শেফালী ও কয়েকজন পুরুষ (৪)

পুরো যমুনা সেতু ট্রেন হাঁপাতে হাঁপাতে পার হলেও এখন চলছে দুর্দান্ত গতিতে। টিটি টিকেট চেক করে চলে গেছে। হাসান সাহেব চা আর কাটলেটের অর্ডার করেছেন। মুহূর্তে পৌঁছেও গেছে। অনেকক্ষণ কারো ভেতর কোনো কথা নেই। চা-নাশতা নিয়েই ব্যস্ততা। শাহেদ শেফালীকে দেখে ভীষণ টেনশনে থাকলেও বুঝতে দিচ্ছে না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কী ড্রাগ এরা দিয়েছে কে জানে? কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভুতি কাজ করছে। এরই ভেতর ট্রেন ঈশ্বরদী জংশন এসে গেছে। এখানে অনেকক্ষণ থামে। শাহেদের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সে নামার প্রস্তুতই নিচ্ছিল। কিন্তু হাসান সাহেব থামিয়ে দিল।

: কষ্ট করে আপনাকে নামতে হবে না, আপনার সিগারেটের ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।

হাসান সাহেব কীভাবে সিগারেটের ব্যবস্থা করবেন শাহেদ ঠিক বুঝতে পারে না। তবে সত্যিই সিগারেট এর প্যাকেট  হাতে একটা ছেলে কামরায় ঢুকেছে। ৬ ফিট লম্বা হবে। মাথায় কোঁকড়া চুল। শ্যামলা বর্ণ। নেশাখোরদের মত চোখ, স্বাস্থ্য এত খারাপ যে সহজেই চোখে পড়ে। শাহেদ, শেফালী আর হাসান সাহেব বাদে কামরায় এখন চতুর্থ ব্যক্তি রাসেল।

হাসান সাহেবের সঙ্গে প্রথম দেখা রাসেলের পল্টন এলাকায়। রাসেল তখন পুরো দস্তুর রাজনীতিবিদ। পল্টন আর আজিজ সুপার মার্কেট তার আড্ডা স্থল। শাসক-শোষক শ্রেণির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বুনে চলা এক মানুষ। মার্কস আর লেনিনের উদ্ধৃতি ঠোঁটস্থ। সেদিন রাসেলরা মার্কিন বিরোধী আর সমুদ্র বন্দর  রক্ষার কোনো মিছিল করে শহীদ মিনার ঘুরে মুক্তাঙ্গনে সমবেত হয়েছে। চট্টগ্রাম অভিমুখী লং মার্চের আয়োজন চলছে। এই সময় রাসেলের কানে এল তাকে উদ্দেশ করেই এক ভদ্রলোক বলছে,

‘চুক্তি হবে এই মুক্তাঙ্গনের পাশে সচিবালয়ে। সচিবালয় ঘেরাও না করে চট্টগ্রাম যাওয়ার হেতু কী’?

চট করে রাসেলের মাথায় কোনো উত্তর আসেনি। সে-ই শুরু হাসান ভাইয়ের সান্নিধ্য পাওয়া। এ পর্যন্ত যত জ্ঞানী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছে রাসেল তার মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রতিটি বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। আর আছে রাজনীতির অঙ্ক কষে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা। আর মুহূর্তেই উত্তেজনা তৈরির অদ্ভুত ক্ষমতা। তিনি যা বলতেন সরাসরি বলেন, যা ভাবেন তার ভেতর কোনো ঘোরপ‌্যাঁচ নাই। পল্টনের একটা ছোট্ট অফিসে তিনি সপ্তাহে একদিন বসেন। বাম/ডান  রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকের যাতায়াত আছে অফিসে। অনেকেই তার ভাবনা জানতে অফিসে আসেন। কেউ কেউ আসেন গল্প করতে। হাসান সাহেব কোন দল করেন না। পাকিস্থান আমলে বোধহয় বাম রাজনীতি করতেন। মাঝে অনেক কাল বিদেশ বিভুয়ে কাটিয়েছেন। হাসান সাহেবের সাথে টপ লেভেলের অনেক বামপন্থী নেতার কানেকশন আছে। প্রায়ই তাদের দেখা যায়। মাঝে মাঝে হাসান সাহেবের এখানে জম্পেশ নাশতা হয়। রাসেল অবশ্য নাশতার লোভে আসে না। হাসান সাহেবের কথা শুনতে আসত। যদিও হাসান সাহেব প্রায় বলেন , এক নানরুটি  তিনজন চায়ে ডুবিয়ে খেয়ে বিপ্লব হবে না হে কমরেড রাসেল। সেট এ থিফ টু  ক্যাচ এ থিফ। লড়াইটা যার সাথে হবে তার সমান না হতে পার কিন্তু ন্যূনতম যোগ্যতা তো লাগবে ফাইট করার।

হাসান সাহেব নিজে কম্যুনিস্ট না তবু বলতেন, দেশের জনগণের প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করার মধ্যেই কমিউনিস্টদের একতা আসবে। মার্কসবাদকে কখনোই ধর্মগ্রন্থ হিসাবে দেখেন না। বরং বারবার বলেন এটা বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। মার্কস কেউ তিনি অতি উৎসাহীদের মতো মূল্যায়ন করেন না। তবে মার্কসবাদে তার অগাধ আস্থা। তিনি নির্বাচনমুখী। বিশ্বাস করেন নির্বাচন করেই গণমানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। প্রধান বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা আর নির্বাচন করে বলেই তারা গণমানুষের কাছে এত জনপ্রিয়। আর অধিকাংশ কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সমালোচনার থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ, ভারত-পাকিস্তানের আধিপত্যবাদ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় দেখে তারা গণমানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না। রাশিয়া, কিউবা, ভারত, চীন থেকে নয় বরং এদেশের জন্য এদেশের মতো করে মতবাদ, তত্ত্ব হাজির করতে হবে এটাই ছিল তার বক্তব্য। রাসেলের কাছে কথাগুলো নতুন।

নেপালে প্রচন্ড আর বাবুরাম ভট্টরাই ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাম দল গুলো নতুন করে স্বপ্ন বুনছে। উপমহাদেশে বাম দল গুলো কক্ষনো কেন্দ্রীয় ক্ষমতার এত কাছাকাছি আসতে পারেনি যা নেপালে ঘটেছে। রাসেলও এই নেপাল নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাসিত। রাসেলের মনে হয় এবার কিছু ঘটবে। নেপালের সাথে উপমহাদেশের রাজনীতি টালামাটাল।  পাকিস্থানে একের পর এক প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হচ্ছে, মায়ানমারে অং সান সুকি ছাড়া পেয়েছে। এর ভিতর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট কে হটিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে।   রাসেল তার উপলব্ধির সঙ্গে হাসান সাহেবের কথা মেলাতে যেত। মাঝে মাঝে তর্ক হতো খুব হাসান সাহেবের সঙ্গে। হাসান সাহেব একটা স্টাডি সার্কেল গড়ে তুলেছেন। রাসেলের মত অনেকেই তার শিস্য। বিশেষ করে যারা তাত্ত্বিক নেতা হতে চাই । এদের মধ্যে রাসেলের যাতায়ত হাসান সাহেবের বাড়ী অবধি। ধীরে ধীরে একটা পারিবারিক সম্পর্কের মত হয়ে গেছে। হাসান সাহেবের স্ত্রী হালিমা ভাবির সঙ্গে অবশ্য কেবল ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে রাসেলের। কয়েকবার দেখা হয়েছে। সব সময় একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখেন। কখনো খোশ গল্প হয়েছে বলে মনে হয় না। সেদিন বিয়ে বাড়ীতে সেই ভাবীর সাথে দেখা।

হালিমা ভাবির সঙ্গে রাসেলের কথা হলো এমন সময় যখন পুষ্প চলে গেছে জীবন থেকে। বিয়ের দিন শত ব্যস্ততার মধ্যে রাসেলের দিকে একবার কেবল তাকিয়ে ছিল। সেই চোখের চাহনির মানে বোঝার মতো অবস্থা তখন রাসেলের নেই। বিয়ে বাড়িতে কেন এল সে? কারণ খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল পুষ্পকে। বিয়ের সাজে কেমন লাগে ওকে। তাই আগ-পিছ চিন্তা না করেই সোজা কমিউনিটি সেন্টারে। কোনো গিফট নেয়ার কথা মনে ছিল না। সামনের সারিতে গিফটের পাহাড় দেখে কথাটা মনে পড়ল। পুষ্পের ভাইয়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সোজা ঢুকে পড়ে পুষ্প যেখানে বসে আছে সেখানে। মোবাইলে একখানা ছবিও তুলে ফেলে। জনাকয় সখীর সঙ্গে চোখাচোখিও হয়ে গেল। যেন ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে চোখগুলো। কানিজ হাত ধরে কমিউনিটি সেন্টারের এক পাশে নিয়ে আসল ওকে।

: আপনার এখানে না আসলে কি চলত না?

: জানি না।

: আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব সামলে নেব। আপনি চলে যান।

: এখনই

: হ্যাঁ এখনই।

: ওর সঙ্গে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

: কোনো কথা হবে না। আপনি ওকে ভালোবাসেন না। আপনি চান আপনার কারণে ও যে জীবন শুরু করতে চাচ্ছে সেখানে কষ্ট পাক?

: বাহ! ভালোই তো বললে। তোমার বান্ধবীর জীবনটা জীবন আমারটা কিছু না।

: রাসেল ভাই। আপনার সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। প্লিজ আপনার পায়ে ধরি। আপনি চলে যান। প্লিজ।

খানিকক্ষণ একটা নিস্তব্ধতা।

রাসেল আর কথা বাড়ায় না। মোবাইলে ওর আরো একটা ছবি তুলতে চেয়েছিল তা-ও আর হয়ে ওঠে না।

গেটের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে অমনি হাঁলিমা ভাবি বলে উঠলেন –

: এই রাসেল, এদিকে একটু শোন।

: জী, ভাবি।

: ওই যে লোকটাকে দেখছ, ওকে কি তুমি চেন?

: না ভাবি। তবে খোঁজ নিয়ে জানছি।

: ভাই যাও না একটু।

ভাবির কণ্ঠটা অদ্ভুত লাগে রাসেলের কাছে। কোনো একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু এখন এত সব ভাবার সময় নেই। রাসেল এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। লোকটা পুষ্পের বড় খালু। ভাবিকে এই তথ্যটা দিয়ে কেটে পড়ে রাসেল। প্রেমিকার বিয়েতে হাজির হয়েছে সে ভাবতেই বিব্রত লাগছে।

একই বিয়ে বাড়িতে আরেকজন ছিল বিব্রত অবস্থায়। সে শাহেদ। জালালের কথামতো ঠিক নয়টায় ঠিকানা খুঁজে হাজির হয়েছে। কিন্তু জালালের খবর নেই। সুমি-রুমি দুই বোনের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। সুমি বেশ খাতিরও করেছে। রুমিকে একটু বেখেয়ালি মনে হলো। শাড়ির আঁচল অসাবধানে বুক থেকে সরে যাওয়াতে শাহেদ একবার দেখে ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিল। গায়ের রং ফরসা। নাক খাড়া। চোখে চশমা। ভ্রু রেখা স্পষ্ট। চুল খোঁপায় শক্ত করে টেনে বাঁধা। দেখে অবশ্য সাধারণ লাগল। অবশ্য অসামান্য রূপসী মেয়েদের প্রায় সময়ই সাধারণ মনে হয়, তবে লক্ষ করার মতো বিষয় হলো বিয়ে বাড়িতেও সে একটা গল্পের বই নিয়ে ঘুরছে। লেখকের নাম হ‌ুমায়ূন আহমেদ। শাহেদ বোধ হয় একটু বেশি সময় তাকিয়ে ছিল,  “আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকবেন না” – এই ছিল শাহেদের দিকে রুমির প্রথম সংলাপ। যদিও অল্পক্ষণ পরেই পরিচয়ের পালা শেষ হলো সুমির মাধ্যমে।

সুমি অনেক যত্নআত্তি করলেও মোটেকালে আড়ষ্টতা কাটছে না। চেনে না জানে না এমন এক বিয়েতে সে উপস্থিত। তবে জালালের কথা সত্য। এদের সত্যিই দুই বিঘা জমির ওপরেই বাড়ি আছে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেড়িয়ে শাহেদ দেখে এসেছে। কাছাকাছিই। দশ টাকা রিকশা ভাড়া। অনেক পুরোনো বাড়ি। অনেকবার সংস্কার হয়েছে। নিচ তলাটা পুরোটাই দোকানপাটে ভরা। ওয়ার্কশপ, বিরিয়ানি, চা, ঢালাই মাল এমন কোনো দোকান নেই যে নেই। দোতলায় রুমিরা থাকে। অনেক ফ্যামিলি মেম্বার মনে হলো। বোঝাই যাচ্ছে এই নিচতলার দোকান ভাড়া দিয়েই ফ্যামিলিটা চলে। রুমিকে অপছন্দ হয়নি শাহেদের। সুন্দর এবং শিক্ষিত। বিবিএ কমপ্লিট করেছে প্রাইভেট ভার্সিটিতে। জালালের কথা দেখা যাচ্ছে ১০০ তে ১০০-ই সত্য। শুধু মেয়ের বয়স মনে হল বেশী। শুধু বেশীই না এই মেয়ের আগে বিয়েও হয়েছিল। ডিভোর্সি মেয়ে। জালাল এ কথা গোপন করে গেছে। বিয়েতে জালালের দেখা নেই। মাথার ভেতর শাহেদের একটা ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

রাসেলেরও মাথার পেছনে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। চা খেতে হবে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে রহমতের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। রহমতের দোকানের স্পেশাল চা (ওর ভাষ্যমতে) খেয়ে আবার হাঁটা। গন্তব্যবিহীন হাঁটা। হুমায়ূন আহমেদের হিমু যেভাবে হাঁটে সেভাবে। তবে তার মতো খালি পায়ে না। রাসেল ভাবে তার জীবনটা এমন কেন? কোনো দিন কি একটু আনন্দ পেয়েছে সে ? মনে করে রাখার মতো কি কোনো ঘটনা আছে তার  জীবনে? সেই ইন্টার লাইফে ঘর ছেড়েছে। মেসে মেসে তার জীবন কেটে গেল। বাবা মা গ্রামে থাকে। এক গাঁদা ভাইবোন। সংসার চালাতে সবসময় হিমশিম খেয়েছে বাবা। ছেলেগুলো একটু বড় হলেই ছেড়ে দিয়েছে । যে যেভাবে পেরেছে ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে। এক সময় ঢুকে গেল বাম রাজনীতিতে। এইসব  জীবনের অস্থির অসন্তোষ বারবার ফিরে আসে। এই এত রাতে আশপাশে প্রচণ্ড কাকের কোলাহল। হুমায়ুনের হিমু হলে ভাবতো কাকগুলোর ব্রেনে বোধহয় সমস্যা দেখা দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছে পুষ্পের কথা।

ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মোবাইলে। রং নম্বর এ ফোন চলে গিয়ে ছিল। ফোন করতেই গালাগালির সম্মুখীন। কিছুটা বিব্রত হলো। তবে জেদও চেপে গেল। এই মেয়েকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। তাই সিম চেঞ্জ করে আবার ফোন। এবার আর আগের মতো না। কীভাবে কীভাবে যেন আলাপ জমে গেল। আসলে মানুষের মুড একটা বড় ব্যাপার। মানুষ যে কখন কী করে বসে তা আগে থেকেই বোধ হয় স্বয়ং বিধাতাও কল্পনা করতে পারে না। এক কথা দু’কথায় বেশ চলছিল। রাতের পর রাত কেটে যেতে লাগল অনর্থক কথায়। কী বলত, আর কী বলত না তা বোধ হয় কোনো দিন মনে করতে পারবে না সে। এভাবে চলছিল বেশ। একদিন আসল দেখা করার প্রশ্ন। একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে। বিপত্তি বাঁধল দেখা করার পর। না রাসেলের পছন্দ হয় ওকে, না ওর পছন্দ হয় রাসেলকে। হয়ত সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ওই যে মানুষের মন বোঝা সাধ্য কার? এরপর রেস্টুরেন্ট, পার্ক, রিকশা, মার্কেটে বহতা নদীর মতো টোনাটুনির প্রেম কাহিনি চলতেই লাগল।

টানা চার বছরের প্রেম কাহিনি শেষ করে যখন মেয়ের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার ভাবনায় আত্মীয়-স্বজনের ঘুম নষ্ট, তখন রাসেলের মাস্টার্সও কমপ্লিট হয়নি। দু’টো টিউশনি করেই হাত খরচটা উঠে আসতো তার। এ অবস্থায় বিয়ের কথা বাড়ীতে বলা পাগলের প্রলাপ। ‘অপেক্ষা কর’- বলা ছাড়া সত্যিই নিরুপায় সে। ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না মোটেই। কিন্তু ভবিষ্যতের ঠিক যে এখনো করতে পারেনি তাকে মেয়ে দেবে, কার দুঃসাহস! পুষ্পের এক কাকির মাধ্যমে অনেকখানি আগানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে এক খালা এসে সব বিগড়ে গেল। ঘটনাচক্রে হালিমা ভাবি আজ সেই খালুরই খোঁজ নিচ্ছে। বিদেশি পাত্র। আবার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ঘটনা কত দ্রুত ঘটতে পারে ধারণা ছিল না। গত কয়েক দিনে কোথা থেকে যে কী হয়ে যাচ্ছে তা-ও ভেবে কূল-কিনারা করতে পারছে না। এবং সব প্রশ্নকেই অমীমাংসিত রেখে সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য কথা রাসেলের জীবনে আজ পুষ্পের বিয়ে।

এ ক’দিন বেশ গোপনীয়তায় কাজ সারা হয়েছে। ওর বিয়ে হচ্ছে এ খবর যখন এল রাসেল তখনো ব্যস্ত আজিজ সুপার মার্কেটে ওদের নতুন পত্রিকা নিয়ে। সমাজ পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সব সময়। কিন্তু নিজের জীবনেই যে এত বড় পরিবর্তন হয়ে যাবে ভাবেনি কখনো। হাঁটতে হাঁটতে ওভার ব্রিজের সামনে এসে এক সিনেমার পোস্টার দেখে দৃষ্টি আটকে গেল, ‘ভালোবাসার দাম’। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। একটা মেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল

: আমারে নিয়ে সিনেমা দেখবেন।

বেশ অবাক হয়ে রাসেল জিজ্ঞাসা করল –

: আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন।

মেয়েটার হাসি ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে নিয়ে আসে। বুঝতে পারল সবটা। মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে এয়ারপোর্ট স্টেশনের দিকে হাঁটল সে। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। স্টেশন এলাকায় একটা হোটেল আছে পরিচিত এক বন্ধুর বাবার। হাঁটা শুরু করতেই দেখল একটা বাচ্চা ছেলে আর তার বাবা ভিক্ষা করছে। বাবাটা একটা অদ্ভুত গাড়িতে চেপে বসেছে। ছেলেটা ঠেলছে। রাসেল কিছু না ভেবেই পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিল। যদিও জানে সারা রাতের সিগারেট খরচ আর থাকছে না। কিন্তু মানুষ তো! কখন কী করে নিজেই বুঝতে পারে না। নোটটা দেখে ছেলেটার চোখ চকচক করছে, সে অবাক। কী করবে বুঝতে পারছে না মনে হয়। বাবাটা বোধ হয় অন্ধ। সে বুঝতে পারছে না ছেলের মুখের অভিব্যক্তি। রাসেলের মনে হলো বাচ্চাটার চোখের আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল। মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার মতো।

পুষ্পের চোখের মায়ায় আটকে ছিল যেমন ও চার বছর। বলার মতো কোনো চেহারা পুষ্পের ছিল না। তারও নেই। তবে ‘দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’- রবি কী দেখে লিখেছিল কে জানে, না তবে রাসেল সত্যিই ওর চোখের প্রেমে পড়েছিল। ছেলেটার মায়াবী ওই চোখকে পেছনে ফেলে রাসেল এগিয়ে যায় সামনে।

সামনে কিছুদূর যেতেই কাওলার ওখানে মনে হল বেঞ্চের ওপর কিছু আছে । একটু এগোতেই পরিস্কার হল একজন মানুষ বসে আছে। তবে মানুষটা ঘরের সব টুকু দেখা যাচ্ছে না। দেখো যাচ্ছে পিঠ। স্ট্রিট লাইটের আলো আসছে। সেই আলোয় কেবল বসে থাকা শরীরের কুঁজো ছায়ামুর্তি বোঝা যাচ্ছে। আর বোঝা যাচ্ছে তার ন্যুজ শরীরের থরথর কম্পন।

কাছাকাছি যেতেই একটি মেয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমস্যা হলো মেয়েটি নগ্ন। এই রাতে একাকী একটা মেয়ে এখানে কেন? শেফালী তখন একনাগড়ে চিংকার করে কাঁদছে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছে না। রাসেল হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কয়েক কদম হেঁটে সামনে এগোল। কিন্তু বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই যেন জমে গেল সে। গা হিম করা দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার।

রাসেল কাছে যেতেই  চিনতে পারে মেয়েটিকে। শেফালী। ওর ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড পীযুষের বান্ধবী। সে এখানে এই কাউলাতে এত রাতে কেন? তার পরনে শুধু ছেড়া সায়া। শরীরে ব্লাউজ বা ব্রেসিয়ার কিছু নেই। পিঠ ও বুক নগ্ন এবং পাশবিক অত্যাচারের চিহ্নে ক্ষতবিক্ষত। রাসেলকে  কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে দেখেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। একপর্যায়ে জড়িয়ে ধরে জোরে বিলাপ করে কেঁদে উঠল। রাসেলের যদিও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু  মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না। রাসেল পাশে পড়ে থাকা রক্তে ভেজা নোংরা শাড়িটাই টেনে এনে তার শরীরের ওপর মেলে দিল। রাসেলের এতটুকু সহানুভূতিতেই শেফালির চোখে তাকে মহান পুরুষ বানিয়ে দিলো। যেন তার সতীত্ব ফিরে এসেছে। যদিও বসে থেকেই শাড়িটা পেঁচিয়ে পড়তে গিয়ে পড়তে পারল না। মূর্ছা গেল। রাসেল উপায়ন্তর না পেয়ে হাসান সাহেবকে ফোন দিয়েছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে ফোন দেওয়ার মতো পরিচিত আর কেউ ছিল না, তারপর এই হাসপাতাল।

জ্ঞান তখন কেবল ফিরেছে। রাসেল শেফালির পাশে  বসে আছে। ছোট কেবিনটার বিছানার এককোণায় শুয়ে আছে শেফালী। দুহাঁটুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গুঁটিসুটি মেরে এক কাত হয়ে শুয়ে আছে। চোখে উদাস দৃষ্টি। শুকনো ঠোঁটদুটো এমনভাবে লেগে আছে যেন একটু নাড়াতে চাইলেই ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। মাথার চুলগুলো যেন দীর্ঘদিনের অযত্নে ধূসর রং ধারণ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে জীবন্মৃত।

 

রাসেল চাপা গলায় ডাক্তারকে বলল –

: ও কি বাঁচবে?

: বাঁচা মরা তো আল্লাহর হাতে।

: আমি যদি ওকে কোনো কথা বলি তাহলে কি ও শুনবে?

: শুনতে পাবে।

রাসেল দুহাতে শেফালীর হাত ধরে আছে, ফিসফিস করে বলল-

: তোমাকে বাঁচতেই হবে।

এই একই কথা রাসেল প্রথম পরিচয়ের দিন বলেছিল।

শিকার যাত্রায় ছয় তরুণ। শেফালী, পীযুষ, অন্তু, সবুজ, আমজাদ আর রাসেল। এক শেফালী ছাড়া সবাই ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড। দলে একমাত্র মেয়ে সদস্য শেফালী। মেয়েটির চোখ দুটো ছোট , বিশেষত্ব হীন, ছোট কপাল তবু কী অদ্ভুত দেখতে। কী! মোহময়ী। পীযুষের কেমন জানি বন্ধু। নওহাটির জঙ্গলে মূলত শেফালীর জন্য পীযুষের পীড়াপীড়িতে এই শিকার যাত্রার আয়োজন। জঙ্গল কি আর আছে? এক সময় শাল, বহেড়া, হরীতকী, পলাশ, হিজল ঘেরা এই জঙ্গলে বক, বনমোরগ, বনবিড়াল, শেয়াল সবই ছিল। ছিল বিচিত্র অনেক সাপ। এখন কালে-ভদ্রে দেখা যায়। তারপরও শীর্ণকায়া খালের পাশে গড়ে ওঠা এই জঙ্গলই ভরসা। খালে মাছ ধরা আর সঙ্গে গুলতি নিয়ে পাখি শিকার। দেখা যাচ্ছে ঘুঘু আর বনটিয়া বেশ পরিমাণেই আছে। আছে শালিকের ঝাঁকও। মাছ ধরতে বড়শি নিয়ে বসেছে পীযুষ আর আমজাদ। সবুজ আছে নৌকার হাল নিয়ে। রাসেল গুলতি হাতে। অন্তু বাঁশের ডগায় পাঁচ-ছয়টি লোহার শলা জুড়ে দিয়ে টেঁটা নিয়ে তৈরি। সে নাকি একটা আইর মাছ মারবেই। এই খালে নাকি বেশ বড় সাইজের আইর এখনো আছে।

নৌকাটা সামান্য দুলে উঠল আর তখনই চোখে পড়ল পাখিটাকে। গাঢ় লাল বুক, গলা হলুদ, নিচের দিকটা সবুজ আর ডোরাকাটা হলুদ রঙের। বনটিয়া বোধ হয়। বনটিয়ার অন্য নাম কি বসন্তবাউরি? এ কথা ভাবার সময় কোথায়? রাসেল গুলতিটা তাক করল। সবারই নজরে এসেছে পাখিটা। একটা চাপা উত্তেজনা, নিশ্বাস বন্ধ। ইশারায় নৌকাটা আরেকটু আগাতে বলল সে। গুলতি থেকে দূরত্বটা বেশিই মনে হচ্ছে। নৌকার সঙ্গে পাখির কৌণিক দূরত্বে লক্ষ্য স্থির করা মুশকিল। তবে সবুজ ওস্তাদ। মুহূর্তেই পাখিটাকে গুলতির ফ্রেমে সবচেয়ে সুন্দর অবস্থানে এনে দিল। নিবিষ্ট মনে তখনো কলাতে ঠোকরাচ্ছে পাখিটা। তাকে আঘাত করার এটাই সর্বোচ্চ সুযোগ। সেকেন্ডের ব্যবধানে পাখিটা বুঝে গেলে সব ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে।

রাসেলের নিশানাও অব্যর্থ। একেবারে মাথায় আঘাত হানল সে। ঝোপের ভেতর পাখিটা পড়তেই হই হই করে উঠল অন্তু। নৌকা ভেড়ান হলো। পাখির জান তখনো অবশিষ্ট আছে। রাসেল হাত থেকে ছো মেরে সেটাকে নিয়ে নিল আমজাদ। আল্লাহু আকবর বলে গলায় ছুরি চালানো হলো। তখনই প্রশ্নটা আসল, এই পাখি খাওয়া হালাল না হারাম। তবে মাসালা দিতে ওস্তাদ হলো সবুজ। থাবা দিয়ে শিকার করে না তাদের গোশত খাওয়া হালাল। তার কথায়, টিয়া পাখি হারাম হলেও বনটিয়া হালাল। এ তো শুধু ফলমূল খায়। আর ঠোঁটে খায় পা দিয়ে শিকার ধরে না। অবশ্য এতসব মাসালা শোনার সময় কোথায়? পশম ছিলে মসলা মেখে শিকে গেঁথে আগুনের ওপর বসানো সারা। এই ঝলসে খাওয়ার বুদ্ধি অবশ্য শেফালীর। বনটিয়া দিয়েই উদ্বোধন হলো আজকের শিকার যাত্রা।

প্রথম শিকার ভালোই বলতে হবে। তারা আশা করেনি এমনটা। শুরুতে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতেই আগাচ্ছিল তারা। এর মধ্যে উদ্ভট প্রশ্ন করার ওস্তাদ অন্তু থাকলে তো কথাই নেই।

‘ভালোবাসার বিপরীত শব্দ কী?’ অন্তুর এমনতর উদ্ভট সব প্রশ্ন করা তার অভ্যাস। প্রশ্নের চেয়ে উদ্ভট হলো কাণ্ডজ্ঞান। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে এমন কিছু বলে বসবে যার সঙ্গে আগে-পিছে কিছুরই মিল নেই। বনটিয়া ধরার আগে হঠাৎ সে প্রশ্নটা করে বসে। যদিও বাকিরা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে পাখি শিকারের উত্তেজনায় মেতে ওঠে।

‘ভালোবাসা’র বিপরীত শব্দ? ভালোবাসার বিপরীত শব্দ ঘৃণা’। এতক্ষণ বনটিয়ার হুড়োহুড়িতে অন্তুর হারিয়ে যাওয়া কথার রেশ আবার সচল করে আমজাদ। ‘ভালো না বাসলেই কি তাকে ঘৃণা করতে হবে’? শেফালীর ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা।

সবুজ  পরিষ্কার করে, ‘না ভালোবাসার বিপরীত কখনোই ঘৃণা নয়। আমি তাকে ভালোবাসি না তার মানে এই না যে আমি তাকে ঘৃণা করি। ভালোবাসার বিপরীত খারাপ বাসা’-  অন্তু বলে ওঠে

পীযুষ জানতে চায়, ‘খারাপ বাসা আবার কী জিনিস’?

অন্তুর দিকেই উৎসুক হয়ে তাকায় সবাই।

: আরে খারাপ বাসা বুঝলা না, খারাপ বাসা মানে হইল তোমার গিয়া কাউরে ভালো না বাসা।

: এইডা কিছু হইল, তুই অফ যা।

পীযুষ ধমকে উঠে। পীযুষের ধমকে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ‘তাহলে ভালোবাসার বিপরীত শব্দ কী দাঁড়াল?’ শেফালী তখনো জানতে ইচ্ছুক।

রাসেল বলল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম ভালোবাসার বিপরীত শব্দ যত্নবান না। আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে আমি তোমার প্রতি যত্নবান, তোমার প্রতিটি কাজে আমি সহায়তা করি, তোমার প্রতিটি কথাকে আমি সম্মান করি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি না তার মানে এই যে আমি তোমার প্রতি কেয়ারিং না। বোধ হয় বাংলায় এমন জুতসই শব্দ নেই’।

পরিস্থিতির সুযোগ নিল আমজাদ। তার গানের গলা ভালো, গাইতেও কসুর নেই। ভারী গলায় গান ধরে বসল,

‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে/

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা/ সখী, ভালোবাসা কারে কয়/সে কি কেবলই যাতনাময়/সে কি কেবলই চোখের জল? /সে কি কেবলই দুঃখের শ্বাস? /

লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুঃখের আশ’।

রাসেলরা মুগ্ধ হয়ে আমজাদের গান শুনছে। তাদের মন ভিজে গেছে আমজাদের গানে।

চুপচাপ তারা বসে আছে কখন বড়শিতে টান পড়ে। অন্তুও খুঁজে ফেরে তার টেঁটার প্রথম শিকার। রাসেল গুলতির ফাঁক দিয়ে দেখল শেফালীর চোখ জলে ভেজা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মুছে ফেললেও নজর এড়াল না তার।

চুপচাপ সময় কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে মাছ ধরা পড়েছে গোটা বিশেক। পাখি মারা হয়েছে চারটি। অন্তু অবশ্য এখনো তার মাছ টেঁটায় বাধাতে পারেনি। পারলে ষোলোকলা পূর্ণ হতো।

হুইস্কির সঙ্গে বরফের অভাবটা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তা ছাড়া তেমন সমস্যা নেই। মজার মজার জোকস বলে যাচ্ছে অন্তু। অন্তু থাকলে পুরো আসর মেতে থাকে। যদিও বিপত্তিটা বাঁধাল ওই অন্তুই। বিশাল শরীর নিয়ে নৌকায় পাগলা নৃত্য শুরু করল। তরলটা পেটে বোধ হয় একটু বেশিই পড়েছে। সঙ্গে মারিজুয়ানার কেরামতি। ফলাফল নৌকাডুবি। খালে পানি নেই তবু এক মানুষতো হবেই। যে যেদিকে পেরেছে ঝাঁপ। ভাগ্যিস সবারই সাঁতারটা জানা ছিল। তেমন কোনো ক্ষতি ছাড়াই পাড়ে পৌঁছানো গেছে। করিতকর্মা সবুজ অবশ্য নৌকা সোজা করে সেচে ফেলল নিমেষেই। কিন্তু জলে সবারই গা ভেজা। পুরুষ মানুষ হওয়ার সুবিধা এই যেখানে সেখানে গায়ের জামা খুলে ফেলা যায়। শেফালীর সেই সুযোগ নেই। বেচারি টিশার্ট পরেছিল। ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। পাঁচ পুরুষের মাঝে একাকী ভেজা নারী লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বক্ষ যুগল পীড়া দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি ওকে। বিভিন্নভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা। যদিও সবাই ওভারলুক করে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে তার আড়ষ্টতা ছাড়ছে না। বসন্তের শুরু হলেও শীতটা এখনো ছাড়েনি। কী মনে করে জ্যাকেট এনেছিল রাসেল। শেফালিকে এগিয়ে দিল। ‘থ্যাংকস’- শেফালি মৃদু স্বরে বলল। রাসেল অনর্থক হাসি হাসল। নৌকার সমস্ত আরোহীরাই ভয়ে পাথর হয়ে আছে। কারো কোনো সাড়া বা নড়াচড়া নেই।

শেফালীকে সহজ করতেই আমজাদকে আবার গান ধরতে বলল। আর শিকার যাত্রা স্থগিত করে বাড়ি ফেরার পালা। অন্তুর ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। নো নাচ। জাস্ট স্ট্যাচু হয়ে থাকবে। অন্তুও এত ভয়াবহ ব্যাপার হতে পারে আন্দাজ করতে পারেনি। সে চুপ করেই থাকল ফেরার পথটা।

ফেরার সময় মনে হলো ভারী সুন্দর জায়গা।  তিরতির করে জল বয়ে চলেছে। দু-পাশে  জঙ্গল।  জঙ্গলের মধ্যে দু-একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গরুর পাল নিয়ে রাখাল ছেলে গ্রামে ফিরছে।  চারদিকে একটা দারুণ শান্তি শান্তি ভাব। নদীর ওপরে বড় বড় তাল  গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে। তাতে জায়গাটার নির্জনতা ও শান্তি যেন আরও বেড়ে গেছে।

আমজাদের ভরাট গলায় আবার গান হচ্ছে,

‘ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে কাছে-দূরে জলে স্থলে বাঁজাই,,, বাঁজাই বাঁশি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি,,,’।

নৌকা চলছে। সূর্য ডোবা গোধূলি বিকেল। সন্ধ্যার নীড়ে ফেরা পাখির কিচিরমিচির। রাসেলরা গন্তব্যের কাছাকাছি প্রায়। পেছনে সারা দিনের স্মৃতি। শেষ গান চলছে। এমনতর আসরে যেমনটি হয় গানের ঠিক-ঠিকানা থাকে না তেমনি ভূপেনের গণসংগীত ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর/সহযাত্রী একই তরণীর যদি সংঘাত হয় তবে ধ্বংস হবে গর্ব মোদের প্রগতির’ দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে তাদের আসর।

: তোমার কথামতো ভালোবাসার বিপরীত শব্দ বাংলায় বলতে পারো উদাসীনতা।

গানের মাঝেই শেফালী হঠাৎ আস্তে বলে উঠল।

: তুমি এখনো সকালের বিষয়টা নিয়ে ভাবছ!

রাসেল বিস্মিত। সবাই গানের তালে রয়েছে। শেষ গানের পরও আবার গান ধরা হয়েছে।

: না, কেন জানি ভালোবাসার বিপরীত কী হতে পারে মাথার ভেতর ঘুরছিল আর শব্দটা মনে হলো। ভালোবাসা কী, কারে কয় কোনো দিন বুঝতে পারলাম না। তবে এটুকু বলতে পারি ভালবাসা মানে শুধু কেয়ারিং না। কেয়ারিং তো হাস্পাতালের নার্সও করে। ভালবাসা অন্য কিছু।

রাসেল হাসল। বলল,

: ভালোবাসা কি কেউ কখনো মুখে বলে বোঝাতে পারে? সব সময় পাশে থাকা, স্যাক্রিফাইস, কনসিডারেশান, বিপদে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়া, সব সময়ে তার উপস্থিতি ফিল করা, অনুপস্থিতিতে খারাপ লাগা –  এই তো ভালোবাসা। ভালোবাসার কথা উঠতেই খেয়াল করেছি তুমি কেমন যেন আনমনা হয়ে গিয়েছিলে। আমজাদের রবীন্দ্রসংগীতেও তোমাকে অশ্রুসিক্ত দেখলাম।

: কখন খেয়াল করলে। তোমার তো চোখ দেখি সবখানেই।

: চোখে পড়ে গিয়েছিল। চোখের কি দোষ?’

: গত মাসে আমি আমার বেবিটাকে মেরে ফেলেছি। আই কিলড হার। আমাদের ভালোবাসার ফসলটাকে হত্যা করেছি।

শেফালীর এমন কথায় মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। বাকশূন্য হয়ে তাকিয়েছি রাসেল ওর দিকে।

: শফিকুল ইসলাম বগা, আমার বয়ফ্রেন্ড। আই রিয়েলি লাভ হিম। আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ওর বাচ্চা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম পাঁচ মাস। বাট হি ইজ এ ফ্রড। আই লাভ এ ফ্রড গাই উইথ মাই লাইফ। হি ইউজড মেনি লাইক মি । আই রিয়েলি হেইট হিম। আই হেইট মাই বডি। আই কিলড মাই ওন চাইল্ড। হোয়াই আই শুড লিভ?

হঠাৎ রাসেল অন্য স্বরে বলল,

: তুমি নিজের জীবনকে ভালোবাস না কেন? ওয়ান লাইফ, জাস্ট ওয়ান। তোমার নিজের জন্যই তোমাকে বাঁচতে হবে।

: বাঁচতে তো চেয়েছিলাম।

: বাঁচার উপায় কি নেই?

: জানি না। হয়তো আছে।

: হয়তো নয়। নিশ্চয়ই আছে।

: কে বাঁচাবে?

: তুমি নিজে বাঁচাবে নিজেকে। অন্য কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না।

: বিশ্বাস করুন, আমি আর পারছি না এই জীবনটা টেনে বেড়াতে।  সত্যই আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।

: অনেক সময়ে আমারও করে না।

: আপনি কি কাউকে ভালবাসেন?

: হুমম বাসি। পুষ্প। ওকে অনেক অনেক ভালোবাসি।

: সে যদি আপনাকে ছেড়ে চোলে যায়, কেমন লাগবে আপনার। সে যদি একজন প্রতারক হয়?

: জানি না।

শেফালির চোখের কোনা জলে ভিজে যাচ্ছে। রাসেল আলতো করে তার হাত চেপে ধরেছে। বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটার বুক কান্নায় ভেঙে যাচ্ছে। কীভাবে ওকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে  না। আজ  দিনটির শেষ এ রকম হবে ভাবা যায়নি। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে শেফালিকে জড়িয়ে ধরতে। বলতে, জীবনটা অনেক বড়। সবাই শফিকুল ইসলাম  নয়। আমরাই হয়তো আবার শুরু করতে পারি আরেকটি মানব সৃষ্টির সপ্তস্তর। কিন্তু রাসেল তো পুষ্পকে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসায় এতটুকু খাদ নেই। রাসেল তবু শেফালির হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমজাদ হয়তো এবার সত্যিই শেষ গানটি ধরেছে,

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে। আমার পরানে যে গান বাজিছে, তাহার তালটি শিখো,,, তোমার চরণ মঞ্জীরে,,,”

আজ যেদিন পুষ্প হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে সেদিনই শেফালি আবার হাজির। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

দেখতে দেখতে তিন দিন পার হয়েছে। শেফালির প্রথম ধাক্কা সামলে উঠেছে। দুঃস্বপ্নগুলো নিরলস ভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মরিয়া হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নগুলো ফিরে আসে। ওষুধের পরিমাণ বা ইচ্ছাশক্তি দুঃস্বপ্নকে থামাতে পারে না। নিজের ওপর এবং পুরো জঘন্য পরিস্থিতির ওপর রাগ করে সে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে বারবার। স্যালাইন, ওষুধের ওপর ঘৃণা জন্মে গেছে। এক ধরনের পাগলামি ভর করেছে। রাসেল মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু রাসেলের হাত ছোয়ার সাথে সাথে  শেফালীর সর্বাঙ্গে একেবারে আগুন ধরে উঠল। এক দলা থুথু ছুড়ে মারলো রাসেলের দিকে। রাসেল বহু কষ্টে পুরুষত্ব উন্মত্ত হওয়া থেকে নিজেকে নিবারন করলো। ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাসেল বের হতেই শেফালীর খারাপ লাগা শুরু হল। একেবারে অকারনেই সে কাজটি করেছে। রাসেলের কি দোষ? কেন তার প্রতিটি পুরুষের ছোয়ায় গা ঘিন ঘিন করছে। রাসেলকে ডাকতে  উঠে দাড়াতে চাইলো। পায়ের তলা দিয়া মাটি যেন সরে গেল। চোখের সামনে সব কিছু বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল! বসে পড়লো। রাসেল বাইরে এসে ভাবল মাথা গরম করা চলবে না। এ মূহরতে সেই শেফালীর আশ্রয়। সেই তার অবলম্বন।

শেফালির সঙ্গে যখন প্রথম স্বাভাবিক কথা হলো শেফালির চেহারায় কোনো আশার চিহ্ন দেখেনি রাসেল। সম্ভবত একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হতে যাচ্ছে শেফালী। রাসেলও কয়েক রাত ঠিকমত ঘুমায়নি। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। হালিমা ভাবি বলল, তুমি একটু বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।  হালিমাও কি সারা রাত ঘুমাচ্ছে? শামসুদ্দিনের চেহারা বারবার ভেসে উঠছে।

বিয়ের দিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সারা রাত। রাত বেশি হয়ে গিয়েছিল। বাসায় যাওয়া হয়নি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে সোজা রাতুলদের বাসায়। বিয়েতে অনেক মজা হয়েছে। তবে হঠাৎ শামসুদ্দিনকে কে বিয়েতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে হালিমা। এ চেহারা ভোলার না। উনি নাকি রাতুলের বউ পুষ্পের খালু। চোখের সামনে সমস্ত স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠছে। কিন্তু কিছুই করা হয়ে উঠল না। কী সুন্দর রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে গেল। কাউকে বলতেও পারল না হালিমা। পাছে বিয়ে বাড়ির আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। তবে একবার যখন খোঁজ পাওয়া গেছে শেষ দেখে ছাড়বে হালিমা।  শামসুদ্দিনের কথা ভাবতে ভাবতে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি তার। সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কি আসলেই হবে? হাসানকে নিয়ে চেষ্টা করতে হবে। কিছুতেই ছাড়বে না। কখনোই না। তবে তার আগে এই মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। কী নিষ্পাপ চেহেরা! কী অত্যাচরই না সহ্য করেছে! একজন মেয়ে হয়ে হালিমার অজানা নয় পর পুরুষের ছোঁয়া কত জঘন্য।

রেইপ ট্রমা সিনড্রোমে ভুগছে মেয়েটি। একরকম ট্রমায় আছে। পনের দিন পর যেদিন হাপাতালে থেকে শেফালীকে রিলিজ দিল, তখনও সন্ধ্যা নামেনি। দরজা খুলতেই হাসান সাহেবকে দেখতে পেল শেফালী। হাসান সাহেব দুটো হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। শেফালীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ঠিক কি জিজ্ঞাসা করলেন বোঝা গেলো না। শুধু বলেই জড়িয়ে ধরলেন। শেফালী কাঠ হয়ে গেল আলিঙ্গনে। তার মাথাটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে হাসান সাহেব কেবলই বলতে লাগল, ‘তুমি কেঁদো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি আছি, আমরা সবাই আছি,  দেখ, তুমি ভালো হয়ে যাবে’। কিন্তু শেফালী এর পিতৃসম আদরেই গাঁ ঘিন ঘিন করে উঠল। এক ধাক্কাই হাসান সাহেবকে সরিয়ে দিলো। শেফালীর এই ব্যবহারে মটেই অপ্রস্তুত হল না কেউ। বরং শেফালীকে দেখে মুহূর্তে চোখ জলে ভেসে যায় হাসান সাহেবের। শেফালীর সঙ্গে এই ছোট্ট জীবনে কী কী ঘটেছে সবই শুনেছেন তিনি। শেফালী জ্ঞান হারালো। বাড়ীতে আসার পরও দুদিন পর পর ফিট হলো শেফালী। আস্তে আস্তে একটু ধাতস্ত হচ্ছিল। তারপরও কোন পুরুষের দৃষ্টি পরলেই, মনে হতো কতগুলো কীট যেন শরীর বেয়ে উঠতে চাইছে। গোসলের জন্যে মনটা অধীর হয়ে উঠতো। মনে হত জীবনটা মিথ্যে, সব মিথ্যে। আত্মহত্যা করে ফেলে। বেচে থাকলেই এই অশুচি শরীরটাকে তাকে চিরকাল বইতে হবে।

হাসান সাহেব আজকাল কোন কিছুতেই মন বসাতে পারেন না। একটা অপরাধবোধ সব সময় তাড়া করে ফেরে। লেখালেখিও হচ্ছে না। কিছু লিখতে বসলেই  শেফালীর মুখটা মনে পড়ে যায়।  কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর  হয়েছে। এই মেয়ের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে সে বিচার কি সে পাবে? শেফালীকে তিনি কন্যাসম আদরে রাখতে লাগলেন। মূলত হাসান সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেস্টাই শেফালী আজকের অবস্থানে । যদিও তার ক্ষোভ এতটুকু প্রশমিত হয় নি। মনে মনে সে যে তার ধর্ষকদের কত ধরনের শাস্তির আয়োজন যে সে করেছে! ধর্ষণের পর একটা কেস ফাইল হয়েছিল। তার কোন কুল কিনারা করতে পারে নি পুলিশ। কোন আসামী ধরা পরে নি। শেফালী বিচার পাবে কিনা সন্দেহ? শেফালী বিচার পাক না পাক তিন বছরের ভিতর সারা দেশ ব্যাপী যুধাপরাধিদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত