ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—১

‘পুরনো ল্যাপটপ বেচতে পারবেন, পুরনো কম্পিউটার বেচতে পারবেন, পুরনো মোবাইল বেচতে পারবেন, পুরনো গাড়ি বেচতে পারবেন, পুরনো জামাই বেচতে পারবেন!’
মালেকা বিবি ধড়ফড় করে উঠে এক লাফে বারান্দায় চলে গেল। চারতলার বারাব্দা থেকে উৎসুকভঙ্গিতে নীচের দিকে তাকাল।
তখনো লোকটি হ্যান্ড-মাইক মুখের সামনে ধরে মাইকিং করে চলেছে—‘পুরনো কম্পিউটার, ল্যাপটপ, গাড়ি, হারমোনিয়াম, ব্ল্যান্ডার, তালা-চাবি এমনকি পুরনো জামা বেচতে পারবেন!’
মালেকা বিবি ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর ঘরে চলে গেল।
বিছানায় মাথা ঠেকাতেই খুকখুক করে কেশে উঠল কেরামত আলী। ঠিক কাশি নয়, বলা ভালো—গলা খাঁকারি। এ ধরনের বিরক্তিকর গলা খাঁকারি কেরামত আলীদের বংশগত অভ্যাস। মালেকা বিবির শ্বশুর মৃত হুরমত আলী, দুই চাচাশ্বশুর যথাক্রমে— নওয়াজ আলী, জাফর আলী এমনকি—কেরামত আলীর খালাত ভাই বশিরুল্লাহর মধ্যেও এই বদাভ্যাস রয়েছে। বংশগত বদাভ্যাস কেরামত আলীর বাবার পক্ষে থাকবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু মায়ের পক্ষ অর্থাৎ কেরামত আলীর খালাতভাই বশিরুল্লাহ পর্যন্ত কীভাবে ছড়িয়েছে—এটা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার।
মালেকা বিবি এ ব্যাপারে প্রচুর কথা শুনিয়েছে কেরামত আলীকে, প্রচুর খোটাও দিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই তার অভ্যাস বদলায় নি। সুযোগ পেলেই সে খুক করে একটি কাশি মেরে দেয়।
এদের চলমান এই বদাভ্যাস দেখলে মালেকা বিবির চির-পরিচিত প্রবাদটি মনে পড়ে—‘ইল্লৎ যায় না ধুইলে, খাসলৎ যায় না মইলে।’—তাই সে একরকম মেনেই নিয়েছে,—যতদিন বেঁচে আছে—এই অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হবে।
মালেকা বিবি বলল, ‘কি গো, তুমি কি জেগে?’
কেরামত আলী বলল, ‘না জেগে কি উপায় আছে?’—বলে আরো একটি কাশি দিল।
মালেকা বিবি তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাল, ‘কেনে, আজ ঠাণ্ডা জল তো দিই নি বিছানায় ঢেলে?’
‘না না না। রোজ তো দাওই ঠাণ্ডা জল। আজ দিয়েছ গরম। প্রীত প্রীত!’
মালেকা বিবির সদ্য ঘুম-ভাঙা ভারি মুখেও নির্ভেজাল হাসির রেখা ফুটে উঠল, ‘ও তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ গো—হ্যাঁ!’
‘তাহলে কাশি কেনে?’
‘কাশি তো নয়;—এ হল—প্রীতিপ্রকাশ।’
‘ও তাই বল!’
মালেকা বিবি স্বস্তিমতো মাথা ঠেকাল বালিশে। আর তখনই সে অস্ফূট-কাতর স্বরে মৃদু শব্দ করে উঠল, ‘আহ!’
‘সকাল সকাল বাতের ব্যথা উঠল বুঝি?—কেরামত আলী চিন্তিত হয়ে জানতে চাইল।
মালিকা বিবি উত্তর করল না।
কিন্তু কেরামত আলী ঠিকই বুঝে নিল—তার স্ত্রীর বাতের ব্যথা উঠেছে। বলল, ‘টিপে দেব কি পা?’
‘দিলে তো ভালোই হয়।’
‘আচ্ছা দিচ্ছি।’
কেরামত আলী শোয়া থেকে উঠে বসল। লম্বা একটা হাই তোলার সাথে আড়মোড়া ভাঙল আয়েস করে। গায়ে দেওয়ার পাতলা কাঁথাটা দ্রত ভাজ করে বালিশের উপর বিছিয়ে রেখে বিছানা থেকে নামতে যাবে এমন সময় তার পাজামা টেনে ধরল মালেকা বিবি।
‘যাচ্ছ কোথা? ফাঁকি দেওয়ার ফন্দি, তাই না?’
‘আরে ফাঁকি নয়—ফাঁকি নয়! এই যে এটা…’—কেরামত আলী তার উত্থিত মধ্যমা প্রদর্শন করল।
ঘটনার আকস্মিকতায় মালেকা বিবি মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘ওমা! ওটা কেনে?’
কেরামত আলী কিঞ্চিৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একবার মালেকা বিবির দিকে আর একবার নিজের হাতের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল, মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে উত্থিত মধ্যমা নামিয়ে কনিষ্ঠা ওঠাল। এমনভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল যার অর্থ হল—আগে ভুল দেখানো হয়েছে। এখন সঠিক।
মালেকা বিবি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘বোকার হদ্দ। মরলেও মানুষ হবে না!’

কেরামত আলী প্রক্ষালন কক্ষে চলে যাওয়ার পর ফোনকলের আমন্ত্রণে তার মোবাইলখানা থিরথির করে কাঁপতে লাগল। এ-ধরনের অনাবশ্যক কাঁপুনি মাালেকা বিবির জন্য বিরক্তিকর। এর চেয়ে রিঙটোন ভালো।
মালেকা বিবি হাত বাড়িয়ে মোবাইলখানা হাতে তুলে নিল। মোবাইলের গালের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে লেখা উঠেছে, ‘বশিররুল্লাহ কলিং।’
সে যাওবা একবার ভেবেছিল অতি জরুরি কোনো ফোনকল হলে রিসিভ করবে কিন্তু যখন কেরামত আলীর পক্ষের কোনো জ্ঞাতি ভাইয়ের নাম দেখল তখন প্রচণ্ড বিরক্তিতে তার কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। ফলে কাঁপন্ত মোবাইলখানার ঘাড় ধরে কুদরত আলীর বালিশের তলে ঠেলে পাঠাল।

কেরামত আলী ঘরে ফিরে মালেকার বাম পা রেখে ডান পায়ে হাত বোলাতে লাগল।
মালেকা বিবির মেজাজ টং করে সপ্ত আসমানে উঠে গেল। বলল, ‘আরে! ডান পা কেনে? বাত কি আমার ডান পায়ে নাকি বাম পায়ে?’
কেরামত আলী সঙ্গে সঙ্গে বাম পায়ে স্থানান্তরিত হল। আলতোভাবে পা টিপতে লাগল। এতে মালেকার রাগ সপ্ত আসমানে ছুটোছুটি করতে করতে অষ্টম আসমান খুঁজতে লাগল। বলল, ‘তুমি আমায় সুড়সুড়ি দিচ্ছ কেনে?’
কেরামত আলী অবাক হয়ে বলল, ‘সুড়সুড়ি দিচ্ছি কোথায়! টিপে দিচ্ছি তো।’
‘এই কি তোমার পা টেপা? হাতে দেখি একটুও জোর নেই? বলি—কাল রাতে খাও নি কিছু? সরষে ইলিশের সাথে কচুর লতি খাওয়ালাম। সজনে পাতার শাক দিয়ে মশুরি ডাল খেলে। আর এত্তগুলো চ্যাংটাকি ভর্তা, বলি, কে খেয়েছে ওগুলো? সব কি তোমার পেটে না গিয়ে তবে শকশোর পেটে গিয়েছে?’
কথার পৃষ্ঠায় কথা বললে কথা বাড়ে তাই কেরামত আলী কিছু বলল না। বরং নব টিপে পাওয়ার বাড়ানোর মতো এক নিমেষে নিজের হাতের জোর বাড়িয়ে দিল। কোনোরকম বিরতি না-দিয়ে মালেকার পা টিপে দিতে লাগল।
শান্ত হল মালেকা।
কিন্তু ঘুমের ঘোরে কিংবা মনের ভুলে পা টিপতে টিপতে কেরামত আলী উঠে এল মালেকার হাঁটুর ওপর।
মালেকা বিবি সঙ্গে সঙ্গে খেঁক করে উঠল, ‘আহ! হাঁটুর উপরে আসছ কেনে?’ এদিকে তো ব্যথা নেই।’
কেরামত আলী নিজের ভুল বুঝতে পেরে, যেভাবে উপরে উঠে এসেছিল ঠিক সেভাবেই নেমে গেল হাঁটুর নিচে।
মালেকা বিবি হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘হয়েছে বাবা—অনেক হয়েছে! এরই মধ্যে তুমি মহাভারতের কয়েক পৃষ্ঠা রচনা করে ফেলেছ। এবার ক্ষান্ত দাও বাপু। কে যেন তোমায় ফোন করেছিল। মোবাইলখানা দ্যাখো।’
কেরামত আলী মনে মনে এ-রকম কোনো কাজের ছুতোই খুঁজছিল—যাতে সে চরম বিরক্তিকর পা টেপা ইস্তফা দিয়ে ভাগতে পারে। তাই মোক্ষম সময়ে মোক্ষম খবরটি দেওয়ার জন্য মনে মনে মালেকা বিবিকে একটি ধন্যবাদ দিল।

বশিরুল্লাহ নামটি দেখামাত্র কেরামত আলী ফিরতি ফোন করল।
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেই বশিরুল্লাহ বলল, ‘দাদা আগামি শুক্রবার বিবাহ। বরযাত্রী রওয়ানা দেবে বাদ জুম্মা। বরযাত্রী হিসেবে তোমাদের দুজনের নাম লিস্টে আছে। তোমরা অবশ্যই বৃহস্পতিবারের মধ্যে চলে আসবে, কেমন?’
কেরামত আলী বলল, ‘সে না-হয় আসব কিন্তু কার বিবাহ সে ব্যাপারে তো কিছুই বললি না?’
বশিরুল্লাহ অবাক হয়ে বলল, ‘এটা তুমি কেমন ধাঁচের কথা বললে দাদা? এই সাত সকালে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে বশিরুল্লাহ অন্যের বিবাহের নিমন্ত্রণ দিতে যাবে কোন আল্লাদে?’
‘ও! তারমানে তুই নিজেই বিবাহ করছিস?’
‘তো কে?’
‘কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন ছিল কি?’
‘ও মা! এ আবার কী বলছ দাদা? এই বিবাহের জন্যে আমার জীবন তামা তামা হয়ে গেল আর তুমি বলছ এর প্রয়োজন ছিল কি-না? ছি দাদা—ছি! তোমার কাছ থেকে এ-ধরনের কথা শুনবার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।’
‘আহা রাগ করছিস কেনে? আমি তোর বড় ভাই। আমি কি তোর খারাপ চাইতে পারি, বল?’
‘কী যে ভালোটা চাইছ— সে তো তোমার কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুমি নিজে বিবাহ করে ভাবীকে নিয়ে সুখের সায়রে ভেসে বেড়াচ্ছ অথচ ছোট ভাইয়ের বিবাহের সংবাদ শুনে খুশি হতে পারছ না। আমার প্রতি তোমার কিসের এত হিংসে, বল তো কেরামতদা?’
‘আরে তুই আমাকে ভুল বুঝছিস রে বশিরুল্লাহ— তোর উপর আমার কোনো হিংসে নেই, তোর খারাপটাও আমি চাইছি না—বরং বলতে চাইছি— সেই কবেই না তোর বিবাহের বয়েস পার হয়ে গিয়েছে; তোর মাথায় হালকা ছিট ছিল বলে পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না—এভাবেই না তোর বয়স চল্লিশ পেরুল—তাই বলছি—এই নবুয়াতের বয়সে আর বিবাহের কী দরকার ছিল? আর কদিন পর তো এমনিতেই সব সাঙ্গ হয়ে যাবে।’
‘দ্যাখো দেখি—আমার খালাত ভাইয়ের কথা শোনো! তা কবে আমার মাথায় ছিট ছিল? এসব অলক্ষণে কথা তুমি কোথায় পেলে? আর আমার বয়েসইবা চল্লিশ পেরুল কবে? না, দাদা—আমি তোমার এসব আজগুবি কথাবার্তা একদমই নিতে পারছি না। তুমি তো দেখছি—ঢাকায় গিয়ে একেবারে বদ লোক হয়ে গিয়েছ! লোকে তবে ঠিকই বলে, ঢাকায় গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না—চিটার-বাটপার হয়ে যায়। থাক। তোমার সাথে আর কথা নয়। রাখি।’
‘আরে শোন শোন। ফোন রাখিস না। আমার কথা শেষ করতে দে। তারপরে রাখবি।’
‘জলদি কথা শেষ কর!’
‘বশিরুল্লাহ ভাই আমার—জাদু সোনা! আমি যদি মনের অজান্তেও তোর মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকি আমাকে ক্ষমা করে দিস। এখন বল—কোথায় তোর বিবাহ হচ্ছে?’
বশিরুল্লার মন মোমের মতো নরম। একটু আগে খুব অভিমান করেছিল। কিন্তু এখন অভিমান ভেঙে ভীষণ আনন্দিত ও লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘পাত্রী তোমাদের ঢাকাতেই থাকে।’
‘বলিস কী!’
‘হ্যাঁ। দেখতে অতি সুন্দর। টানা টানা চোখ। লম্বাটে নাক। একহারা লম্বা। চিকনি চামেলির মতো দেখতে।’
‘তাই!’
‘হ্যাঁ। তা তুমি চিকনি চামেলিকে চেনো তো কেরামতদা?’
‘তুই কি রঘনাথপুরের চানমাঝির ছোটবোনের কথা বলছিস?’
‘আরে ধুর! কিয়ের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি।’
‘তাহলে সে কোন চামেলি?’
‘ও খোদা! তুমি যদি চিকনি চামেলিকেই না চেনো তাহলে তোমার ঢাকায় গিয়ে কী লাভটা হল? তোমার অবস্থা তো দেখছি খুবই শোচনীয়। আমরা বরং অজপাড়ায় থেকেই তোমার চে বেশি জানতে পেরেছি। সে যাকগে। তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?’
‘না, এখনো শেষ কথাটা বাকি আছে রে।’
‘বলে ফেল। আমার হাতে একদমই সময় নেই। বোঝই তো বিয়ে-শাদির মৌসুমে ছেলেদের কেমন ব্যস্ততা যায়।’
‘না মানে বলছিলাম যে, আমাকে তো নিমন্ত্রণ করলি—তোর ভাবীকে নিমন্ত্রণ করবি না?’
‘ওমা! এ আবার কী বলছ দাদা? ভাবীকে তো প্রথমেই নিমন্ত্রণ করলাম।’
‘না না সেটা করেছিস ঠিক আছে। কিন্তু একবার তাকে হ্যালো বলে নিমন্ত্রণ করলে বেশি ভালো হত না?
‘ও বুঝতে পেরেছি। একজনকে বললে হচ্ছে না। দুজনকে আলাদা আলাদা বলতে হবে। অর্থাৎ তোমাদের দুজনের মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে—এই তো?’
‘আহা ইউক্রেন-রাশিয়া হবে কেনে? কখনোই সে আশঙ্কা নেই। আমাদের দুজনের সম্পর্ক হল—মধুর সম্পর্ক। আমরা একজন আর একজনকে ছাড়া অচল। কেউ কাউকে রেখে কোথাও যাই না। কেউ কাউকে রেখে খাই না পর্যন্ত। এমন মধুর সম্পর্ক তুই সচরাচর দেখতে পাবি না।’—স্ত্রী-কীর্তনমূলক কথাগুলো বলতে বলতে কেরামত আলী খুব আগ্রহীভঙ্গিতে মালেকার দিকে তাকিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। কারণ—এসব স্তুতি বাক্যের একটি শব্দও স্ত্রীর কর্ণ-কুহরে প্রবেশ করে নি কেননা ততক্ষণে সে ঘুমের দেশে হারিয়ে গিয়েছে।
ফোনের ওপাশ থেকে বশিরুল্লাহ বলে উঠল, ‘দাদা, আর কটা দিন পরেই দেখতে পাবে—আমার আর পুতুলের মধ্যে তোমাদের চেয়েও গভীর সম্পর্ক—এই বলে রাখলাম—হ্যাঁ!’
‘ও আচ্ছা—তা তোর হবু বঁধূর নাম বুঝি পুতুল?’
‘তাহলে আর বলছি কী!’
‘বাহ! ভারি সুন্দর নাম। খুব পছন্দ হয়েছে নামটি।’
‘ভেতরে ভেতরে তুমি আবার লোভ করছ না তো দাদা?’
‘ছি ছি! কী বলিস যা-তা। তুই আমার ছোটভাই। তোর বউয়ের প্রতি আমি লোভ করব কেনে?’
‘বুঝে-শুনে বলছ তো?’
‘আহা আমার একজন সুন্দরী বঁধূ আছে না? একজন থাকতে অন্যের জিনিসের দিকে আমি নজর দেব কেনে রে বোকা?’
‘সে তুমি যাই বল—পুরুষ মানুষ দিয়ে কি বিশ্বাস আছে? তারা তো সুযোগ পেলেই অন্যের বউয়ের সাথে লটরপটর শুরু করে দেয়। বল—দেয় না?’
‘তা হয়তো কেউ কেউ দেয় তাই বলে দুনিয়ার সব পুরুষকে এক পাল্লায় মাপিসনে ভাই।’
‘ঠিক আছে কেরামতদা। কথা আর বাড়াব না। এবার ভাবীর ফোন নাম্বারটা দাও। আমি এক্ষুনি তাকে ফোন করে নিমন্ত্রণ পৌঁছে দিচ্ছি।’
‘নাম্বার দিতে হবে না। সে আমার সামনেই আছে।’
‘তাহলে তাকে ফোনটা দাও।’
‘দাঁড়া দিচ্ছি।’
কেরামতত আলী খুব মোলায়েম কণ্ঠে বলল, ‘এ্যাই শুনছ গো, বশিরুল্লাহ তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইছে, সামনে ওর বিবাহ…তাই ও তোমাকে নিমন্ত্রণ করবে…নাও, ওর সাথে দুটো কথা বল!’
মালেকা বিবির নড়নচড়নের কোনো আলামত লক্ষ করা গেল না।
কেরামত আলী হালকামতো মালেকা বিবির কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘মালেকা! এ্যাই মালেকা—শুনছ গো! বশিরুল্লাহর সঙ্গে দুটো কথা বল। তোমার সাথে দুটো কথা বলতে পারলে আমি নিশ্চিত ওর খুব ভালোলাগবে।’
কেরামত আলীর ঠেলা-ধাক্কা আর অনর্গল কথার কেওয়াসে কাঁচাঘুম ভেঙে যাওয়ায় মালেকা বিবি খেঁক করে উঠল, ‘গুতোচ্ছ কেনে? বলি—এত গুতোনোর কারণটা কী? বাতের ব্যথায় সারারাত ঘুমোতে পারি নি—এখন চোখে একটু নীদ এসেছে; তাও কি তোমার সহ্য হল না? বলি—আমি একটু ঘুমোলেই তোমার মাথায় ঠাডা পড়ে কেনে? আমায় ঘুমাতে দেখলে তোমার মাথায় কিরা ওঠে নাকি পেছনে গুঁড়া কিরমিতে কামড়ায়?’
এই রে! বশিরুল্লাহ নিশ্চিত মালেকার সব কথা শুনছে। ফলে কেরামত ভাবল—মালেকা এখানেই ক্ষান্ত দিক। আর কিছু না বলুক। সে অপরাধীর মতো অনুনয় করে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে—ঠিক আছে। তুমি বরং ঘুমোও। আমি বশিরুল্লাহকে বলে দিচ্ছি—তুমি ঘুমোচ্ছ!’
মালেকা বিবি ছো মেরে কেরামতের হাত থেকে মোবাইলখানা নিয়ে বলল, ‘তা আর বলতে হবে না। আমি নিজেই ওর সঙ্গে কথা বলছি।’
ঘটনা কী থেকে কী হয়ে গেল—সেটা ভেবে কেরামত আলী ভীতু বেড়ালের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।
মালেকা বিবি বলল, ‘কেমন আছ বশিরুল্লাহ!…না না, নতুন করে আর কিছু বলতে হবে না। আমি সব শুনেছি। তোমার বিবাহের কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু জানো তো ভাই, আমার ভীষণ বাতের ব্যথা। একবার বসলে উঠতে পারিনে। উঠলে আবার বসতে অসুবিধে। তাই আমি যেতে পারছিনে। তোমার ভাইকে পাঠিয়ে দেবখন। তুমি এবারের মতো আমায় মাফ করে দাও ভাই।’
‘সে না-হয় বুঝলাম ভাবী, কিন্তু বিবাহ তো বারাবর করবার জিনিস নয়—একবার হয়ে গেলে আর হবে না!’—বশিরুল্লাহ বলল।
মালেকা বিবি বলল, ‘বুঝতে পেরেছি ভাই—কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই যেতে পারছিনে। বিয়েটা হয়ে যাক। পরে একদিন না-হয় তোমাদের সাথে দেখা হবেখন। আমি তোমাদের জন্য অগ্রিম শুভকামনা জানিয়ে রাখছি। তোমাদের দাম্পত্য জীবন মধুর হোক।’
‘ঠিক আছে ভাবী। ভালো থাকবেন। শরীরের যত্ন নেবেন।’

মালেকা বিবি মোবাইলখানা রেখে চোখ বন্ধ করল।
কেরামত আলী ভাবল, হয়তো অল্পের জন্য ইজ্জতটা রক্ষা হল যেমন করে কান ছুঁয়ে গুলি উড়ে যায়।
মিঁউমিঁউ স্বরে বলল, ‘আবার দেব কি?’
মালেকা বিবি বলল, ‘দাও।’
পা টিপে দেওয়া হল বড় একটি অস্ত্র। মালেকা যতই রেগে থাক, কেরামত যদি একবার মুখ ফুটে বলতে পার— পা টিপে দেব কি,—সঙ্গে সঙ্গে মেঘ গলে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। তাই কেরামতও এই সুযোগটা নেয়।
খুব মোলায়েমভাবে মালেকা বিবির পা টিপে দিতে দিতে মিহি স্বরে বলল, ‘তুমি যদি না যাও তবে আমি যাব কেনে?’
পা টেপার সুখে মালেকা এখন শান্ত। তাই কণ্ঠও ঝাঁঝহীন, ‘আমার তো বাতের ব্যথা। তোমার সমস্যা কী?’
‘সমস্যা একটাই। সেটা তুমি জানো।’
‘না। আমি জানিনে!’
‘জানো না বললেই হবে কেনে? তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না?’
‘ওরে আমার আল্লাদ রে! আমি সারারাত বাতের ব্যথায় ছটফট করি। তুমি তো ঠিকই নাক ডেকে ঘুমাও!—কই, কখনো কি জিজ্ঞেস কর—আমি ঘুমাতে পারছিনে কেনে?’
‘দ্যাখো—মিথ্যে বলব না। মিথ্যে বলা পাপ হবে। আসলে হয়েছে কী—ঘুমোলে আমার কোনোদিকে খেয়াল থাকে না। তাই পেরে উঠি না।’
‘হয়েছে বাবা হয়েছে—আর তোমার ঘুমের দোহাই দিতে হবে না।’
‘তারমানে আমি একাই যাচ্ছি?’
‘সে তুমি যা ভালো মনে কর। এ নিয়ে আমি আর কথা খরচ করতে চাইছিনে। তবে তোমার প্রতি আমার একটাই কথা—ওখানে গিয়ে আবার কোনো ঝামেলা বাধিয়ো না।’
‘নিশ্চয়—নিশ্চয়!’

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত