জীবনযাপন

এখন যখন বিকেলে লাবিব বাসার পথ ধরে ফেরে ; নিকট অতীতের স্মৃতি তার মনের পাতায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এইতো কয়েকদিন আগেও যখন তার একমাত্র বোন মারা যায়নি। পিঠাপিঠি বোন তাই দিনভর খুনসুটি তারপরও দিনশেষে ভাইবোনের কি নিখুত ভালোবাসা। বাড়ি ফেরার সময় অপলক পথের দিকে চোখ দিয়ে রাখে। এই বুঝি তার ভাইটা এলো। সারাদিন কতোটা দকল যায় তার ভাইটার উপর দিয়ে। সেই ভোরে পেট ভরে খেতে পারলো কি পারলো না বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ভোরে স্যারের বাসায় যেয়ে প্রাইভেট পড়ে তারপর কলেজের ক্লাস। ক্লাস শেষে একটা টিউশনি করিয়ে তারপর বাড়িতে ফেরে। তা নিয়ে মায়ের কি রাগ। তবে বাপের আয় দিয়ে সংসার চললেও পড়াশোনার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে যায়। তাই রাগটাও গভীর নয়। লাবিব বলে, সে বড় হয়েছে এখন অন্তত তার কিছু একটা করা দরকার। তবে এইটুকু একটা ছেলে সারাদিন এতো দকল নিতে দেখলে মায়ের মন খারাপ হয়। তারপর নিজের পড়াশোনার চাপ তো আছেই। তারপরও দিনশেষে যখন লাবিব বাসার কাছাকাছি আসতো, তখনও তার বোনটি তার জন্য পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এলেই কতো কথা শোনাত। মাষ্টার সাবের পড়ানো শেষ হইছে কেমনে! আচ্ছারে তোর স্টুডেন্ট ছাত্র না ছাত্রী? নিশ্চয় ছাত্রী তাইনা? তাইতো বলি পড়াতে এতো সময় লাগে কেন। লাবিবের কি রাগ, তোর মাথা। আইছে ছাত্র না ছাত্রী জিগাইতে। যা নাইলে চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। এই তর্কাতর্কির শেষ হয়না তাই মা রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে ধমক দেয়, দুইটাই কি শুরু করলি! সারাদিন দুইটা দুইদিকে পইরা থাকে তাই একটু শান্তি নাইলে আমার এতোদিনে পাগল হয়ে রাস্তায় বের হওয়া লাগতো। আর লাবিব তুই যাতো হাত মুখ ধুয়ে আয় খাবার দিতাছি। 

    এখনও বাড়ির রাস্তাটা, রাস্তার পাশের দোকানটা, পাকা রাস্তার পাশে অল্প মাটিতে সটান দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছটা, দুইরুমের টিনসেড বাড়িটা এবং সেই ছোট্ট বারান্দাটা যেখানে তার বোন তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো সব ঠিক আছে। এসব কিছুর একচুলও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু আজ সেই সবকিছুই কেমন যেনো পরিবেশের সাথে বড়ো বেমানান। ফুল বিহীন কুৎসিত একটি গাছের মতোই সবকিছুই যেনো কেমন কুৎসিত। কারণ সেই ফুলটিই একদিন ঝরে গেছে। যেই ফুল বাড়ির শোভা বর্ধন করতো। এখন এই বাড়ির পথের কাছে আসলে লাবিবের মন খারাপ হয়ে যায়। অলক্ষ্যে তার চোখে পানি আসে। কিন্তু বিধির বিধান পুরুষ মানুষের কাঁদতে নাই। সে গলা ছেড়ে কাঁদতে চায়। কিন্তু জীবন কি আর থেমে থাকে? সময়ের কাটা আর নদীর স্রোতের মতো জীবন বয়ে যায় এবং সকলকে সেই জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে সময় পার করতে হয়। কি আর করার আছে, তাই নিরবে বাড়িতে আসে। ঝগড়া করার কেউ নেই। ঘরে গিয়ে আলতো করে ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখে। অথচ কিছুদিন আগেও এই ব্যাগ রাখা নিয়ে ভাই বোনের কি ঝগড়াই না হতো। লাবিব এসেই ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলতো খাটের উপর। বোনটা বলতো, একটা কিছু তো গোছাতে পারছ না। লাট আহেব আইছে ব্যাগটা টেবিলে গুছিয়ে রাখতে পারে না। ব্যাগ কাপর-চোপর এখানে সেখানে ছড়িয়ে রাখ, আর আমিতো আছিই বান্দি তাইনা! বউ আসতে দে, ঝাড়ু দিয়ে মেরে মেরে ঠিক করবে। তারপর বুঝবে। লাবিব বলে, তোর মাথা; সুটিয়ে লাল করে দেবো। আর, আর তোরে এইসব কে বলতে বলছে! তোরও একটা স্বামী পরবে দেখিছ, কালো টাকলা ইয়া বড়ো বড়ো ভুড়ি। সারাদিন উঠতে একবার, বসতে একবার যখন পেটাবে তখন বুঝবি। বোন বলে, কি, কি বললি, দেখাচ্ছি মজা, আমার স্বামী কালা টাকলা ভুড়িওয়ালা হবে না! দেখাচ্ছি তোরে,,। তারপর যা শুরু হতো সবই বালখিল্য হাসাহাসি, মারামারি চুল ধরে টানাটানি ইত্যাদি ইত্যাদি। রান্নাঘর থেকে মা এসে ধমক দিয়ে দুইটারে আলাদা না করলে হয়তো তা ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম একটি মহাযুদ্ধের রুপ ধারণ করতো। 

    কিন্তু আজ— 

        ঝরে গেছে ফুল, গাছ ব্যাথায় আকুল, তুই ছিলে তখন বাড়ি ছিলো, আমুদ ছিলো, খুশি ছিলো। ভোরের শিশির ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে টুপটুপ করে ঝরে পরতো। আজ তোর হাতে রোপন করা সেইসব ফুলগাছ আছে। যারা এককালে সুবাস ছড়িয়ে বাড়ির শোভা বর্ধন করতো। কিন্তু এখন তারা শুধু একটা মাত্র গাছ। বনজঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষাক্ত, বিবৎস গাছ গুলোর মতোই একটা গাছ। মনে পরে? একবার এই ফুলগাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়তে গিয়ে তোর হাতে কতো মার খেয়েছিলাম। তখন আমি খুব করে কেঁদেছিলাম। মনে মনে তোকে কতোই না বকেছি। অভিশাপ দিয়েছি। একবার পরিকল্পনা করেছিলাম, গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন চুপিচুপি সবগুলো ফুল ছিঁড়ে মাটিতে ছড়িয়ে দেবো। কিন্তু দেখ আজ আমার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি কিন্তু একটি ফুলও আর নেই গাছে। সব ঝরে পরেছে। শেষ অবলম্বন হারিয়ে আজ গাছগুলো মরমর। আজ বুঝতে পারলাম কেন তুই আমাকে ফুল ছিঁড়তে দেখলে মারতে আসতে। সেই ফুলগুলো, গাছগুলো আসলে তোর একটা অংশ। যা তোর অস্তিত্বের সাথে এতোকাল মিশে ছিলো। আজ তুই নেই ফুলগুলোও নেই। কাল গাছও থাকবে না। মূলসহ উপড়ে সব চলে যাবে। সব। আর কিছুই থাকবে না। তোরে একটা কথাতো বলাই হয়নি, আজকাল মায়ের অবস্থা ভালো না। সারাদিন তোর সাথে কথা বলে। মনে মনেই হাসে, কান্না করে। বলে আমি আসবো তোর কাছে, আসবো। আসবো অচিরেই। তুই কি ভালো আছিস! আচ্ছা মারা যাওয়ার পর কি হয়! 

চলবে..

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত