শেফালী ও কয়েকজন পুরুষ (৫)

বোরহান উদ্দিন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট এর সাবেক এসিস্টেন্ট কমিশনার। বয়স হয়েছে। কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন। শাহেদদের ট্রেনে এই ভদ্রলোকও চেপে বসেছেন। তিন তিনটি খুনের কেসের ফয়সালা করতে এই ট্রেনে উঠেছেন। একরকম শখের বশেই এই কেসে জড়িয়েছেন। এই তিন জন গত বছর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নস্থানে খুন হয়েছেন। প্রতিটি খুন খুব নিখুত পরিকল্পনায় করা হয়েছে। নূন্যতম clue রাখা হয় নি। দৈনিক প্রতিদিন ভোরের খবরের সিনিয়ার সাংবাদিক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, আলীবাবা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মামুন ভুইয়া আর জার্মান প্রবাসী শফিকুল ইসলাম। খুনের ভিতর একটাই মিল এদের সবার বাড়ি একই গ্রামে আর এরা এক সময় ঢাকার ওয়ারীর একটি মেসে থাকত। ওই মেসের মোটামুটি সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শেষ। আহামরি কোন ইনফরমেশন পাওয়া যায় নি। তবে ওই মেসের আরেকটি ছেলে রাসেল এর বান্ধবী শেফালী ওই একই গ্রামের। সেই সূত্র কাজে লাগিয়ে বোরহান উদ্দিন এই ট্রেনে ঊঠেছেন এমনটি নয়। এই হত্যকান্ডগুলোর সাথে তার দৃঢ় বিশ্বাস হাসান সাহেবের যোগসাজশ আছে। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে তিনি মোটিভ সম্পর্কে অবগত হয়ছেন। এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো বাকী।

খুব কাঁকতলিয়ভাবে একটি খুনের সাথে আরেকটি খুনের খোঁজ পাওয়া গেছে। ঘটনার শুরু সাংবাদিক কামালউদ্দিনের খুন হওয়ার মধ্যে দিয়ে। কামালউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায় ডিপ ফ্রিজের ভিতরে। সাত দিন অফিসে না আসায়, ফোন রিসিভ না করাই যখন খোঁজ শুরু হয় তখন এই লাশ আবিস্কার। বুরহান উদ্দিন এই বিল্ডিং এই থাকতেন। কামাল সাহেব ৬ তলায় আর বোরহান সাহেব ৮ এ। একই বিল্ডিং এ থাকার সুবাদে মাঝে মাঝে দেখা হত। সেই সুত্রেই তিনি এই কেসে জড়িয়েছেন। রিটাড়মেন্টের পর এমনিতেও কোন কাজ নেই। পুলিশ পুলিশের মত তদন্ত করছে আর পাশাপাশি বোরহান সাহেব। সাংবাদিক কামালউদ্দিনের মোবাইল সার্চ করে অনেকের মাঝে আলীবাবা গ্রুপের মামুনের আর জার্মান প্রবাসী শফিকুল ইসলামের নাম পাওয়া যায়। দেখা গেছে আগের সপ্তাহ যাদের সাথে কামাল উদ্দিন কথা বলেছেন তাদের মধ্যে এই দুজনের কেউ বেঁচে নেই। সাপের কামড়ে মারা গেছে মামুন আর শফিকুল ইসলাম রোড এক্সিডেন্টে। স্বাভাবিক ব্যপার কিন্তু কেন জানি একটা খটকা লেগেছিল। তদন্তে নেমে পড়লেন পুরদমে। বোরহান সাহেবের ধারনা  মামুনকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। সাপের বিষে মামুন মারা যায়নি। রেড ইন্ডিয়ানরা যে ধরনের বাঁশের ব্ল গান ব্যবহার করে সেরকম কিছু দিয়ে বিষ দূর থেকে ছোড়া হয়েছে। যে বস্তুর মাথায় বিষ লাগিয়ে ছোড়া হয়েছে তা সাপের কামড়ের মত অবিকল ক্ষত তৈরি করে। ফলে সবাই ভেবেছে সাপের কামড়। এরকম মনে হবার কারন মামুন যেখানে মারা গেছে তার পাশের ধান ক্ষেত থেকে এই ব্ল গান পেয়েছেন। তন্ন তন্ন করে খুঁজে এই আবিস্কার। অপরাধী যত চালাকই হোক কিছু না কিছু রেখে যাবেই। ব্ল গান টেস্ট করা হয়েছে। সন্দেহ নির্ভুল। এখন মামুনের লাশ তুলে ময়না তদন্তের পালা। পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টায় আছেন তিনি। কিন্তু পুলিশ কেন লাশ তুলবে? ভিক্টিমের আত্মীয়দের কারও কোন অভিযোগ নেই। বোরহান সাহেব তবু লাশ তোলার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। লাশ তোলার মিছিলে আরেকজন  শফিকুল ইসলামকেও উচ্চ মাত্রার ড্রাগ দেওয়া হয়েছিলো। বোরহান উদ্দিন বেশ আটঘাট বেঁধেই তদন্ত করতে নেমেছেন। সেখানকার একটা সিসিটিভি ফুটেজ কয়েকশবার দেখেছেন। ফুটেজটি বগা মারা যাবার দুমিনিট আগের এক মুদি দোকানের সূত্রে পাওয়া। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সাম্থিং রং উইথ মিঃ বগা। তার পা ফেলার ভঙ্গী, হাত বার বার উপরে তোলা কোন কিছুই স্বাভাবিক না। পুলিশ অবশ্য এসব মানতে নারাজ। যে ট্রাকের তলায় বগা মরেছে তার চালক আসাদ সীকারুক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।  শেফালী মেয়েটার সাথে মামুন, শফিকুল ইসলাম সবার সম্পর্ক ছিলো। মেয়েটির এখনকার বয়ফ্রেন্ড রাসেল আবার একই মেসে থাকত। মেয়েটি কিছুদিন আগে রেইপ হয়েছিল। সব মিলিয়ে একটা তালগোল পাকানো আছে এই খুনগুলো আর মেয়েটিকে ঘিরে বেশ বুঝা যাচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শেফালী বা রাসেল কারো কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। দুজনে আবার হাসান সাহেবের ছত্রছায়ায় আছেন। হাসান সাহেব বেশ ঘাঘু মাল।  আমেরিকান দূতাবাসে গত সপ্তাহে ডিনার করেছেন। এ ধরনের লোককে চাইলেই ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় না।  গতিবিধি নজর রাখতেই বোরহানুদ্দিন এই ট্রেনে চেপে বসেছেন। তার ইনফরমারের তথ্য মতে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে আজ ট্রেনে।

ট্রেনে ঊঠার পর থেকে শেফালী আর রাসেল দুজন দুজনার সাথে গল্প করে যাচ্ছে। কোন টেলিভিশন ড্রামা নিয়ে কথা বলছে দুজন। শফিকের দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। হাসান সাহেব শেফালী আর রাসেলের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। নতুন এই প্রজন্মকে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে হাসান সাহেবের। শাহবাগের পর এই প্রজন্ম সম্পর্কে ধারনায় পাল্টে গেছে তার। শাহবাগে হাসান সাহেবও ছিলেন।

রাসেল ব্লগে লেখালেখি করতো। লেখালেখির সুবাদে তার বেশ ভক্তও আছে অনলাইনে। শাহবাগে হাসান সাহেব এসে কিছু বলুক খুব করে চাচ্ছিল রাসেল। তবে মূল মঞ্চে না। মূল মঞ্চ সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকেই সরে আসছে। রাসেলরা আলাদা মঞ্চ করেছে। মাইক-লাইট-মঞ্চের পেছনে খরচ আছে। এত টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে? চিন্তায় রাসেলের মুখমণ্ডল ভার হয়ে আছে। তারপরও কিভাবে কিভাবে জানি সব জোগার হয়ে গেল। হাসান সাহেব বক্তিতা দিলেন।

 

‘জেগে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। তারা বিচার চায়, পুরো দেশ এভাবে যে জেগে ওঠা ১৯৭১ এর পর কে দেখেছে? যদিও ১৯৭১ এর মতো কিছু কুলাঙ্গার ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়েছে বেঁচে থাকবার জন্য। ধর্ম কি? একটা মতবাদ বা একটা বিশ্বাস বা একটা পদ্ধতি বা একটা চিন্তা মনে ধারণ করার নামই ধর্ম। আর ইসলাম ধর্ম! সে তো আমরা যারা মুসলিম সবাই জানি মন থেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করাই হচ্ছে ইসলামের মর্মবাণী। যার উদ্ভবের মূলে রয়েছে শান্তির চির বাসনা। যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তির মর্মবাণী ছড়িয়ে তাকে আজ ১৯৭১ এর রাজাকার, আলবদররা নিজেদের বাঁচাতে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। যে মসজিদ মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান তা কার জন্য ব্যবহার হচ্ছে? কাকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হচ্ছে? ধর্ম সে তো মানুষের জন্যই। সে মানুষকে আশ্রয় দেয়, প্রতিশ্রুতি দেয়, সান্ত্বনা দেয়, সমাধান দেয় এবং সন্তুষ্টিও দেয়। তবে কে না জানে ধর্মই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় মানুষের জন্য যখন কিছু ভণ্ড ধার্মিক পার্থিব ক্ষমতার লোভে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে হানাহানি, রক্তপাত, বিভেদ ঘটিয়ে জাগতিক সমস্যার সমাধানের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বেড়ায়। জাগতিক সমস্যার সমাধান হবে কি সেই সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করে। তাদের উদ্দেশ্য তো জানা। তারা চায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে। মানুষের নিত্য সমস্যা সমাধানে তাদের আগ্রহ নেই শুধু লোভ ক্ষমতার।

ধর্মের নামে যারা ৭১-এ এ গণহত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, লুটতরাজ চালিয়েছে তারা আজ আবার সেই ধর্মকে পুঁজি করেই শাহবাগ আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে পথে নেমেছে। আর আমরা যদি তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিভ্রান্ত হয় তবে শুধু যে আমাদের ক্ষতি তা নয় এ ধর্মেরও ক্ষতি। ইসলামেরও কলঙ্ক। যে রাজাকার শিশুকে ধর্ষণ করেছে সে যদি আজ ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেকে বাঁচায়, একজন মুসলিম হিসাবে সে লজ্জা আমরা কোথায় রাখব? যে নিরস্ত্র বাঙালিকে মারতে নেতৃত্ব দিয়েছে সে কি ইসলামের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাবে? যারা দুই লাখ মা-বোনকে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে ধর্ষণের জন্য তুলে দিয়েছে, বাঙালিকে বুদ্ধিহীন করতে শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা আজ ধর্মকেই তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করবে আর মুসলমানরা তা চেয়ে চেয়ে দেখবে এ কি হতে দেওয়া যায়? ধর্ম কি আজ খুনী, লুটেরা, ধর্ষকের সহায় হবে?’

এ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বলে একটু থামেন হাসান সাহেব। শাহবাগে বক্তৃতা দিতে রাসেল তাকে ধরে এনেছে? মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে অনেক দিনের না বলা কথা গুলো বলতে থাকেন হাসান সাহেব।

‘প্রতিটি জাতির এমন কতিপয় সামাজিক আবেগ আছে যার মধ্যে জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্যাসের আকারে পুরোমাত্রায় বিরাজমান থাকে। রাজনৈতিক পরাধীনতার সময় সে আবেগ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে এবং কোনো রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে সে আবেগই ফণা মেলে হুংকার দিয়ে ওঠে। আজ শাহবাগে সেই আবেগ পূর্ণমাত্রায় প্রজ্বলিত হয়েছে। অভ্যুত্থানের স্বভাব আগুনের মতো। সে ছড়িয়ে পড়ে, ভয় পাইয়ে দেয়। শত্রুদের নয় শুধু, মিত্রদেরও। আজ শাহবাগেও একই দৃশ্যর পুনারাবৃত্ত। ঘটনা উনসত্তরের মতো। কিংবা তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে। ৯০ এর পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ আর দেখেনি পুরো বাংলাদেশ। শাহবাগের আন্দোলন শিকড়ে যাওয়ার আন্দোলন, আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার আন্দোলন। এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনেক। দীর্ঘদিন একটা অথর্ব রাজনৈতিক অবস্থার ভেতরে থাকতে থাকতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় গণজাগরণ ঘটেছে পুরো বাংলাদেশে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। একজন রিকশাওয়ালা যেখানে টিপ সই দিয়ে সংহতি প্রকাশ করছে, একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করছেন শাহবাগের জন্য, একজন প্রবীণ নেচে উঠছেন এই আবেগকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।‘

আন্দোলনের খবর শেফালী পড়ত খবরের কাগজে। জ্ঞান হবার পর থেকে সে কোনো মিছিল দেখেনি। কোনো সমাবেশে তার যাওয়া হয়নি, আন্দোলন মানে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে লড়াই, একদল লাঠি নিয়ে তেড়ে যাবে আর একদল দূর থেকে ইট ছুড়বে, এমনই ভেবে এসেছে সে এতকাল। শাহবাগের রাস্তা পুরো বন্ধ। দোকানপাট আধভেজান। চারদিকে লোকে-লোকারণ্য। শেফালী, রাসেল, রাসেলের অনেক বন্ধু আর হাসান সাহেব সে সকাল থেকেই বসে আছেন চত্বরে।  হাসান সাহেব তার বক্তৃতাটা শেষ করলেন এ বলে-
: যতই ষড়যন্ত্র হোক, যতই ধর্মকে আন্দোলন ব্যর্থ করতে ব্যবহার করা হোক যে আগুন শাহবাগে প্রজ্বলিত হয়েছে তা এত তাড়াতাড়ি নিভবে না। নিভতে পারে না রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত। একজন ধার্মিক, একজন মুসলমান এই বাংলায় কোনো দিন ইসলামকে ধর্ষক, খুনি, লুটেরাও রক্ষাকবচ হতে দেবে না, বিজয় সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।

রাসেল হাসান সাহেবের বক্তৃতায় বেশ বিব্রত। কম্যুনিস্টদের আস্তানায় উনি শুধু ধর্ম নিয়েই বলে গেলেন কেন ঠিক বোঢগম্য হল না। যেন এটা একটা ধর্মীয় দলের সভা। হাসান সাহেবের আফসোস আজ হালিমা বেঁচে নেই, হালিমা যার স্বপ্ন ছিল এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সেই দেখে যেতে পারল না। গত বছর এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। হাসান সাহেব প্রতিনিয়তই এই শাহবাগ চত্বরে হাজির হন। রাসেল, শেফালীও আসে মাঝে-মধ্যে। তবে ইদানীং রাসেলের ধারণা হচ্ছে আন্দোলন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এই আন্দোলনের সুযোগে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করছে। হাসান সাহেব যদিও বোঝান –
: স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে যে অর্থনৈতিক মুক্তি মানুষ প্রত্যাশা করেছিল তা ঘটেনি তাই বলে কি যুদ্ধের দরকার ছিল না? স্বাধীনতার সুফল আজ এই ১৬ কোটি মানুষ ভোগ করছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল যে কী ভয়ংকর তা কে না যান? আজ শাহবাগে যে ঘটনা ঘটছে তার থেকে কেউ বেনিফিশিয়ারি হতে পারে তবে সবচেয়ে বেনিফিশিয়ারি তো জনগণ। তারা একটা ৪২ বছর না করতে পারা বিচার আজ করতে পারছে। একটা জাতির পাপমোচন হবে। শুধু তাই না ভবিষ্যতে অনেক আন্দলনের সূতিকাগার হবে এই শাহবাগ।

শেফালির অবশ্য এসবে মনোযোগ নেই, সে শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিচ্ছে। শেফালির জীবনটাকে যারা তিলে তিলে শেষ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করছে শেফালির মনে। কাউকে সে ছাড়বে না। কত রাত যে স্বপ্ন দেখে দেখে ঘুম ভেঙে উঠেছে শেফালী। কত হাসি খুশি মেয়ে ছিল সে। পুরো ঢাকা শহর দিন রাত চষে ভেড়িয়েছে। অথচ এ শহর এত অনিরাপদ হবে – কে জানতো? শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়আঁচছে সে। প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করা হয়ছিল, হাতে নানা জায়গায় কালসিটে এখনো রয়ে গেছে। সে বেঁচে আছে অনেক ব্যথা নিয়ে। অসম্ভব মানসিক শক্তি ছিল বলে হয়ত পেরেছে। ধর্ষকের চেহারার বিষয়ে শুধু তার কিছু স্মরণ নেই। শত চেশটাতেও মূখ গুলো মনে করতে পারেনি। ভাবতে গেলেই মাথায় তীব্র সন্ত্রনা হয়। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শেফালীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছিল।  রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল। অর্থ, তাঁর গর্ভে তাঁর ধর্ষকের সন্তান। ধর্ষকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাতে শুরু করে। এর মধ্যে মিরপুর থেকে এক আসামি সাইফুর আর বনশ্রী থেক থেকে অর্জুন নামে আরেকজন গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু কাউকেই ঘটনার সাথে পুলিশ পুরোপুরি মেলাতে পারেনি। আদালতে কিছুই প্রমান হয়নি। হয়তো সত্যিই ওরা জড়িত না। মিডিয়ার চাপে দুটো আসামী ধরে পুলিশ নাটক করেছিল।

শেফালী ওদের দেখেছে। পুলিশ কাস্টাডিতেই দেখেছে। তারও মনে হয়নি ওরা ছিল। শেফালী এখনো খুঁজে বেড়ায় আর সীমাহীনভাবে মনে করার চেষ্টা করে অপরাধীদের চেহারা। ওদের চিনতে না পারলে কি হবে,   মামুন স্যার, বগা ভাই এ দুজনকে তো সে চেনে। এরাও ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে শেফালীকে। এদেরও শাস্তি প্রাপ্য।  তাদের কে হত্যা না করলে তার মন শান্ত হবে না। প্রথম দফায় লিস্টে আছে মামুন সার। যে তার চোদ্দ বছরের দেহটাকে প্রথম অপবিত্র করেছিলো। সামনে ঈদ। এ সময় মামুন বাড়ি আসে। শেফালী তার প্লানের অংশ হিসাবে সেই রাজধানী ছাড়ার পর প্রথম কোটচাঁদপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

রাত দুইটা বাজে। এবার উঠতে হবে। ব্রিজ খেলা অনেক হয়েছে। আর ভালো লাগছে না। যদিও তাসের এই পর্ব সারা রাতই চলবে। তবে মামুন বিদায় চাইল। বন্ধুরা নাছোড়বান্দা। কেউ ছাড়তে চায় না। চাঁদ রাত বলে কথা। সারা রাত ক্লাবে হই হুল্লোড়। আজ আবার একটা ছাগল চুরি করা হয়েছে। রান্না ভালো হয়নি। কেমন একটা বমি বমি লাগছে। মামুন ঢাকায় থাকে। ঈদের সময় শুধু বাড়ি আসা। চাঁদ রাতে পাড়ার এই ক্লাবটির চেহারা বদলে যায়। প্রায় সব বন্ধুই জড়ো হয়। এবার শুধু নয়ন নেই। ডিভি পেয়ে আমেরিকা চলে গেছে। নয়নের উদ্দেশ্যে শোকগাথা লেখা হয়েছে। কাশেম লিখেছে। কবি হিসাবে এই মফস্বলে তার আবার খানিক নাম ডাক আছে। ভোর চারটায় আরেকবার গলা ভেজানোর ব্যবস্থাও আছে। মামুনের মন ক’দিন ধরে এমনিতেই খারাপ। বিয়ের পর মেরিনাকে ছাড়া প্রথম ঈদ করছে। মামুন শত প্রলোভন উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ল। শরীরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথার ভেতর একটা ভোঁতা যন্ত্রণা। ক্লাব থেকে বেরিয়ে বাড়ির শর্টকাট পথ ধরল। ধানখেতের আল দিয়ে। রাত ভালোই হয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলে চার্জ নেই। অভ্যস্ততায় পথ চলতে একটু কষ্টই হচ্ছে। হঠাৎ করে বমি চলে এসেছে। আর আটকাতে পারল না। ধান খেতের পাশেই বসে পড়ল। মনে হচ্ছে আর দাঁড়াতে পারবে না। আশপাশে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল। কেউ কি আছে। অন্ধকারে ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখনো অনেক পথ। একটু পানি পেলে ভালো লাগত। কুলি করা দরকার। ঠিক এ সময় নিমাই দা এসে উপস্থিত

: কিরে, মামুন না। কি হয়েছে তোর?

: নিমাই দা। খুব খারাপ লাগছে।

: দাঁড়া। আমাকে ধরে দাঁড়া।

: মনে হয় পারব না। একটু পানি খাওয়াতে পারবে।

: পানি নেই। ধর স্প্রাইট খা।

: দেও।

মামুন স্প্রাইট দিয়েই কুলকুচি করল। আরেকবার বমি হয়ে গেল।

: নিমাই দা, আমাকে একটু বাসায় দিয়ে আসবা।

: শোন আমার বাসা তো কাছেই। তুই চল। আগে কিছুক্ষণ রেস্ট নিবি।

মামুন বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল। নিমাই দা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের অঙ্কের মাস্টার ছিলেন। মামুনদের অনেক সিনিয়র। অসম্ভব ভালো। কিছু মানুষ থাকে উপকার করার জন্য জন্মায় সেই টাইপের। এক সময় নিমাইদার ছোট ভাই পীযুষ মামুনের ছাত্র ছিল, সে অনেক কাল আগের কথা, মামুন মফস্বল ছেড়েছে অনেক আগেই। মামুন নিমাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। দু’জনেই নীরবে এগিয়ে চলছে। গুনগুন করে নিমাই দা কি যেন একটা গাইছে। মামুনের তখন শোনার মতো অবস্থা নেই। হঠাৎ নিমাই দা মামুনের হাত শক্ত করে ধরল।

: কি হয়েছে?

: সামনে দেখ।

সামনে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাফনের কাপড় পড়ে পাঁচটা লাশ পড়ে আছে ধান খেতের ওপর। হালকা নড়ছেও। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল কেন জানি।

: চল।

: কী ওগুলো!

: চল না। গিয়ে দেখি।

: যাবা?

: ধুর গাধা। তুই তো ভয়েই আধমরা হয়ে গেলি।

: আমি তো এমনিতেই আধমরা। কিছু দেখলে কিন্তু ফুল মরা হয়ে যাব।

: বকবক করিস না। চল… সাবধানে পা ফেলিস। সাপের উপদ্রব বেড়েছে। গতকাল একজনরে কামড়াইছে। গোখরা। জায়গায় ফিনিস।

কিছু দূর যেয়েই ঘটনা পরিষ্কার হলো। ধান খেতের ওপর কে যেন কাপড় শুকাতে দিয়েছে। সাদা কাপড়। সেগুলোই দূর থেকে লাশের মতো লাগছে। দু’জনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি। নিমাই দা’র গানটা এবার বোঝা যাচ্ছে। নজরুল সংগীত।

‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাইরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি…,
ভুলিও স্মৃতি মম নিশীথ স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি…,’

মামুনও এককালের শিল্পী মানুষ। বাস্তবতার জাঁতাকলে আজ তা সুদূর অতীত। বহুদিন পরে সেও গানে যোগ দিল।

মামুন শুয়ে আছে নিমাই দার বাড়িতে। বাসা পর্যন্ত যেতে পারেনি। নিমাই দা’র বাড়ির সামনে আরেকবার বমি। কিছুতেই নিমাই দা ছাড়ল না। একটা এভমিন পাওয়া গেছে। বৌদিও খুব ভালো। সাক্ষাৎ প্রতিমার মতো চেহারা। মামুনের বিছানা গুছিয়ে দিল। বেশি কথা না বাড়িয়ে মামুন চুপচাপ শুয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা বাড়ি নিমাই দাদের। তিন রুমের। ওপরে টিন। এ বাড়িতে অনেক সময় কেটেছে মামুনের একটা সময়। নিমাই দা’র একটা ছোট বোন ছিল। রাজশ্রী। মামুন অঙ্ক দেখিয়ে দিত সময়-সময়। মামুনের সঙ্গে একটা অনৈতিক সম্পর্কও কীভাবে যেন গড়ে উঠেছিল যৌবনের প্রথম বছরে। রাজশ্রীর বয়স তখন কত? ১৬ বোধ হয়। নিমাই দা’র বাসায় আসা-যাওয়ার সুবাদে কীভাবে কীভাবে যেন কাছাকাছি চলে এসেছিল। শেফালীর চড় খেয়ে মামুন ঢাকা চলে এল। যান্ত্রিক নগরে হলো জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। খুব একটা গ্রামের দিকে যাওয়া পড়ত না। ঈদ-পরব বাদে। একবার গিয়ে শোনে বিয়ে হয়ে গেছে রাজশ্রীর। সে অবশ্য অনেক দিন হলো। শুনেছে এখন তিন ছেলেমেয়ের মা।

নির্জনতা ভর করেছে। মনে হচ্ছে বাসায় বোধ হয় আর কেউ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মামুন রাজশ্রীর চেহারাটা মনে করা চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। আর দু-চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অদ্ভুত একটা শব্দে। মনে হচ্ছে এ ঘরে কোনো মহিলা নামাজ পড়ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে নামাজ পড়ার সময় যেমন আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ। মামুন চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলার চেষ্টা করল সে ভুল শুনেছে। গাছের শব্দ হতে পারে। কিছুক্ষণ পর আর আওয়াজ পাওয়া গেল না। চোখ খুলে আরেক বিস্ময়। নিমাই দাদের ঘরে টানিয়ে রাখা কৃষ্ণের ছবিটা যেন মামুনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মামুন চোখ বন্ধ করে ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করল। দূরের কোনো আলো জানলা দিয়ে ছবির ওপর পড়ে এমন হতে পারে। ঠিক তাই। নিজের আহাম্মকিতে নিজেই হাসার পালা। এরপর ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম আসছিল না তার। একটার পর ভূতের গল্প মনে পড়ছে। মামুন মেরিনার কথা মনে করার চেষ্টা করল। ডামাডোলে বেশ কিছু দিন ভুলে ছিল। আজকের এই নির্জনতা কেন জানি উসকে দিল সেই স্মৃতি।

সেদিন অনেকক্ষণ ধরে রোদে দাঁড়িয়ে আছে মামুন। ঘামে একাকার। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লাইন ছেড়ে যাওয়া যাবে না। বিডিআরদের একদল রিলিফ দিচ্ছে লাইন এদিক-ওদিক হলেই লাঠির বাড়ি। মামুন রিলিফ নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ায়নি। পুরো ব্যবস্থাটা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করছে নিছক কৌতূহলে। অসহায় মানুষদের কষ্ট উপলব্ধির ব্যর্থ চেষ্টা। ভদ্রলোকের মুখোশ পড়ে আঁতলামী আর কী! মামুনের সঙ্গে আছেন কামাল ভাই। একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন ক’দিন ধরে। একটা পত্রিকায় কাজ করেন। তার সঙ্গেই আসা। এ সময় দেশ জুড়ে ঝড়ের ভয়াল থাবা। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে কৌতূহল আর কামাল ভাই যাচ্ছে তার সঙ্গী হওয়ার রোমাঞ্চ পেয়ে বসল তাকে। কিন্তু রোদের দাপটে আর টিকতে পারল না। সরে আসতে হলো। ভরপেট খেয়েও দাঁড়াতে পারল না সে, আর না খাওয়া লোকগুলো কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই অবাক হতে হয়।গত কয়েক দিন দেখেছে মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম। বেঁচে থাকা কত কষ্টকর তবু কী আশায় যেন বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন প্রতারিত তবু স্বপ্ন দেখে বারবার। ঘূর্ণিঝড় আইলা দক্ষিনের জেলাগুলোয় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। সব পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কত বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় খুলনার সাতক্ষীরার কত এলাকা, কত গ্রাম যে পানির তোলে বিলীন হয়ে গেছে তার ইয়াত্তা নেই। তবু ক্ষয় ক্ষতি এড়ানো গেছে সুন্দরবনের জন্য। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে বারবার চিতিয়ে বুক বাড়িয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। অথচ এই সুন্দরবন ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে কত মানুষ। কত কিসিমের যে চেষ্টা। সুন্দরবনের গাছ কেটে উজাড় করা, জনবসতি স্থাপন করা, নদীর মাঝ দিয়ে জাহাজ এসব তো ছিলুই নতুন যুক্ত হচ্ছে উন্নয়নের নামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

পথের এক কোণে একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছে এক বুড়ো চাচা। কাস্টমার নেই বললেই চলে। জনাকয়েক সাংবাদিক আর রিলিফ দিতে আসা মামুনের বয়সী কিছু ছেলে মেয়ে আছে। চা খাবে সে। পিরিচে না ঢেলে চা খেতে পারে না। একটা মেয়ে খুব কৌতূহল নিয়ে মামুনের ফুঁ দিয়ে চা খাওয়া দেখছে। মামুন তাকে কিছুটা অবাক করে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করল

: ভালো আছেন?

অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে সীমাহীন চেষ্টা তার স্মরণ করার। মামুনই আবার কথা বলে উঠল–

: আপনি ঢাকা থেকে আসছেন।

: জি। কিন্তু আপনাকে তো…

: চিনতে পারলেন না। তাই তো। আমিও পারিনি।

চায়ের বিল মিটিয়ে সোজা হাঁটা ধরে মামুন। পেছনের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে। জানে অবাক বিস্ময়ের এক জোড়া চোখ নিরীক্ষণ করছে। সেই প্রথম মেরিনার সঙ্গে দেখা।

এর অনেক দিন পর। মেঘের দিকে তাকিয়ে ছবি কল্পনা করা মামুনের ছোট বেলার অভ্যাস। সহরাদি উদ্যানে বসে সেই চেষ্টায় করছিল। এমন সময় প্রশ্ন –

: কেমন আছেন।

অবাক হবার পালা। সেই মেয়েটি। যেন মামুনকে জব্দ করার জন্যই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।

: আপনি ঢাকাতেই থাকেন।

আগের সেই কথোপকথনের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা বোধ হয়।

: আপনি?

: কি চিনতে পারেননি? আমি কিন্তু ঠিকই চিনেছি।

: আমিও চিনেছি। কিন্তু একটু অবাক হয়েছি আপনাকে দেখে।

: আপনি তো অবাক করে দিতে ভালোবাসেন। তা নিজে অবাক হয়ে কেমন লাগছে।

মামুন হাসল। সে হাসিই যেন মামুন আর মেরিনার সম্পর্কটাকে আরও অনেক দূর নিয়ে চলল। পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে ভাব ভালোবাসায় গড়াল ব্যাপারটা। মনের রঙিন ঘুড়ি উড়িয়ে দিল এই যান্ত্রিক নগরে, সব কোলাহল ছাড়িয়ে নির্জন-নিরিবিলিতে প্রেম করতে করতে একদিন মেরিনার সঙ্গে বিয়েও হয়ে গেল। আসলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন কিছুই ছিল না দুজনের ভেতর। সে পারিবারিক হোক আর সামাজিক। তাই খুব সহজেই ওরা একে অপরের কাছে আসতে পেরেছিল। বাসর রাতে হৈমন্তীতে পড়া সেই কথাটা নাড়া দিয়ে গেল – ‘পাইলাম’।

মেরিনা আর মামুনের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। একেবারে তুই সম্পর্ক। ভালোবাসার কমতি পরিলক্ষিত হয়নি কখনো কোথাও। ঢাকা শহরে একটা ছোট্ট নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকে। সব মিলিয়ে সাড়ে আট শ বর্গফুট। একটা কাজের মেয়ে দেশের বাড়ি থেকেই এসেছে। ভালোই চলছিল। খুনসুটি, ঝগড়াঝাঁটি যে একেবারে হতো না তা না। তবে সাময়িক। সকাল ৭টার মধ্যে মামুনকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সারা দিন অফিসে থাকে। ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা। মেরিনার একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টার কমতি নেই মামুনের। টিভি তো আছেই সঙ্গে একটা নেটের লাইনসহ পিসি। কিন্তু এই নেট লাইনই একদিন দু’জনের নিবিড় সম্পর্কে হঠাৎ কেন যে ফাটল ধরাল তা বুঝে উঠতে পারল না কেউ। আসলে দোষটা কার কোথায় কতটুকু সে প্রশ্নে কোনো দিনই একমত হতে পারেনি তারা। প্রথম প্রথম নেটে মেরিনা কী করে না করে খুব আগ্রহ ভরে মামুনকে দেখাত। কিন্তু তারপর কোথায় যেন একটা গোপনীয়তা। লুকোচুরি খেলা। কিছু বিশেষ লোকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বারবার মানা করা সত্ত্বেও মামুন আবিষ্কার করে কী নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সে। ভয়ংকর কিছু হলেও হতে পারে, মামুন প্রশ্রয় দিতে পারে না। নিজের মনটার ভেতর অশুভ চিন্তা বয়ে যায়। নারীর অধিকারের প্রশ্নে বড় বড় বুলি আওড়ানো মামুনই নিজেকে আবিষ্কার করে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে অভিনেতা হিসাবে। এক কথা দু’কথায় তর্ক। সেখান থেকে কাচের জিনিস ভাঙা হয়। টিভির রিমোট বাদ পড়ে না। তবু থামতে চায় না। বহু ব্যবহার করা তর্কের মুহূর্তে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ মেখে দেওয়া ওষুধটাও ইদানীং আর কাজ করে না। ঝগড়া চলতেই থাকে ভোর রাত অবধি।

একদিন হয়তো আদর করতে চাইছে সে মেরিনাকে-

: এটা কী হলো?

: ভালোবাসা।

: এ সব ন্যাকামি আমার সঙ্গে আর করবা না।

: আচ্ছা করব না একটু হাসো।

: ধ্যাত, ছাড় না, ছাই?

: ছাড়ব না। কী করবে?

: উফ। অসহ্য।

মেরিনার রেগে উঠে চলে যায়। অনেকক্ষণ কোনো খোঁজ নেই। মামুন পিছু পিছু গিয়ে দেখে সেই নেট। মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়। ভদ্রলোকের ঘরে অনুচ্চারিত কথামালা উচ্চারিত হয়। একদিন সব ভাব ভালোবাসাকে অপমান করে গায়ে হাত তুলে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মেরিনা। দু’চোখ বেয়ে নেমে আসতে থাকে জল। লজ্জায় সে জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সামনে থেকে দ্রুত উঠে গিয়ে বেডরুমে ভেতর থেকে দরজায় সিটকিনি দেয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে মামুন।

পরদিন অফিস থেকে ফিরে মেরিনাকে আর বাসায় দেখতে পায় না। ফুলির হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে গেছে –

‘চললাম। আমার একাকিত্বকে ঘোচাতে না পেরে সহজাত পুরুষালি স্বভাব দেখিয়েছ। তোমার কাছ থেকে আমার আশা অনেক বেশি ছিল। আর দশজনের সঙ্গে তোমার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিলে। ভালো থেক’। মামুন মেরিনার সেই গভীরতায় প্রবেশ করতে পারে না যেখানে বোঝাপড়া ঘনিষ্ঠ হতে পারে।

এভাবে মান ভাঙানোর খেলা চলে। কিছু পরোপকারী আত্মীয়-স্বজনের মধ্যস্থতায় আবার শুরু হয় পথ চলা। কিন্তু সময়ের বাঁকে বাঁকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। মেরিনা বাপের বাড়ি যায়। আবার আসে। মামুনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। দু’জনের ভেতরে গভীর হতাশার কালো মেঘ। ভালোবাসায় বিশ্বাসের অভাব। যেন অপরিচিত দুই যুবক-যুবতী এক ঘরে রাত্রিযাপন করছে। কারও কারও পরামর্শে সন্তান নেয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কিন্তু ভ্রূণ বেড়ে ওঠে না। ডাক্তারের কাছে নিত্য যাতায়াত। কোনো সুরাহা হয় না। উচ্চ রক্তচাপ এসে যুক্ত হয়। একটু ধৈর্য ধারণের আহ্বান আসে। মামুন অসন্তুষ্ট হয়। বাবা হতে পারবে কি না সংশয় হয় তার। মেরিনার মেজাজ অকারণেই খিটখিটে থাকে। মামুনের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া হয় আবার সামান্য কারণেই। এদিকে মামুনের হাতে বড় প্রমোশনের হাতছানি। আরও বেশি তটস্থ সে ক্যারিয়ার গড়তে। প্রায় রাত হতে থাকে ফিরতে। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবেও রাত করে। বাসায় ফিরে ঝগড়ার একঘেয়েমি ভালো লাগে না। বরং অফিস বস শোভানার সান্নিধ্য সুখকর মনে হয়। কথার পিঠে কথা বলতে ভালোই লাগে তার সঙ্গে। শোভানা সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে থাকে। কিন্তু থেকে থেকে এমন এমন কথা বলে ওঠে মামুন হেসে গড়াগড়ি। এ রকম কত অনর্থক কথাতেই না মেরিনার সঙ্গেই রাতের পর রাত পার হতো। আজকাল কথা বলার বিষয়ই খুঁজে পাওয়া যায় না।
তারপরও কথা হয় রাতে শুয়ে পড়ার পর।

: তোমার প্রমোশনের খবর কি?

: আর প্রমোশন! যেভাবে লোক ছাঁটাই হচ্ছে চাকরিটা না চলে যায়।

: কেন সে রকম সম্ভাবনা দেখছ নাকি।

: না। এমনি বললাম। তবে অনেক ছাঁটাই হয়েছে।

মেরিনার শরীরে কথার সঙ্গে সঙ্গে মামুনের হাত খেলা করে। অবাধ্য জন্তুর মতো বশ মানতে চায় না আঙুল।

: আহ! বাদ দাও না।

: কেন?

: ভালো লাগছে না। বরং চল বারান্দায় বসি। আজ পূর্ণিমা।

: পূর্ণিমা দেখতে ইচ্ছা করছে না। বরং তোমাকে দেখি।

: ও মাই গড। আমি তো ভুলেই গেছি। আজ মধ্য রাতের পর দেখা যাবে উল্কাবৃষ্টি। এই চল ওঠ ছাদে যাব।

: এখন উল্কা বৃষ্টি দেখতে যাবে।

: হু।

: তুমি যাও। আমার ভালো লাগছে না। ঘুমাব।

মেরিনা চলে যায়। মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে মামুন ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাতে ঘুম ভাঙে। পাশে মেরিনা নেই। আবিষ্কার করে নেটে থাকতে থাকতে কম্পিউটার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকতে গিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের চ্যাট রুমটার দিকে চোখ যায়। অচেনা মনে হয় মেরিনাকে। রীতিমতো ধাক্কা খেতে হলো। মেরিনা আরেকটি ছেলের সঙ্গে ভালোমতো জড়িয়ে পড়েছে। ছেলেটির নাম বাবর। ঢাকাতেই  থাকে। কথোপকথনে মামুনের কথাও আছে। আছে সীমাহীন অসুখী হবার কথা। শরীরকেন্দ্রিক নোংরা বার্তারও চালাচালিও।

এরপর মেরিনার সঙ্গে ভয়ংকর রকমের ঝগড়া হয়। মারামারির পর্যায়টা বস্তিকেও হার মানায়। সেই ঝগড়ার প্রায় মাস তিন হতে চলল মেরিনা আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। বাপের বাড়িতেই আছে। মামুনেরও ইচ্ছা হয়নি। একটা মাস একা একায় কাটিয়েছে। কখনো বাসায় কখনো বা বোনের ওখানে। তৃতীয়, চতুর্থ পক্ষের মধ্যস্থতায় ঘটনার দফারফা হয়নি।

মেরিনাকে ওভাবে রেখেই এবার ঈদ করতে এসেছে মামুন। একা। মিতার ব্যাপারেও আগ্রহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মেরিনা, মিতা কারও ব্যাপারেই কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। জীবনটা বয়ে বেড়ানোই কেন জানি অসহ্য মনে হচ্ছে। কোনো কিছুতেই মন বসে না। একটু পুরোনো আড্ডায় এবারের ঈদ করে চাঙা হতে চেয়েছিল। চেষ্টা করলেই কি সব পেছনে ফেলে আসা যায়? নিমাই দার ঘর থেকে আজান শোনা যায়। ভোর হয়ে আসছে। আরো একটি রাত নির্ঘুম কাটল। আসছে ভবিষ্যতের অনেক প্রশ্নের মীমাংসার দাবি তবু মিটল না।

মামুন একটা সিগারেট ধরাতে বাইরে বের হলো। অনেক দিন পর সূর্য ওঠা দেখতে এত ভালো লাগছিল যে আগের ঘটনা তার মন থেকে হারিয়ে গেল। সেই সময় শেফালী আর পীযুষ ঘরে ঢুকছে। ঢাকা থেকে তারা এসেছে নাইট কোচে। শেফালী নিজের বাসায় উঠবে না তাই পীযুষকে সঙ্গে করে আনা। এখানে যে মামুন স্যার থাকতে পারে কল্পনাতেও ছিল না। মামুন বহুদিন পর শেফালিকে দেখে একটু অবাক। শেফালী মুহূর্তেই বদলে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই মামুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক তখনই পায়ে তীব্র আর তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করল মামুন। মনে হলো সাপে কেটেছে। পুরো পৃথিবীটা এক নিমেষের জন্য দুলে উঠল। একটা চিৎকার , যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। নিমাই দা , বৌদি চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে, আরো কত লোক জড়ো হলো, মামুনের অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবার আগে একবার মেরিনার মুখটা মনে পড়ল। শেফালী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য সে ভিড় থেকে বেরিয়ে এল। আর তখনি আকাশ কাল হয়ে বৃষ্টি নামল। পেছনের দৃশ্য দেখার আর চেষ্টা করল না। তার প্রতিশোধ নেয়া আর হয়ে ওঠে না, তার আগেই সাপের কামড়ে পৃথিবী ছেড়েছে মামুন স্যার। সেই মামুন স্যার সেদিন প্রথম তার চৌদ্দ বছরের শরীরটা অপবিত্র করেছিল।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত