ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—৬


বশিরুল্লাহর লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মহিলাদের মিহিকান্না রূপ নিয়েছে আহাজারিতে। আর কইতরি বেগমের স্বরচিত নতুন পদ ক্রন্দন-নৃত্যে গতি এসেছে।
কেরামত আলীর সেদিকে যাওয়া নিরাপদ মনে হল না। তার চে বরং বাড়ির সামনের নারকোল-সুপোরি তলে পায়চারি করা ভালো। সে চুপচাপ পায়চারি করতে লাগল।
হঠাৎ বিশাল ভুঁড়িঅলা এক অল্পবয়স্ক লোক সালাম প্রদর্শন করল তাকে।
সে থতমত খেয়ে সালামের উত্তর দিল।
ভুঁড়িঅলা লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘আমার নাম শাহিন মাহমুদ। হেড অব এনএসআই, কুষ্টিয়া।’
কেরামত আলীর ভেতরটা উত্তেজনায় ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। এ যেন মেঘ চাইতে না চাইতেই বৃষ্টি। মনে মনে সে গোয়েন্দা বিভাগের কাউকেই আশা করছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছিল—এই কেস ডিল করার জন্য একজন গোয়েন্দা কর্মকমর্তা দরকার।
কেরামত আলী বলল, ‘আমি কেরামত আলী, এ্যাসিসট্যান্ট ক্লার্ক, মৎস্য বিপণন বিভাগ, কাওরান বাজার ঢাকা।’
‘ও তার মানে আপনার বাসা ঢাকাতে?’
‘জি। ২৪২/এ রোকেয়া ভিলা, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি—ঢাকা।
‘বাহ! দারুণ!’—শাহিন মাহমুদ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে কেরামত আলীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘সিগারেট চলে তো?’
‘স্যরি স্যার। আগে খুব চল— কিন্তু বিয়ের পর থেকে ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ভাবীর ভয়ে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন? আপনি তো দেখছি রীতিমতো বীরপুরুষ।’—শাহিন মাহমুদ সিগারেটে আগুন সংযোগ করতে করতে বললেন।
কেরামত আলী বলল, ‘ভয়ে নয় স্যার—ভালোবাসায়।’
‘তাহলে তো আপনি মহাপুরুষ।’
‘সে যাই বলুন স্যার—সংসার যদি সুখের হয় রমণীর গুণে তবে মনে রাখবেন, পুরুষের তাতে রয়েছে অর্ধেক অংশ।’
‘ঠিক বলেছেন— ঠিক!—বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
‘বাহ! আপনার তো দেখছি কবিতা মুখস্থশক্তি দারুণ।’
‘না না না—আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এ-ধরনের কিছু কবিতার লাইন বিসিএস পরীক্ষার আগে মুখস্থ করতে হয়েছিল। সেই স্টক থেকে মেরে দিলাম আর কী!’
‘ও তাই বলেন!’
‘দাঁড়ান। আপনাকে আরো দুএকটা কবিতার লাইন শোনাই: আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।—এটি কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কবি কুসুম কুমারি দাশের লেখা।’
কেরামত আলী বলল, ‘আহ! কী সুন্দর। যেমন বৃক্ষ তেমন ফল।’
শাহিন মাহমুদ হড়হড় করে বলে চললেন, ‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে!’
কেরামত আলী বলল, ‘বাহ! চমৎকার।’
‘এই কবিতার মূলভাবটা শুনবেন?’
‘অবশ্যই।’
‘মাইকেল মধুসূদন রচিত কপোতাক্ষ নদ কবিতার মূলভাব:
কপোতাক্ষ নদ চতুর্দশপদী কবিতায় কবি যশোরের সাগরদাড়ির পাশ দিয়ে কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষের প্রতি তাঁর গভীর প্রেমবোধের পরিচয় দিয়েছেন। বিদেশি সাহিত্যে আত্মপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ কবি ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে স্বজনহীন জীবনযাত্রার মাঝে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত মাতৃরূপ কপোতাক্ষ নদকে স্মরণ করেছেন। তিনি সেখানে এ নদের মায়ামন্ত্র ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন…এ পর্যন্তই থাক।’
‘আহা থামলেন কেনে স্যার? দারুণ লাগছিল শুনতে। কী গভীর দেশপ্রেম থাকলে এত সুন্দর করে লেখা যায় চিন্তা করুন স্যার!’
শাহিন মাহমুদ এক গাল হেসে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী—ওভাবে কখনো চিন্তা করি নি। কারণ আমরা পড়েছি বিসিএসের জন্য।’
‘আপনার পঠন-পাঠনশক্তি ঈর্ষা করার মতো স্যার। আমি খুবই মুগ্ধ হলাম। আমার ধারণা—আপনি আরবি লাইনে পড়লে খুব সহজেই হাফেজ হতে পারতেন।’
‘আপনি শুনলে অবাক হবেন—আমি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা মাদ্রাসা ছাড়লেন কেনে?’
‘বেতের বাড়ি খেয়ে। তখন শীতকাল। ফজরের নামায না পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম। এই কারণে বড় হুজুর আমার পিঠে বেত ভাঙছিলেন। সেই থেকে মাদ্রাসাকে গুডবাই জানিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম।’
‘চিন্তা করে দেখছেন স্যার—কী বিচিত্র মানুষের নিয়তি? মাদ্রাসায় পড়লে আজ আপনি থাকতেন হাফেজে-মওলানা কিন্তু নিয়তির কারণে আপনি হয়েছেন—গোয়েন্দা অফিসার।’
‘সেটাই।’
‘স্যার যদি বেয়াদবি না নেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’
‘করেন।’
‘আপনি কি বিয়েথা করেছেন নাকি—এখনো আনম্যারিড?’
‘না রে ভাই! কপাল এখনো ফাটে নি।’
‘কি যে বলেন স্যার। এত যোগ্য আপনি—তারপরও কপাল ফাটতে এত দেরি হচ্ছে কেনে?’
‘ভাগ্য রে ভাই—কপালের নাম হল গোপাল। কারো ভাগ্যের শিকে অনায়াসেই ছিঁড়ে যায় আর কারোটা ঝুলে থাকে। কী আর করব বলেন?’
‘স্যার যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনার বিয়ের ঘটকালি করতে চাই।’
‘ঘটকালি করতে চান? বেশ তো—করেন না। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড। মেইল আইডি দেওয়া আছে। পাত্রীর ছবি ও বায়োডাটা পাঠাবেন। ব্যাটে-বলে মিলে গেলে এক মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে।’
‘ধন্যবাদ স্যার—ধন্যবাদ। আর একটা কথা বলার ছিল।’
‘বলেন।’
‘না মানে বলছিলাম—কোন ধরনের পাত্রী আপনার পছন্দ?’
‘সুন্দরী, টল ফিগার, নামায-টামায পড়ে—এ-রকম হলেই চলবে!’
‘বাহ—কী সুন্দর চাওয়া আপনার। অন্যকোনো ডিমান্ড আছে কি?’
‘গাড়ি-বাড়ি—এগুলার কথা বলছেন তো?’
‘জি জি।’
‘না। ওসব চাই না। তবে চেষ্টা করবেন পাত্রী যেন স্বচ্ছল ফ্যামিলির হয়। আর যেন শহরের হয়। গ্রামের দিকে ইচ্ছা নেই।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি অতি শীগ্রই পাত্রীর সন্ধান দেব স্যার।’
‘তা আপনি কি এই মরা বাড়িতে এসেছেন?’
‘জি জি! বশিরুল্লাহ আমার সাক্ষাত খালাত ভাই।’
শেষ টান মেরে সিগারেটের শেষাংশ মাটিতে ফেলে জুতোয় একটা ঘষা মেরে শাহিন মাহমুদ বললেন, ‘চলেন—ভেতর বাড়ি যাই।’
কেরামত আলী বললেন, ‘স্যার যদি কিছু মনে না করেন তো—আপনাকে চান্দুর সাথে কথা বলতে বলব।’
‘চান্দু!— গোয়েন্দা হেড বললেন, ‘এই চান্দুটা আবার কোন চান্দু?’
‘দারোগা বাবু চান্দু পর্যন্ত তদারকি সম্পন্ন করে চলে গিয়েছেন। আপনি যদি চান্দুর পর থেকে শুরু করেন আপনার জন্যে সুবিধে হবে।’
‘ও আচ্ছা। কিন্তু দারোগা সাহেব চলে গিয়েছেন কেন?’
‘জরুরি কাছে তাকে যেতে হয়েছে।’
‘ওকে। আমি যেখান থেকে শুরু করছি তার আগের অংশ কি পুরোটা আপনি জানেন?’
‘জি স্যার। চলুন যেতে যেতে বলছি।’

চান্দুর দোকানে যেতে যেতে কেরামত আলী কৌশলে মজনুর প্রসঙ্গটা তুলল, ‘স্যার, যদি কিছু মনে না করেন আর একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’
‘করেন।’
‘আপনার কি প্রেম করার অভিজ্ঞতা আছে?’
‘হঠাৎ প্রেম!’—কিছুটা অবাক হলেন গোয়েন্দা প্রধান।
‘একটা কারণ আছে স্যার। আগে বলুন আপনার অভিজ্ঞতা আছে কি-না?’
‘নাহ। তবে খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হয় নি।’
‘বলেন কী স্যার! আপনি দেখতে সুদর্শন। পড়াশোনায় ভালো ছিলেন—তারপরও প্রেম করেন নি—ব্যাপারটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হচ্ছে।’
‘শোনেন। প্রেম হল আজিব জিনিস। কার কখন প্রেম হয়ে যায় এটা বলা মুস্কিল। আমার রুমমেট ছিল—সোলায়মান, অলটাইম পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাত না। কখনো কোনো আড্ডা দিত না। ক্লাস, লাইব্রেরি, ডাইনিং আর ঘুম—এটাই ছিল ওর ডেইলি রুটিন। চেহারা নরমাল। হাইট নরমাল।—অথচ হঠাৎ একদিন শুনি—এই সোলায়মানের জন্য পাগল হয়েছে আমাদেরই এক বান্ধবি—নাম রোকেয়া। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন— সোলায়মান প্রেম করতে আগ্রহী নয়।’
‘দারুণ ঘটনা তো। বলতে থাকেন স্যার। শুনতে বেশ লাগছে।’
শাহিন মাহমুদ জিপারে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘হিসু করা দরকার।’
ফাঁকা রাস্তা। দুপাশে সবুজ ফসলের মাঠ। সামনে কলাক্ষেতও দেখা যাচ্ছে।
কেরামত আলী বলল, ‘ঐ কলাক্ষেতে মেরে দিন স্যার।’
শাহিন মাহমুদ দৌড়ের ভঙ্গিতে রাস্তা থেকে নিচে নামলেন—মানে কলাক্ষেতে ঢুকে পড়লেন।
কেরামত আলী তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর ঢিলা কুলুপ নিতে নিতে কলাক্ষেত থেকে বেরিয়ে এলেন শাহিন মাহমুদ। কিন্তু তিনি সরাসরি রাস্তায় না উঠে ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে নানাভাবে এঁকেবেঁকে, মোচড়ামুচড়ি করে ঢিলা কুলুপ সম্পন্ন করলেন। তারপর রাস্তায় উঠলেন।

তারা আবার হাঁটা দিলেন চান্দুর দোকানের উদ্দেশ্যে।
কেরামত আলী বলল, ‘তারপর কী হল স্যার? আপনার বন্ধুর প্রেম হয়ে গেল?’
‘সে এক লম্বা হিস্টোরি। সোলাইমান কোনোভাবেই প্রেম করবে না। কিন্তু রোকেয়া তা শোনে না। সোলাইমানের একটাই কথা—আগে পড়াশোনা শেষ করবে, তারপর বিসিএস দিবে, চাকরি হবে—তারপর বিয়ে করবে। ততদিন যদি রোকেয়া অপেক্ষা করে তাহলে সে রোকেয়াকে বিয়ে করবে এবং বিয়ের পরে প্রেম করবে। এই ছিল সোলাইমানের ডিসিশন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, সোলাইমানের ডিসিশন মন্দ না। তাই একদিন রোকেয়ার সাথে কথা বললাম। ওকে নানাভাবে বোঝালাম। রোকেয়া আমার কথা বুঝল। এবং সোলাইমানের ডিসিশন মেনে নিল। কিন্তু কবি কোথায় নিরব জানেন?’
‘কোথায় স্যার?’
‘কবি যখন কেচকিকলে পড়ে তখন নীরব।’
‘মানে বুঝলাম না স্যার।’
‘বুঝবেন কীভাবে? পুরোটা শোনেন, তারপর বুঝবেন। আমার বন্ধু এত ভালো ছাত্র, বিসিএসের সমস্ত গাইড তার মুখস্থ কিন্তু তার বিসিএস হল না। প্রথম বার, দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার—কোনোবারই হল না। ততদিনে তার চাকরির বয়স যায় যায় অবস্থা। শেষে জয়েন করল একটি প্রাইভেট ব্যাংকে।’
‘আর আপনার সেই বান্ধবি—রোকেয়া? উনার কী হল?’
‘রোকেয়ার প্রথম চাঞ্চেই বিসিএস হয়ে গেল। এসিলেন্ট। এসিলেন্ট হওয়ার ছয় মাস পর বিয়ে করল ম্যাজিস্ট্রেটকে। এরপর ওদের অনেক গল্প আছে। সেসব থাক। যে কারণে এতবড় গল্প বললাম সেটা হল—প্রেম সহজ জিনিস না। বড়ই জটিল জিনিস।’
‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। আমার ধারণা—বশিরুল্লাহ খুন হওয়ার পেছনে প্রেম ঘটিত কোনো গল্প আছে।’
‘যেমন?’
‘বশিরুল্লাহর বিবাহের ডেট ছিল আগামিকাল। বাদ জুম্মা বরযাত্রী যাওয়ার কথা ছিল কনের বাড়ি—এটা জানেন তো?’
‘হ্যাঁ শুনেছি।’
‘অথচ তার আগে খুন হয়ে গেল বর। কে খুন করল?’
‘কে?
‘মজনু।’
‘মজনু কে?’
‘পুতুলের খালাত ভাই।’
‘পুতুল কে?’
‘যার সাথে বশিরুল্লার বিবাহ হওয়ার কথা ছিল। হিসাবটা মিলিয়ে দেখুন স্যার।’
শাহিন মাহমুদ থেমে পড়লেন। ডান হাতের চার আঙ্গুল নাড়িয়ে কী যেন হিসেব মেলানোর চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ‘হতে পারে। কিন্তু খুন করে মজনুর লাভ কী? সে কি পুতুলকে পাবে? পাবে না তো? এখন ঢুকতে হবে হাজতে।’
‘তাহলে তাকে এ্যারেস্ট করুন স্যার।’
‘এ্যারেস্ট?’
‘জি স্যার।’
‘এ্যারেস্ট করার আগে আরো কিছু এভিডেন্স লাগবে। হুট করে কাউকে এ্যারেস্ট করা যায় না। তবে যে তথ্যটা আপনি দিলেন—এটা প্রাথমিক নথিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ইনভেস্টিগেশন পয়েন্ট হিসেবে ভালো।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত