আতর বিবি লেন (২)

করিম বক্সের চায়ের দোকানে বিষম ভীড়। আর একটা লোকও দোকানে দাঁড়াবার মতো যায়গা নেই। বাইরের রাস্তাতেও লোকজন দাঁড়িয়ে; কেউ ভেতরে উঁকি দিতে চাচ্ছে,কেউ কেউ জানে না এখনো ঘটনা কি তাই অন্যদের জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে চাচ্ছে—যদিও এখনো কেউ জানে না আসল ঘটনা কি। এই ভীড়ে তারেকও আছে,সে উদগ্রীবভাবে তাকিয়ে আছে আলমগীর মুহুরীর দিকে। এই জমে থাকা ভীড়ের কারণ যিনি।

মুহুরীর অবস্থা বিশেষ ভালো না। ঠোঁটের দুইপাশে ফেনা জমে আছে,গায়ের শাদা পাঞ্জাবীর নানান যায়গায় নানান ধরনের রক্ত—কাঁচা ও শুকনো কালো। বারবার পানি খাচ্ছেন আর এদিক ওদিক থেকে আসা প্রশ্ন শুনে প্রশ্নকর্তার দিকে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।

দিনটা শুক্রবার,সময় সকাল সাড়ে ছয়।

বন্ধের দিন এমনিতেও বাজার জুম্মার পরে সরগরম হয়,কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। লোকজন সময়ের সাথে আরো বাড়তে লাগলো। মসজিদের সামনেও আছে ভীড়। সেখানেও মানুষজনের জটলা বেশ গোল ধরে মসজিদের সামনে ইট বাঁধানো জায়গা ঘিরে। দুইটা মানুষের লাশ সেখানে। মসজিদের ইমামের ও ভাটপাড়ার মনির মিস্ত্রির। মুয়াজ্জিন হাসানের মুন্ডুহীন লাশ পুকুরের বাঁধানো ঘাটে। সেখানেও জটলা আছে এক পল্লা। পুকুরের সবুজাভ পানিতে হাসানের কাটা মাথা মুখ ডুবিয়ে ভেসে আছে; মাঝে মাঝেই কোনো মাছ এসে ঠোকর দিয়ে যাচ্ছে, তাই দেখে মনে হয়, হাসান বুঝি পুকুরে খেলাচ্ছলে শরীর ডুবিয়ে ভেসে আছে।

মসজিদের দক্ষিন পাশে প্রাইমারি স্কুল আর স্কুলের বিশাল মাঠ। যার একদিকে আম বাগান। সেখানেও জটলা আছে মানুষের। কিন্তু মানুষজন সেখানে বেশিদূর এগোতে পারছে না একটা কুকুরের কারণে। আম বাগানের সবচেয়ে পোক্ত গাছটায় ফাঁসে ঝুলে থাকা হাসমতকে পাহাড়া দিচ্ছে তারই অতি আহ্লাদের পালিত কুকুর। কাউকে কাছে ধারে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। হয়তো সে জানে না এখনো, তার মালিকের আর পাহাড়ার প্রয়োজন নেই।

তারেক ভোর থেকেই বাজারে। পেশায় সে রাজমিস্ত্রী। বর্ষায় তেমন কাজ না থাকলে সে কামলা হিসেবে খাটে। খাটতে সে পারে জ্বীনের মতোন। আজকে বাজারে সে কামলা হিসেবে এসেছে। ভোর বেলায় বাবলা গাছের নিচে দেশি-বিদেশি কামলারা এসে বসে থাকে। যার যাকে প্রয়োজন এসে নিয়ে যায় দিন দরে। তারেকও সেখানে বসে বিড়ি ফুঁকছিলো। কিন্তু হঠাৎ বাজারের এক পাশ থেকে অনেক মানুষের চিৎকার শুনে অন্য সকলের সাথে রওনা হয়েছিলো মসজিদের দিকে। এসে আটকে গেলো করিম বক্সের চায়ের দোকানের সামনে। 

আলমগীর মুহুরী এখনো নির্বাক। লোকজনের ফিসফাস থেকে তারেক যা জানতে পারলো তাতে বোঝা যাচ্ছে আলমগীর মুহুরীই সর্বপ্রথম ফজরের নামাজ পড়তে এসে এইসব ঘটে যাওয়া কর্মকাণ্ড আবিষ্কার করেছেন। স্কুলের পাশের আমবাগান উনারই বাপ-দাদার সম্পত্তি। ভোর বেলায় আমবাগানের ভেতর দিয়ে মসজিদের দিকে আসার সময় কুকুরের আহাজারিতে করে প্রথম দেখতে পান হাসমতের ফাঁসিতে ঝুলে থাকা লাশ। সেখান থেকে কুকুরের তাড়া খেয়ে জান বাঁচাতে দ্রুত মাঠ পেরিয়ে মসজিদে এসে রক্তে পিছলে মাটিতে পড়ে যান—দেখেন আরো দুইটা কাটাছেঁড়া রক্তাক্ত লাশ। সেখান থেকে ভয়ে দৌড়ে বাজারের দিকে দিশেহারা হয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান পুকুরে মুয়াজ্জিন হাসানের কাটা মুন্ডু ও ঘাটে বাদ বাকি শরীর। করিম বক্স চায়ের দোকান খুলতে এসে তার দোকানের সামনে মুহুরীকে অচেতন অবস্থায় পায়। মাথায় এক বালতি পানি দিয়ে হুঁশ আনানোর পর থেকে এখন অবধি তবদা খেয়ে বসে আছেন লাশের মতোনই। 

তারেকের দম ফাটানো হাসি উপচে আসতে চায় সব দেখে শুনে।

তারেকের বাপ ছিলো হরেক কাজের কাজী। কাঠমিস্ত্রীর কাজ,রংমিস্ত্রির কাজ,ক্ষেতখামারি কাজ,চুরি-ডাকাতি কি জানে না সে। তার বাপ বউ পিটানোর জন্যে বিখ্যাত ছিলো। দুইটা বউ পিটিয়ে মেরে ফেলার পর গ্রামের লোকজন আর তাকে বিয়ে করতে দেয় নি। এর মধ্যে তারেকের মা ছিলো দ্বিতীয় বউ,তথা সবচেয়ে ভালো বউ। তারেকের বাপ দ্বিতীয় বউয়ের শোক কখনো ভুলতে পারেনি। 

তারেকের মা যখন মারা যায় তারেক তখন বছর আষ্টেকের বালক। গ্রামের আনাচে কানাচে যতো গাছ আছে সব ছিলো তার চেনা। অই বয়েসেই এলাকায় তারেকের নামডাক ছিলো বিখ্যাত চোর হিসেবে। 

এই আলমগীর মুহুরীর কথাই ধরা যাক। অত্র এলাকায় উনার চেয়ে কিপ্টে লোক আর আছে কি না খুব সন্দেহের বিষয়। মুহুরীর সম্পর্কে এলাকায় কথ্য আছে যে যদি পায়খানায় এক টাকার পয়সা পড়ে যায় তবে তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে তুলতেও দ্বিধা করবেন না।

তারেকের বয়েস তখন দশ। মুহুরীর বড় মেয়ে সুমীর বিয়ে। মুহুরীর বাড়ির বিশাল উঠানে শামিয়ানার নিচে হাজারে বিজারে লোক খাচ্ছে। শামিয়ানার এক পাশে সাড়ি সাড়ি দইয়ের পাতিল। তারেক আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলো সেখানে। পড়নে একটা মুমূর্ষু হাফপ্যান্ট ছাড়া খোদার দেয়া কংকালসার শরীরে আর কিছু নেই।

হঠাৎ মুহুরী তদারকি করতে দইয়ের পাতিলের কাছে এসে দেখেন,একটা পাতিলের দইয়ে বিশাল গর্ত—অর্থাৎ কেউ দুই হাতে কোষ করে দই নিলে যেমন হবে তেমন। আর মাটিতে ফোঁটা ফোঁটা দই দেখাচ্ছে হাতের মালিক কোথায় যেতে পারে। মুহুরীর হাতের লাঠি কষে ধরে দইয়ের ফোঁটা অনুসরণ করে গিয়ে দেখেন পশ্চিম ভিটার পেছনে লুকিয়ে তারেক হাতের দই চাটছে। সেদিন সময়মতো লোকজন এসে না ধরলে দই চুরির অপরাধে মুহুরী তারেককে পিটিয়ে মেরেই ফেলতেন। তারেকের বাপ ছগির মিয়া আলমগীর মুহুরীর দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই। তারেকের বাপ সেইদিন সন্ধ্যা বেলায় তারেকের হাত ধরে মুহুরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো,কদ্দুর দইয়ের জন্যে পোলার হাত ভাঙ্গলেন ভাইসাব। কাজটা ভালো করলেন না।

মুহুরী ও তার বড় দুই সুপুত্র ছগির মিয়ার দুঃসাহস দেখে মোটেও সন্তুষ্ট না হয়ে, বরং চোরের মায়ের বড় গলা ইত্যাদি বলে ও সাথে অকথ্য গালিগালাজ করে খেদিয়ে দিয়েছিলো।

ফেরার পথে তারেকের আজো স্পষ্ট মনে আছে তার বাপ বলেছিলো,পুতরে—ডিম পারে হাঁসে,খায় বাঘডাঁশে। এইযে সম্পত্তির ঠাট,এগুলা বেশিদিন থাকবো না। অপেক্ষা কর।

 

তারেকের বাপ তাকে দই চুরির চেয়েও ক্ষুদ্রতম অপরাধে এর চেয়েও বেরহম ভাবে মেরেছে বহুবার। কিন্তু মুহুরী সেইদিন মারার পর ছগির মিয়া মুহুরীকে শাসানি দিয়েছে বলে,তারেক বেশ অনেক দিনের জন্যে তার বাপকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো। যতোদিন না তার মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে ছগির মিয়া।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত