ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—৪


সাংবাদিক তরুণটি—নাম জাফরুল্লাহ জায়েদ—এতক্ষণ কামরাঙা গাছের তলে দাঁড়িয়ে বশিরুল্লাহর মায়ের ক্রন্দন দৃশ্য ধারণ করছিল। এর আগে সে ড্রোনের সাহায্যে এ-বাড়ির টপ ভিউ দৃশ্য ধারণ করেছে। গাছাগাছালি ঘেরা বাড়িটার টপ ভিউ চমৎকার। আশা করা যাচ্ছে—এই খুনের সংবাদের ভেতর দিয়ে তার অভিষেকটা দারুণ হবে।
সে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের থানা প্রতিনিধি। এতদিন স্থানীয় পত্রিকায় বিনা বেতনে সাংবাদিকতা করেছে। পাশাপাশি ইউটিউবে তার একটি নিউজ চ্যানেল রয়েছে। সেখানে সে আলোর মুখ দেখতে না-পাওয়া খবরগুলো পরিবেশন করে থাকে।
দারোগা বাবু তার পূর্ব পরিচিত। ফলে বেঢপ মাইক্রোফোনটি তার সামনে ধরতেই দারোগা বাবু বললেন, ‘অপরাধী যেই হোক—তাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে। তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচার কাজ সম্পন্ন হবে। আইনের চোখে সবাই সমান।’
সাংবাদিক জাফরুল্লাহ জায়েদ প্রশ্ন করল, ‘আগামিকাল যার বিয়ের ডেট ছিল, তাকে কেন মরতে হল?’
‘সেটা আমি কেমন করে বলব? আমি তো এ ব্যাপারে অবগত নই।’—কিঞ্চিৎ ভড়কে গিয়ে উত্তর দিলেন দারোগা বাবু।
সাংবাদিক বলল, ‘সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেফতার করতে পেরেছেন কি?
‘গ্রেফতারের জোর চেষ্টা চলছে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ অলরেডি কাজ করছে। আশা করছি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামি গ্রেফতার হয়ে যাবে।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ।’

তারপর সাংবাদিক জাফরুল্লাহ জায়েদ দাঁড় করিয়ে রাখা মোবাইল ক্যামেরার অপশন পরিবর্তন করে নিজের ছবি ধারণ করাল। সংবাদের এন্ডিং সেগমেন্টে হড়হড় করে বলতে লাগল: একটি খুনের ঘটনায় কদমতলায় নেমে এসেছে কালো মেঘের ঘন ছায়া। এ এলাকার মানুষরা ভীতসন্ত্রস্ত সময় পার করছে। অতিসত্ত্বর এই খুনের বিচার হবে—এটাই কদমতলাবাসীর দাবি। কুষ্টিয়ার আলডঙ্গার কদমতলা থেকে জাফরুল্লাহ জায়েদ।
তরুণ সাংবাদিকের সংবাদ সংগ্রহ করা এখানেই শেষ।

কেরামত আলী এগিয়ে গেল সাংবাদিকের দিকে। বলল, ‘সাংবাদিক সাহেব! আমি কি আপনার সাথে দুটো কথা বলতে পারি?’
‘তা পারেন—কিন্তু তার আগে দারোগা স্যারের থেকে আমি বিদায় নিয়ে নেই?’
কেরামত আলী বলল, ‘নিশ্চয়।’

সাংবাদিক দারোগা বাবুর কাছে যেতেই দারোগা বাবু বললেন, ‘আজকের ইন্টারভিউ কেমন হল?’
তরুণ সাংবাদিক বাহবা দিয়ে বলল, ‘দারুণ হয়েছে স্যার—মারদাঙ্গা! ফাটাফাটি!’
প্রশংসা পেয়ে গদগদ হেসে দারোগা বাবু বললেন, ‘বানিয়ে বলছেন না তো?’
‘আরে না স্যার। আপনার কি মনে হয় আমি বানিয়ে বলব?’
‘তা মনে হয় না। কিন্তু এটাও বিশ্বাস হয় না, আমি ভালো বলেছি।’
‘না স্যার। টিভিতে দেখলেই বুঝতে পারবেন। ম্যাডামের থেকে মন্তব্য নিয়েন। দেখবেন—ম্যাডাম আপনার প্রশংসা করতেছেন।’
দারোগা বাবু আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘আর ম্যাডামের প্রশংসা! সে আশায় গুঁড়েবালি।’
‘কেন স্যার?’
‘বললে তো বিশ্বাস করবেন না। তারপরও বলি—আমি যদি শাহরুখ খানের মতোও ইন্টারভিউ দেই আপনার ম্যাডাম দেখে বলবে—ফালতু। বলবে—আমার কোনো কথাই হয় না।’—বলে হো হো করে হেসে বললেন, ‘যাইহোক। এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? বসেন। কোক খান।’
‘না স্যার। সংবাদটা ধরাতে হবে। আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।’
‘ঠিক আছে। আপনাকে আর না আটকাই। যান তাহলে। পরে কথা হবে।’
‘জি স্যার। স্লামালিকম।’

সাংবাদিক চলে যাচ্ছিল, কেরামত আলী তাকে ডেকে থামাল।
সাংবাদিক বলল, ‘ও স্যরি ভাই! আপনার কথা ভুলে গেছিলাম। বলেন ভাই, কী বলবেন?’
কেরামত আলী সাংবাদিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার নাম কেরামত আলী। এ্যাসিসটেস্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার, ঢাকা।’
‘ও আচ্ছা। কী বলবেন—বলেন?’
‘বশিরুল্লাহ আমার সাক্ষাৎ খালাত ভাই।’
‘ও আচ্ছা।’
‘একজন জলজ্যান্ত মানুষ, রাত্রি পোহালেই যার বিবাহ করতে যাওয়ার কথা—সে কীভাবে খুন হয় সাংবাদিক সাহেব?’
সাংবাদিক বলল, ‘সেটাই।’
কেরামত আলী বলল, ‘আপনার কি মনে হয় ভাই? খুনী কি ধরা পড়বে নাকি পড়বে না?’
‘অবশ্যই ধরা পড়বে।’
সাংবাদিক বুঝতে পারল—ইনার মিঁউমিঁউ টাইপ কথাবার্তায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। ফলে সে তাকে অ্যাভোয়েড করার জন্য ফেসবুকে ঢুকল। সুচারুভাবে আঙ্গুল চালাতে লাগল নিউজ ফিডে।
কেরামত আলী বলল, ‘এই খুনের পিছনে নিশ্চয় পূর্বপরিকল্পনা ছিল—আপনি কী মনে করেন?’
‘অবশ্যই। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া কোনো খুন করা সম্ভব না।’
‘আপনি একদম ঠিক বলেছেন সাংবাদিক সাহেব। আমার ধারণা—এই খুনের হোতা নিশ্চয় কোনো সংঘবদ্ধ চক্র।’
‘সেটাও হতে পারে।’—সাংবাদিক জাফরুল্লাহ জায়েদ বিরক্ত হয়ে বলল।
কেরামত আলী বলল, ‘আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন কি?’
‘না না বিরক্ত না—কিন্তু আপনি কী বলতে চাইছেন—সেটা বুঝতে পারছি না।’
‘আমার খালাত ভাই নিখাঁদ ভালো মানুষ। তার নামে কোনো বদনাম নেই। কোনো মামলা নেই। কারো সাথে তার কোনো শত্র“তাও ছিল না। তাহলে সে কেন খুব হল, বলতে পারেন?’
‘আমি খুবই দুঃখিত ভাই। নিউজ ধরাতে হবে। যাই।’
সাংবাদিক জাফরুল্লাহ জায়েদ চলে গেল।

কেরামত আলীর মনে হল—সাংবাদিক ঠিকই বলেছেন। অর্থাৎ—এই খুনের ব্যাপারে কেরামত আলী আসলে কী বলতে চাইছে?
একটু আগে সে দারোগার কাছে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল—বলতে পারে নি। মেম্বর সাহেবকেও কিছু বলতে চেয়েছিল—বলতে পারে নি। এটা তার একটা বিশেষ সমস্যা বটে। চিন্তাগুলো গুছিয়ে তুলতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে—কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না।

দারোগা বাবু হাত ইশারায় কেরামত আলীকে ডাকলেন।
কেরামত আলী তাঁর কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘ময়না তদন্তের জন্য আমরা এখন লাশ নিয়ে যাব।’
কেরামত আলী বলল, ‘তাহলে আমার খালাকে সামাল দেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে স্যার।’
‘যতই কঠিন হোক। আমার ধারণা—আপনি তাকে সামলাতে পারবেন।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’
‘গুড।’
‘আমার একটা অনুরোধ রাখবেন স্যার?’
‘বলেন—শুনি।’
‘আপনি যদি কিছু সন্দেহভাজন মানুষের সাথে কথা বলতেন, আমার ধারণা দুএকটা ক্লু পেয়ে যেতেন।’
‘সুন্দর প্রস্তাব। তা আপনি সন্দেহভাজন মানুষের লিস্ট দেন। আমরা তাদের জেরা করি।’
‘লিস্ট তো আমার কাছে নেই।’
‘কার কাছে আছে?’
‘আমার খালার কাছে আছে।’
‘তাহলে আপনি আপনার খালার সাথে কথা বলেন।’
‘ঠিক আছে। আমি যাই—খালার সাথে কথা বলি গিয়ে।’

সন্দেহ করার মতো কাউকে পেল না কইতরি বেগম।
বশিরুল্লাহ সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাত। তার কোনো কাজ ছিল না। কোনো কাজ পারতও না। টিভি দেখত। একা একা দাবা খেলত। আর বিকেল হলে চান্দুর দোকানে গিয়ে চানাচুর-চিপস—স্প্রাইট এইসব গিলত। শুয়ে-বসে খেয়ে-পরে আজদাহা থলথলে স্বাস্থ্য বানিয়েছিল বশিরুল্লাহ।
ছোটবেলা থেকেই বশিরুল্লাহ হাবাগোবা। সহজ-সরল। লোকে বলে, বশিরুল্লাহর মাথায় ছিট। এই কারণে বিয়ের বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় নি।
বিয়ের পড়ন্ত বয়সে বেশ ধীর-স্থির হয়ে পড়েছিল বশিরুল্লাহ। পাড়ার লোকেরাও বলতে শুরু করেছিল, বশিরুল্লাহ ভালো হয়ে গেছে।
এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল কইতরি বেগম। ফকরু ঘটককে অগ্রিম বকশিশ দিয়ে পাত্রী খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফকরু ঘটক পাত্রীর সন্ধান দিযেছিল। পাত্রী ঢাকা শহরে থাকে। বড়লোকের বাসায় বুয়াগিরির কাজ করে। শুনে কইতরি বেগম হোঁচট খেলেও নিজের ছেলের কথা চিন্তা করে ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলেছিল। মনে মনে পণ করেছিল—বুয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন করে ফেলতে হবে। বরঞ্চ বশিরুল্লাহকে বলতে হবে—পাত্রী শহরের গার্মেন্টে চাকরি করে। না-হলে বশিরুল্লাহ বেগড়া দিতে পারে।

যে কথা সেই কাজ।
কইতরি বেগমের পরিকল্পনা মাফিক বিয়ের সম্বন্ধ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে এসে কী থেকে কী হয়ে গেল।
কেরামত আলী বলল, ‘বশিরুল্লাহ চিপস-চানাচুর একাই খেত কি?’
কইতরি বেগম বলল, ‘না না। বশিরুল্লাহ যাওয়ার আগে থেকেই হীরা গিয়ে বসে থাকত চান্দুর দোকানে।’
‘কেনে? হীরা গিয়ে বসে থাকত কেনে?’
‘কেনে আবার—খাওয়ার লোভে!’ নিজের ভাগ্নের বোকামিকে অবজ্ঞা ভরে বিড়বিড় করল, ‘কিচ্ছু বোঝে না। ঢাকাইয়া বেকুব।’
কেরামত আলী বলল, ‘হীরা কে?’
‘লিয়াকত মোল্লার ছেলে। হারামি বাদাইমা একটা। বশির ছিল বড় বাদাইমা। আর হীরা হল—ছোট বাদাইমা।’
‘হীরার পক্ষে কি এই কাজ করা সম্ভব? তোমার কি মনে হয়?
‘কস্মিন কালেও না। আরে বেকুব আমার বশিলল্লাহ ছিল হীরার খানাপিনার থলি। সে কেন নিজের খনিখানা ভাঙতে যাবে? আর তাছাড়া হীরা হল এতটুকুন ছেলে। সে খুনাখুনির কী বোঝে?’
কেরামত আলী বিরতি নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। কিন্তু কোনোকিছুর সাথে কোনো কিছু মেলাতে পারল না। শেষে বলল, ‘তোমার সাথে বশিরুল্লাহর ঝগড়া-বিবাদ হত কি?’
কইতরি বেগম বিস্মিত হয়ে কেরামত আলীর দিকে তাকাল। বলল, ‘তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? তারমানে তুই বলতে চাইছিস—আমি আমার ছেলেকে খুন করেছি? হারামজাদা কোথাকার। তুই দেখি ঢাকায় গিয়ে খালি বেকুব না—আস্ত বাটপার হয়ে গেছিস!’
‘না না খালা আমি সে কথা বলি নি। তুমি শুধু শুধুই আমাকে গালমন্দ করছ।’
‘তুই কি বলছিস তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। এক্ষুনি যদি আমার চোখের সামনে থেকে না ভাগিস আমি তোর কপাল ফাটাব।’
কেরামত আলী ভয় পেয়ে কেটে পড়ল।

দারোগা বাবুকে হীরার সন্ধান দিয়ে কেরামত আলী বলল, ‘এর সাথে কি একবার কথা বলে দেখবেন স্যার?’
দারোগা বাবু বললেন, ‘কথা বলতে অসুবিধা নেই। কিন্তু তাকে পাব কোথায়?’
আজগর আলী মেম্বর তখন নারকোল-সুপারি তলে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছিল।
দারোগা বাবু তাকে ডাকলেন।
সঙ্গে সঙ্গে মেম্বর সিগারেট ফেলে, দ্রুত হাত নেড়ে উড়ন্ত ধোঁয়া তাড়িয়ে দারোগা বাবুর কাছে হাজিরা দিল, ‘জি স্যার বলেন।’
দারোগা বাবু বললেন, ‘হীরার সাথে কি কথা বলা যাবে?’
‘অবশ্যই স্যার।’
‘আমাকে তার কাছে নিয়ে চলেন।—বলে দারোগা বাবু উঠে দাঁড়ালেন।
যাওয়ার আগে যদু-মধুকে বললেন, ‘লাশ মর্গে পাঠিয়ে দে।’
যদু-মদু একসঙ্গে যৌথ স্যালুট দিয়ে বলল, ‘ওকে স্যার।’

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত