আতর বিবি লেন (১)

অধ্যায়ঃ এক

 

বড় রাস্তার মোড়ে,ইউসুফ মিয়ার দোকানের বাইরের দেয়ালে,টিমটিমে জ্বলতে থাকা হলুদ বাতির নীচে,একটা টিকটিকি ঝুলে আছে। একটু দূরে একটা কাঠের টুলে বসে,একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে হাসমত। তাকিয়ে আছে টিকটিকিও—তার সামনে বসা গাবদাগোবদা একটা পোকার দিকে।

অনেকক্ষণ হলো নিশ্চল,শিশুর খেলা শেষে রাবারের খেলনা যেমন নিশ্চল একা একা পড়ে থাকে মাটিতে।

হাসমত হাত নেড়ে মশা সরায় মুখের সামনে থেকে।

টিকটিকিটা জড়বস্তুর মতো তাকিয়েই আছে পোকাটার দিকে; অনেকক্ষণ ধরে একটুও নড়ছে না দেখে হাসমতের ধৈর্য্য একটু একটু ঢিলা হয়ে আসছে। পোকাটা একবার টিকটিকির মুখের সামনে আসে,আবার দূরে যায় একটু; যেন তার ছোট জীবনকালে সে কখনো এতোটা শঙ্কিত বা বিভ্রান্ত হয়েছে কিনা সে জানে না,কিংবা হয়তো এই বোকা পোকা তার বর্তমান হাল হকিকত নিয়ে একটুও ওয়াকিবহাল নয়। সে জানে না ভবিষ্যৎ তার জন্যে কি পরিণতি লিখে রেখেছে।

টিকটিকিটা তবু নড়ে না,হয়তো সে আরো ভালো সুযোগের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিংবা সে ভুলে গেছে সে কি,কেন এইখানে— কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো।

হাসমত দাঁতের ফাক দিয়ে একরকম চিক-চিক শব্দ করে টিকটিকি কে ডাকে—”কি রে ব্যাটা খাবি না?”

নির্বিকার টিকটিকি তবুও নিশ্চল,একবার জ্বিব বের করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো; হয়তো এবার সে খাবারের জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু হাসমতের আর ধৈর্য্যে কুলায় না, তার কাছে মনে হলো নির্বোধ প্রানীটা বুঝি তাকে ভেংচি দিলো; উঠে গিয়ে হাতের লাঠিটা দিয়ে সে টিকটিকিটাকে তাড়িয়ে দেয়ঃ—”যা শালাহ বাইঞ্চোদ,আর খাওন লাগবো না,আজকে উপাস থাক।”

হাসমত তার বাঁশিতে ফু দেয়,ঘড়িতে দেখে—রাত দেড়টা। আড়মোড়া ভেঙ্গে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে বাড়ি দেয় গোটা দুয়েক। ঠকাশ ঠকাশ শব্দ বন্ধ দোকানের শাটারে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে; কিছু ঝিঁঝিঁ ডাকছে; বৃষ্টি হয়েছিলো বিকালে তাই কিছু ব্যঙ ডাকছে,এছাড়া আর অন্য কোন সাড়া শব্দ নাই। মাঝে মাঝে অল্প দূরের বড় রাস্তা ধরে ভারী ভারী গাড়ির শরীর গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সেটা টের পাওয়া যায় ভোঁতা নরম শব্দে আর মাটির হালকা কাঁপনে।

হাসমত এবার ঘুরে আসবে একবার পুরো বাজারটা।

বাজারের দক্ষিণ পাশের কাঁচাবাজারের গলি দিয়ে ঢুকে একবারে বাজারের মাঝখানের গলিতে গিয়ে উঠে মিনিট তিনেক হাঁটলে বাজারের জামে মসজিদটা পড়বে সামনে। অজুখানায় হাতে মুখে পানি দিতে হবে। তার ঘুম পাচ্ছে। 

হাসমতকে হাঁটা ধরতে দেখে তার পালা কুকুরটাও রওনা হলো পিছুপিছু। হাসমত সেদিকে তাকিয়ে হাসলো। ভাবলো ব্যাটার একটা নাম দেয়া দরকার এবার। চার বছর সে এই বাজারের পাহারাদারী করে,আর তার রাতের সহযোগী এই কুকুরের চাকরীও প্রায় দুই বছর হয়ে এলো। একদম কচি বাচ্চা ছিলো,প্রথম যেদিন রাস্তার ধারে একা কাঁদতে দেখে কুকুরটাকে নিয়ে এসেছিলো হাসমত।

বাঁশিতে আবার দু’বার ফু দিয়ে সে একটা বিড়ি ধরালো। হাতের লাঠি বগলে নিয়ে চললো অন্ধকার গলি দিয়ে,অনিয়মিত দূরত্বে কোনো কোনো দোকানের বাইরে ইলেক্ট্রিক লাইট জ্বালা আছে; কিন্তু তাতে অন্ধকার দূরীভূত না হয়ে কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেছে আরো।

হাসমতের বিরক্ত লাগতে লাগলো হঠাৎ সবকিছুতে।

বয়স পঞ্চাশের ঘরে হলেও তার কোন এখনও তরতাজা পেশল শরীর। অল্পবয়েসে রিক্সা চালাতো,মাল টানতো,আর চালের মেইলে কাজ করতো মাস-কাবারি। এসবে মন উঠে যাবার পর সে নিজেই চুরি-চামারি করতো। 

একবার পাশের গ্রাম ভবানীপুরের মনু হাজীর বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে সাগরেদসহ হাতেনাতে ধরা পড়লো। হাজী সাহেব মানুষ ভালো। গ্রামের মানুষ তাকে কেটে টুকরা করে পুঁতে ফেলতে চাইলেও,তিনি বলেছিলেন,বেচারা অভাবে পড়েই চুরি করে। স্বভাব দোষে তো আর না। তাকে একটা সুযোগ দেয়া হোক ভালো হবার। পরেরবার এমন কাজে ধরা পড়লে যা ইচ্ছা করা যাবে। 

আর সেইদিন,মানে সেই রাত থেকেই তাকে এই পাহারাদারীর চাকরী দিয়ে দেয়া হলো। চাকরী মন্দ না। প্রতি দোকান থেকে একশ করে নিয়ে তার ভালোই কামাই আসে। বাজার দিন দিন গ্রামের এই অংশটাকে রাক্ষসের মতো খেয়ে খেয়ে বড় হচ্ছে। তারও ধীরে ধীরেই রোজগার বাড়ছে। অথচ হাসমত ছোটবেলায় বাপের সাথে হাটের দিন এই বাজারে যখন আসতো, তখন মনে আছে তার স্পষ্ট—বাজার কই? দুইটা বড় বড় বট গাছের নিচে নতুন সবজি, পুকুর নদী থেকে আসা তাজা মাছ নিয়ে কয়েকজন বসে থাকতো খোলা আকাশের নিচে—মাকড়সারা যেমন জাল পেতে চুপচাপ শিকারের আসায় বসে থাকে। টিনের দোকান ছিলো বড়জোর দশটা। এইযে ইউসুফ মিয়ার বিশাল পাকা দোকানঘরের সামনে সে বসে ছিলো,এই ইউসুফ মিয়ার বাপ চালাতো একটা চায়ের দোকান। দশ হাত লম্বা দশহাত চওড়া এই দোকানে লোকে ইটের উপর বসে চা খেতো বলে দোকানের নাম হয়ে গিয়ে ছিলো ইটালির চায়ের দোকান। নামের কারণে হয়ে গেলো পশার। সেই থেকে শুরু। আজকে ইউসুফ মিয়া বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানী,সবচেয়ে বড় গুদামের মালিক। প্রতিবছর কাঁচামাল মজুদ রেখে দাম বাড়ানোটা তার কাছে একটা ব্যবসায়িক খেলা। কয়দিন আগের ঘটনা? অথচ কতোকিছু বদলে গেলো।

মসজিদটা বাজার থেকে একটু আলগা। বহু বছর আগে এ বাজারেরই এক আত্মীয়-পরিজনহীন ধনী বৃদ্ধ আড়তদার হজ্বে যাবার আগে তার আড়তের যায়গা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন,বাজারের মসজিদ বানাতে। সাথে বেশ কিছু কাঁচা টাকাও বাজারের রুই-কাতলাদের জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন,মসজিদ যেন হয়ই—তা নিশ্চিত করতে। আর বাদ বাকী বিষয়-সম্পদ যা ছিলো তা নগদ টাকায় ভাঙ্গায়ে নিয়ে রওনা দিলেন হজ্বে। উনার ইচ্ছা ছিলো সৌদীতে গিয়েও একটা মসজিদ বানাবেন,নিজে হবেন সে মসজিদের খেদমতগার। যতদিন বাঁচেন তাতে তার চলে যাবে। আর মৃত্যুর পর তার হিসাবে যোগ হবে লাখে-বেলাখে নেকী,যতদিন মসজিদ থাকবে।

কিন্তু বৃদ্ধের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি তারপর,কেউ জানে না তিনি ক্বাবার দেখা পেয়েছিলেন কিনা। তার সাথের লোকজন যারা গিয়েছিলেন হজ্ব করতে তারাও পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলেতে পারেননি। লোকমুখে তখন একটা কথা চালু ছিলো যে,নগদ টাকা পয়সা হাতিয়ে হজ্বের দালাল সেই বৃদ্ধকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছিলো কোথাও। কিন্তু কোন তথ্য প্রমাণ নেই।

তার দিয়ে যাওয়া যায়গায় মসজিদ হয়েছিলো ঠিকই। পাকা সাদা দালান উঠলো,সুউচ্চ লাল মিনার হলো। মসজিদের পাশে ইমাম-মোয়াজ্জিনের থাকার জন্যে টিনের একটা একচালা ঘর তোলা হলো। মসজিদের পাশে পুকুর আগেই ছিলো। সে পুকুর কাটিয়ে সংস্কার করে, তোলা পানি রাখারও আলাদা ব্যবস্থা করা হলো। পুকুরের কাঁচা ঘাট পাথর দিয়ে বাঁধানো হলো। অর্থাৎ সেই বৃদ্ধ আড়তদার যেখানেই থাকুন না কেন,তার হিসাবের খাতায় ঠিকই নেকি জমা হচ্ছে এখনো।

মসজিদের কাছাকাছি যখন চলে এসেছে হাসমত—যখন আর একটা মোড় ঘুরলেই মসজিদের সামনের খোলা যায়গাটা দেখা যাবে, ঠিক তখনই— তার ভেতরকার পুরানো অভিজ্ঞতা তাকে বললো সতর্ক হতে। হাসমত আলগোছে একটা দেয়ালের গায়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো মসজিদের দিকে। 

মসজিদের বাইরের বারান্দায় অল্পশক্তির সোডিয়াম আলো জ্বলছিলো বলে সামনের ইট বিছানো খালি যায়গাটা মোটামুটি আলোকিত— সেখানে কালো জামা পড়া কেউ একজন একটা বিশাল রামদা নিয়ে দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না,মুখে তার রুমাল বাঁধা। তার পা মাটিতে অবলীলায় পরে থাকা এক সাদা গেঞ্জী পড়া লোকের বুকের উপর রাখা। আর সেই লোকের মধ্যে কোন নড়নচড়ন দেখা যাচ্ছে না। হলুদ আলোতেই বেশ বোঝা যাচ্ছিলো লোকটার সাদা গেঞ্জিতে রক্তের গাড় খয়েরী ছোপ। কিন্তু লোকটাকে চেনা যাচ্ছে না। উঁচু হয়ে থাকা ভুড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছে অন্তত এই যে ইনি ইমাম সাহেব নন। ইমাম সাহেব হালকা পাতলা ছোটখাটো বিনয়ী মানুষ—দূর দেশ থেকে এখানে এসেছেন জীবিকার খোঁজে। দেখলে মনে হয় হাঁটার সময় ইনি কদম গুণে গুণে হাঁটেন।

হাসমত খুব চতুরতার সাথে হাতের বিড়ি লুকিয়ে ফেললো আড়ালে; সাবধান তো সে আগে থেকেই ছিলো। এবার সরীসৃপের মতো নিঃশব্দে দেয়াল ঘেষে অন্ধকারে চলে এসে শুধু একটা চোখ বের করে উঁকি দিলো। মসজিদের পুর্বপ্রান্তে পুকুরের পাশে মুয়াজ্জিন হাসানের থাকার ঘর। ঐদিক থেকে চাপা হুঙ্কার আর গোঙ্গানোর শব্দ আসছে। হুড়মুড় শব্দ আসলো বেশ কয়েকবার। একটু পরই চুল মুঠিতে ধরে হেঁচকা টানে টিনের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো মুয়াজ্জিন হাসানকে। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিলো তার কপাল বেয়ে রক্ত নামছে। পড়নের সাদা হাফ হাতা গেঞ্জীটার বুকের কাছে রক্তের রঙে গাঢ় অন্ধকার হয়ে আছে। হাসান এখন আর কোন আওয়াজ করছে না মুখ দিয়ে। তাকে টেনে নিয়ে এসেছে যে দুজন লোক তাদেরও মুখে রুমাল বাঁধা। কিন্তু হাসমত তবু তারেককে চিনতে পারলো ঠিকই;  সবুজ হাফ-হাতা গেঞ্জি পড়া,আর সাদা লুঙ্গি। মুখ দেখা লাগে না; শরীরের গঠন আর নড়নচড়নের পদ্ধতি দিয়েও পরিচিত মানুষ অপরিচিত পরিবেশে বেশ সুন্দররকম চেনা যায়। তারেক এই গ্রামেরই লোক। দিনের বেলা কামলা খাটে আর রাতে সেই কামাইয়ের টাকা জুয়ায় উড়ায়—এই কথা গ্রামের অজানা কারো নেই। আরো দুইজন মুখ ঢাকা লোক অন্ধকার থেকে বের এসে দাঁড়ালো হাসানের পাশে। হাসানের চুলের মুঠি ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথেই কাটা কলাগাছের মতোন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। জ্ঞান হারিয়েছে হয়তো।

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে চাপা গলায়। তার মধ্যে তারেকের গলাই সবচেয়ে উঁচুতে। 

আড়াল থেকে দেখতে থাকা হাসমতের বুকটা টপাশ টপাশ শব্দে বাজছে। মুহুর্তেই তার মনটা মাঝখান দিয়ে দুইভাগ হয়ে গেলো। 

এক ভাগ বললো এখনো ডাক্তার বাড়ি দৌড়ে গেলে পৌঁছাতে মিনিট সাতেক লাগবে।  সেখান থেকে লোক জড়ো করে নিয়ে চলে আসতে কতক্ষণ লাগবে? হাসানকে বাঁচানো যাবে তো? হৈহল্লা শুনে হয়তো লোকগুলো পালিয়েই যাবে। 

মনের আরেকভাগ বললো,যেখানে দাঁড়ায়ে আছো সেখানেই থাকো। আজকে এরা পালিয়ে গেলেও জেনে যাবে সাক্ষী আছে। একবারে মাটিতে তো আর মিশে যাবে না ওরা। শোধ নিতে কতক্ষণ? 

আড়াল থেকেই হাসমত যখন মনের দ্বিধায় স্থির দাঁড়িয়ে স্থলে তোলা মাছের মতো মনে মনে কাতরাচ্ছে—দেখতে পেলো তাকে পাশ কাটিয়ে তার ভোম্বল ভোলা কুকুর হেলেদুলে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত