ডিটেক্টিভ কে কে (কেরামত আলীর কেরামতি)—৭


চান্দুর চাঁদিতে চুল কম। থুতনিতে পাটের আঁশের মতো এক গোছা দাড়ি ঝুলছে। দেখতে এমন—যেন আঁঠা দিয়ে থুতনিতে দাড়িগোছা লাগানো। মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়—প্রচুর পান খাওয়ার অভ্যাস তার। তাগড়া শরীর। গায়ের রং ফর্সা।
সে জাবর কাটতে কাটতে অভ্যস্ত হাতে চায়ে চিনি মেশাল। চায়ের কাপে চামচটা এমনভাবে ঘোরাল সেটা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো দৃশ্য। চামচের ঘূর্ণনে চায়ে-দুধে-চিনিতে দারুণ সংমিশ্রণ হল কিন্তু কাঁচের গ্লাসে বাড়তি শব্দ যেমন হল না তেমনি এক ফোঁটা চা-ও উপচে পড়ল না। একেই বলে হাতের কারিশমা।
চান্দু ছোট্ট ট্রেতে দুকাপ চা এবং সাথে একটা চিনির কৌটা দিল।
প্রসারিত হাসি হেসে বলল, ‘চিনি যদি লাগে তো নিয়ে নিবেন স্যার—আমি সামান্য দিয়েছি।’
গোয়েন্দা প্রধান চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমারটাতে চিনি একদম পারফেক্ট। কমও না। বেশিও না।’
কেরামত আলী বলল, ‘আমারটায় সামান্য লাগবে!’—কোয়ার্টার চামচ চিনি নিজের চায়ের কাপে মিশিয়ে নিয়ে বলল, ‘দেশে আজকাল ডায়াবেটিক খুব বেড়ে গেছে স্যার। চিনি যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো।’
‘আপনার হালকা-পাতলা শরীর, আপনাকে এ্যাটাক করতে পারবে না। কিন্তু আমার জন্যে রিস্কি।’—গোয়েন্দা প্রধান বললেন।
‘আপনি তো এখনো বোধ হয় চল্লিশ ক্রস করেন নি, তাই না স্যার?’
‘আরে কী বলছেন—ভুঁড়ির কারণে আমার বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছেন?—আমি কেবল থার্টি ফোর। তিন মাস আগে ৩৪ বছর পূর্ণ করলাম। ভুঁড়ির কারণে বয়স একটু বেশি লাগে—এই যা।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম স্যার। যাইহোক। যেটা বলছিলাম—চল্লিশ ক্রস করলেন তো একটা রিস্কি সিঁড়িতে পা রাখলেন। প্রেশার, ডায়বেটিক, কোলস্টেরল আপনাকে সুস্বাগতম জানাতে থাকবে। আপনি যদি সতর্ক থাকেন আপনার কিছু হবে না। কিন্তু যদি সতর্ক না থাকেন তাহলেই কেল্লাফতে। সতুরাং সতর্ক থাকবেন স্যার। মনে রাখবেন: prevention is better than cure.
‘দারুণ বলেছেন ভাই।’
‘আমি অবশ্য ছ’বছর আগে চল্লিশ ক্রস করেছি। আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত এগুলোর একটাও আমাকে ছুঁতে পারে নি।’
গোয়েন্দা প্রধান বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে আপনি এখন ফোরটি সিক্স!’
‘জি স্যার।’—কথাটা বলে বেশ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে তাকাল কেরামত আলী।
‘কী বলেন—আপনাকে দেখে তো চল্লিশই মনে হয় না।’
নাভি চুলকাতে চুলকাতে চান্দু মিঞা গোয়েন্দা প্রধানকে মেনশন করে বলল, ‘স্যার, কারণ হল—উনার চিকনা শরীরে কোনো মেদ বাসা বাঁধতে পারে নাই! তাই এত ঝরঝরা—হ্যাংলা-পাতলা!’

—কেরামত আলী বলল, ‘কখন কাকে এই রোগগুলো এ্যাটাক করবে তা কিন্তু আগে থেকে বলা মুস্কিল।’
নাভির ময়লা চিপটাতে চিপটাতে চান্দু মিঞা বলল, ‘তাও ঠিক। আজকাল গ্রামের দিকেও ডায়বেটিক ঢুকে পড়ছে। করোনা যেমন ঢুকে পড়ছিল—ওইরকমভাবে ডায়বেটিকও ঢুকে পড়ছে। আর একটা রোগ গ্রামে প্রচুর ঢুকছে স্যার। সেইটা হল—মাজা ব্যথা। শুক্কুর বারে মসজিদে গেলে দেখা যায় গ্রামে কী পরিমাণ মাজা ব্যথার লোক বাড়ছে। ইমাম সাবের পেছনের সারিতে প্রচুর মানুষ চেয়ারে বসে নামায পড়ে!—ইনারা সবাই মাজা ব্যথার রোগী। অবশ্য ইনাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাব লয়।’
শাহিন মাহমুদ ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘ভাব লয় মানে?’
‘মানে অসুস্থতার ভাব লয়। ধরেন—৫/৭ জন বুড়া লোক আছে যাদের সত্যিকারের কোমর ব্যথা। তারা চেয়ারে বসে নামায পড়ে। এইটা ঠিক আছে। কিন্তু শুক্কুর বারে মসজিদে গেলে দেখবেন—১০/১৫ জন লোক চেয়ারে বসে নামায পড়তেছে। বাকিরা কেন পড়তেছে? জাস্ট ভাব নেওয়ার জন্য।’

কেরামত আলী খেয়াল করল, খোশগল্প বেশ চলছে কিন্তু মূল বিষয়ের প্রতি গোয়েন্দা প্রধানের খুব একটা গরজ নেই। তাই সে ভাবল—খাশগল্পের লাগাম টেনে ধরা দরকার।
সাহস করে কৃত্রিম গলা খাঁকারিমূলক একটা কাশি দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর সূত্রপাত ঘটিয়ে ফেলল কেরামত আলী। বলল, ‘বিগত চার/পাঁচ দিনের মধ্যে— আপনার দোকানে কোনো অপরিচিত লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে কি?’
‘অপরিচিত লোক মানে?’ —চান্দু মিঞা বলল।
‘এমন লোক—যাকে আপনি আগে কখনো দেখেন নি।’
চান্দু মিঞা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, অপরিচিত লোকের আনাগোনা লক্ষ করা গেছে!’
কেরামত আলী বলল, ‘তাদের দু-একজন সম্পর্কে একটু বলবেন?’
‘অবশ্যই। শোনেন তাহলে বলি: এর ভিত্রে একজন লোক আসল দরবেশ বাবা টাইপ। পরনে নানারঙের রঙিন কাপড়ে জোড়াতালি দেওয়া আলখেল্লা, হাতে একশটা আংটি, হাত ভরা চুড়ি, জটলা চুল-দাড়ি। তখন দুপুরবেলা। ফাঁকা দোকান। আমি তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম আরে, এ-ধরনের লোক আমাদের এদিকে আসল কোত্থেকে?’
গোয়েন্দা প্রধান বাঁশের বেঞ্চিতে এক পা ভাজ করে তুলে দিয়ে সিগারেট ধরালেন।
কেরামত আলী বলল, ‘তারপর?’
চান্দু মিঞা গোয়েন্দা প্রধানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘স্যার বসতে কি অসুবিধা হচ্ছে? চিয়ার দিব?’
‘না না না। ঠিক আছে।’
চান্দু মিঞা এবার তার মূল গল্পে ফিরে গেল: ‘দরবেশ টাইপ লোকটা এক কাপ চা আর বনরুটি চাইল। ঐদিন বনরুটি শেষ হয়ে গেছিল। আমি বললাম, বনরুটি নাই—বাটারবন আছে—চলবে? তা লোকটা মাথা নোয়াল—মানে চলবে। আমি জলদি বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চা বানিয়ে দিলাম। একটা বাটারবন দিলাম। লোকটা চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে বাটারবন খেল।’
কেরামত আলী সোৎসাহে বলল, ‘তারপর কী হল?’
গোয়েন্দা প্রধানের মোবাইলে ফোন এল। কনফিডেন্সিয়াল ফোন। তিনি বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একটু দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলেন।
কেরামত আলী বলল, ‘এ ছাড়া আর কোনো লোক এসেছে গত চার/পাঁচদিনের মধ্যে?’
চান্দু বলল, ‘আসছিল।’
‘বলেন—শুনি।’
‘স্যার ফোন শেষ করে আসুক—বলি।’
কেরামত আলী বুঝল চান্দু তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তা না দিক। তাতে কেরামত আলীর কিছু যায়-আসে না। সে খুব ভালো করেই জানে—বর্তমান সমাজে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পদবী আর অর্থবিত্তে যারা শক্তিশালী তারাই নমস্য। বাকিরা ফেউ। এখানেও নতুন কিছু নয়। ফলে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
ফোনে কথা বলা শেষ করে গোয়েন্দা প্রধান এলেন।
চান্দু বলল, ‘স্যার, শুরু করব?’
গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ‘শুরু করেন।’
চোখের পিচুটি মুছে নিয়ে চান্দু আবার দরবেশ টাইপ লোকের গল্পে ঢুকল, ‘তো লোকটা চায়ের মধ্যে চুবায়ে চুবায়ে বাটারবন খায় আর আমার দিকে তাকায়। আমি ভাবলাম কী না কি!—তখন সে বলল, তোর দোকানে কি ইন্দুর-চিকা ঢোকে?—আমি আঁৎকা ধাক্কা খেয়ে বললাম, ইন্দুর-চিকা ঢোকে মানে? লোকটা বলল, বাটারবনে ইন্দুরের গন্ধ।’
‘তারপর?’—গোয়েন্দা প্রধান বলল।’
‘সে হন হন করে হেঁটে চলে গেল।’
‘বিল দিল না?
‘না।’
‘ইনি ছাড়া আর কে এসছে এ কয়দিনের মধ্যে?’
‘কয়দিন আগে চিকনা-চাকনা একটা ছেলে আসছিল, গাঞ্জুইটা চেহারা।’
‘এর সম্পর্কে ডিটেইল বলেন।’
‘ছেলেটা এসে আমার কাছে জিগাইল, ভাই, এদিকে বশিরুল্লাহদের বাড়ি কোথায়? বশিরুল্লাহ তখন দোকানেই ছিল। স্যার, আপনি যেখানটায় বসে আছেন— ঠিক ওখানে বসেছিল। পাশে ছিল সাগরেদ হীরা। দুইজনে চিপস খাইতেছি। আমি বললাম, কী দরকার—বশিরুল্লাহ তো এখানেই আছে। ছেলেটা বশিরুল্লাহর কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করল।’—চান্দু কনিষ্ঠা দেখিয়ে বলল, ‘তারপর আমি চলে গেলাম।’
‘কোথায় গেলেন?’
‘এই যে দেখালাম!’,—চান্দু আবারো কনিষ্ঠা দেখাল।
‘ও। এর বাইরে আর কেউ আসে নি?’
‘আসছিল স্যার। মনে পড়ছে না। বশিরুল্লাহর খোঁজ খবর নিতে আসছিল। সেটা অবশ্য ফুলতলা থেকে। ফুলতলার লোক।’
‘ফুলতলার লোক মানে?’—কেরামত আলী জানতে চাইল।
চান্দু বলল, ‘বশিরুল্লাহর যেখানে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।’
‘ও আচ্ছা।’
‘তো ঐ লোকটা আসছিল বশিরুল্লাহর খোঁজ-খবর নিতে।’
কেরামত আলী বলল, ‘কীরকম খোঁজ-খবর?’
চান্দু মিঞা গোয়েন্দা প্রধানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘স্যার—এই খোঁজ-খবরের মানে হল—গোপনে পাত্র সম্পর্কে জানা। মানে পাত্রের আগে বিয়ে-টিয়ে হয়েছিল কি-না, অর্থ-সম্পত্তির পরিমাণ কেমন—এইসব আজাইরা বিষয়।’
‘ও বুঝতে পেরেছি।’
‘কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন স্যার!’—চান্দু যেহেতু কেরামত আলীকে পাত্তা দিচ্ছে না তাই সে নতুন কৌশল অবলম্বন করে প্রশ্ন করতে চাইল গোয়েন্দা প্রধানের কাছে।
গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ‘কী?’
‘বশিরুল্লাহর খোঁজ-খবর নিতে যে এসেছিল তার বয়স কত—এটা জানা দরকার?’
‘আপনার বয়সি।’—চান্দু বলল।
কেরামত আলী বলল, ‘দেখতে কি আমার মতো?’
‘হ্যাঁ, আপনার মতোই চিকনা-চাকনা। তবে গায়ের রং আপনার চাইতে কালো।’
‘নাম কী?’
‘শরিয়ত মণ্ডল।’
‘আচ্ছা ধন্যবাদ।’
—চান্দুকে ধন্যবাদ দিয়ে— কেরামত আলী অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু কি পাওয়া গেল স্যার?’
‘হ্যাঁ…ঐ যে…গাঞ্জুইট্টা ছেলেটা!’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। মনে হচ্ছে—তাকে পাওয়া গেলে খুনের রহস্য ভেদ করা যাবে।’
—কেরামত আলী উত্তেজিত হয়ে চান্দুর উদ্দেশ্যে মধ্যমা প্রদর্শন করে বলল, ‘আপনি এটা করার পর কি ছেলেটাকে দোকানে পেয়েছিলেন?’
চান্দুও তার মধ্যমা প্রদর্শন করে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘এটা কিরে ভাই? আপনি দিনে-দুপুরে এসব কী দেখাচ্ছেন?’
নিজের ভুল শুধরে নিয়ে কেরামত আলী কনিষ্ঠা প্রদর্শন করে বলল, ‘স্যরি এটা। মানে আপনি পেচ্ছাপ করে এসে কি ছেলেটাকে পেয়েছিলেন?’
চান্দু বলল, ‘হ্যাঁ। আমি এসে দেখি, ততক্ষণে তাদের মধ্যে দোস্তি হয়ে গেছে। দেখি যে, একসাথে ললিপপ খাইতেছে।’
‘বলেন কী! বিয়ের বয়সের ছেলে ললিপপ খায়!’—অবাক হয়ে জানত চাইলেন গোয়েন্দা প্রধান।
‘খালি কি ললিপপ? আচার-চাটনি-লজেন্স—সব খাইত বশিরুল্লাহ। মাথায় ছিট ছিল তো, মাটি ছাড়া সব খাইত।’
কেরামত আলী বলল, ‘শেষে কী হল?’
‘বশিরুল্লাহ, হীরা আর ঐ গাঞ্জুইট্টা ছেলেটা এক সাথে চলে গেল।’
‘কোথায় গেল?’
‘তা জানি না।’
‘এটা কবেকার ঘটনা?’
‘তা ধরেন—৪/৫ দিন আগের ঘটনা।’
‘সেদিন কী বার ছিল, মনে করতে পারেন?’
‘শনি বার। না, রোববার ছিল।’
‘তখন কয়টা বাজে?’
‘তখন বিকাল। ধরেন—চারটা সাড়ে চারটা বাজে।’
কেরামত আলী নিজের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বলল, ‘স্যার আমার মনে হয় হীরার সাথে কথা বলার দরকার।’
‘হীরাটা যেন কে?’—গোয়েন্দা প্রধান জানতে চাইলেন।
‘ওই যে বলল—বশিরুল্লাহর সাগরেদ। বশিরুল্লাহদের পাড়াতেই ওদের বাড়ি।’
‘আবার সিগারেট ধরালেন গোয়েন্দা প্রধান। একযোগে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘শোনেন কেরামত সাহেব, ময়নাতদন্ত আসার আগে আমাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। ময়না তদন্ত আসুক তারপর আমরা জোরেসোরে মাঠে নামব। আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
‘জি স্যার বুঝতে পেরেছি।’
স্যারের কথায় সায় দিয়ে চান্দু বলল, ‘স্যারদের কাজের একটা সিস্টেম আছে—বুচ্ছেন? তারা আমার-আপনার মতো আন্তাজি-কুন্তাজি কাজ করে না। সিস্টেমেটিক কাজ করে। ঠিক কি-না স্যার?’
‘তা তো বটেই। পুলিস সুরতহাল করে লাশ মর্গে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে ময়নাতদন্ত আসবে। ময়নাতদন্ত আসার পর আমরা দুই বিভাগ একযোগে কাজ করব।’
‘বাহ! কি সুন্দর সিস্টেম। শুনে মনটা জুড়িয়ে গেল। স্যার, আর এক কাপ চা দেই?’—চান্দু বলল।
গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ‘দিবেন? দেন খাই।’

(চলবে)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত