শেফালী ও কয়েকজন পুরুষ (৬)

ট্রেন চলছে বিরতিহীন ভাবে। ট্রেনের শব্দ বাদে আর কোনো কোলাহল নেই। রাসেল আর শেফালী কামরার বাইরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। হাসান সাহেবের সামনে রাসেল সিগারেট খায় না। মূলত সিগারেট খেতেই বাইরে আসা। প্রচণ্ড বাতাসে রাসেলের চুল উড়ে রাসেলের চোখে-মুখে পড়ছে। শেফালীও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। শীত জাঁকিয়ে বসেছে। প্রচণ্ড শীতে সিগারেটের ধোঁয়া মুখের ভেতর পুরে দেওয়ার একটা আলাদা মজা আছে।

বার্থে শাহেদও সিগারেট ধরিয়েছে। হাসান সাহেব বোধ হয় ঘুমিয়েছে। যথারীতি নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শাহেদের নাক ডাকার অভ্যাস নেই। তবে মাঝে মাঝে ঘুমালে তাকে বোবায় ধরে। তখন বিশ্রী রকমের চিৎকার করে সে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুমের ভিতর এমন চিৎকারে সুমি ভয়ে আঁতকে ওঠে। এখন অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বোবায় ধরলে শাহেদ একটা কমন স্বপ্ন দেখে। সে একটা আয়নায় আটকে গেছে। কিছুতেই বের হতে পারছে না। জোরে চিৎকার করছে কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না। অথচ সবাই তার চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। শাহেদের এখনো মনে হচ্ছে সে যেন আয়নার ভিতর বন্দি। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এরা মোবাইল কেড়ে নেই নি। এদের উদ্দেশ্যও বোঝা যাচ্ছে না। জালাল থাকলে এই বিপদে পড়া লাগত না। কখন বের হয়ে যেত। জালাল কে কি ফোন দেবে? নাকি সুমিকে দেবে? বাসায় সুমি একলা আছে। সুমি মা হতে চলেছে। সুমির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেল।  তার বনশ্রীর এক ফ্ল্যাটে থাকে। খুব ভালই চলছে সংসার। গত সপ্তাহের কথা। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। বেশ একটা ঠান্ডা সকাল। শোয়ার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে শাহেদ দেখল সু মি শুয়ে আছে। সূর্যের আলো এসে পড়ছে। আর অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। শাহেদ অনেকক্ষণ ধরে ভোরের আলোয় আলোকিত অর্ধ নগ্ন সুমিকে দেখল। ইচ্ছা হলো বুকে কামড়ে দিতে।  প্রথম যেদিন কামড় বসিয়েছিল সুমি রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘খাটাশ!’ সে রাগ কাটাতে অনেক হাতে পায়ে ধরতে হয়েছিল। এর মধ্যে কাজের মেয়েটা এসে উপস্থিত। ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে। এভাবে আরও কয়েকবার বিভিন্ন কারণে। কাজের মেয়েটার উপর শাহেদের বিরক্তি চরমে পোউছাল। একাকী ঘরে সুমির সাথে একটু নিরিবিলি থাকার জো নেই। বাসা ভর্তি লোকজন। শাহেদ যেয়ে দরজা দিল।  তারপর পাশে গিয়ে বসে বুকের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে ডাকলো। সুমি তাকালো। খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল। কিছু বলল না, যেন শাহেদকে  আহবান করছে।  শাহেদ মুখটা নামিয়ে জিহবা লাগায় আর দেখতে থাকে, থাকতে থাকতে বলে উঠল, কী সুন্দর! তারপর প্রাণপণ শক্তিতে মুখে নিয়ে শুষতে থাকে। সুমি হাঁপাচ্ছে। শাহেদও হাঁপাতে হাঁপাতে ছেড়ে ছেড়ে দিলো, আর তৎক্ষণাৎ সুমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। বাথরুমের খিল দিল। শাহেদও বেসিনে মুখটা ধুয়ে বেরিয়ে পড়ে। শফিক বাইরে বেড়িয়ে দেখে গেটের কাছে জালাল দাঁড়িয়ে আছে। চোখ টক্টকে লাল।  জালালের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই সুমিদের দুই বিঘা জমির উপর বাড়িটা নিয়ে কথা হচ্ছে শাহেদের।

‘ইতিহাস তো শুনলেন, বাড়িটির মূল্য ধরেন বিশ কোটি। আপনার দশ আমার দশ। আপনি রাজি থাকলে বলেন।’ ধূর্ত শিয়ালের মতো প্রথম দিন বলেছিল জালাল।

শাহেদের পুরো ঘটনা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। শ্বশুরবাড়ির এত ইতিহাস জানা ছিল না। তার শাশুড়ি যে রুমির আপন মা না এটা জানত শাহেদ। কিন্তু এত লম্বাচওড়া ইতিহাস এই বাড়ি ঘিরে জানা ছিল না। শাহেদের আপন নানা শ্বশুর মানে সুমির নানা ছিলেন পাকিস্তানি। ৭১ এর পর  বউ কে ফেলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। নানি শাশুড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের মেয়ে। বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। এই যে দুই বিঘা জমির ওপর বাড়ি তা আদতে ওই পাকিস্তানি ভদ্রলোকের। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে ভয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে পালিয়ে গেছে। শাহেদের নানি শাশুড়ি এরপর এই এত বড় বাড়িতে একা পড়েছিলেন। সঙ্গে মেয়ে রুমির মা রোমেলা। পুরো যুদ্ধের সময়টা যে কত কুকীর্তি করেছে এই পাকিস্তানি ভদ্রলোক। এত বিশাল বাড়ি রক্ষা করতেই নিজের মেয়ে রোমেলাকে বিয়ে দিয়েছিলেন সুমির নানি শাহেদের বর্তমান শ্বশুর খবির উদ্দিনের সঙ্গে। শাহেদের শ্বশুর খবির উদ্দীন রুমির নানার ম্যানেজার আখলাস উদ্দীনের মেজ ছেলে। দেশ স্বাধীনের পর এই বাড়ি ভোগদখলের জন্যই রোমেলার সঙ্গে খবিরের বিয়ের আয়োজন করে আখলাসউদ্দিন। রোমেলা শাহেদের স্ত্রী সুমিকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। খবিরউদ্দিন আবার বিয়ে করে আর পরের ঘরের মেয়ে রুমি। যাকে বিয়ে করার জন্য জালাল এখনো লেগে আছে।

জালালের সঙ্গে শাহেদের প্রথম দেখা হয়েছিল চট্টগ্রামে। দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে যেদিন তার পরের দিনের ঘটনা। অস্ত্র নাকি এসেছে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য। শাহেদ ভাবে,  ভারতে উলফার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে হয়তো। কিন্তু আমাদের কী দায় পড়েছে এতে অংশীদার হওয়ার? ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে চটানোর জন্য না জানি ভবিষ্যতে তারা কি প্রতিশোধ নেই। পুরো চট্টগ্রাম শহর সুনসান। শাহেদ পারিবারিক একটা কাজে চট্টগ্রাম এসেছিল। স্টেশনে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায়। এ সময় প্রথম জালালের সঙ্গে দেখা।

: আপনি স্টেশন যাবেন?

: হুমম।

: বাস মনে হয় পাওয়া যাবে না, চলেন শেয়ারে একটা সিএনজি নিই।

সেই প্রথম জালালের সঙ্গে শেয়ার করা শুরু। প্রথম দিনই অনেক জিনিস শেয়ার করেছিল। প্রথম সি এন জি, তারপর ট্রেনের টিকিট। একটা টিকিট পাওয়া গিয়েছে। আরেকটা স্ট্যান্ডিং। অগত্যা কিছু পথ শাহেদ বসে, কিছু পথ জালাল। ট্রেনে শেয়ারে চা খাওয়াও হল, শেয়ারের সিগারেট তো আছে।ভবিষ্যতে  শেয়ারের পালা দুই বিঘা জমির উপর বাড়ির।  জালাল আর শাহেদ কত বার যে মিটিং করেছে এই এক বাড়ি নিয়ে।

‘আপনার স্ত্রী এতিম। এতিমের সম্পত্তি এত দিন এই মানুষগুলো ভোগদখল করে আসছে প্রতারণা করে। পুরো সম্পত্তির আসল দাবিদার ভাবি আর আপনার ছেলে। রাজি থাকলে বলেন। সব কাগজপত্র বের করে আনব। হাতে আমার পার্টিও আছে। পুরো বিশ কোটি টাকায় দেবে। আপনার কাজ শুধু সুমি ভাবিকে রাজি করান’

‘ তুমি আমাকে কেন এসব বললে?’

‘ধরেন শ্বশুরটা যদি হঠাৎ মরে যায়। সম্পত্তি কিন্তু ভোগদখল করবে আপনার চাচা আর ফুফু শাশুড়িরা। দেখাবে পুরো সম্পত্তি আপনার দাদা শ্বশুরের। তাতে যা সামান্য ভাগ পাবেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।‘

শাহেদ দোটানায় ভোগে। সারা রাত ঘুম আসে না। তার মনে আরেক চিন্তা। জালালকেই বা সে ভাগ দেবে কেন? পুরোটাই তো তার স্ত্রীর। কাগজপত্র একটু চেষ্টা করলে নিশ্চয় বের করা যাবে। বাড়ি বিক্রিও কোনো সমস্যা না। সুমির সঙ্গে সে কি পুরো ব্যাপারটা শেয়ার করবে। যদি রুমি বাগড়া দেয়। তার বাবা-চাচার পক্ষ নেই। শাহেদকে ভুল বোঝে। কিংবা বিশ্বাসই যদি না করে। কতটুকু ও জানে কে জানে। এভাবেই চলে দিন। জালাল ফোন করতে থাকে। আলাপচারিতা চলে। কীভাবে কী হবে? সবকিছুই কঠিন গোপনীয়তার মধ্যে। কাগজপত্র মাসখানেকের মধ্যেই হাতে পৌঁছে যায়। জালালের কথা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। শাহেদের ঘুম আসে না। বিশ কোটি টাকার স্বপ্ন দেখে শুধু। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া মাঝখানের দশ কোটির ভাগ জালালের- বড্ড পীড়া দেয়। অনেকে ভেবে চিনতে জালালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলে শাহেদ।

জালালের কথা শুনে শাহেদ চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী নখ দিয়ে ঠোঁট কাটতে থাকে। মন কোনো বিশেষ জায়গায় ছিল না, ছড়িয়ে ছিল অনেক জায়গায়, উদ্দেশ্যহীন হয়ে।

:’এখনই ভায়রা ঠিক বলতে পারছি না। আমায় একটু ভাবতে দাও।‘

: ভাবাভাবি করতে বেশি সময় নিয়েন না, লাদেনকে মাইরা ফেলছে। গাদ্দাফীকেও।

: তার সঙ্গে সম্পর্ক কী?

: দিন কাল ভালো না, কখন আমেরিকা আইসা আমাগো দেশ দখল কইরা নেয়।

: আমেরিকা নিবে কেন?

: আমেরিকা না নিক, ভারত তো নিতে পারে। ফেলানীরে মাইরা কাঁটাতারে ঝুলাই দিচ্ছে।

: কীসের মধ্যে কী বলো?

জালালের নেশা চড়েছে বুঝতে পারে শাহেদ।

ঃ দেখ এ সপ্তাহে আমি খুলনা যাচ্ছি। অগিশিয়াল একটা কাজে।

; আপনি খুলনা যাইতেছেন আর আমি যাইতেছি পাকিস্থান।

ঃপাকিস্থান কেন?

ঃকারন আছে। আপনার জন্যই যাইতেছি। যাইহোক , আমার সাথে খুলনা যাওয়ার আগে একবার আরিচা ঘাট যেতে হবে।

বলে জালাল হাটা দেই। শাহেদ ঘরে ঢোকে। তার অপেক্ষাতেই ছিল সুমি। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নেই। এর মধ্যে কাজের মেয়ে চা নিয়ে এসেছে। চায়ের দিকে খেয়াল নেই। সুমির মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে শাহেদ।

: তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে বোধ হয় তিনবার বলল। শাহেদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আছে অন্য ধ্যানে। পুরো বাড়ির মালিক এই সুমি। মানে প্রায় কুড়ি কোটি টাকার মালিক। ও কি জানে ব্যাপারটা? কোনো দিন তো আলাপচারিতায়ও আনেনি। এর মধ্যে এক সন্তানের মা হয়েছে। শাহেদ জানে বাড়িটা তার দাদা শ্বশুর আখলাস উদ্দিনের।  নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন জেনে এসেছে এত দিন। কোনো কিছুই করতে হতো না তার। মাস শেষে দোকানের ভাড়া পেত। এ বাড়ি ছাড়া তার আর কোথাও কিছু আছে বলে জানে না শাহেদ। শ্বশুরের তিন ভাই-বোন বাড়িতে এক সঙ্গে থাকে।

শাহেদ বর্তমানে যে বেসরকারি ফার্মে চাকরি করে সেখানে মাস শেষে আয়টা খারাপ না। ঢাকা শহরে একটু ভদ্রভাবে চলার জন্য যথেষ্ট। এক ছেলে আর সুমিকে নিয়েই একটা আ্যাপার্টমেন্টে শাহেদের সংসার। বিয়ের আগে জালাল যতই দুই বিঘার জমির উপর বাড়ীর কথা বলুক না কেন শ্বশুর বাড়ি থেকে খুব একটা প্রত্যাশাও ছিল না। শ্বশুর মারা গেলে যা হবে তা পরে ভাবা যাবে। কিন্তু জালালের এই নতুন কথাগুলো খুব কানে বাজছে – “পুরো বাড়ীটার মালিক একলা সুমি। মূল্য ২০ কোটি। ২০ কোটিতে কয়টা শূন্য শাহেদ ভাই?”

সুমির কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে –

‘এত গ্যাঞ্জামের ভিতর তোমার না গেলেই কি না?’ মুখ ভার করে বলে সুমি।

‘নারে সোনা পাখি। জরুরি তলব। অদূর ভবিষ্যতে পদ্মা ব্রিজ হলে খুলনার চেহারা পাল্টে যাবে। আমাদের মালিক এখনি খুলনায় ইনভেস্ট করতে চাঁচছেন। উনিও যাবেন।‘

কথা বলতে বলতে আদর চলতে থাকে। মান ভাঙ্তে শাহেদ বরাবরই আদরটা শুরু করে পায়ের পাতা থেকে। পায়ের পাতা থেকে চুমু খেতে শুরু করে আস্তে আস্তে হাঁটু অব্দি ওঠে। তারপর তলপেট এবং নাভিমূলে চুমু খায়। গালে গলায় গ্রীবায় চুমু খেতে খেতে সুমি পালটা প্রশ্ন ছোড়ে –

ঃ তাহলে তোমাকে প্লেনে পাঠাতো। ট্রেনে যাওয়ার কি দরকার?

ঃ  ডাইরেক্ট খুলনা প্লেন নেই।  যশোর থেকে আবার গাড়ী করে যেতে হবে।

ঃ তা তোমার মালিক যাবে কিভাবে?

ঃ হেলিকাপ্টারে। তাদের সাথে কি আমার তুলনা চলে।

মন সায় দেই না অজানা বিপদের আশঙ্কায়। বেলা পড়ে এসেছিল, তবুও রোদের তাপ বেশ। একদল চড়ুই বারান্দায় ছোট ছোটে ঠোঁটে কিচকিচ করে কথা বলছে আর খেলছে। শাহেদ অনেকক্ষণ ধরে খেলা দেখছে, সুমি বেশ বুঝতে পারে শাহেদের কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সুমির মন আজ ভয়ংকর রকম খারাপ। তার প্রিয় লেখক কাল রাতে মারা গেছেন। কী আশ্চর্য বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে চুপচাপ মরে গেলেন হুমায়ুন। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে। এ কি বিশ্বাস করা যায়?

শঙ্খনীল কারাগার। নন্দিত নরকে পড়ে চোখ ছলছল করেনি এমন পাঠক কি আছে? প্রিয়তমেষু, কৃষ্ণপক্ষ, নবনী, হিমু, মিসির আলী, শুভ্র  – সকাল থেকে কত কি যে মনে পড়ছে রুমির, কখনোই একুশের বইমেলায় দেখবে না হ‌ুমায়ূন স্যারকে। দেখবে না অটোগ্রাফ শিকারিদের সেই দীর্ঘ লাইন। ইশ! আজ রোববার নাটকের সুজা খন্দকারের মতো হ‌ুমায়ূন যদি কফিন থেকে বেরিয়ে বলত, ‘আমি কি মারা গেছি?’। পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বের একটা গরিব দেশের মানুষদের কত সহজেই না জীবনের সকল দুঃখ ভুলিয়ে হাসিয়ে চলেছেন যুগের পর যুগ। সুমি যদি সাহিত্যর কোনো ভালো কিছু পড়তে পেরেছে তবে বলবে হ‌ুমায়ূন তাকে পড়তে শিখিয়েছে। হ‌ুমায়ূন না পড়লে কোনো দিনই বাংলা সাহিত্যর কঠিন কঠিন লেখাগুলো পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত না। শাহেদের অবশ্য হুমায়ন ভক্তি নেই। সে রবীন্দ্র প্রেমিক। তারকাছে রবীন্দ্রনাথ বাদে ২য় কোন কবি সাহিত্যকের প্রয়োজন নেই। রবিন্দ্ররনাথের বিকল্প কি আছে বাঙ্গা সাহিত্যে যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। শাহেদ ভেবে পাই না কিছু মানুষ কেন রবিন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে। যদিও এক কবি নিয়ে পড়ে থাকাটা মোটেও গরবের কিছু না। ৩০ বছর ধরে একই রকমের লেখা লিখে একটা পুরো জাতিকে নেশায় বুদ করে রেখেছে সেটা হুমায়ুনের জন্য বিশাল ব্যাপার হলেও জাতি হিসাবে আমাদের জন্য লজ্জার। আমরা হুময়ুন বলয় থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। যেমন পাইনি রবীন্দ্রনাথ থেকে। নজরুল থেকে। আমাদের সবার ধারনা বাংলা সাহিত্য এদের চেয়ে বড় কোন প্রতিভা আশা আর সম্ভব না। এ নিয়ে অনেক তর্ক হলেও আজ কোন কথা উঠাই না শাহেদ। সুমির মত দুঃখ না পেলেও হুমায়ূষকে  হারানোয় এক ধরনের বেদনা তাকেও ছুয়ে গেছে।

তাছাড়া এমন্তিতেই সে অশান্তির ভিতর আছে।  বিশ কোটি টাকার বাড়ি আর জালাল তার অশান্তির কারণ। আলো থাকতে থাক্তেই  আবার জালালের সাথে বেড়িয়েছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না। আরিচা ঘাটে আছে এখন। চাকা পাংচার হয়েছে।

: চাচা, একটু হাওয়াটা…

: কত রাখব?

: সামনের চাকায় ৪০ পেছনে ৩৫।

: আমার ছেলে কয় সব চাকায় সমান হাওয়া দেওয়া উচিত।

: আপনার ছেলে বুঝি ড্রাইভার?

: হ। লসএন্জেলেস এ ট্যাক্সি চালায়।

: আপনার ছেলে আমেরিকা থাকে?

: হ, বাবা। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। দুইটাই বিদেশ। মেয়েটা কানাডা থাকে। মন্ট্রিলে।

: ছেলেমেয়ে দু’জনায় বিদেশ থাকে। আর আপনি এই গোয়ালন্দ ঘাটে বইসা গাড়ির চাকায় হাওয়া দেন কেন?

: হা! হা! কী করমু বাজান? ডায়াবেটিক। ডাক্তার বলছে পরিশ্রম করতে। ছেলেমেয়ে কেউ তো চাই না। কিন্তু শরীর তো ঠিক রাখতে হইব। ভর সন্বেধ্লায় ছেলের বউ, ঘি-পরোটা বানাইছে। সঙ্গে আবার গরুর মাংস। খাওয়ার লোভ ছাড়তে পারি না। খাই আবার এই পরিশ্রম কইরা একটা ব্যালান্স রাখার চেষ্টা। লন। আপনাদের হাওয়া দেওয়া শেষ।

: চাচা কত দিতে হবে?

: দেন। আপনাদের যা ইচ্ছা। আমার তো টাকার জন্য পরিশ্রম করা না।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করে প্রাইভেটকারের যাত্রীরা। ছেলেমেয়ে আমেরিকা, কানাডা থাকে,  যার ছেলের বউ পরোটা, গরুর মাংস রেঁধে খাওয়ায় আর তাকে দিয়ে গাড়ির চাকার হাওয়া দিয়েছে একটু বিব্রতই দুজন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগতে ভুগতে এক শ টাকার একটা কড়কড়ে নোট চাচার হাতে দিয়ে এক টানে মাইল মিটার আশিতে।

কে যেন বলেছিল, যুব বয়সের গর্ব হলো শক্তি ও সৌন্দর্য, বৃদ্ধ বয়সের গর্ব হলো বিচক্ষণতা। নোটটা নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রহিম মিঞা। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ। ঢাকার লোকজন আসলেই বলদ কিছিমের। একটু চেষ্টা করলেই বিনা পরিশ্রমে দশ টাকার জায়গায় এক শ টাকা বাইর করন যায়।

কিছু দূর আসতেই মুখ খোলে শাহেদ।

: তোমার কি মনে হয় ওই বুড়োর ছেলেমেয়ে আমেরিকা কানাডা থাকে।

: কীসের আমেরিকা, কানাডা? ফুল টাউট বুইড়া।

জালাল হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।

: তাহলে এক শ টাকার নোটটা দিয়া দিলে যে,

: জাল নোট দিছি। বাঘের ওপর টাঘ থাকে বুইড়া বোঝে নাই।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে জালাল।

শাহেদও অবাক হয় জালালের প্রতিভায়। হঠাৎ করেই জালাল ফোন দিয়ে ডেকে এনেছে। কী নাকি জরুরি দরকার। নিয়ে এসেছে এই গোয়ালন্দ ঘাটে। কোথায় যাবে এখন শাহেদ জানে না। কৌতূহল আর চাপতে পারে না। কেবল জিজ্ঞাসা করবে এমন সময় গাড়ি থামায় জালাল।

: শাহেদ ভাই, নামেন।

: এইখানে।

: হ, এবার আমরা নৌকায় উঠব।

: নৌকায়!

শাহেদ আর জালাল নৌকায় বসে আছে। বেশ বড়োসড়ো নৌকা। শোয়ার ব্যবস্থা আছে।  বিশাল চাঁদ। মদ তো আছেই।

: কেমন একটা রাজা বাদশা রাজা বাদশা ফিল হইতেছে না শাহেদ ভাই?

: রাজা বাদশা!

: আমার বহু দিনের স্বপ্ন শাহেদ ভাই। বিশাল বজরা হবে। এমন চাঁদনি রাতে বের হব। বজরা ভরে থাকবে ফলমূল আর মদে, সামনে বাইজি নাচবে।

: বাইজি নাচবে।

: হ, সুন্দর সুন্দর বাইজি। গান হবে, নাচ হবে, কবে যে টাকা হবে শাহেদ ভাই?

ঃ অনেক টাকা হলে আর কি করবা?

ঃ একটা হোটেল দিব। সারাদিন রান্না হইবো। আমি সব কিছু টেস্ট করতে থাকবো।

ঃ সব কিছু খাওয়া তোমার ইচ্ছা?

ঃ খাওয়ার কস্ট যে কি কস্ট শাহেদ ভাই? আপনি বুঝবেন না। জীবনে যে কি কস্ট করেছি এই খাওয়ার জন্য।

: বুঝলাম অনেক স্বপ্ন। তা তোমার হাতে হাতুড়ি কেন?

: হাতুড়ে দিয়া মাঝ নদীতে নৌকা নিয়ে ফুটা কইরা দিব। নৌকা ডুইবা যাব, আমরা নদীতে সাঁতার কাটমু।

: তা তুমি কি এই রাত তিন পারে নদীতে সাঁতার কাটার জন্য আমারে নিয়ে আসছ?

: না শাহেদ ভাই। আপনারে আনছি আপনার লুইচ্চা শ্বশুরের গল্প করতে।

: লুইচ্চা!

: চরম লুইচ্চা। বয়স হইছে ৫০ এর ওপর। এখনো কচি কচি মাইয়া নিয়ে ফুর্তি করে।

: কী বল এসব?

:  জানি বিশ্বাস যাইবেন না। কিন্তু এই জালাল আপনার সঙ্গে কোনো দিন মিছা কথা বলে নাই।

: তা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার এই কথা বিশ্বাস হইতেছে না।

: ডেমো দিব, ডেমো দিতেই আপনারে নিয়ে আছি। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আপনার শ্বশুরের কাম-কাইজ দেখতে পাবেন।

ঘাটে সারি সারি রিকশা দাঁড়িয়েই থাকে। পাড়া দশ টাকা, পাড়া দশ টাকা বলে চেঁচিয়ে যায়। রিকশায় চেপে বসেন খবিরউদ্দিন। মাসের প্রথম পূর্ণিমায় লঞ্চে চেপে তার গোয়ালন্দ ঘাট আসা লাগে। ঠিক কখন কবে থেকে এই নিয়ম করে আসা তা তারও ঠিক মনে নেই। বয়স এখন ৫৫ ছুঁই ছুঁই। আগের সেই যৌবনও নেই। তবু এখানে আসাটা যেন তার একটা নেশা। পাড়ায় তার ঘরও নির্দিষ্ট। গত ত্রিশ বছর ধরে এই ঘর সে বদল করেনি। খবিরউদ্দিন আসার আগেই মদের গ্লাস পরিষ্কার করে রাখে নিজ হাতে জোলেখা। মিষ্টি জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে রাখে। আর কারও বানানো পান খবিরউদ্দিন মুখে রোচে না।

প্রথম কবে দেখেছিল খবিরউদ্দিনকে ঠিক মনে পড়ে না। ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে সেও হয়তো নিত্যদিনের মতো দাঁড়িয়ে ছিল বুকের মাপ দিতে কাস্টমারদের। খবিরউদ্দিন হা করে তাকিয়ে ছিল তার মুখের দিকে। জোলেখায় হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল। কী সংকোচই না ছিল খবিরউদ্দিন। সে নাকি ভুল করে চলে এসেছে। উঠেছিল স্টেশনে যাবার জন্য রিকশায় আর রিকশাওয়ালা তাকে এখানে নিয়ে আসছে। আজ অবশ্য সবই অতীত। বিগত যৌবনা দেহপসারিণী জোলেখার বয়সও ৫০ পেরিয়েছে। পাড়ার লোকে ‘খালা’ বলে সম্বোধন করে। এই খালা ডাক চারটে ঘরের মালিক হওয়ার সুবাদে।

আজ খবিরউদ্দিন ভাগ্য খুবই ভালো। আকাশ থেকে যেন ঝরে পড়ছে জ্যোৎস্না। চাঁদনি রাত আর মেয়েটা গত পরশুই এসেছে। একেবারে নতুন। চাঁদনি রাতে বিশাল পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরে খুব স্পেশাল কাস্টমারদের আলাদা খাতির মেলে। শুধু রাতটুকুর জন্য সব ব্যবস্থা রাখা হয় চরে। মাঝি উথাল-পাথাল জোছনায় হাজারগুণ সৌন্দর্য বাড়া পদ্মার স্রোত ভেঙে ভেঙে চর অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। ভোর অবধি কাকপক্ষীরও দেখা মিলবে না। সারা রাত এবার এই চরে কত শত যে কাণ্ড-কারখানা। নাচ, গান, হই হুল্লোড় কিংবা শুধু খোলা আকাশের নিচে আদিম ঘানি টানা। খবিরউদ্দিন পানের পিক ফেলে এই প্রথমবার মেয়েটার দিকে তাকায়। চওড়া লম্বাটে ফোলা ফোলা মুখ, ভুরুর ওপরে একটা গভীর কাটা দাগ যেন ভুরুটা ওপর দিকে টানা। সব মিলিয়ে কোমল বিষণ্ন ভীরু চেহারা। আড়ষ্টতা এখনো কাটেনি। মাথা নিচু করে আছে। এমনতর ঘটনা অবশ্য নতুন না। গলাখাকারি দিয়ে খবিরউদ্দিন জিজ্ঞাসা করে –

: নাম কি?

ওপাশ থেকে কোনো জবাব মেলে না। মেয়েটা মাথা নিচু করেই বসে আছে। তার ভীষণ ভয় করছে। ঘটনা যে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে গত দিন সাতেকের কিছুতেই কোনো হিসাব মেলে না। দু’বেলা ভাতের কষ্ট দূর করতে হারুণের সাথ ধরেছিল। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিল হারুন। মাত্র দু মাসের মাথায় গার্মেন্টস ধসে পড়ল, চারদিকে লাশ আর লাশ, রানা প্লাজার ধ্বংস স্তূপ থেকে কীভাবে যে সে বেঁচে ফিরেছে শুধু মাত্র আল্লাহই জানে। মাসখানেক পর পেটের দায়ে আবারো হারুনের শরণাপন্ন হয়েছিল। জানত আবার কোনো গার্মেন্টসে কাজ দেবে। বাড়িভর্তি মানুষগুলোর আর দুঃখ থাকবে না। কত স্বপ্নই না উঁকি দিয়ে হারিয়ে গেছে এই নরকে এসে।

খবিরউদ্দিন আবারও জিজ্ঞাসা করে

: নাম কি?

কোনো উত্তর নেই। শুধু একটু নড়েচড়ে বসে। বিরক্ত হয় খবিরউদ্দিন। জোলেখা বিবি তো এত কাঁচা কাজ করে না। একেবারে রেডি না করে তো কাউকে পাঠায় না। আনাড়ি নিয়ে আমোদ-ফুর্তি হয় না। নাটাইয়ের সুতা খেলানোর বয়সও আর খবিরউদ্দিন মিঞার নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পারে রঘুনাথ মাঝি। লোকটার মজবুত শরীর। বয়সে সে প্রৌঢ়। থ্যাবড়া নাক, চ্যাপ্টা মুখে এক বোঝা দাঁড়ি। দাড়ির ফাঁক দিয়ে হলদে বড় বড় দাঁতগুলো ঝিলিক মারে। শতেক তালি দেওয়া জীর্ণ পোশাক। পায়ে ছেঁড়া জুতো। হাতে একটা প্রকাণ্ড বইঠা। বাজখারি গলায় চেঁচিয়ে ওঠে –

: মাগী, নাম জিজ্ঞাসা করে কইতে পারো না। মুখে কি ধোন পুইড়া রাখছো?

কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যায়। মৃদু স্বরে নাম বলে। খবিরউদ্দিন মিঞা হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলে। ভীষণ অনিচ্ছায় আসতে হয়। চাঁদের আলোয় মুখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। হাত ধরে খবিরউদ্দিন মিঞা। বোকার মতো মেয়েটা বলে ওঠে–

: আপনি আমারে বিয়া করবেন?

হো হো করে হেসে রঘুনাথ। হাসি থামতেই চায় না। হাসি সংক্রামক। খবিরউদ্দিন হেসে ওঠে। এরই মধ্যে চর অবধি পৌঁছে যায় নৌকা।

গ্লাসে মদ ঢালে খবিরউদ্দিন। রঘুনাথ ওদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে। মেয়েটা এখনো জড়সড় হয়ে বসে আছে চৌকির ওপর। একটা বিছানা, একটা টেবিল আর একটা চেয়ার রাখা আছে চরে। টেবিলের ওপর মদের বোতল আর পানের বাটা সাজানো। গলায় এক ঢোক ঢেলে মেয়েটা দিকে তাকিয়ে খাবে কি না জিজ্ঞাসা করে খবিরউদ্দিন মিঞা। উত্তরের অপেক্ষা না করে দুই গ্লাসে দুই পেগ বানিয়ে নিয়ে আসে। একটা হাতে ধরিয়ে দেয়।

: খা।

গ্লাস হাতেই বসে থাকে মেয়েটা। রাগ ওঠে খবিরউদ্দিন মিঞার।

: দেখ মাগী, আমারে রাগাস না। তোর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করার টাইম আমার নেই। তোরে খাইতে কইছি খাইবি আর যা করতে বলমু তাই করবি। খাইয়া আমার মাথাটা একটু টিপে দে। তোর কাজ কারবার দেখে ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হইছে মাথায়। আগে জানলে তোরে নিতাম না।

: আমি খাব না।

: তুই খাবি, তোর বাপ খাবে। হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাছে টেনে মুখে গ্লাস উপড়ে দেয় খবিরউদ্দিন মিঞা।

বিদঘুটে স্বাদে গা গুলিয়ে ওঠে। তার জীবনে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তার ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে বারবার শিউরে উঠছিল। এক ধাক্কায় খবিরউদ্দিন মিঞাকে সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দেয়। খবিরউদ্দিন মিঞাও রাগে কাঁপতে কাঁপতে পিছু পিছু ছোটে। কিছু দূর যেতেই পা ফসকে মুখ উবুড় করে বালিতে পড়ে যায় মেয়েটা। একটা বিশ্রী শব্দ হয়। যেন কিছুতে ধাক্কা খেয়েছে। কোনো কিছুতে মাথা ঠুকলে যেমন শব্দ হয়।

: এই মাগী কী হইছে তোর। ফাজলামি করিস না, উইঠা আয়।

মেয়েটা উঠে আসে না। খবিরউদ্দিন মিঞা একটু এগোতেই দেখতে পায় রক্তে বালি ভিজে যাচ্ছে। কোনো ভাঙা নৌকা চরে ছিল। নৌকার কোনায় লেগে মাথা ফেটেছে বোধ হয়। খবিরউদ্দিন মিঞা কাছে যেয়ে ধাক্কা দেয়।

: এই মাগী, ওঠ।

কোনো সাড়া না পেয়ে নাকের কাছে আঙুল ধরে। শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে না বুঝতে বেগ পেতে হয় না। মেয়েটা মরে গেছে। কী ভয়ানক বিপদে পড়তে যাচ্ছে অযথায় আজ খবিরউদ্দিন মিঞা। কার মুখ দেখে যে সকালে ঘুম থেকে উঠেছিল। এই ঝামেলা দফারফা করতে হাজার পঞ্চাশেক টাকা বেরিয়ে যাবে।

ঠিক এ সময় মনে হলো কে যেন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার দুই জামাই শাহেদ আর জালাল। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে খবিরউদ্দিন।

: মাইয়াটা কি মইরা গেছে শ্বশুর আব্বা?

জালাল প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় খবিরউদ্দিনের দিকে। খবিরউদ্দিনের মনে হলো সে পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছে ভয়ে।  শাহেদের কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। নিজের শ্বশুর এমন ধরা পড়ে গেছে। চোখের দিকে ঠিক তাকাতে পারছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।

খবিরউদ্দিন ভেবে পায় না কী বলবে। আমতা-আমতা করে বলে

: তোমরা এখানে?

: আপনারে দেখতে আসলাম শ্বশুর আব্বা। ভাবলাম একটু দোয়া নিয়ে যাই।

চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পাগলা কুকুর কামড় দেবার আগে যেমন করে ঠিক তেমনিভাবে ফুঁসছে জালাল। এ চাহনি কোনো মানুষের নয়। জালালের চাহনি যেন কোনো পিশাচের। খবিরউদ্দিন মিঞা যেন ভয় তাড়াতেই চিৎকার করে।

: এই কী করস? কী হইছে তোর? ফাজলামি করিস না।

জালাল ওভাবেই তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলোর সঙ্গে বয়ে এল ঝোড়ো বাতাসের ফিসফিসানি একটা শব্দ। দূর থেকে অনেকগুলি শেয়ালের ডাক আর মাছের দাপানির শব্দ ভেসে আসছে।

খবিরউদ্দিন মিঞা এক কদম করে পেছাতে থাকে। পা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। সরতে চাইছে না। মনে হচ্ছে পা দুটো অসাড় হয়ে গেছে। আর তক্ষুনি চারিদিকটা কেমন অন্ধকার আর শূন্য হয়ে গেল। আর সেই অন্ধকারেই খবিরউদ্দিন মিঞা দেখল একটা ভয়ংকর অবয়ব- তার মাথা বরাবর হাতুড়ি ছুড়ে মারল। তারপর উপর্যুপরি হাতুড়ির বাড়ি। ঘিলু আর রক্তে একাকার। শাহেদ বুঝে উঠতে পারেনি জালাল এমন কিছু করবে। জালালকে থামানোর আগেই দফারফা সারা। মৃতের চোখ দুটি একটু অস্বাভাবিকভাবে বিস্ফোরিত

: এইটা তুমি কী করলা?

: এই ব্যাটা না মরলে রুমি ভাবি কখনো রাজি হবে না বাড়ি বেচতে। এই রক্তের সম্পর্কই টিকা আছে রুমি ভাবির। বাপ বাইচা নাই বাড়ি এখন সে বেচতেই পারে। যাক আপনারে পরে বুঝাই কমুনে। অহন আসেন দুইজন মিল্যা লাশ পদ্মায় ভাসায় দিই পুলিশি ঝামেলায় পরা যাইব না।

শাহেদ আর কী করবে। একটা খুন হয়ে গেল তার চোখের সামনে। ধাতস্থ হতে সময়  লাগবে। জালালের সঙ্গে হাত লাগায় শাহেদ। টেনেহিঁচড়ে লাশটা পানিতে ভাসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই প্রমত্ত পদ্মা গিলে খেয়ে ফেলে খবিরউদ্দিনকে। নদীতে জোছনা যেন গোলে গোলে পড়ছে, লাল রক্তে পানি লালচে হয়ে গেছে,  তার ভিতর একটা লাশ পদ্মার গহিনে হারিয়ে গেলো। হঠাত দৃশ্যটা ভয়ংকর সুন্দর মনে হল। পৃথিবীতে এত সুন্দর দৃশ্য সে আগে দেখেছে বলে মনে হয় না – শাহেদের কাছে।

: আমাদের বন্ধুত্ব আজ পাকা হইয়া গেল শাহেদ ভাই। দু’জন মিল্যা শেয়ারে একটা খুন করছি। আপনি চাইলেও আর আমার সাথ ছাড়তে পারবেন না।

সর্বাঙ্গ ধুলো কাদা মাখা, রক্তাক্ত হাত নিয়ে জালাল শাহেদকে জড়িয়ে ধরল।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত