বনলতা — (৪)

সৃষ্টির আদি ‘ তে কবে মানুষ কল্পনা করতে শুরু করেছিলো? কি ছিলো তখন তাদের প্রথম কল্পনা? এই প্রশ্ন প্রায়ই আসা-যাওয়া করে বনলতার খোলা চিন্তায়। তখন খাদ্য ছিলো মানুষের প্রধান চাওয়া । জীবন ধারণ ছিলো প্রধান যুদ্ধ। এই চাওয়া পুরনের সাথে সাথে এগিয়ে আসে অতীত ফেলে। এখন কেবল বাঁচার জন্য কেউ বাঁচতে চায়না। এখন কল্পনা মনের খোরাক। সময় মানুষকে আগায় আবার একই সাথে পেছনে টানে। এই টানাপোড়েনে যুগে যুগে কল্পনাকে কাব্যরূপ দেন কবিরা। কল্পনা প্রবল মানুষকে সাধারণ মানুষরা একটু ভয় পায় বলেই মনে হয় বনলতার। নতুন কিছু তৈরীতে কল্পনার প্রয়োজন আর পুরাতনের ধ্বংসও। এই ধ্বংস মানতে পারবে কেন সাধারণ মানুষ।

নিজেকে কল্পনাপ্রিয় ভাবে বনলতা তাই ধ্বংস’কে সাদরে গ্রহণের ক্ষমতা আছে বলেই জানতো একটু আগে পর্যন্ত। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার পৃথিবী টলে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছে “অপার জীবনানন্দ”।

বালুতটে সযতনে গড়া আল্পনা যখন ঢেউ এসে ভেঙে নিয়ে যায় তখনকার শূন্যতা শুধু আঁকিয়েই অনুভব করেন। ইমেজ হারিয়ে যায় চোখের সামনে থেকে মনের ভেতর ঠিক রয়ে যায়। আবার তৈরী করেন। তৈরীই তার স্বভাব।

অপার জীবনানন্দ ‘ পড়তে শুরু করে বনলতা অনুভব করে প্রচন্ড ঢেউ এসে কবির আগের অবস্থান ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর কেবলই কবি সত্তা। সেখানে তৈরী হচ্ছে রক্ত মাংসের জীবনানন্দ দাশ। যিনি ক্ষোভ, কাম, বেদনা, অপমানে পর্যুদস্ত। ভালো লাগেনা বনলতার। হাঁসফাঁস লাগে। সে ভুলে যাচ্ছে সময়, অবস্থান, পরিবেশ। মানতে পারছে না সে। লেখক আদিত্য রহমান এমন বিশ্লেষণ কেন করতে গেলেন? গাল কান ঝাঁঝাঁ করে বনলতার। কেবল কবি হিসেবেই না হয় জানতো কবিকে।

বই রেখে উঠে যায়। কান গাল ঝাঁঝাঁ করছে। গলা শুকিয়ে আসে। আয়নায় দেখে নিজেকে। তখন অনুভব করে একজন জীবনানন্দ জেগে উঠেছেন কোথাও।
তিনি ফিসফিস করে বলেন
– কেন বনলতা? কবিতা লিখেছি বলে আমি কি মানুষ নই? আমারও রক্ত মাংসের শরীর আছে। তোমার মতো আমারও ব্যথা আছে, হৃদয়ে সবার হেলা করা জমাট বেঁধে যাওয়া প্রেম আছে। না বলা কান্না আছে। পাখির শিসে, শিশুর হাসিমুখে সুখ বোধ আছে। আমার কী থাকতে নেই এমন বনলতা?

বেশ কিছুক্ষণ ধরে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দেয়। মাথার ভেতরে জীবনানন্দ এখন বেশ মজবুত ভাবেই দাঁড়িয়ে গেলেন মনে হল বনলতার। তিনি এবার মোলায়েম ভাবে বলেন,
– শান্ত হও বনলতা। ভাবো। তোমার মতো নয় বরং তার চেয়ে বহু গুণ অপমানিত হয়েছি ঘরে বাইরে।কে আমাকে ভালোবেসেছে? কে তোমাকে ভালোবেসেছে সেকথাও আমি কী লিখিনি?

‘তোমারে চিনিবে শুধু প্রেম জোছনা –
বধির জোনাকি!
তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি!
তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ- মৌন – আলোহারা,
তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা! ‘

বনলতা বই বন্ধ করে চুপ হয়ে বসে থাকে। কান্না পায় ভীষণ ভাবে। ফোনে তখন মেসেজ আসে — লেখক আদিত্য রহমান।

– ভালো আছেন?

বনলতা লেখে
– জী ভালো।

ওপার থেকে আসে
– ভালো থাকবেন।

বনলতা সাথে সাথে লেখে
– বিরক্ত হলেন?

আদিত্য লেখেন
– না, মনে হলো আপনাকে বিরক্ত করলাম।

বনলতার বুঝতে পারে নিজের আচরণের ত্রুটি, স্বভাবতই কোনো কিছু খেয়াল না করা। যা অন্যের নিকট অপমান জনক। সে লজ্জিত হয়ে ব্যাখ্যা করে
— আসলে আপনার বই পড়ছিলাম, হঠাৎ খুব খারাপ লাগছিলো। আমার ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। মাফ করবেন।

— না, না, ছিঃ। আপনি পড়ছিলেন আমি ডিস্টার্ব করলাম, আমি দুঃখিত।

— প্লিজ এভাবে বলবেন না। আমি ঠিক সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে।

লেখক হয়তো বুঝলেন বা বুঝলেন না। তিনি লিখলেন
— আচ্ছা, ঠিক হয়ে যাবে। পড়ে জানাবেন কেন এমন হলো।

— জী অবশ্যই।

বনলতা বই পড়ছে। পাশে একজন বসে আছেন। যিনি কথা দিয়েছেন বনলতাকে উপায় দেখাবেন উড়ে যাবার। এই বিষাক্ত ধুলোমাটি আর হীন মানসিকতায় পূর্ণ মানুষের পৃথিবী থেকে নতুন পৃথিবীতে যাবার উপায় তাঁর জানা। কেউ জানবেনা সে কথা, বুঝবেও না কখনও। কোনো আইনেই তা অসিদ্ধ হবেনা। তবে শর্ত আছে, যদি বনলতার ক্ষতের গভীরতা তাঁর চেয়ে একটু বেশি হয় তবেই।

হন্যে হয়ে ব্যাথা আর জ্ঞানের পাহাড়, চোখ-মনের খোন্তা-বেলচায় খুঁড়ে যাচ্ছে বনলতা। শর্ত পূরণ করা চাই তার। আজ রফিকের কথা ভুলে গেছে সে। স্নিগ্ধা ভাবির বিষয় নিয়েও আর মন খারাপ হচ্ছেনা তার। এই প্রথম। চার বছরে কোনো একটা দিন তার এমন যায়নি! কারণে অকারণে এই দুই’মানুষের কথা মনে করে হঠাৎ সমস্ত আলোকে, দিনকে বা রাতকে অসহ্য মনে হতো তার।

বই এর দীর্ঘ ভূমিকা শেষ করে এক এক করে লেখকের নাম দেয়া অধ্যায় ধরে এগিয়ে চলে বনলতা। যেন সন্তপর্ণে কোন সরু পথ ধরে অন্যজগতের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। শেষ লাইন লিখেছেন কোনো দ্বিধা নেই, সংশয় নেই, অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার উচ্চারণে স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ বলেছেন এটি নিছক দুর্ঘটনাই।

চোখ দুটো কড়কড় করে তবুও বই শেষ করে তবেই হাত থেকে রাখবে সে।
দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে।
কানের কাছে যেন শুনতে পায় ফিসফিস করে কেউ আবৃত্তি করে —

‘জানি এমন দিন আজো আসে নিকো
এ রকম যুগ ঢের — হয়তো বা আরো ঢের দূরের জিনিস।
আজ, এই ভূমিকায় মুহূর্তের বিস্মৃতির, স্মৃতির ভিতরে।
সারাদিন সকলের সাথে ব্যবহৃত হয়ে চলি,
জিতে হেরে লুকায়ে সন্ধান ভুলে;
নিরুদ্দিষ্ট ভয়
খামিরের মতো এসে আমাদের সবের হৃদয়
অধিকার করে রাখে।’

বনলতা বইয়ের ভেতর বুকমার্ক গুজে। ফোন হাতে নেয় মেসেজ টাইপ করে বইয়ের লেখক আদিত্যকে –

— দুটো কথা বলতে চাই, অনুমতি পেলে।

সেন্ড করার পর সময় দেখে সে, অস্বস্তি হয়। রাত বেশি হয়নি, তবুও মনে হয়, এখন সময়টা ঠিক নয়। প্রায় সাথে সাথে রিপ্লাই আসে

— হ্যাঁ, বলুন না। মাত্র দুটো কেন? সব কথা বলুন।

উত্তর দেখে হতচকিত হয়ে যায় বনলতা। এমন সপ্রতিভ আন্তরিক হয় নাকি লেখকরা! সে ভেবেছিলো হয়তো তিনি মেসেজ সিন করে রিপ্লাই আসবে কাল সকালে কথা হবে।

বনলতার হকচকিয়ে যাওয়া দেখে পাশে বসা জন মৃদু হাসলো নাকি! সে কি বুঝে গেছে বনলতা কি বলতে চায়। ওপাশ থেকে ফের ভেসে আসে

— কই বলুন!

— না আমি আসলে অসময়ে বিরক্ত করলাম।

— ভাববেন না। অসময় বলে কিছু হয়না। বলুন।

পাশে বসা মানুষটির তীর্যক মৃদু হাস্যমুখ অনুভব করে বনলতা, সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর সামনে কিছু বলবেনা। সে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে।

— আমি কখনো কোনো লেখকের সাথে এভাবে সরাসরি কথা বলিনি তাই কিছু ভুল হলে ক্ষমা করবেন।

লিখেই বোঝে বোকার মতো হয়ে গেলো কথাটা। তবে এ কথা তো সত্যি কতো বই পড়েছে সে। পড়তে পড়তে কোনো লেখকের সাথে কথা বলবে আসলেই কল্পনা করেনি সে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে

— আরে ভাই এতো বিনয় করতে হবে না। আমি বিশেষ কিছু নই। বই’ই লিখি কেবল। রাজকার্য জানি না। আপনি যে কিনে পাঠ করছেন, এতেই আমি ধন্য। কী বলবেন বলুন।

— কী বলবো!

— বাহ! দুটো কথা জানতে চাইবার অনুমতি নিয়ে বেমালুম ভুলে গেলেন! ভারী মানুষতো আপনি!

এতো চমৎকার করে কেউ কথা বলে একজন সাধারণ পাঠকের সাথে! বনলতা মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হবার বাতিক তার। অনেক ঘেঁটে আবিষ্কার করেছিলো সে – মুগ্ধ হতে জানলে অন্তরের ভেতরের শিশুসারল্য বজায় থাকে। পাশের মানুষটিকে সে দেখতে পায় না। কোথায় গেলো সে! হয়তো বারান্দায় অথবা মিলিয়ে গেছে। সুযোগটা কাজে লাগায় সে। পাশে বসে কেউ একজন হাতের দিকে চেয়ে থাকলে কি আর তাঁর বিষয়ে কথা বলা যায়! সে ইতস্তত লেখে

— প্রতিটি অধ্যায়ের নাম গুলো সুন্দর দিয়েছেন।

— ধন্যবাদ। এবার দ্বিতীয়টি বলুন।

— আপনি জীবনানন্দ দাশকে অনুভব করতে পারেন?

আবার বোকা বোকা লাগে তার নিজেকে। সাথে সাথে সেই মানুষটি কোথাও থেকে এসে হাজির হন। বনলতাকে বললেন তিনি ‘অন্তত তোমার থেকে বেশি।’

লেখক এবার লিখলেন

— তা মনে হয় কিঞ্চিৎ পারি৷ বই পড়তে কেমন লাগছে বললেন না?

— আমি ঠিক বলতে পারিনা।

— মানে?

বলতে না পারার ব্যাধি বনলতার। এ নিয়ে অনেক অশান্তিও আছে। তার বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারে না। অগোছালো কথারা প্রায় সময়ই খুব বাজে পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় তাকে। তার চেয়ে চুপ করে থাকতেই আরাম হয়। আবার অনেক কথা নিজের সাথেই নিজে বলে, মন হালকা হয়।

অনেক সময় সে রফিকও হয়। রফিক খুব রেগে গিয়ে খারাপ ব্যবহার করলে। নিজে রফিক হয়ে নিজের কাছে ক্ষমা চায়।

লেখক যেহেতু তার এই স্বভাবের সাথে পরিচিত নন তাই তিনি এই কথার মানে জানতে চাইছেন। বনলতা সরল মনে লেখে

— আসলে আমি অনুভূতির কথা গুছিয়ে বলতে পারিনা। এই যে কবি বুঝতেন এক্সিডেন্টে তাঁর মৃত্যু হবে আবার নিজেই বলেছেন – নিছক দুর্ঘটনা। ব্যাপারটা কেমন যেন। না?

— অবশ্যই ব্যাপারটা কেমন যেন। তিনি কবি, কবির সব কিছুই তো কেমন যেন হয়। তাইতো এতো আগ্রহ ওঁকে নিয়ে। আপনি পড়ুন, বুঝতে পারবেন, বলতেও পারবেন।

— পারবো! কিন্তু কবি তো তা দিচ্ছেন না।

— মানে? কে কী দিচ্ছে না!

বনলতার মনে হয় এবার নির্ঘাত লেখক বাজে বকে সময় নষ্ট করার ওর সময় নষ্ট করার জন্য বিরক্ত হবেন। নয়ত ওকে পাগল ভাববে।

— না, আসলে কবিকে সেভাবে ভাবতাম না। আপনি কবি থেকে রক্তমাংসের মানুষটাকে এনে হাজির করলেন। তাই সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আপনি বিরক্ত হবেন শুধু এসব বাজে কথায় সময় নষ্ট করার জন্য। আমি দুঃখিত।

— আপনি শুধু শুধু দুঃখিত হচ্ছেন কেন। আমি মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। চাইলে সারা রাত কথা বলতে পারেন।

বনলতার বিস্ময়ের খেই হারিয়ে যাচ্ছে। একদিকে কবি এখন বসে তার পাশে। অন্যদিকে লেখকের অমায়িক ভদ্রতা! হয়তো লেখকের কাছে সে’ও একটা বিষয় হ’য়ে উঠেছে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে লেখে

— না, আজ আর কথা নয়। আমি পড়ি কাল কথা হবে।

— আপনার ইচ্ছে। বই তো হারিয়ে যাচ্ছে না। রাত জেগে না পড়ে বরং ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে। শুভরাত্রি।

বেশ প্রশান্তি অনুভব হয় বনলতার। ওষুধ ছাড়া আরেকটা রাত সে ঘুমের কোলে ঢ’লে পড়ে।

—- —– ——

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত