাগ্য কি আর সগলিরি হয় রে নজরুল্লা? লাখে একজনের ভাগ্যোত এল্লে জোটে।
নজরুল কয়, হামি যামু খুঁজবের? তুমি হামাক লিয়ে যাবে? কুনুদিন যদি খুঁজে পাই তাল্যা ভাগাভাগি করে নিমু!
কাসেম কয়, কষ্টিপাথর খুঁজার আগে হামরা পানের বরজ খুঁজে দেখি আগে। এডে পাল্যা আরো বেশি ট্যাকা পাওয়া যাবি।
-কাসেম ভাই, পানের বরজোত কি আছে?
কাসেম বলে, পানের বরজের ভেতরে মানে পানের গাছোত মাটির নিচোত একটা ফল থাকে। ঐ ফলডা সব গাছোত হয়না। একশো দেড়শো বছর পান গাছ থাকলে একমাত্র ওই গাছোথিই পাবু? কিন্তু এল্লে পুরাতন গাছ যেটি সেটি পাওয়া যাবিনে। পাল্যাও, ডোমার, ডিমলার দিকোত যদি কুনু হিন্দুবাড়িত পাত্যা পারিস। হিন্দুরা এটা দুডে গাছ থুয়ে দেয়। পাল্যা ঐ গাছগুলোতিই পাবু।
এ ফলের ভেতর একধরনের ইউরোনিয়াম পদার্থ থাকে এবং তা বিক্রি হয় শত শত কোটি টাকাতে। নজরুল ভাবে, এ ফল খুঁজে পাওয়া সহজ সাধ্য ব্যাপার নয়। আর পেলেও গাছের মালিক সহজে দেবে কি? আর কিভাবেই বা বুঝবে, এই পানগাছের নিচে ফল ধরে আছে?
কাসেম কয়, যে পান গাছের গোড়াত মাটি ফাটে ফাটে গেছে আর দেকপু, ডেঁয়ো পিঁপড়েগুলো তার গাছের গোড়াত ঘুরঘুর করতেছে, তাল্যা বুঝপু, এ গাছের গোড়াত ফল ধরে আছে। তোলার সমি ফল ফাটে গেলে হব্যার লয়।
নজরুল বলে, এডে হবির লয় কাসেম ভাই। ম্যালা কঠিন কাম। পাওয়াডা আরো কঠিন। তার চায়ে, চলো, হামাগেরে মহাস্থানতই তো ম্যালা কষ্টিপাথর আছে। মহাস্থান গড়ের উপরকার মেলা মানুষেরাই এল্লেনের ব্যবসা করিচ্চে!
কাসেম কয়, খারাপ কসনি। আগে এল্লেনের ভেতরি ঘুরে দেখা হোক। ভাগ্যোত থাকলে অল্পতি হবি। তামান পাতার ঘুরে যা না হবি এটি ঘুরলেই সেল্লেন হবি। শুনিস নি, তামান পৃথিবীর মানুষগুলোর আড়াইদিনের খোরাক হামাগোরে মহাস্থানের মাটির লিচোত আছে!
নজরুল আর কাসেম মিলে প্রতিদিনই বিকাল হলেই মহাস্থান যায়। গিয়ে কষ্টিপাথরের যারা ব্যবসা করে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথম প্রথম পাত্তা দেয়না তারা। এভাবে অনেকদিন পার হতে থাকলে দুই একজন নুড়ি পাথরের সন্ধান দেয়। এগুলা বৃষ্টি হলেই মাটির উপর ছোট ছোট নুড়ি পাথরের মত দেখা যায়। বৃষ্টি শেষ হলে তাদের মুখে রোদ পড়লে ঝলকে উঠে। মনে হয় নুড়িপাথরগুলো দাঁত বের করে ফ্যাঁকফ্যাঁক করে হাসতেছে। এই নুড়ি পাথরগুলোর তেমন মূল্য নেই। দুই শো, তিন শো নতুন কোনো ব্যবসাদার হলে তাদের কাছে থেকে সর্বোচ্চ পাঁচশত দাম হাঁকাতে পারে। এগুলো দিয়ে নজরুলদের পোষায় না।
কাসেম কয়, হামাগেরে বড় দ্যান মারা লাগবি। এল্লে পুঁটি মাছের ভাগা। এল্লে দিয়ে হবিনে।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলে, বাপুরে, চাটে চাটে খা, একবারে কামড়ে খাসনে! হামরা এল্লে বেঁচ্যা বেঁচ্যাই আজকে লিজের পায়ের উপর খাড়া হছি। হামরা যখন এল্লে ব্যবসাত আচ্চি তখন কেউ হামাগোরোক পোছেওনি। বুঝলে, কাসেম।
নজরুল কিংবা কাসেমের এসবে চলেনা। আস্তে আস্তে বড়র দিকে যায়। লোকজন হালচাষ করলে লাঙ্গলের ফলার নিচে মাটির কান্দা উঠে আসে। তখন মাটি খুঁড়ে দেখে যে, সেই প্রাচীন আমলের পাতিল। এভাবে অনেক কিছু মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে স্থানীয়রা বেঁচাবিক্রি করে। এগুলার দাম অবশ্য নুড়ি পাথরের চাইতে বেশি। কিন্তু এতেও তাদের মন ভরেনা। তারা খুঁজতে থাকে কষ্টিপাথর। বড় বড় কষ্টিপাথর। যে কষ্টিপাথর একটা পেলেই তারা কোটিপতি হতে পারবে।
মনে পড়ে সে সময় কি ঘোরের ভেতরেই না ছিলো নজরুল। একদিন হঠাৎ ওর ঢাকায় থাকা দুলা ভাইকে ফোন দিয়ে বলে:
-ভাই, এ্যাটা একাউন্ট খোলা লাকপি?
-ও প্রান্তে থেকে দুলা ভাই বলে: -কোথায়, কুন ব্যাংকে?
নজরুল বলে: -সুইচ ব্যাংকোত! সুইচ ব্যাংকের নাম শুনেছে ওর খালাতো ভাইয়ের কাছে থেকে। মানুষের যখন প্রচুর টাকা পয়সা হয় তখন নাকি সুইজারল্যান্ডের সুইচ ব্যাংকে একাউন্ট খোলে।
দুলাভাই কয় -ফাতরামি করিচ্চু লিকি? এতো ট্যাকার মালিক তুই হলু কদ্দিন? -টালটুল হলু নাকি?
কিন্তু নজরুল তো টাল হয় নাই। তার বাসায় আজকে ঢাকা থেকে দু’জন ক্যামিস্ট এসেছে। দুইজন বড় ব্যবসায়ী এসেছে। এদের আবার ঢাকার মতিঝিলে অফিস আছে। বিভিন্ন এ্যাম্বাসিদের সাথে তাদের চলাফেরা আছে- ব্যবসা বানিজ্য আছে। বাসায় রাতে শোয়ার আগে তারা বলেছে- মিয়া, ইস্ট ইন্ডিয়া আমলের একটা স্ট্যাম্প পাইলে তুমি অতো টাকা রাখবা কোথায়?
এই স্ট্যাম্পের ভেতর ইউরেনিয়াম পদার্থ থাকে। যা দিয়ে পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করে বড় বড় দেশ। এই স্ট্যাম্প কেনারও সামর্থ্য নাই সব দেশের। একমাত্র বড় বড় রাষ্ট্রের ছাড়া কেউ কেনার সাহস রাখেনা। তোমার যা খুশি মানে যা যা দরকারী মনে করবা তা তা দিয়েও আরো সত্তুরটা ফ্যামিলিরে তোমার মতো করে সাজায়ে দিতে পারবো আমরা।
ঢাকায় কয়টা ফ্ল্যাট -কয়টা গার্মেন্টস চাও? সব দিবো। রাজার হালোত চলতে পারবা মিয়া!
নজরুল মূলত একারণেই সুইচ ব্যাংকে একাউন্ট খোলার চিন্তা ভাবনা করে।
পরেরদিন সকালবেলা সবাই মিলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া আমলের একটা স্ট্যাম্প পরীক্ষা করতে। এই স্ট্যাম্পের খোঁজ দিয়েছিলো তাদেরই একজন পরিচিত মানুষ। তারাও এ কাজে লেগে আছে অনেক বছর হলো। তাদের কাছে স্ট্যাম্প আছে কিন্তু তারা বিক্রি করতে পারছেনা। স্ট্যাম্পের যা দাম তা কেনার মতো কোনো পার্টি এতদ অঞ্চলে নাই। তারা দীর্ঘদিন ধরেই বলতেছিল। কিন্তু নজরুল গায়ে মাখাই নাই এতোদিন। এগুলা অরিজিনাল পাওয়া যায় নারে। সব ফাকিং। দুই নম্বর জিনিস দিয়ে ভরা। এদ্দিন ধরে ঘুরতেছে কিন্তু অরিজিনাল জিনিস তার চোখে পড়ে নাই আজতক পর্যন্ত। তবু ঐ পরিচিত মানুষের জোড়াজুড়িতে নজরুল রাজি হয়ে তার পার্টিদের নিয়ে যায়।
ঢাকার কেমিষ্টরা যখন একে একে ঐ স্ট্যাম্পের উপর পরীক্ষা চালাতে থাকে তখন অনেক পরীক্ষাই ঐ স্ট্যাম্প পাশ করে। এই স্ট্যাম্পের উপর মোটে আট ধরনের নিরীক্ষা চালাবে তারমধ্যে অলরেডি পাঁচ নিরীক্ষাতেই পাশ করেছে। বাকি থাকে আর তিনটা।
কাসেম কয়, এ তিনডেও হবি। মাল মনে হয় অরজিনালই!
নজরুলের মুখ আলোয় উস্নায় হতে থাকে। এইতো স্বপ্ন ছুঁই ছুঁই করছে তাকে। আর তিনটা পরীক্ষা হলেই পাশ। দু’হাত ভরে টাকা আসবে। সারাজীবন আয়েশ করে খাওয়া যাবে। কিন্তু কেমিস্ট যখন স্ট্যাম্পের উপর ষষ্ঠতম পরীক্ষা চালালো তখন ফেইল করলো স্ট্যাম্প। পরীক্ষার নামটা ছিলো রাইস পরীক্ষা। মানে, স্ট্যাম্পের উপরে দুই তিনটা চাল রাখা হলে সে চাল ফুটে যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? অরিজিনাল পাথর কিংবা স্ট্যাম্প হলে রাইস ফুটবেই। যেহেতু হলোনা সেহেতু বোঝা গেল এই স্ট্যাম্পটা দুই নাম্বার করে বানানো। মাথায় বাজ পড়লো নজরুলের। দুইদিন হলো আগত অতিথিদের আপ্যায়ন বাবদ এবং কেমিস্টদের ভাড়া করা আর স্ট্যাম্পওয়ালাকে অগ্রীম টাকা দেওয়া বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখেরও উপর। এগুলো জলাঞ্জলি গেলো নজরুল আর কাসেমের। স্ট্যাম্পওয়ালাকেও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছিলোনা যেহেতু এগুলা অবৈধ জিনিস। ফলে এক লাখ টাকার উপরে গচ্চা যায় নজরুলদের। নজরুল বুঝতে পারে, ঐ পরিচিত মুখরা স্ট্যাম্পওয়ালার এজেন্ট একেকজন। এভাবেই তারা পার্টিদের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা রোজগার করে।
ঢাকা থেকে আগত কেমিস্ট আর ব্যবসায়ীরা যখন ফেরত যাবে তখন নজরুলের মাথায় হাত রেখে বললো:
-আংকেল তুমি মাত্র ছোট মানুষ। পড়াশুনা করতেছো পড়াশুনাই করো। এসবে এসে টাকা পয়সা নষ্ট করো না। এগুলা একটা অরিজিনাল জিনিস হলে এক লক্ষ জিনিসই ভুয়া বের করে। এদের একটা চক্র। এরা অনেক জায়গাতেই ফাঁদ পেতে বসে থাকে। এদের কাজবাজ নেই। এ থেকে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে এদের সংসার চলে। এগুলো মেকি জিনিস। তুমি পড়াশুনাই চালিয়ে যাও। এপথে এসে কতো কোটিপতি যে আজ পথের ভিখেরি হয়েছে। এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!
নজরুল ভাবে, হয়তো এমন দহনে সেও পুড়েছে! নয়তো কারো পুড়ে যাওয়া দেখেছে!
কিন্তু নজরুল দমে যাবার পাত্র নয়। ভাগ্যের কাছে হার মানতে রাজি নয় সে। যেহেতু তার বাড়ির কাছেই মহাস্থানগড় সেহেতু প্রতিদিন বিকাল হলেই মহাস্থানে যায়। সে ভাবে যেখানে আল্লাহপাক গোটা দুনিয়ার মানুষের আড়াই দিনের খোরাক রেখেছে সেখানে এক নজরুলের একটা ব্যবস্থা হবেনা একথা সে বিশ্বাসই করতে চায়না। নজরুলের এ ব্যবসা যাতে লাটে না ওঠে তার জন্য হাতে আংটি ব্যবহার করে। এ আংটি কিনে আনায় মহাস্থানের মাজার শরীফের কোনো পীরের ভক্ত মারফতে। তার জন্য অনেক টাকা ব্যয় হলেও নজরুল মনে মনে আশ্বস্থ হয়-
যাক এই মালটা আসল! এইবার মনে হয় সবকিছুই ফিট খাবি হামার সাথে। গুঁটি লাল হবি হামার! যেটি সেটিকের আংটি লয় আজমীর শরীফের আংটি!
কিন্তু নানা প্রকার পাথরের আংটি ব্যবহার করেও তার ভাগ্যকে দুর্ভাগ্যের কাছে থেকে ফেরাতে পারেনা।
যখন এ ব্যবসাতেও নজরুলের ভাগ্য সহায় হলোনা তখন নজরুল দারুণ বিষন্ন মন নিয়ে চলাফেরা করে। তা দেখে তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এবার নিশ্চিত নজরুল আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াবে।
পুরা গ্রামের বন্ধু-বান্ধব একত্র জড়ো হয়ে এলাকার মুরুব্বী স্বজনদের নিকট ধর্ণা দিতে কিংবা প্রচারণা শুরু করে। কিন্তু নজরুল ভোটে দাঁড়াবে না নিশ্চিত। তবু তার বন্ধু বান্ধবরা নজরুলের মাঝে নেতৃত্বগুণ খুঁজে পাওয়ার ফলে তাকে তারা ভোটে দাঁড় করে দিবেই এই পণ তাদের। কিন্তু নজরুল বুঝতে পায়না তার ভেতর কেমন করে নেতৃত্বগুণ খুঁজে পেলো তারা। সে তো সব সময়ই আড়ালে-আবডালে থাকে- নিজের থেকেই নিজেই পলাইয়া থাকে। তাহলে, নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় কেমন করে? এদিকে এলাকায় রব রব সাউন্ড উঠতেছে নজরুল এবার চেয়ারম্যানের ক্যান্ডিটেট বারে?
-চৌধুরী বাড়ির ঐ সোল যদি ভোটোত দাঁড়ায় তালে পরে ঐ সোলকই কলে ভোট দেওয়া লাগপি বারে। নজরুলের বন্ধুবান্ধবদের সাথে সাথে পাড়ার মুরুব্বিরাও একথাই প্রচার করতে থাকে। নজরুলের বন্ধুরা তাকে ভোটে দাঁড় করানোর পেছনে আরেকটা যুক্তি খাড়া করায় নজরুলের সামনে।
-কঁ, রফিক চেয়ারম্যান হামাগোরক অপমান করার জন্যিই তো আতোত গ্রামের আর দশজনেক লিয়ে হামাগোরক পাটের ভিওত থেকে মেয়ে সহ ধরিসলো!
-ক, এরি প্রতিশোধ লেয়া লাগবির লয়?
নজরুল মনে করে, কেনো প্রতিশোধ নিতে হবে। রফিক চেয়ারম্যান যদি আমাদের ধরে ভুল করে থাকে তাহলে প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নেবে। মানুষ তাকে ছেড়ে দিলেও প্রকৃতি ছাড় দিবেনা কখনো। আর সেও যদি কুকুর হয় তাহলে নজরুলদেরও কেনো কুকুর হতে হবে। নজরুল মনে মনে ভাবে কিন্তু বন্ধুদের তা মুখের উপর বললে চলবেনা। তারা সবাই মন খারাপ করবে। ভাববে, যে নজরুলের জন্য তারা হাঁটু সমান পানিতে নেমেছে সেই যদি উল্টো কথা কয় তাহলে তারা কার জন্য লড়বে? এ জন্য নজরুল বন্ধুদের বলে,
হ, ঠিকই তো প্রতিশোধ লেওয়াই লাগবি!
একথা নজরুল নজরুলের বন্ধুদের বলতেই হয়। কেননা ঐ সময় গ্রামের সব বন্ধুরাই হাতের উপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, যে করেই হোক এবার রফিক চেয়ারম্যানকে নির্বাচনে ফেল করাবেই! কিন্তু নজরুল বুঝতে পারেনা তার জন্য নজরুলকেই কেনো রফিক চেয়ারম্যানের প্রতিপক্ষ হতে হবে? রফিক চেয়ারম্যানকে তো পরাজিত করার জন্য এই ইউনিয়নে তো আরো অনেক বাঘা বাঘা লোক আছে।
নজরুল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্যান্ডিটেড হয়ে দাঁড়াতে পারতোও। কিন্তু নজরুল যে লেখালেখি করে, ফলে, তার এ নির্বাচনে গেলে তার লেখালেখি নষ্ট হয়ে যাবে। নোংরা রাজনীতি তাকে লেখার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। কে জানে, নজরুলের বন্ধুদের ভেতর থেকেও কেউ কেউ হয়তো নজরুলের এই লেখালেখি পছন্দ না করার কারণে পেছন থেকে উস্কানিও মারতে পারে। নজরুল মনে করে সেটা ব্যাপার না। তারা নজরুলের বন্ধু; বন্ধু হয়ে বন্ধুর ভাল সবাই চায়। নজরুল চেয়ারম্যান হলে তাদেরও অনেক সুনাম হবে যে, তাদের বন্ধুই আজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এটা যেকোনো বন্ধুর জন্যই গৌরবের ব্যাপার। নজরুলের জন্যও ব্যাপারটা বেশ স্বস্তিদায়কই হতো। যদি নজরুল লেখালেখির জগতে না আসতো। তার ভেতরে সে সম্ভাবনাও দেখেছিলো সবাই। নজরুলের উদ্দেশ্য যেহেতু লেখালেখি করা সেহেতু নজরুল এই চলমান স্রোতে গা মিশিয়ে চলতে চান নাই। সে ভাবে এই রাজনীতির ভেতরে একবার গা মেশালে সেখান থেকে আর ফেরত আসতে পারবেনা। এককথায় এখনকার নজরুল আর ফিল্ডের রাজনীতি করতে চায় না। হ্যাঁ, সে রাজনীতিও করবে তবে সে রাজনীতির ফাইট হবে ইন্টেলেকচুয়ালিটির। বুদ্ধিবৃদ্ধিকভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা থাকবে তার। যেহেতু কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। ফলে তাকে রাজনীতির ভেতরে থাকতে হবে। কিন্তু সাধারণ অর্থে রাজনীতি বলতে যারা বোঝে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি সেসবের ধারেকাছেও থাকবে না নজরুল। ফলে বন্ধুদের তীব্র ভালবাসায় সিক্ত হবার পরও নজরুল চেয়ারম্যানের ক্যান্ডিটেট হয়না। এ নিয়ে নজরুলের বন্ধুদের মাঝে নানাপ্রকারের প্রতিক্রিয়া হতে থাকে।
কেউ কেউ বলে: কারো কারো মুখোত দুধের সর তুলে খিলেবের চালেও কেউ কেউ খায় না বারে!
-ক্যাঁ, হামরা কি মুখোত বিষ তুলে দিচ্ছি! আদরের জিনিস ছাড়া হয়না বারে- কপালোত দুক্কু থাকে!
-হ্যাঁ, নজরুলের কপালে দুঃখ তোলাই আছে হয়তো। নজরুলের এখন মনে হয়। নয়তো কেন সে বারবার ভাগ্যের কাছে হেরে যাবে?
নজরুল সরলমনা। ফলে সবসময় সে সরলভাবেই থাকতে চেয়েছে। খুব বেশি কিছু চায়নি সে। সামান্য মানসম্মান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। দিনের তিনবেলা দু-মুঠো ভাত চেয়েছে শুধু। এর বেশি কিছু চায়নি নজরুল। কিন্তু এ সামান্য চাওয়াটাই মনে হয় পাহাড়-সমান কিছু চেয়েছে। দুনিয়াতে অন্যান্যদের চাওয়া-পাওয়া কিংবা লাইফ লিডিং যেভাবে করে তার কিছুই চায়নি সে। অনেকে বলে, আল্লাহ হয়তো নজরুলের ইচ্ছাপূরনের ভেতরে নজরুলের কোনো অমঙ্গল আছে বলেই তার ইচ্ছাপূর্ণ হচ্ছেনা। কিন্তু নজরুল জানেনা তার মঙ্গল বলতে কি? তার সৃষ্টি করা বান্দাদের না খেয়ে রাখাটাই কি মঙ্গল? তাদের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখাটাই কি মঙ্গল? আল্লাহর দোহাই দিয়ে এসব ভাঁওতাবাজি কথাবার্তা সে বুঝতে চায়না, মানতে চায়না। সে মনে করে এসব কথা যারা বলে তারা হয় বুঝে শুনেই বলে নয়তো তাদের এজেন্সি হয়ে কথাবার্তা ছড়ায়।
-তুই আল্লাহর কাজ কাম করিস ন্যা দেখেই তো আল্লাহ তোর সাথে ইংকে করিচ্চে!
আল্লাহ এতোই নিষ্ঠুর তাহলে? বান্দা কিছু দিলে তারপর সে বান্দাদের দেবে?
আল্লাহ কি তাহলে গিভ এন্ড টেক এ বিশ্বাস করে?
নামায-রোজা পালন করলেই কি শুধু আল্লাহ মানুষকে খাওয়ায়? তাহলে দুনিয়ার এতো যে অন্য ধর্মের লোক আছে তারা না খেয়ে আছে?
এসব বুঝতে চায়না নজরুল। সে অতোটা নাফরমানি লোক না তবু আল্লাহ তাকে এতো শাস্তি দিচ্ছে? কালু বলে।
নজরুলের মনে পড়ে যায় ইন্টারমিডিয়েটের কলেজ লাইফে ইংরেজি ক্লাসে লিটন স্যার একটা গল্প বলেছিলো: একটা মেয়ে খুব পূণ্যবতী। সে প্রতিদিন সকালবেলা পরিস্কার পবিত্র হয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করে। সর্বোপরি ঈশ্বর খুশি হয় এমন কোনো কাজ নেই যে, সে মেয়েটি করেনা। সে মনে প্রাণে ঈশ্বরকে স্মরণ করে। পুজা করার সময় ঈশ্বরের কাছে তার চাওয়া হলোÑ যেকোনো মূল্যে সে যেনো বিবাহ পরবর্তী ভাল থাকে এবং ভাল স্বামী পায়। তো, সে মেয়ের বিয়ে হয় বেশ ধুমধাম করে এবং ভাল স্বামীও পায়।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিয়ের সপ্তাহ পার হতে না হতেই তার স্বামীটা জঙ্গলের ভেতর সাপে কেটে মরে যায়। হিন্দুদের ভেতর সমাজে একটা রীতি আজও প্রচলিত আছে তা হলো কোনো মেয়ের একবার বিয়ে হলে তার পরবর্তীতে আর বিয়ে হয়না। মানে, এ সমাজে পরবর্তীতে তার বিয়ে দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
সেই মেয়েটির স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই মেয়েটি রোজ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। একদিন মন্দিরে ঠাকুর পুজো করতে কান্দনরত মেয়েটিকে দেখে সান্ত্বনা স্বরে বলে-
-মাগো, ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন।
ঈশ্বরের পক্ষালম্বন করে এ কথা শোনা মাত্রই হাতে থাকা মুড়ো ঝাঁটা দিয়ে ঠাকুরকে দেয় একটা ধাবড়ানি! মেয়েটি কেঁদে কেঁদে বলে, যে ঈশ্বরের জন্য সারাজীবন ঈশ্বর বন্দনা করেছি- ঈশ্বর যাতে খুশি থাকে তার জন্য সারাজীবন সেই কাজই করেছি। তার প্রতিদান আমাকে এই দিলো। সেই ঈশ্বরকে আমি কি করবো যে ঈশ্বর মানুষের মঙ্গল করতে পারেনা। এই গল্প মনে করে নজরুল অদৃশ্যবাদকে ভর্ৎসনা করতে থাকে। তাই তো, ঈশ্বর কেনো সবাইকে এক নজরে দেখেনা। তার তো সবাইকে একই নজরে দেখার কথা। নজরুল এসবকে পাত্তা দেয়না মোটেও। কালুকে বলে,
শোন, এল্লে কিছুই লয় বুঝছু? যাই যিংকে কর্ম করবি তাই সিংকে ফল পাবি।
নজরুলের কপালে কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছেনা। এমনকি নিলা পাথরের আংটি ব্যবহার করার পরও। সে কতো কি ই না করলো জীবনে। তবু জীবন নজরুলকে বারবার বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে!

 

১০

একবার তার এলাকার এক বন্ধুর সাথে কক্সবাজারে ঘুরতে যায়। কক্সবাজারে ঘুরতে ঘুরতে ঐ বন্ধুটি বলে,
যকোন আনুই এটি, তখন এটি থাক্যা এনা মাল লিয়ে যাই। যাতে এটিকের আসা যাওয়ার খরচ উটপিহিনি!
নজরুল বাঁধা দেয়, সে বলে, এল্লে করার জন্যি এটি আচ্চি হামরা? খামো দামো আর ঘুরমো। এল্লে দুই নম্বর ব্যবসা করার জন্যি এটি আসিনি।
নজরুল এই কথা বলতে গিয়ে মুখের ভেতরে আটকে দেয়। এই খানে নজরুল যে বেড়াতে এসেছে তার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তার বন্ধুই করেছে। এ কথা তার মুখে শোভা পাবেনা বলে মুখে এসেও আটকে যায়। নজরুল নিরুত্তর থাকে। সে কথা বলেনা। তার বন্ধু বলে,
কি রে নজরুল টাসকি মারে গেলু ক্যা?
নজরুল স্তব্ধ হয়ে যায়। বলতে চাইলেও বলতে পারেনা কিছুই। ধ্যান্দা মাছের মতো চুপ করে রুমের কোনায় শুয়ে থাকে। নজরুলের আরো যে দুই বন্ধু কক্সবাজারে গিয়েছিলো তারা পরস্পর আলাপ করে।
এটিকের রেট ম্যালা কম। এট থেকে নাফ নদী সাঁতরে পার হলিই বার্মা। অরিজিনাল মাল। এই মাল লিয়ে গেলে কাস্টমাররা গপাগপ গিলবি!
নজরুল চেয়ে চেয়ে শোনে তাদের কথা। নজরুল নির্বাক। যেহেতু তাদের সাথে সে এসেছে সেহেতু তাদের বিরোধীতাও করতে পারতেছেনা। এই বিরোধীতা না করার পেছনের কারণটাও ঐ টাকাই।
নজরুলের বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেয়, কাল বেনার আশাত থাকা যাবির লয় এক্ষুনি দেখা করা লাগবি। চ, যাই!
অগত্যা নজরুলকেও তাদের সাথে হাঁটা দিতে হয়। যখন মূল ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছায় তখন প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা। নিচে গাড়ি পার্কিং করে নজরুলেরা উঠলো সি-বীচের কাছের একটা হোটেলে। নজরুলদের চলনফেরন দেখলে বোঝার উপায়ই নেই তারা গরীব শ্রেণীর মানুষ। ভাড়া করা কার, পোষাক আশাক, চলনফেরনে পুরো দস্তুর ধনীক শ্রেনীর লোক মনে করবে যে কেউ।
-বাড়িত থাকতে ভাত পাস নে আর এটি অ্যাসে ফুটানি মারাচ্ছু!
মনের অজান্তেই নজরুলের এই কথা ভেসে উঠে আর নজরুল খিক খিক করে হাসে। এর হাসার কারণ জানতে চাইলেও জানায় না কাউকে।
নজরুলের বন্ধুরা পূর্বে থেকেই যাদের সাথে কন্টাক করে রেখেছিল- তারা কক্সবাজারে পৌঁছানোর পর থেকেই তাদের সাথে গাইড হিসেবে ছিলো। তারাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কি খেতে হবে, কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের গাইড অনুসারে সারাদিন সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি আর ঘোরাঘুরি করে সময়গুলো কাটে। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে নজরুলের বন্ধুরা তাদের অভ্যাসমতো ইয়াবা সেবন করে। ইয়াবা সেবন করলে পুনর্জীবিত হয় কোষগুলো, একারণে শরীরে এনার্জি ফিরে আসে আবার। ফলে, তারা কখনোই শারীরিক দূর্বলতা অনুভব করেনা। এবারও তাই করলো ওরা। এর সঙ্গে যোগ হলো বার্মিজ মেয়েদের হাতে ইয়াবা খাওয়ার অপূর্ব সুযোগ। নজরুলের বন্ধুরা ও নজরুল অনেকদিন ধরে মনে মনে চাইছিলো যে তারা যদি কখনো ইয়াবাসেবনের পার্টনার হিসেবে পেতো তাহলে কতোই না ভাল লাগতো। এই কক্সবাজারে বার্মিজ মেয়েদেরকে খুব সস্তায় রাতের হোটেলগুলোতে যৌনউৎসব করার জন্য ভাড়া খাটতে দেখা যায়। এই জোসনা রাতে ছাদের উপর বসে- রাতের সমুদ্রের গর্জন শুনে নজরুলদের মনটা আরো বেশি চনমনে হতে থাকে। সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য বার্মিজ মেয়েটা হাত বাড়ায়। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য নজরুলেরাও সাড়া দেয় অকুল দরিয়ার বুকে। মনে হয় তাদের সামনে সমুদ্র গোঁঙাচ্ছে, সে গোঙ্গানোর মাঝে পানির ঢেউ তাদেরকে আরো উতলা করে দিচ্ছে!
এমন অনুভূতির মাঝে নজরুলের মন গাইবান্ধার অনুভূতিও যেচে শুনাচ্ছে, এই মুহুর্তে। সেদিন কি করুণ বাস্তবতার সামনেই না পড়তে হয়েছিলো তাকে। ক্ষুধার জ্বালা যে কি তা ভুক্তভোগী না হলে সে মর্মরবেদনাকে প্রাঞ্জল করে বর্ণনা করা যায়না। চিকিৎসার অভাবে ঐ মেয়ের অন্ধ, বয়োবৃদ্ধ বাবা বিছানার উপর ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আর নিচে মাটির উপর পাটি পেড়ে সেক্স করছে নজরুল। এ দৃশ্য অবাস্তব মনে হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তব। মানুষ কতোটা ভেঙ্গে গেলে এ মর্মর বেদনাকে সঙ্গী করে তা অজানা অনেকের।
নজরুল টগবগে তরুণ। অতো কিছু বোঝার দরকারও নেই তার। সে সেক্স করতে এসেছে, মাথা গরম আছে, এইখানে মাথা ঠান্ডা করতে পারলেই হলো। অতো ভাবাভাবিতে সে নাই। মেয়েটিও চায় এতো গভীরের ক্রন্দন কাউকে না শোনাতে। শোনায়েও লাভ নাই। ফলে, খুব সহজেই- খুব অনায়াস ভঙ্গিতেই বলে,
নে নে- তাড়াতাড়ি কর। তুই উঠে গেলে আরেকজন আসবে। তাকেও শান্তি দেওয়া লাগবে!
নে, নে লাগা। কাল কিস্তি ৫০০টাকা। পরশু আব্বাক লিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবি। মেলা ট্যাকা লাকপি!
নজরুলের মাথা গরম, -দু’ডে পাহাড় দেখা মাত্রই নদীর ভেতর তরতর করে পানি পড়ে যায়!
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন ফজরের আজান দিচ্ছে তা টেরই পায়না নজরুল।
পরের দিনের সকাল সত্যিই অভূতপূর্ব। এই সকালবেলার রূপের সাথে নজরুলদের দেখা সাক্ষাত কখনোই নাই আগে। কাচের গ্লাসের সামনেই সমুদ্র। সমুদ্রের পানিগুলো মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে হোটেলের পায়ের কাছেই থেমে যাচ্ছে। পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে বকের সারি। এসব দৃশ্য দেখতেই দেখতেই মেসিয়ার এসে চার্ট দিয়ে গেল সকালের নাস্তার। খাবারের মেন্যু নির্ধারণ করার পর প্লেট ভরে নাস্তা এলো। নজরুলেরা খেলো পেট ভরে। নজরুলের নিজেরই মনে হচ্ছে সে ইতোমধ্যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভেতরে প্রবেশ করেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হাল্কা মিউজিক। এই মিউজিক সকাল বেলার মেডিটেশনের জন্য বাজতেছে কিনা তা বুঝতে পারেনা নজরুলেরা। তারা কখনো এরকম সিচুয়েশনে পড়ে নাই কিংবা মেডিটেশন জিনিসটা কি সেটাও বোঝেনা। নজরুলদের এসবের প্রয়োজন পড়েনা। মেডিটেশন যে কাজের জন্য দরকার পড়ে শরীরের; নজরুলদের শরীরে তার প্রয়োজন পড়েনা। এমনিতেই শরীর রিলাক্স থাকে। নজরুলের বন্ধু বলে, এল্লে বড়লোকদের জন্যি। হামরা দিনতামান যে দৌড়ের উপরে থাকি এল্লে করার সময় কুনটি? তবু নজরুলেরা যেহেতু এই এরোস্ক্রেট হোটেলে উঠেছে সেহেতু তাদের ঐ এরোস্ক্রেটদের মতই আচরণ করতে হবে। নইলে তাদের মান সম্মান থাকবেনা। সবাই খ্যাঁত বলেই ভাবা শুরু করবে। ফলে, নজরুলেরা এরোস্ট্রোক্রেট না হয়েও এরোস্ট্রোক্রেটের ভাব নিয়ে চলাফেরা করতে হয়।
সকালের নাস্তা শেষ হতে না হতেই একে একে পরিচিত হওয়ার এসেছে এখানকার স্থানীয় দুই একজন ব্যবসায়ী। তাদের পরিচিত হয়, এখানকার ব্যবসায়ীরা নজরুলদেরকে পীর মনে করে। মানে, তারা যে, অনেক বড় এটা তাদের মনে হতে থাকে। নজরুলদের হাবভাব এমনই বোঝায় তাদেরকে।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে নজরুল, এই রকম দুই নম্বর ব্যবসাতেও যে সিন্ডিকেট থাকতে পারে তা এখানে আসলে উপলব্ধি করতে পারতো না নজরুল। এইরকম সিন্ডিকেটে সব পেশার লোকজনই যুক্ত থাকে। এই পরিস্থিতি দেখে নজরুল একদম ঠান্ডা হয়ে যায়! নজরুল ভাবে,
তালে সগলি যদি ইংকে দুই নম্বর ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে তালে পরে হামাগেরে দেশের ক্যাং করে অসুখ ভাল হবি? যখন ডাক্তারই রোগ না সাড়ার পথ্য লেখে?
-যাক, আপাতত নজরুলের এসব ভেবে লাভ নেই। দেশ নিয়ে চিন্তা করে নজরুল কি করবে? নজরুল না হয় টাকার পিছে ছোটেনা তাই বলে সবাই কি তাই? নজরুলের মতো বোকা মানুষ কয়জন আছে এই দেশে। নজরুল এ সমাজের আনফিট মানুষ। তার কথা চিন্তা করলে দেশ আগাবে না পিছাবে নজরুলের বন্ধুরা ভাবে। ওর চিন্তা বাদ দেও, হামাগেরে সাথে কথা কও, য়ুই কবি মানুষ, উদাস হয়ে থাকাই ওর নিয়তি। য়ুই ইংকেই হয়ে থাকুক।
ফলে, নজরুলের বন্ধুদের সাথে ব্যবসায়ীদের সাথে কি কি বিষয়ে ডিল হয় তার কোনো কিছুরই খবর পায়না নজরুল। নজরুলের বন্ধুদের নজরুলের উপর আস্থা নাই।
নজরুলোক কেউ গুঁতো মারলেই নজরুলের পেটোত থাক্যা সব কথাই হর হর করে বার হবি। ওক কওয়া হবিনে কোনোকিছুই।
এছাড়াও নজরুল এ পথে নতুন। ফলে, নজরুলকে তো কওয়াই যাবিনে কিছু! কিন্তু নজরুল ভাবে, তার বন্ধু সিলেকশনে ভুল আছে। সে কেনো এদের সাথে মিশবে? যাদের কারনে সামাজিক ভাবে সে হেয় হতে পারে এরকম বন্ধুদের তার লিস্ট থেকে কেটে দেওয়া উচিত। পরক্ষনে নজরুল ভাবে, কে কি করবে সেটা তাদের ব্যাপার। সে নিজে সলিড আছে এটাই যথেষ্ট। আর তাছাড়া এই কক্সবাজারে সে একা একা ঘুরতে এলে তার অনেক টাকাই হতো। অন্তত, সে টাকা খরচ হওয়া থেকে সে বাঁচলো তো অন্তত। এত টাকা নজরুলের পক্ষে বেয়ার করা সম্ভব ছিলো না। নজরুল জানে, তার এইসব সখ-আহ্লাদ পুরণ করার জন্য তাকে কতো বৈচিত্রময় লাইফের সাথেই না মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। যেমন এ যাত্রায় কক্সবাজার দেখার ইচ্ছা পূরণকল্পে তাকে যেতে হয়েছিলো ইয়াবাখোরদের সাথে। এতে করে তার লাভ হয়েছে অনেক। বিশেষত, শিক্ষা হয়েছে যে, সবার সাথে সম্পর্ক থাকলেও কিছু কিছু সম্পর্ককে না বলতে পারার সাহস রাখতে হবে।
নজরুলের সমস্যা হইতেছে যে, সে একা একা কোনোকিছুই করতে পারেনা। পাশে দুই একজন বন্ধুবান্ধব না থাকলে নজরুলের মনে হয় অপূর্ণতা নজরুলকে গ্রাস করতেছে। ফলে, তার সব কাজেই কেউ না কেউ নজরুলের পাশে থাকেই। তার বন্ধু পরিজন কেউ পাশে না থাকলে নজরুল কোনোকিছুতেই মনোযোগ স্থির করতে পারেনা। কিন্তু নজরুল দেখেছে তারা যারা নজরুলের পাশে থাকে তারাই সবচেয়ে বেশি তাকে ডিমোটিভেটেট করেছে। ফলে, নজরুল নিজ পায়ের উপর কখনোই দাঁড়াতেও পারে নাই। এরকম অভিযোগ নজরুলের পরিবারের। কিন্তু নজরুল ভাবে, তার সমস্যা এটা না। তার সমস্যা আরেক জায়গাতে। নজরুল বলে,
লোকেরা তো সগলি খালি গ্যান দেয় কিন্তু এত গ্যান লিয়ে সে কি করবি? -গ্যান ধুয়ে ধুয়ে পানি খামু লিকি! গ্যান দেওয়ার চাইতে ট্যাকা দে!
সমাজের মানুষের বৈশিষ্ট্যই এমন তুমি না চাইলেও তোমাকে ফ্রি ফ্রি জ্ঞান বিতরণ করবে। জ্ঞান দিয়ে দিয়ে তোমাকে আরো নার্ভাস করে তুলবে। কিন্তু তোমার আসল প্রয়োজনের দিকটা নিয়ে একবারও কথা বলবেনা। মানুষ বিষয়ে নজরুলের বোঝাপড়া অনেক হয়েছে। এ মহল্লার কার কি চরিত্র সেটা বুঝে গেছে। ফলে, এসব বিষয় তাকে আর ভাবায় না। কিন্তু না ভাবলেও তো চলেনা আবার। কেননা, নজরুল এ সমাজেরই মানুষ। তাকে তো সমাজের লোকেদের ভেতরই মিশতে হয়, চলাফেরা করতে হয়, আদানপ্রদান করতে হয়। যদি সবাই এইরকম ধান্দাবাজ, চাটুকার হয় তাহলে নজরুল মিশবে কাদের সাথে? নজরুলের জন্য তো আলাদা সমাজ ব্যবস্থা নাই। সে জানে না এগুলোর উত্তর। সে শুধু সফল হতে চায়। গেইন করতে চায়। কিন্তু সফল কিংবা গেইন হওয়ার জন্যও তো উপযুক্ত সমাজের দরকার পড়ে। নজরুল মনে করে, ব্যক্তি সফল এবং অসফল হওয়ার পেছনে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কাঠামোর উন্নত হওয়ার প্রয়োজন। নইলে, প্রচুর মেধাবী হয়েও এখানে কোনো লাভ নেই। কারণ মেধাবী হয়ে কি করবে যদি উপয্ক্তু প্ল্যাটফরম না পায়।
কিন্তু শুকটু বলে, লিজের দিকোতও তাকান লাগপি। খালি খালি, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থার দোষ দিলে হবিনে! তোর কি যোগ্যতা যে, তোক রাষ্ট্র আস্যা মাথাত মুকুট তুলে দিপি?
শুকটুর একথাতে নজরুল মোটেও পাত্তা দেয়না। নজরুল মনে করে, একাডেমিক লেখাপড়াই লেখাপড়া না। আইডিয়ালিজমই মূল ব্যাপার। একটা রাষ্ট্র কিংবা সমাজকে উন্নত করতে গেলে আইডিয়াগুলাকেই কাজে লাগাতে হবে।
শুকটু কয়, থো থো, তোর চাইতেও কতো বড় বড় আইডিয়া লিয়ে মানষেরা ঘুরঘুর করিচ্চে তারাই পাত্তা পাচ্চেনা!
নজরুল কয়, এডেই তো সমস্যা রে। যারা সরকারোত বসে থাকে, তাদেক ছাই দিয়েও ধরা যায়না। তুই যে, আইডিয়ার খনি লিয়ে বসচু সেডে যদি সরকারোক না জানাতে পারিস তালে ক্যাং করে কি হবি? এটিও গিরিমিন্টি! তোর হামার কথা শুনবের লয়। শুনবি বড়লোকেগেরে কথা। বুঝছু, ইংকে কত বড় বড় আইডিয়া ভাসে গেলো রে, কিন্তু কেউ চাখেও দেকপের চালোনা!
কিন্তু নজরুল দমে যাবার পাত্র নয়। সে এর শেষ দেখেই ছাড়বে! ছোটবেলায় এক বিজ্ঞজন নজরুলের হাত দেখে বলেছিলো, ও বেশিদুর পড়ালেখা করবেনা ঠিকই কিন্তু ওর ভেতর এমন কিছু আছে যা দিয়ে সে অনেক দুর পর্যন্ত যেতে পারবে! কিন্তু নজরুল জানতে পারেনি অনেক দুর পর্যন্ত পৌঁছানো মানে কতদূর পর্যন্ত? আর অনেক দুর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য তার ভেতর এমন কি আছে? বারবার ব্যর্থ হওয়াটাই কি এমন কিছু? যাতে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে অনেক দুর পর্যন্ত যেতে পারে? নজরুল ভেতরে ভেতরে আবারো হাসে। সে মনে করতে চায় সে সব কাজে ব্যর্থ হলেও একবার জয়ী হয়েছিলো। সে কথা মনে হতে না হতেই আবারও হেসে ফেলে। সে জয়ী হওয়ার অর্থ নিশ্চয়, রোজিনাকে নিয়ে। যে রাতে রোজিনা তার হাত পাও ধরে বলেছিলো, হামাক একোন ছাড়ে দেও- হামি কুলাবের পাচ্চিনে!
হ্যা, নজরুল শক্তিশালীই। নজরুলের শুধু দরকার উপয্ক্তু প্ল্যাটফরম। নজরুলের মতো অনেকেই উপযু্ক্ত প্ল্যাটফরমের অভাবে হারায়ে গেছে। কিন্তু উপযুক্ত প্ল্যাটফরম পেলে নজরুলকে হারানোর সক্ষমতা খুব কম লোকেরই আছে। তার প্রমাণ অনেক দিয়েছে নজরুল।

(ধারাবাহিক..

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত